শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১১) : সেলিনা হোসেন
 প্রকাশিত: 
 ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০২:১০
 আপডেট:
 ৪ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:৩৭
                                
বিবিসির খবর শুনে যশোর রোড়ে তোলপাড় করে মারুফ। চেঁচিয়ে বলে, পাকিস্তান সরকারের গায়ে আগুন ধরেছে। পুড়ছে সরকার। সেইজন্য এমন মিথ্যা কথা। 
অভিজিত ওর ট্রানজিস্টারে খবরটা শুনিয়েছিল। সেই থেকে ওর মাথায় আগুন জ¦লছে। প্রতিদিন শরণার্থীর ভিড় জমে যশোর রোডে। গতকাল একজন ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে অঞ্জন নামে। ডাক্তার তার বাবা-মা আর একটি ছোট মেয়েকে নিয়ে ঢাকা থেকে এসেছে। মাঠের মাঝখানে একটা তাবুতে আশ্রয় পেয়েছে তারা। ঠিকমতো খাবার পায়নি। বাচ্চা মেয়েটি ক্ষুধায় কাঁদছে। অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছে অঞ্জনের মা। ঘাসের ওপরে পেতে দেয়া একটি পাতলা চাদরের উপর শুয়ে থাকায় খুব করুণ দেখাচ্ছে। মারুফ অঞ্জনকে বলে, আমার তাঁবুতে একটা কাঁথা আছে দেব আপনাকে? 
- না, না, লাগবেনা। আমার মা অনেককিছু সহ্য করতে পারে। 
- ঠান্ডা লেগে আবার জ¦র না আসে। 
- আমি দেখব মাকে। আপনি যেতে পারেন। 
- ঠিক আছে, যাচ্ছি। আপনাদের শরণার্থী কার্ডের কথা বলব। 
- আচ্ছা বলবেন। আমিও একটু পরে যাব আমাদের ভারতীয় ভাইদের কাছে। তাদের মাটিতে মাথা রেখে জীবন বাঁচানোর জন্য এসেছি। 
- আচ্ছা, আমি যাই। 
মারুফ চলে গেলে জয়ন্ত মায়ের কাছে গিয়ে বসে। বাড়ির পাশের দুই প্রতিবেশি মৌলবাদী জঙ্গী গোষ্ঠীর সদস্য। নানা ধরণের উৎপাত শুরু করলে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় দেশ ছেড়ে চলে আসার। যশোর রোডে ঢোকার পর থেকে বিষণœতা কেটে যায়। চারদিক থেকে শিশুদের কান্না শুনলে অঞ্জনের মনে হয় এ এক ধরণের সুরের মূর্ছনা। বেঁচে থাকার স্বপ্ন ছুঁয়ে আছে। ওদের কান্নাকে বুকে টেনে থামাতে হবে। যশোর রোডের দু’পাশের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে শরণার্থীদের বাঁচিয়ে রাখার আয়োজন চলছে। ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্না থামানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। ভারত সরকার নানাভাবে শরণার্থীদের সুরক্ষার চেষ্টা করছে। তারপরও অভাব ছাড়ে না। এমন ধারণায় অঞ্জন হেঁটে যায় যশোর রোডে। বড় বড় গাছগুলো ছায়া বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে। নিচে দাঁড়ালে শরীর ¯িœগ্ধ হয়ে যায়। এতুকিছু দেখে বাবা-মাকে নিয়ে তাঁবুতে এসেছিল অঞ্জন। যশোরের সীমান্ত পার হলেই যশোর রোড। অথচ এত সুন্দর এই রাস্তাটি আগে দেখা হয়নি। ঘুরতে আসা হয়নি এই এলাকায়। নিজের উপর রাগ হয় অঞ্জনের। সুস্থ সময়ে দেখার চিন্তা কেন মনে হলোনা! বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতে আসতে পারত। নিজেকে মনে মনে বকাবকি করে মায়ের পাশে এসে বসে।
- মাগো, শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে? 
- হ্যাঁরে বাবা, ওই যে বর্ডার থেকে হেঁটে এসেছি সেজন্য হয়রান হয়ে গেছি। মনে হচ্ছে গায়ে শক্তি পাচ্ছিনা। - কিছুক্ষণ রেস্ট করলে ঠিক হয়ে যাবে মা। 
- আনজুম কই রে? তোর বাবা কই? 
- বাবা আনজুমকে নিয়ে ওইদিকে গেছে। আনজুমের জন্য কিছু খাবার খুঁজছে বাবা। 
- আমরা পাঁচজন গেরিলা যোদ্ধাকে সাহায্য করার জন্য পাকিস্তানি সমর্থকরা আমাদের উপর হামলা করল। আমরা শরণার্থী হলাম। 
- আমি দেখতে যাই বাবা কোথায় আছে? 
- না বাবারে, তুই আমার কাছে বসে থাক। আমি একটু ঘুমানোর চিন্তা করছি। 
- এইখানে শুয়ে তোমার কি ঘুম আসবে? 
- এখন হয়তো আসবেনা। কিন্তু পরে আসবে। 
- আচ্ছা, তাহলে তুমি চুপচাপ শুয়ে থাক। আমি বসে থাকছি তোমার জন্য। বাবা যখন আসবে আসুক। এইখানে বসে বাবার জন্য অপেক্ষা করি। 
কেউ আর কথা বলেনা। দুজন মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস বয়ে যায় শরণার্থী শিবিরে। দুজন মানুষের স্মৃতি একইসঙ্গে তোলপাড় করে। ফেলে আসা জীবন ভেসে ওঠে মনের মাঝে। দুজনে একই ভাবনায় মগ্ন হয়। শুরু হয় স্মৃতিতে অবগাহন--
চলবে
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৩)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৪) 
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৫)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৬)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৭) 
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৮)
বিষয়: সেলিনা হোসেন

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: