শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৯) : সেলিনা হোসেন
 প্রকাশিত: 
 ১৭ আগস্ট ২০২২ ০১:২৮
 আপডেট:
 ৪ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:৩৫
                                
- আপনি কোথায় থাকবেন? 
- আমার ব্যবস্থা আছে। একটি ঘর খালি রেখেছি আমরা শরণার্থীদের জন্য। এই চরের সবাই মিলে আমরা এই আয়োজন করেছি। এখন আপনাদের খাবার আসবে সুখরঞ্জনের বাড়ি থেকে। আপনারা ঘরে ঢুকে বসুন। 
মায়ারাণী সবার আগে ঢুকে পড়ে। হরেন্দ্রনাথ সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়। চলে যায় লোকজন। কেউ কেউ বলে, একটুপরই আসছি। 
মায়ারাণী দেখতে পায় ঘরের মেঝেতে পাটি পাতা আছে। এক কোণায় চাদর-বালিশ আছে। ঘুমুনোর সময় ব্যবহার করা হবে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে পাটির উপর বসে থাকে মায়ারাণী। বুকের ভেতর গভীর প্রশান্তি ছড়ায়। মনে হয় বেঁচে থাকার স্বস্তি পাওয়া হলো। এখন স্বাধীনতার জন্য কাজ করার পথ খুঁজে নিতে হবে। পরক্ষণে ভাবনা থমকে যায়, এজন্য যে গর্ভের সন্তান নড়ে ওঠে। বিব্রত বোধ করে মায়ারাণী। এই সন্তানের জন্মের দুই মাস বাকি আছে। তার আগে কিছু করা যাবে না। বীথিকা কাছে এসে বসে। বলে, মা কি ভাবছো? 
- যুদ্ধ করার কথা ভাবছি।
- কেমন করে যুদ্ধ করবে? 
- যুদ্ধের পক্ষে নানা কাজ করব। এটা আমার যুদ্ধ হবে। থাক আর কথা বলিস না। 
খাবার নিয়ে ঘরে ঢোকে দুই-তিনজন মহিলা। নিজেরাই থালায় ভাত-তরকারি দিয়ে সবার দিকে এগিয়ে দেয়। একজন মায়ারাণীর দিকে তাকিয়ে বলে, আপনার জরুরি কিছু দরকার হলে আমাদেরকে বলবেন। এই ঘরের পেছনে পেসাব-পায়খানার জায়গা আছে। আপনারা কোথা থেকে আসছেন? 
- খুলনার শ্রীনগর গ্রাম থেকে। 
- কিভাবে এসেছেন? 
- নৌকায়। 
- কতক্ষণ লেগেছে আসতে? 
- চারটা নদী পার হয়ে আসতে তিনদিন তিনরাত লেগেছে। 
- ওহ বাবা। অনেক কষ্ট হয়েছে না? 
- না, না তেমন কষ্ট হয়নি। 
পাশ থেকে হরেন্দ্রনাথ উত্তর দেয়। 
- এখান থেকে কোথায় যাবেন? 
- আপনারা বলেন শরণার্থী ক্যাম্প কোথায় আছে? 
আর একজন নারী সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমাদের কেউ কেউ আপনাদেরকে দিয়ে আসবে বশিরহাট ক্যাম্পে। 
- আমরা কি কালকে যেতে পারব? 
- না, আর একদিন থাকেন। দম ফেলেন। এই ঘরে চাদর বিছিয়ে গড়াগড়ি করে ঘুমাবেন। এই মেয়ে তোমার নাম কি? 
- বীথিকা। ওর নাম কৃষ্ণপদ, ও নিরঞ্জন, ও অমল। 
- দেখতে পাচ্ছি সামনে আর একজন আসছে। 
- হ্যাঁ, আমি একটা বোন চাই। বোন পেলে আমার খুশির সীমা থাকবেনা। 
- ভালোই বলেছো মা। 
- তিনটি ভাইয়ের সঙ্গে আমার দিন সুন্দর কাটে। 
- যুদ্ধের কথা মনে হয় না? 
- হ্যাঁ, হয়। আমি এখানে কোথাও সুযোগ পেলে অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং নেব। তারপর যুদ্ধ করব। 
- সাবাস মেয়ে, সাবাস। জয় হোক তোদের। 
বীথিকা চেঁচিয়ে বলে, ‘জয় বাংলা’। 
এলাকার মহিলারাও ‘জয় বাংলা’ বলে উঠে দাঁড়ায়।
- আমরা এখন যাচ্ছি। কালকে দেখা হবে। 
বেরিয়ে যায় সবাই। 
হরেন্দ্রনাথ বিস্মিত কন্ঠে বলে, এই চরেরর লোকেরা কেমন আন্তরিকভাবে আমাদের গ্রহণ করেছে। ওদের ঋণ শোধ হবার নয়। 
- ঠিক বলেছ বাবা। একটা কুঁড়েঘর খালি রেখেছে শরণার্থীদের জন্য। 
- আমাদের মাথার উপর হাত দিয়ে রেখেছে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর নির্দেশ না থাকলে এরা আমাদের এমনভাবে গ্রহণ করতে পারতনা। 
- না বাবা, এটা শুধু সরকারি নির্দেশ না, নিজেদের চেতনাও আমাদের জন্য কাজ করছে। নইলে আমরা এমন আন্তরিকতা পেতামনা। আমি এখন তিন ভাইকে নিয়ে পুরো চরটা ঘুরে ঘুরে দেখব। 
- জলের ধারে বেশি যাবিনা। এরা তিনজনে যেন হুড়মুড়িয়ে জলে না নামে। 
- হ্যাঁ মা, সাবধানে ঘুরব। আমরাতো এমন চর কখনো দেখিনি। 
- আচ্ছা ঘুরে আয়। 
বীথিকা ভাইদের নিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। এদিক-ওদিক দৌড়ে ব্রিজের নিচে এসে দাঁড়ায়। দেখতে পায় চরের ওপাশ থেকে এপাশে ব্রিজটা চলে গেছে। বীথিকার মনে হয় কালকে ওরা যখন যাবে তখন এই ব্রিজ পার হয়ে যাবে। পরক্ষণে ভাবে, নাও হতে পারে। দেখতে পায় দূরে বাবা দাঁড়িয়ে আছে। ওরা একদৌড়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। 
বীথিকা বলে, বাবা এই চরটা কি সুন্দর!
- হ্যাঁ মা, খুব সুন্দর। আমি এখানে দাঁড়িয়ে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছি। দেশ স্বাধীন হলে আমরা এখানে বেড়াতে আসব। এখানকার মানুষেরা খুব ভালো। সবাই আমাদেরকে কত মায়া দেখাল। 
- ঠিক বলেছো বাবা। আমরা এখানে শুধু বেড়াতে আসব না। একদিন দুপুর বেলা এদের জন্য খাওয়ার আয়োজন করবো। পারবে না? 
- পারব। তোর মায়ের কাছে টাকা রাখব। তোর মা জমিয়ে রাখবে। সবাইকে খাওয়াতে অনেক টাকা লাগবে। 
- তা লাগবে বাবা। আমরা সবাই মিলে খরচ কমিয়ে ফেলে টাকা জমাব। 
- ঠিক বলেছিস মা। দেশ স্বাধীন হলে আমাদের একবার আসতে হবে। 
- যাই আমরা চরের ওই দিকটা দৌড়ে আসি। তিন ভাইয়ের হাত ধরে বীথিকা দৌড়াতে থাকে। হরেন্দ্রনাথ ছেলেমেয়েদের আনন্দ দেখে হাসিমুখে ঘরে ফেরে। 
পরদিন চরের কয়েকজন মিলে ওদেরকে বশিরহাট শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। স্থানীয় মানুষের সহায়তায় ত্রাণ হিসেবে কিছু খাদ্যদ্রব্য পায় ওরা। এসব খেয়ে তিন-চার দিন কেটে যায়। কোনো অসুবিধা হয়না। তবে দিনগুলো বেশ কষ্টে কাটে। তখন তাদের কষ্ট দেখে মানা ক্যাম্পে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় স্থানীয় লোকেরা। একটা বাসে করে তাদেরকে ট্রেন স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। বীথিকা তার মা ও ভাইদের ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে ট্রেনে ওঠায়। কিন্তু ওর বাবা উঠতে পারেনা। দিশেহারা হয়ে যাই সবাই। বীথিকা নিজে চোখের পানি মোছে। ভাইয়েরা কাঁদতে শুরু করে। বিথীকা বলে, আমরা পরের স্টেশনে নেমে যাব। 
- ঠিক বলেছিস। 
পরের স্টেশনে ট্রেন থামলে বিথীকা সবাইকে নিয়ে নেমে পড়ে। ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে গেলে বিথীকা মা-ভাইদের নিয়ে স্টেশন মাস্টারের রুমে যায়। স্টেশন মাস্টার ওদের দিকে তাকিয়ে বিব্রত হয়ে জিজ্ঞেস করে, কি ব্যাপার কি হয়েছে আপনাদের? 
- আমরা ভীষণ বিপদে পড়েছি। 
- কি হয়েছে? 
- আমারা মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থী। আমাদেরকে ক্যাম্প থেকে ট্রেনে উঠিয়ে অন্য ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছিল। ভিড়ের ঠেলাঠেলিতে আমার বাবা ট্রেনে উঠতে পারেনি। 
- ঠিক আছে আপনারা বাইরে গিয়ে বসুন। আমি আগের স্টেশন মাস্টারকে ফোন করে দিচ্ছি। পরের ট্রেনে তুলে দেবে তাকে। 
সবাই মিলে বাইরে এসে স্টেশনের বেঞ্চে বসে। একজন কাছে এসে বলে, শুনলাম আপনারা শরণার্থী। এখানে বিস্কুট আর কলা আছে। নিন, খেতে থাকুন। 
বিথীকা হাত বাড়িয়ে ঠোঙাটা নেয়। বয়সী মানুষটিকে প্রণাম করে। তারপর সবাই মিলে কলা বিস্কটু খায়। বাকিটা বাবার জন্য রেখে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখতে পায় ষ্টেশনে ট্রেন ঢুকছে। সবাই মিলে ওখানে দাঁড়িয়ে খেয়াল করে যাত্রীদের। দেখতে পায় নেমে আসছে হরেন্দ্রনাথ। বিথীকা তিন ভাইকে বলে, তোরা দৌড় দিয়ে বাবার কাছে যা। আমাদের কাছে নিয়ে আয়। 
- না, না বাবাকে আনব কেন? আমরাতো বাবার সঙ্গে যাব। বাবা এখানে কি করবে? 
- মায়ারাণী বলে, হ্যাঁ তাই। চল আমরা এগিয়ে যাই। ট্রেনে উঠব। 
সবাই মিলে এগিয়ে গেলে হরেন্দ্রনাথ সবাইকে নিয়ে ট্রেনে উঠে যায়। যারা ওদের নিয়ে যাচ্ছিল তারা ওদেরকে মানা ক্যাম্পের কাছে নামায়। চারদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায় বিথীকা। পাহাড় ও হ্রদ পরিবেষ্টিত মানা ক্যাম্প। ওদিকে তাকালে দৃষ্টি ফেরানো যায়না। হরেন্দ্রনাথ ও মায়ারাণীও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। ওখানেই ঠাঁই হয় তাদের। বাসস্থানটিও চমৎকার। চারদিকে বাঁশের চর্ঁাচের বেড়া এবং উপরে টিনের চাল। বাকি যারা ছিল, তাদের অনেকের ঠাঁই হয় তাঁবুর নিচে। এই ক্যাম্পে শিশুখাদ্য সরবরাহে কোনো ত্রæটি রাখেনি ভারত সরকার। শিশুদের জন্য গুড়া দুধের ব্যবস্থা ছিল। প্রত্যেককে বিশেষ কার্ড দেয়া হয়েছিল খাদ্যসহ বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী পাওয়ার জন্য। সবাই খুব হাসিখুশিভাবে দিন কাটাত। শরণার্থী হওয়ার দুঃখ নিয়ে কষ্ট ছিলনা। এমন সুন্দর প্রকৃতির মাঝে সুন্দর সময়ের মহিমায় দারুণ সময় কেটে যায় বিথীকার পরিবারের। ছোট তিন ভাই সারা দিন এদিক-ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করে। কেউ ওদের বাধা দেয়না। বিথীকা মাকে বলে, এমন জায়গা কি ওরা আর জীবনে পাবে গো মা। বাধা না দেয়াই ভালো! খেলুক ওরা। 
- যদি হারিয়ে যায়?
- না গো মা হারাবেনা। ওদের আমি সবসময় পথ চেনাই। 
- আচ্ছা যা, তুই ওদের সঙ্গে থাকিস। 
- আমি ওদের দিকে সবসময় খেয়াল রাখি। 
- আচ্ছা, ভালো করিস।
(চলবে)...........
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৩)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৪) 
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৫)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৬)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৭) 
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৮)
বিষয়: সেলিনা হোসেন

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: