সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (তৃতীয় পর্ব) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
১৯ জানুয়ারী ২০২১ ১৯:০৯

আপডেট:
১৯ জানুয়ারী ২০২১ ১৯:৫৯

 

- পারব কেন? সব জোগাড় করেই তো তোদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমিতো ধরে নিয়েছিলাম যে জায়গায় বিবরণ তোরা জানতে চাইবি। আন্দাজে এক জায়গায় যাওয়ার জন্য তোরা তৈরি হয়ে থাকবিনা।
- বুঝেছি তুই অনেক মেধাবী মেয়ে। আর ব্যাখা করতে হবে না। পাড়াগুলোর নাম বল।
- প্রথমে পড়বে বার্মিজ পাড়া, তারপরে হমথৈই পাড়া। এরপর আছে নামদা পাড়া। সবশেষে কাউখই পাড়া।
- নামগুলো বেশ অন্যরকম। শুনতে ভালোলাগলো।
- মুরংদের ভাষার নাম। অন্যরকমতো আমাদের কাছে মনে হবে। তবে পাড়াগুলো দেখতেও ভালোলাগবে। সবুজ প্রকৃতির মাঝে ছোট ছোট বাড়িঘর। নেটে দেখতে কি যে অপরূপ লাগছিল। আমার মুগ্ধতা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তখনই মনে হয়েছিল এলাকায় গিয়ে কাছ থেকে না দেখলে বেঁচে থাকার স্বপ্ন পূরণ হবে না। এমন শূন্যতা নিয়ে মরে যেতে চাইনা।
- বাবারে বাবা, কতকিছু যে ভাবতে পারিস তুই আশিকা।
- তোরা সবাইতো আমার ভাবনার সহযোগী। তোদেরকে না পেলে আমার ইচ্ছা পূরণ হত না।
- ঠিক বলেছিস। তোর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ হলাম। 
- এবার আমরা কাছ থেকে দেখব তোর স্বপ্নের বনভূমি। আমি মনে করি ওরা প্রকৃতির সন্তান। ওদের বেঁচে থাকা অসাধারণ জীবনদর্শন। পুরো দেশটা এভাবে পূর্ণ থাকুক আমাদের সামনে।
প্রত্যেকের কথায় অজানাকে জানার সুর শুনতে পায় আশিকা। সব কথা সঙ্গীতের মতো ধারণ করে নিজের হৃদয়ে। ভেসে আসে গানের বাণী, গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ আমার মন ভোলায় রে-। মেয়েরা একসঙ্গে গানটি গাইতে থাকে। একটি পংক্তিই পুরো গানটি কারো মুখস্ত নেই। কারণ ওরা কেউ গানের শিল্পী নয়। একটুপরে ছেলেরাও ওদের সঙ্গে যুক্ত হয়। বেশিক্ষণ গাওয়া হয় না। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে গান গাইতে হাসি পায় সবার। পথে যারা হাঁটছে কিংবা রিকশায় আছে সবাই তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। আশিকা চারদিকে তাকিয়ে লজ্জা পায়। সবার দিকে তাকিয়ে বলে, যাই বাড়িতে গিয়ে যাবার দিন ঠিক করি।

একটি রিক্সা দাঁড় করায় ইউসুফ। বলে, উঠে পড়। বাড়ি গিয়ে কাজে বসে যা। দূরে কোথাও যাবার কথা ভাবলে আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। মনে হয় কলম্বাসের মতো একটি দেশ আবিষ্কার করব। মানুষের বসতিতে পূর্ণ হয়ে উঠবে দেশের ছবি। হাতে আঁকা ক্যানভাসের ছবি নয়। প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা ছবি। প্রকৃতি নিজের হাতে এঁকেছে সে ছবি।

- নাহ আমাদের সবাই কবি হয়ে যাচ্ছে দেখি। সবার চিন্তায় দিগন্তের রেখা এসে ঢুকছে।
- আমারও তাই মনে হচ্ছে। আশিকা মৃদু হাসিতে নিজেকে উদ্ভাসিত করে। এদিকে-ওদিকে পথচারীদের কেউ কেউ দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছে। মঞ্জুরিকে বলে, তুই নিজে কি ভাবছিস মঞ্জুরি?
- যাব, দেখব ভ্রমণের আনন্দ নিয়ে ফিরে আসব। এটুকুই আমার ভাবনা। আমার তোদের মতো কবিত্ব শক্তি নেই যে ভাবনার অতলে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে দার্শনিক হয়ে যাব।
- ব্যস, ব্যস। থাম। অনেক বলেছিস। যাই।

আশিকার রিক্সা চলতে শুরু করে। সূর্য পশ্চিম আকাশে চলে গেছে। হুড-খোলা রিক্সায় নিজেকে একজন পর্যটকের মতো লাগছে। চারদিকে গাড়ি, কখনো তুমুল শব্দে হর্ণ বাজে। শোনা যায় রিক্সার টুনটুন ধ্বনি। ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মানুষ। নিজেকে পর্যটকের ভাবনা থেকে বের করে না এনে চিন্তায় ঢোকায় বান্দরবনের পাহাড়ের চূড়ায় নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র। রিকশার হুড তুলে দিয়ে মাথা ঠেকালে মনের পাতায় ভেসে ওঠে পাহাড়ের অসাধারণ সৌন্দর্য। বছরখানের আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল নীলগিরিতে। যাওয়ার উদ্যোগ ছিল ওর বাবার। ওর মাকে বলেছিল, মেয়েটির ইচ্ছা পূরণের জন্য যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। আমার এক বন্ধু বলেছে, খুবই সুন্দর এলাকা। গেলে মন ভরে যায়। আশিকার কথা ভেবে আমিও মন ভরাতে চাই। তুমিও মন ভরাবে গো বানুবিবি।

হামিদা বানু হাসতে হাসতে উচ্ছসিত হয়ে বলেছিল, আমিতো মেয়েটার দিকে তাকালে ওর চেহারায় অনেককিছু দেখতে পাই। 
- আমিও ওর আনন্দ দেখলে সব দুঃখ আড়াল করে রাখতে পারি। ও কাছে না থাকলে দুঃখ আবার ফিরে আসে।

আশিকা ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করে। ভাবে রাস্তার চেনাছবি এই মুহূর্তে দেখার দরকার নাই। বাবা বলেছিলেন, আমার বন্ধু আমাকে বলেছিল, বান্দরবনের চিম্বুক-থানচি সড়কটি নির্মাণ করেছিল সেনাবাহিনীর সতেরো ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটেলিয়ন। এই সড়কের কাপ্রুপাড়া এলাকায় নিরাপত্তা চৌকি হিসেবে প্রথমে এটা বানানো হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এটা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
হামিদা বানু সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, ভালোই হয়েছে গো, এজন্য আমরা যেতে পারছি। নইলেতো যেতে পারতাম না।

আশিকা চোখ খুলে সামনে তাকায়। ঘাড় কাত করে আকাশ দেখে। যেন ও নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। পাহাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর। সমুদ্র থেকে পাহাড়ের উচ্চতা দুই হাজার দুইশত ফুট। এক অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর এলাকাটা। উপরে আকাশ, মাঝখানে পাহাড়, নিচে সমুদ্র। বাবা-মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থেকে ও চিৎকার করে বলেছিল, আমার বাংলাদেশ দেখা তোমরা পূর্ণ করলে আব্বা-আম্মু।

আতিকুর রহমান মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেছিল, আমাদের দেশে সাতান্নটি আদিবাসী নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আছে। এ বিষয়টিও তুমি ভালোবেসে জানবে।
- এই এলাকাটা কোন আদিবাসীদের আব্বু?

- এখানে ম্রো জনগোষ্ঠী বেশি সংখ্যায় বাস করে। আমাদের সব জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ভিন্ন। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর উৎসব আনন্দ দেখলে তোর মনে ভরে যাবে আশিকা। এই সাংস্কৃতিক উৎসব আমাদের দেশের বৈচিত্র্য বাড়িয়েছে। 

আতিকুর রহমান আরও বলে, এই এলাকার নদীর নাম সাঙ্গু নদী। ছোট ছোট পাহাড়ের গাঘেঁষে বয়ে গেছে সাঙ্গু নদী। আমরা একবার এই নদী পথে থানচি যাবরে আশিকা। দেখবি কত নয়নভরা দৃশ্য। তোর জন্যই আমি এসব খোঁজখবর করেছি।

আশিকা বসে পড়ে বাবা-মায়ের পায়ে মাথা ঠেকায়। হামিদা বানু দুহাতে ওকে বুকে টেনে নেয়। আশিকা দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমরা আমার জীবনকে ধন্য করে দিয়েছ। যতদিন বেঁচে থাকব তোমাদের ভালোবাসা আমার বঙ্গোপসাগর হয়ে থাকবে। নিজেকে জীবনভর সমুদ্রের পাড়ে দাঁড় করিয়ে রাখব।

আতিকুর রহামন বলে, আবার আসব তোকে নিয়ে। এবার আমরা রাঙামাটির সাজেক ভ্যালিতে যাব। ওটাই আমাদের শেষ সীমান্ত। তারপরে ইন্ডিয়া।
- এখানকার কটেজগুলোর নাম খুব সুন্দর আব্বা।

হামিদা বানু বলে, হ্যাঁরে, ঠিক বলেছিস।

আশিকা মুখস্তের মতো বলতে থাকে, যেমন মেঘদূত, আকাশলীনা, নীলাঙ্গনা, মারমা হাউজ। আমরা যেটায় আছি এটার নাম আকাশলীনা। আমিতো এই কটেজে ঢোকার সময় নাম দেখে মন ভরে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম, এই নাম ধরে একটা গান বানাব।

হামিদা বানু উৎফুল্ল কন্ঠে বলে, বানিয়ে ফেল। আমরা তিনজনে তোর সঙ্গে গান গাইব। পাহাড় থেকে নামতে নামতে সমুদ্রের ধারে যাব।
- না গো মা, পারবনা। মাথায় আসেনা। ইচ্ছা হলেই যদি সব পারতাম তাহলে তো-
আশিকা কথা শেষ করে না।
আতিকুর রহমান হাসতে হাসতে বলে, তুই আমাদের আনন্দ খেয়ে ফেললি মা।
- না, বাবা, তোমরা সবাই সাগর, নদী, আকাশ, পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাক দেখবে গান ভেসে আসছে। এখানে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির গান শোন বাবা। মানুষের কন্ঠের গান না।
- ঠিক বলেছিস মা। দ্যাখ দ্যাখ আকাশে রঙধনু দেখা যাচ্ছে।
- রঙধনুর দিকে তুমি তাকিয়ে থাক। শোন সাত রঙের গান।
মেয়ের কথায় হা-হা করে হাসে আতিকুর রহমান। বলে, আমার বন্ধু বলেছিল, রোদ, বৃষ্টি, আকাশের পেঁজো তুলোর মতো মেঘ, সেইসঙ্গে রঙধনুর রঙের সোনালি দৃশ্য, কখনো মেঘের গর্জন সব মিলিয়ে প্রকৃতির নানা দৃশ্য দেখে মোহিত হয়ে যাবি। পাখিদের ওড়াউড়ি, বিচিত্র ডাকাডাকি সব মিলিয়ে বেঁচে থাকার অনুভব গভীর হয়ে যাবে। মনে হবে এখান থেকে ফিরবনা।

আতিকুর রহমান হাসলে হামিদা বানু বলে, তোমার বন্ধু ঠিকই বলেছে। ভাগ্যিস তোমার বন্ধুর কথা মনে করে এসেছ। আমার আর আশিকার তিন দিন ধন্য হয়ে গেছে। আমরা কখনো নীলগিরিতে পাওয়া আনন্দ ভুলব না।

আতিকুর রহমান বলে, হ্যাঁ, ভুলবনা।
- আমরা আবার আসব বাবা।
- হ্যাঁ, আসব। আসতেই হবে।
আশিকা দুহাতে তালি বাজায়। স্লোগানের মতো বলতে থাকে, বাবা বাবা, জয়তু বাবা। আমি এখানে আরো দুদিন থাকতে চাই বাবা। কাপ্রুপাড়ায় ঘুরে ঘুরে ম্রো মেয়েদের সঙ্গে আড্ডা দেব। পারব আরও দুদিন থাকতে?
- না রে পারবনা। আমিতো তিন দিনের বুকিং দিয়েছিলাম। এখানে আসতে হলে আগাম বুকিং দিতে হয়। এই তিন দিনে দেখছিস তো দেশি-বিদেশি পর্যটকে ভিড় হয়ে আছে এলাকা।
- হ্যাঁ, ঠিক বাবা। ঠিক আছে আমরা চলে যাব। প্রকৃতি দেখতে এত মগ্ন ছিলাম যে মানুষের কথা মনে হয়নি। প্রকৃতি দেখার আনন্দের পরে মানুষের কথা মনে হলো। ম্রো জনগোষ্ঠী কীভাবে জীবন কাটায় তা বুঝতে চেয়েছিলাম।
- এবার হলো না। আমরা আবার আসব রে। মন খারাপ করিস না।
- ঠিক আছে বাবা। আমরা আবার আসব।

এই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে রিকশার হুড ফেলে দিয়ে মাথা সোজা করে বসে আশিকা। নীলগিরির স্মৃতি ওকে মুগ্ধতার আমেজে ভরিয়ে রাখে। চারপাশের ঘরবাড়ি, গাড়ি, রিকশার দিকে তাকিয়ে থাকলেও শহর ওর মনোলোকে ধরা পড়ে না। ওর বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছে। আর দুই মিনিটে নামতে হবে।

নিজের বাড়ির সামনে রিক্সা থামলে ভাড়া মেটায় ও। বাড়ির সামনে বারান্দায় উঠে বেল বাজায়। দরজা খুলে দেয় হামিদা বানু।

- কি রে ক্লাস করেছিস? বেশ তাড়াতাড়ি চলে এসেছিস। ভালোই করেছিস।
- হ্যাঁ মা। ক্লাস করেইতো এলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস ফাঁকি দেব এটা আমি ভাবতে পারিনা। কখনো ক্লাস মিস করিনা।
- বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিসনি? এটা তো তোর নেশা। 
- দিয়েছি। ওরা আমাকে বান্দরবনে যাবার দিন ঠিক করার কথা বলেছে। যাদের সঙ্গে বান্দরবন যাব ঠিক করেছি ওরা সবাই ছিল।
- ও আচ্ছা। প্রোগ্রাম ঠিকঠাক করে ফেলেছিস।

আশিকা মুখে কিছু না বলে মাথা কাত করে সায় দেয়। হামিদা বানু হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে। মুখে কিছু বলে না। 

- আব্বা এসেছেন? আব্বার সাড়াশব্দ পাচ্ছিনা। 
- এখনো আসেনি। আমরাতো সন্ধ্যায় খেতে যাব। তাড়াহুড়োর কিছু নাই। তুই দুপুরেতো কিছু খাসনি। হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে আয়। যা ঘরে যা।
- আমরা সবাই মিলে বাদাম খেয়েছি মা।
- বাদাম তো শখের খাবার। ওতে কি পেট ভরে?
- পেট ভরে না মা। কিন্তু আমার এখন ভাত খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না। ফ্রিজে যে গাজরের হালুয়া আছে সেটা খাব।
- নুডুলস করেছি। সেটাও খেয়ে নে।
- ওয়াও, এই দিয়ে আমার পেট ভরে যাবে। এসব তো মায়ের রান্নার মায়াবী খাবার।
- বলতেও পারিস কথা। মাগো তোর কথা শুনে আমার প্রাণ জুড়ায়। দুঃখ ভোলে।

আশিকা মাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেয়। বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখে। আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় কিছুটা সময়। হামিদা বানুও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখে। ছাড়তে চায়না মেয়েকে। পরস্পরের ধারণায় দুজনে মিলে এক হয়ে গেছে। এসময় হামিদা বানু বলে, আয়, খেতে আয়।

- তোমাকে ছাড়তে আমার মন চায়না। মনে হচ্ছিল, তুমি আর আমি মিলে একজন হয়ে গেছি।
- ওরে আমার সোনা মেয়েরে। আয় খেয়ে নে।
- আচ্ছা মা, কাপড় বদলে আসছি।

আশিকা নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকে। 

রাতে চাইনজ রেস্টুরেন্টে খেতে আসে সবাই। ওর বাবা আতিকুর রহমান সরকারি কর্মকর্তা। নিজেও ঘুরতে ভালোবাসে। আশিকা কোথাও যেতে চাইলে না করে না। বলে, ভ্রমণ এক ধরণের শিক্ষা। এই শিক্ষা থেকে ছেলেমেয়েদের বঞ্চিত করা ঠিক না। 

আশিকা বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞ বোধ করে। আতিকুর রহমান মেয়েকে বলে, কি রে কি খাবি অর্ডার দে।

আশিকা মেুনর দিকে তাকিয়ে পছন্দের খাবারের কথা বলে বেয়ারাকে। ও লিখে নিয়ে গেলে আশিকা মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি কি ঠিক ঠিক আইটেমের কথা বলেছি?

- হ্যাঁ, বলেছিস। তুইতো জানিস আমাদের প্রিয় খাবারের কথা। তবে ডেজার্ট খাব কি সেটাতো বললি না।
- আমরাতো ভ্যানিলা আইসক্রিম খাব আব্বা। ছেলেটি এলে বলে দেব। আগে তো স্যুপ দিয়ে যাক। আমিতো জানি স্যুপ মায়ের সবচেয়ে বেশি পছন্দ।
- হ্যাঁ, তাইতো। চাইনিজ খাবার খেতে এলে আমি স্যুপ খেয়ে পেট ভরাতে চাই।

শব্দ করে হেসে ওঠে আশিকা। হাসে আতিকুরও। হাসতে হাসতে বলে, তোর মা নিজেও কিন্তু ভালো স্যুপ রান্না করে। আমিতো খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলি। তারপর বাইরে আসি খাবারের টেষ্ট বদলের জন্য।

- এটাও খুব দরকার আব্বা। বাইরে খেতে আসলে আামর দিন অন্যরকম হয়ে যায়। মনে হয় দিন বদলের পালা। বাইরের খাবার খেয়ে দিনের সঙ্গে ভিন্নরকম বন্ধুত্ব করি।
- আমরা তো এসেছি তোর ভ্রমণ সেলিব্রেট করতে। এটা না করলে আমার মন খারাপ হয়। 
- আমি তা জানি আব্বা। আপনি আমাকে টাকা দেন। ঘোরাঘুরিকে শিক্ষা বলেন। দেশ দেখা বলেন। দেশকে ভালোবাসতে বলেন। জীবনের বিনিময়ে ভালোবাসা। আপনি আমাকে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে যুদ্ধ করেছিল। আপনি নিজেও বীর মুক্তিযোদ্ধা। আর আমার জন্ম স্বাধীনতার পরে। এভাবেই মানুষ দেশের জন্য জীবন দেয়। আপনার কাছে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে মনে হয়, ইস আমি যদি তখন যুদ্ধ করার বয়সে থাকতাম তাহলে আমিও যুদ্ধ করতাম।

বাবা-মা দুজনেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসে। হামিদা বানু হাসতে হাসতে বলে, তোর এত সাহস রে মেয়ে? আমিতো তোর বয়সী ছিলাম তখন। আমি কিন্তু যুদ্ধের কথা ভাবিনি।

- কেন মা? ভাবনি কেন?
- থাক, এসব কথা না বলাই ভাল। পাকিস্তানি সেনাদের আমি খুব ভয় পেতাম।

আতিকুর রহমান বলে, বঙ্গবন্ধুর দেশের জন্য ভালোবাসা দেখে আমি শিক্ষা নিয়েছিলাম। এমন করে দেশকে যিনি ভালোবাসতে পারেন, তিনি জাতির মাথার উপর থাকবেন। অর্থাৎ জীবনের বিনিময়ে ভালোবাসা।

- হ্যাঁ, অবশ্যই জীবনের বিনিময়ে ভালোবাসা। দেশের কোনো বড় ধরণের সংকট হলে সর্বশক্তি দিয়ে রুখতে হবে।
হামিদা বানু নীরবে কথা শোনেন। মাথা নাড়ান। সে সময় বেয়ারা স্যুপ নিয়ে আসে। হামিদা বানু সবার বাটিতে স্যুপ দেন। আশিকা চামচে স্যুপ তুলে বলে, চিয়ার্স।

আতিকুর আর হামিদা বানু দুজনেও চিয়ার্স বলে।

স্যুপ খাওয়া হলে ফ্রাইড রাইস আসে। মিক্সড ভেজিটেবল ও ফ্রাইড চিকেন আসে। এবার আশিকা সবার প্লেটে রাইস তুলে দেয়। যে যার মতো ফ্রাইড চিকেনের টুকরো নেয়। আশিকা ভাবে, এ যেন স্বপ্নের ভুবন। বেঁচে থাকার সত্যকে রঙিন করে রাখা। বাবা-মা দুজনই ওকে এমন নির্মল আনন্দে ভরিয়ে রেখেছে। আশিকা ওদের একমাত্র সন্তান। এই নিয়ে দুজনের মন খারাপ নেই। কখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে না, আরও দু’একজন সন্তান হলে ভালো হতো। 

- তোরা কি যাবার দিন ঠিক করেছিস রে?
- হ্যাঁ, আব্বা আমি আগামী এগারো তারিখ ঠিক করেছি। বাড়ি গিয়ে অন্যদের মেইল করে তারিখটা জানাব। সবাই যাবার জন্য প্রস্তুত আছে। 
- ফিরবি কবে?
- পাঁচ দিন থাকব। এর বেশি একদিনও না।
- থাকার জায়গা ঠিক হয়েছে?
- হ্যাঁ, হয়েছে। উপজেলায় একটি হোটেল পেয়েছি। আমি বুকিং দিয়েছি।
- বাহ, সবতো বেশ গুছিয়ে ফেলেছিস। তুই পারিসও মা। তোর এসব গুণ আমার প্রাণ ভরিয়ে দেয়। 
- মায়ের কাছ থেকে গুছিয়ে কাজ করা শিখেছি বাবা। আপনাকে ভেজিটেবল দেই।
- দে মা। তোর হাতে খাবার পাওয়া আমার অনেক বড় আনন্দ।
- আব্বা আমাকে অন্য চোখে দেখেন। শুধু নিজের মেয়ে হিসেবে না।

হামিদা খাতুন স্যুপের চামচ মুখের কাছে নেয়ার আগে বলে, তোকে তোর আব্বা কীভাবে দেখে বলত আমাকে।

আশিকা গম্ভীর স্বরে বলে, বাবা আমাকে একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখে, যার কাছ থেকে আব্বা সব রকম সহযোগিতা পেতে চান। শুধু মেয়ে বলে আমাকে আদর করে রাখেন না।

- বাব্বা, এত বুঝিস। তোর বোঝার তো শেষ নেই রে মেয়ে।
- ওর বোঝাকে তো আমি স্যালুট করি হামিদা বিবি। তুমি ওর জন্ম দিয়ে আমাকে ধন্য করেছ। 
- সেজন্যই তুমি শুধু ওর বাবা নয়, মাথার উপরের মানুষ। আমাকে তুই কীভাবে দেখিস রে মা?
- তুমি আমার বন্ধু মাগো। আমার প্রাণের মানুষ। তোমার সঙ্গে কথা বলা আমার একদিকে যেমন শেখার বিষয়, অন্যদিকে ভালোলাগার গভীরতা।

আতিকুর মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ চোখে বলে, বাব্বা, এতকিছু। মেয়েটাকে বুঝতে আমাদের জ্ঞান লাগবে।

আশিকা শব্দ করে হেসে বলে, আব্বা তোমাদের ভালোবাসা পেয়ে শুধু বড় হইনি। ভালোবাসার সঙ্গে বড় হওয়ার স্বপ্ন পেয়েছি। আমার বড় হয়ে ওঠা পূর্ণ করে দিয়েছ তোমরা। আজকে বাড়ি ফেরার সময় শুধু নীলগিরি পাহাড়ের কথা মনে হয়েছিল।

হামিদা বানু বলে, সমুদ্র সৈকত দিয়ে হাঁটার কথা মনে হয়নি?

- সেটাও মনে আছে মাগো। টেকনাফ থেকে সমুদ্র সৈকত দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমরা কক্সবাজারে এসেছিলাম। ওহ্ মাগো এ যাত্রা কি ভোলার কথা।
- ঠিক বলেছিস একদম ভোলার কথা না। আর বেশি কথা না, চল খাওয়া শেষ করি। 

বাবা-মা দুজনে হাসিমুখে খাবারে মনোযোগী হয়। কাটাচমচ দিয়ে ভাত খাওয়ায় তারা অভ্যস্ত নয়, তবু নানা চেষ্টায় খেতে থাকে। রেস্তোরায় তো হাত দিয়ে খাওয়া যাবেনা। অন্য টেবিলের সবাই তো একইভাবে খাচ্ছে। নিজেদের প্রেস্টিজ রাখতে হবে। এভাবে খেতে আশিকা অভ্যস্ত। ওর কোনো ঝামেলা হয়না। তারপরও খাওয়া শেষ করে তিনজনে। প্লেট খালি হলে বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করে, ডেজার্ট লাগবে স্যার?

- লাগবে। ভ্যানিলা আইসক্রিম আন।
বেয়ারা চলে যায়। আতিকুর মেয়েকে বলে, কি রে ঠিক বলেছি? নাকি অন্যকিছু খাবি?
- না, বাবা ঠিক আছে। আমিতো আইসক্রিম ভালোবাসি।
- আমিও আইসক্রিম খাব। হামিদা বানু মাথা নেড়ে বলে। তিনজনে কোকের গ্লাসে চুমুক দেয়। কেউ কোনো কথা বলে না। নিশ্চুপ কেটে যায় কতক্ষণ। আইসক্রিম এলে তারা খেয়ে নিজেদের খাওয়ার পর্ব শেষ করে। বিল মিটিয়ে বেরিয়ে আসে। আশিকা গাড়িতে ওঠার আগে বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, থ্যাঙ্কু আব্বা। থ্যাঙ্কু মা।
- এটা হলো তোর ভ্রমণের সেলিব্রেশন।
- বাবা তুমি এতকিছু করতে পার। আমি মাঝে মাঝে অবাক হই।

আতিকুর কিছু বলার আগে হামিদা বানু বলে, মাঝে মাঝে এমন সময় কাটানো খুব দরকার গো। দিনগুলো ভরে যায়। তুমি যে আমাদেরকে মাঝে মাঝে বাইরে খেতে নিয়ে আস এটা তোমার খুব ভালো ভাবনা।

- তোমাদের ভালো লাগাতো আমার আনন্দ গো। এতে পরিবারের ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হয়। তুমিওতো আমাদের জন্য নানা খাবার রান্না কর। স্কুলে চাকরির পরে থাকে আরও কাজ। খাতা দেখা থেকে শুরু করে নানা কিছু। এত কাজের পরেও তুমি রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে রাখ না।
- হয়েছে, চলো আমরা যাই। মেয়েটা কয়দিন বাড়িতে থাকবে না তার জন্য আমাদের মন খারাপ থাকবে।
- না, মা আমিতো সবসময় বলি তোমরা মন খারাপ করবেনা। মনে করবে আমি শেখার স্কুলে গিয়েছি। তোমরা আমার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছ।
- হয়েছে অনেক কথা। এখন চল।

গাড়িতে ওঠে তিনজন। রাস্তায় প্রবল যানজট। রাত বাড়ে। রাস্তা খালি হয় না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। বেশ রাতে বাড়ি ফিরে যে যার ঘরে ঢুকলে আশিকার মনে হয় তারাভরা রাতের আকাশ নেমে এসেছে ওর ঘরে। এ রাততো শুধু রাত নয়। এ রাত পারিবারিক বন্ধনকে আকাশ করার রাত। নইলে বেঁচে থাকা কঠিন হয়।

আশিকা ঘুমুনোর প্রয়োজন মনে করে না। কেবলই ভাবে শরীরটা পাখি হয়ে আকাশে উড়ছে। ওটা উড়তে চায়। বিছানাকে গাছের ডাল ভেবে বসতে চায়না। দিগন্তের কাছে পৌঁছালে শরীরে মনে দিগন্তজোড়া শান্তি হবে। ও হেসে গড়িয়ে পড়ে। ঘরের ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে হাসে। হাসির তোড়ে ভালোলাগার জায়গায় রঙিন ফানুস ওড়ে। শুনতে পায় দরজায় টুকটুক শব্দ। দরজা খুললে দেখতে পায় বাবা-মা দুজননেই দাঁড়িয়ে আছে।

- কি রে একা একা হাসছিস কেন? কি ভাবছিস রে
- আমার মনে হচ্ছে আমি একটা পাখি হয়ে আকাশে উড়ছি। সেজন্য আমার ঘুম আসছে না।
বাবা-মা দুজনে হা-হা করে হাসে। হাসির দমকে ভেসে যায় পুরো বাড়ি।
আতিকুর বলে, আমার বাড়িতে এমন হাসির জোয়ার আছে ভাবতেই আমার বুক ভরে যাচ্ছে রে ময়না পাখি।
হামিদা বানু সঙ্গে সঙ্গে বলে, ওরে আমার টুনটুনি। বিছনায় শুয়ে দেখ ঘুম আসবে।
- আমি তোমাদের ময়না পাখি আর টুনটুনি।
- না, শুধু দুইটা পাখি না। তুই আমাদের সব পাখি।
- আমি কাক হব না, শকুন হব না।
হামিদা বানু ওর মাথায় হাত রেখে বলে, না, না, এসব নামে ডাকব না তোকে। এখন থেকে অনেক পাখির নাম শিখব। সুন্দর সুন্দর নাম।
আশিকা প্রথমে মাকে জড়িয়ে ধরে। পরে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলে, তোমরা আমার মাথায় হাত রাখ। তাহলে আমার ঘুম আসবে।

দুজনে মাথায় হাত রেখে মিনিট পাঁচেক জড়িয়ে রাখে মেয়েকে। তারপর বলে, যা শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে।

আবার ঘরের দরজা বন্ধ করে আশিকা। টেবিলে বসে কম্পিউটার খোলে। বন্ধুদের মেইল করে তারিখটা জানায়। পাশাপাশি লেখে, শুভ যাত্রার জন্য সবাইকে অভিনন্দন। আমাদের জয়যাত্রায় নন্দিত হোক পাহাড়ি পথ। অচেনাকে চেনার দৃষ্টি খুলে যাক আমাদের। আমাদের মাথার উপর বিছিয়ে থাকুক বনরাজির সবুজ ছায়া।

 

সেলিনা হোসেন
প্রখ্যাত সাহিত্যক, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক

 

ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (প্রথম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (দ্বিতীয় পর্ব)

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top