সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

একা এবং একা (পর্ব ষোল) : আহসান হাবীব


প্রকাশিত:
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:৩৩

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:৫৩

 

(আহসান হাবীব মূলত একজন প্রফেশনাল কার্টুনিস্ট। তিনি পেশাগত কারণে সাধারনত কমিকস, গ্রাফিক নভেল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন। তিনি যখন লিখেন তখন তার মাথায় থাকে কমিকস বা গ্রাফিক নভেলের কনটেন্ট। তার গল্পের পিছনে থাকে স্টোরি বোর্ডের মত ছবির চিত্রকল্প। এই কারণেই তার লেখায় একটা সিনেমাটিক ড্রামা থাকে প্রায়শই। তিনি মনে করেন যেকোনো গ্যাজেটেই/ফরম্যাটেই হোক, স্ক্রিনে যে গল্প পাঠক পড়ছে, সেখানে তার সাব-কনসান্স মাইন্ড ছবি খুঁজে। আর তাই ‘প্রভাত-ফেরী’র পাঠকদের জন্য তার এই ধারাবাহিক ইন্ডি নভেল ‘একা এবং একা ’ )

 

পর্ব- ষোল

সুরঙ্গের ভিতর প্রচন্ড শব্দে ভেঙে পড়ল তৃতীয় বেরিক্যাডটা। দুজনেই সুরঙ্গের ভিতর ধাক্কা খেতে খেতে  ছিটকে বের হয়ে এল বেড়িক্যাডের বাইরে। প্রফেসর চিৎকার করলেন-

-মারুফ দম বন্ধ করে থাক পানি আসছে!

সঙ্গে সঙ্গে গুম গুম শব্দে ছুটে আসা পানি তাদের উপর আছড়ে পড়ল, মাছগুলোও নিশ্চয়ই চলে এসেছে! তবে কি তারা ব্যর্থ? মৃত্যুকে এখন  গ্রহণ করতে হবে ঠান্ডা মাথায়, যেমনটা বলেছিলেন প্রফেসর। কিন্তু শেষ বেরিক্যাডটা তো মারুফ ভেঙেছে। তাহলে মারুফ পানির মধ্যে কেন? ততক্ষনে সুরঙ্গ ভরে গেছে পানিতে। হঠাৎ হু হু করে নিচের দিকে নামতে শুরু করল মারুফ, প্রফেসর কোথায়? সুরঙ্গটা হঠাৎ করে অনেক ঢালু হয়ে গেছে। নিজেকে পানি ভর্তি সিলিন্ডারের মধ্যে ফাঁদে পরা একটা অসহায় ইঁদুরের মত মনে হচ্ছে!

তখনই ঝুপ ঝুপ করে দুজনে ছিটকে এসে পড়ল বাইরে একটা চওড়া ড্রেনে। মারুফ উপরে তাকিয়ে দেখে ঝক ঝকে নীল আকাশ। তবে কি তারা সত্যি সত্যি মুক্ত হতে পেরেছে শেষ পর্যন্ত! লম্বা করে শ্বাস নিয়ে তাকিয়ে দেখে তার পায়ের কাছে চিৎ হয়ে পরে আছে প্রফেসর! তখনই আশে পাশে কোথাও প্রচন্ড একটা বিস্ফোরন হল। মারুফ তাকিয়ে দেখে তারা যে বিশাল পাইপের মুখ দিয়ে ছিটকে এসে পড়েছে এই চওড়া ড্রেনে, সেই পাইপের মুখ দিয়ে গল গল করে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, একটু আগেই বের হচ্ছিল পানি এখন বেরুচ্ছে ধোঁয়া, এসব কি হচ্ছে?

-প্রফেসর?
-উ
-আপনি ঠিক আছেন?
-হু
-শব্দ হল কিসের?
-কুটুম ঘরটা গুড়িয়ে গেছে কয়েক সেকেন্ড আগে।
-কে করল এই কাজ?
-মনে হচ্ছে আমিই। প্রফেসর কুল কুল করে হাসলেন। অফিসিয়ালি তুমি আর আমি কুটুমঘরে এই মাত্র মারা গেলাম! অন্তত জেলখানার ভিতর সবাই তাই জানবে!

-আমরা তাহলে মুক্ত?
-নট ইয়েট
-কেন? আমরা ঠিক কোথায়?
-আমরা এখনো হাসিমপুর জেলখানার ভিতরেই আছি ...
-তাহলে?

প্রফেসর উত্তর দিলেন না। নিঃশব্দে কুল কুল করে হাসতে লাগলেন।

খিল খিল করে হাসছে সাবিনাও। সূর্য অস্ত যেতে শুরু করেছে, তারা তখনও সমুদ্র সৈকতে বসে, বরুণ আর সাবিনা।

-এত হাসো ক্যান কি হইছে?
-আপনের কি আমি হাসলে?
-যত হাসি তত কান্না বলে গেছে রাম সন্না...
-এই রাম সন্না লোকটা কে?
-হইব কোন সাধু সন্ন্যাসী, শোন চা খাইবা?
-এইখানে চা পাইবেন কোথায়?
-তুমি বস। আমি নিয়া আসি
-কি বলেন আমি এখানে একা বসব?
-আরে বাবা এক মিনিটও লাগবে না। ঐ যে দেখছ তিনটা লোক ওরা ফ্লাস্কে করে গরম গরম চা কফি দুইটাই বেঁচে। ছোট ছোট ঝাল বড়াও বেচে খাইবা?-----আচ্ছা আইনেন।
-তুমি বস, আমি যাব আর আসব
-আচ্ছা

বরুণ উঠে লোকগুলোর দিকে হাঁটতে থাকে। সাবিনা তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। কি অসাধারণ দৃশ্য। মনে হচ্ছে সমস্ত সমুদ্রটাকে লাল রং ছিটিয়ে সূর্যটা ডুব দিতে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। কতক্ষন তাকিয়ে ছিল সাবিনা নিজেও জানে না। হঠাৎ খেয়াল হল বরুণ কোথায়?

চারদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে বরুণ তো চা আর ঝাল বড়া  নিয়ে এল না এখনো। সাবিনা উঠে দাড়ায়; আশে পাশে একটা লোক নেই। দূরে সেই তিনটা লোককেও এখন আর দেখা যাচ্ছে না। সাবিনা এদিক ওদিক তাকিয়ে বরুণকে খোঁজে। এখন সে কি করবে? হঠাৎ করে তার প্রচন্ড ভয় লাগতে শুরু করেছে। বরুণের কি তাহলে খারাপ কিছু হল? সাবিনা আধা ঘন্টার মত  অপেক্ষা করল, ফোন দিল। ফোন ধরল না বরুণ।  তারপর হাঁটা শুরু করল তাদের হোটেলের দিকে। তাদের হোটেলের নাম নিউ হানিমুন কটেজ। নামটা মনে আছে সাবিনার। হোটেলটা খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না আশা করি।

হোটেলের কাউন্টারে এসে যা শুনলো তাতে করে মাথা ঘুরে গেল সাবিনার। একটু আগে নাকি বরুণ এসে তার ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেছে। মানে কি? হঠাৎ কি সন্দেহ হল, সাবিনা চাবি নিয়ে ছুটে গেল রুমে। রুম খোলাই ছিল। কি আশ্চর্য সত্যি সত্যি বরুণের ব্যাগ নেই। টাকা ভর্তি সাবিনার সেই চামড়ার ব্যাগটাও নেই। সাবিনার মাথার ভিতরটা ফাকা হয়ে গেল। ঝুপ করে বিছানায় বসে পড়ল। একটা প্রচন্ড আতঙ্ক  গ্রাস করলো সাবিনাকে; সে কি করবে? তারপরও কাঁপা হাতে বরুণের মোবাইল ফোনে ফোন দিল ... একবার দুবার তিনবার। বরুণ ফোন ধরল না ওপাশ থেকে একটা মেয়ে বার বার  বলছে ‘এই মুহুর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে  না... একটু পর আবার ফোন করুন...’    ‘এই মুহুর্তে  সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে  না... একটু পর আবার ফোন করুন...’   

-আমরা কিন্তু এখনো জেলের ভিতরে
-বলেন কি তাহলে বেরুবো কিভাবে?
-ঐ যে দেখছ না পানির বিশাল ট্রাকটা, মাসে একবার এই ট্রাকটা ঢোকে এখানে; কুটুম ঘরের পানি বদলাতে। সন্ধ্যাটা নামুক। আমরা দুজন ঐ পানির ট্রাকের নিচে ঢুকে যাব। একটু কষ্ট হবে তবে কুঠুম ঘরে এবং তার থেকে বের হতে আমাদের দুজনের ট্রেনিং হয়ে গেছে। আমরা ঐ ট্রাকের ক্র্যাঙ্ক শ্যাফটে ঝুলে থাকব, বেশী না বিশ মিনিট।
-কি বলেন গাড়ীর ক্র্যাংক স্যাফটতো একটা রোটেটিং পার্টসের মত, ওখানে ধরে থেকে ঝুলব কিভাবে?
-ঠিকই ধরেছ তুমি। গাড়ীর পিস্টনগুলো ওখানে মুভ করে। কিন্তু এর পুরোটাই ঘুরে না। আমি দেখিয়ে দিব কিভাবে আমরা আকড়ে থাকব ক্র্যাঙ্ক স্যফটটা।
-আচ্ছা তা না হয় থাকলাম তারপর?  
-গাড়ীটা বাইরে গিয়ে এক জায়গায় থামবে তারপর আমরা মুক্ত!
-এত কিছু প্ল্যান আপনি কিভাবে করলেন?
-একদিনেতো করিনি। বিন্দু বিন্দু করে সিন্ধু। চল আপাতত এই সিন্ধু নদী থেকে বের হই। সিন্ধু নদীই বটে চওড়া ড্রেন দিয়ে তখন হুর হুর করে পানি আসতে শুরু করেছে। তবে পরিস্কার পানি।
-এদিকে সেন্ট্রিদের গার্ড তেমন নেই, জায়গাটা নো ম্যানস ল্যান্ডের মত। তারপরও সাবধান। কেউ দেখে ফেললে পুরো পরিকল্পনা বরবাদ হয়ে যাবে আমাদের। অবশ্য এখন সবাই ঐ কুটুম ঘর নিয়ে ব্যাস্ত। নিশ্চয়ই আমাদের লাশ খোঁজাখুজি করছে!

চারিদিকে অন্ধকার হওয়ার একটু আগেই দুজন হামাগুড়ি দিয়ে পানির বিশাল ট্রাকটার নিচে পৌঁছে গেল।

ক্র্যাঙ্কটস্যাফটের শক্ত ধাতব সিলিন্ডারের মত জিনিষটার কোন জায়গায় কিভাবে ঝুলে থাকতে হবে বিশ মিনিট সেটা দেখালেন প্রফেসর। কৌশলটা মন্দ না, একটু ঝুকি আছে বটে!

-খুব শিগ্রী আমরা বের হচ্ছি। ফিস ফিস করলেন প্রফেসর
-ট্রাকের লোকজন কি জানে তাদের গাড়ি নিচে লুকিয়ে বের হচ্ছি আমরা?
-একজন জানে।

সন্ধ্যা সোয়া ছটায় ধীরে সুস্থ্যে পানির বিশাল ট্রাকটা হেলেদুলে বের হল জেলখানা থেকে। জেলখানার ভিতরে তখন তমুল হই চই চলছে। কারণ কুটুম ঘর উড়ে গেছে কোনো রহস্যময় হাই এক্সপ্লোসিভের কারণে, কিভাবে কি হল কেউ বুঝতে পারছে না। ভিতরে যে দুজন ছিল তারা যে জীবিত নেই এটাও সবাই বুঝে গেছে। এদিক ওদিক ছিটকে পড়ে আছে কিছু মৃত মাছের ছিন্ন ভিন্ন দেহ, যারা একসময় কুটুম ঘরের থই থই পানিতে রাজত্ব করত। ভয়ঙ্কর মাছগুলোকে এখন আর অতটা ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে না। হয়ত তারা মৃত বলেই। তবে প্রফেসর আর মারুফের চিহ্ন মাত্র নেই কোথাও। দুএকজন আসামী আফসোস করল মাথা ঝাকিয়ে ‘আহা প্রফেসর লোকটা ভাল ছিল’। মারুফের কথাও দু একজন বলল। মানুষের মৃত্যু যে কখন কিভাবে আসে কেউ বলতে পারে না।

সরযুবালা বিদ্যনিকেতনে আবার পুলিশ এসেছে কুদ্দুসের খোঁজে। এবার সরাসরি নিরুবালা আচার্যের রুমেই ঢুকলেন ওসি সাহেব।

-ম্যাডাম স্যরি আপনাকে বার বার বিরক্ত করতে হচ্ছে
-না কোনো অসুবিধা নেই।
-খবর শুনেছেন বোধ হয়?
-কি খবর?
-আপনাদের স্কুলের ড্রিল শিক্ষক মারুফ সাহেব, জোড়া খুনের আসামী। যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল যার।
-হ্যাঁ হ্যাঁ তাকে অবশ্য আমি স্কুলে পাইনি, তবে তার কথা অনেক শুনেছি স্কুলে এসে। কি হয়েছে তার?

-গতকাল সে মারা গেছে এক বিষ্ফোরনে। জেলখানার ভিতরেই
-তাই নাকি?, আহা বেচারা, জেলখানার ভিতর কিসের বিষ্ফোরন?
-তা অবশ্য ডিটেইলস জানা যায় নি। আচ্ছা যে কারণে এসেছিলাম। কুদ্দুসের কোনো ছবি কি আছে আপনাদের স্কুলের ফাইলে?

-একটা ছিল। কিন্তু এখন আর দেখছি না। আমার ধারনা কুদ্দুস নিজেই সরিয়েছে। ছেলেটা অনেক ধুরন্ধর এখন বুঝতে পারছি
-হু তাই মনে হচ্ছে। তবে সে যে আপনাদের মজিদ স্যারেকে খুন করেছে তা আমরা নিশ্চিত হয়েছি। যে বাস থেকে নামিয়ে কুদ্দুস মজিদ স্যারকে হত্যা করেছে। সেই বাসের কন্ডাক্টর আর ড্রাইভার  যে বর্ননা দিয়েছে তাতে করে কুদ্দুসের শারীরিক বর্ননা মিলে যায়।  

-আচ্ছা স্কুল ফান্ডের ঐ টাকা?
-হ্যাঁ , খুব সম্ভব স্কুলের তিন সাড়ে তিনলাখ টাকাও সে হাতিয়ে নিয়েছে। সম্ভবত টাকার জন্যই খুন!

ওসি সাহেব আরো কিছুক্ষন কথা বললেন চা বিস্কুট খেলেন আবার বিরক্ত করার আশ্বাস দিয়ে চলে গেলেন। তবে খুব শিগ্রী কুদ্দুসের বিরুদ্ধে চার্জ শীট দেয়া হবে সেটাও জানালেন্।

মারুফের মৃত্যু সংবাদ টিচার্স রুমে পৌছে যেতে দেরী হল না। মনিকা মাডামের কানেও গেল। তিনি চুপ চাপ শুনলেন। তাকে ক্লাশে যেতে হবে এখনই।  আজ পড়াবেন নিউটনের সূত্র। বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হল। নিউটনের সূত্র যেন তার উপর কাজ করছে না। তার পা দুটোকে উপরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কেউ। হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে। কোন মতে এসে ক্লাশে বসলেন। কি আশ্চর্য নিউটনের একটা সূত্রওতো তার কিছুতেই মনে পড়ছে না! 

একটা স্টেশনে বসে আছে প্রফেসর আর মারুফ। স্টেশনের নাম উলিপুর স্টেশন। নিরিবিলি একটা স্টেশন। জংশন স্টেশন; যদিও এই মুহুর্তে নিরিবিলি। ট্রেন সান্টিংএর শব্দ ছাড়া বড় কোন শব্দ নেই।

-প্রফেসর?
-বল
-আপনাকে ধন্যবাদ
-কেন?
-এইযে আমরা দুজন এই স্টেশনে, মুক্ত হয়ে বসে আছি। এর সমস্ত কৃতিত্ব আপনার।  
-না আমার একার না তোমার কৃতিত্বও যথেষ্ট আছে। এক একটা ব্যারিক্যাড ভাঙতে যদিএক দুই সেকেন্ড দেরী হত। তাহলে ঐ সুরঙ্গের বদ্ধ পনিতেই ডুবে মরতাম আমরা দুজন্, ভয়ঙ্কর মাছতো ছিলই।

-আচ্ছা সুরঙ্গের ভিতরের প্যাঁচটা বুঝতে পারলাম না আমি
-ওটা আসলে একটা গোলক ধাঁধার মত। হঠাৎ পানি আসল এর কারণ শেষ ব্যারিক্যাডটা আ্সলে একটা ওয়ান ওয়ে ভালবের মত। ওখানে পানি আর মাছ কুটুম ঘরের দিকে ঘুরে যাবে, আর ময়লা আবর্জনা সুরঙ্গ দিয়ে বাইরে ড্রেনে এসে পড়বে। আমরা যেমন ময়লা আবর্জনার সাথে বাইরে চলে আসলাম।

-আপনি বলেছিলেন পানির সঙ্গে মাছ চলে আসবে।
-হ্যাঁ তাই আসে তবে দুএক মিনিট দেরী হয় মাছ আসতে। আমাদের ভাগ্য ভাল ঐ দুই এক মিনিট পানির ঝাপটা সহ্য করে বাইরে আসতে পেরেছিলাম। আজকের খবর দেখেছ ?
-কি আছে খবরে?
-কেন আমাদের দুজনের মৃত্যু সংবাদ। এই যে কি লিখেছে দেখ ‘গতকাল হাসিমপুর জেলে এক বিস্ফোরনে যাবজ্জীবন প্রাপ্ত দুজন আসামীর করুণ মুত্যু হয়...’ কুটুম ঘরের কথা কিছু লিখে নি। কিভাবে লিখবে ওটা ছিল একটা ইললিগ্যাল টর্চার রুম। যাক অফিসিয়ালী আমাদের মৃত্যু ঘোষনা হয়ে গেছে। আমরা এখন দুজন এঞ্জল! ... হা হা করে হাসলেন প্রফেসর। তারপরই গম্ভীর হয়ে গেলেন তিনি। গলা নামিয়ে বললেন। ‘মারুফ এখান থেকে আমাদের দুজনের পথ আলাদা হয়ে যাবে। তুমি তোমার পথে আমি আমার পথে... কিন্তু...’

-কিন্তু?
-কিন্তু তার আগে একটা ছোট্ট অপারেশন করলে কেমন হয়? জাস্ট ফর ফান
-কি অপারেশন?
-ঐ লোকটা কে দেখ, লোক বলা ঠিক হচ্ছে না তরুণই বলা যায়। লোকটার নাম সম্ভবত বরুণ । কারণ একটু আগে সে ফোনে বলছিল ‘আমি বরুণ তুই কই?’

মারুফ খেয়াল করল। তাদের থেকে বিশ গজ দুরের বেঞ্চে একটা লোক বসে আছে শক্ত করে ধরে আছে একটা ব্যাগ। লোকটাকে একটু অস্থির মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মাঝে মাধ্যে তাকাচ্ছে মারুফদের দিকে, খুবই সতর্ক ভঙ্গি।

-দেখলাম
-এই লোকটা মনে হচ্ছে আমাদের মতই বড় কোন অপরাধ করে পালাচ্ছে। তার সঙ্গে দুটো ব্যাগ, ছোট ব্যাগটা আকড়ে ধরে আছে। ঐ ব্যাগে নিশ্চয়ই মূল্যবান কিছু আছে। চল ওর সঙ্গে একটু ফান করি। আমি দেখতে চাই আমার ধারণা ঠিক আছে কিনা। এটাকে বলে এন্টিসিপেশন জেশ্চার।
-বেশ কি করতে হবে?
-আমরা উঠে গিয়ে দুজন লোকটার দু পাশে বসব। তারপর...

তাই করলেন তারা হটাৎ উঠে গিয়ে লোকটার দুপাশে শান্তভাবে বসলেন দুজন। লোকটা চমকে তাকাল দুজনের দিকে।

-আ-আপনারা?
-বরুণ কেমন আছ? প্রফেসর ভারী গলায় বললেন।
-কি কি বলছেন আ- আমি বরুণ না।
-বরুণ তোমার ঐ চামড়ার ব্যাগে কত টাকা আছে? লোকটা ফ্যাকাশে মুখে তাকাল। ঘন ঘন ঢোক গিলছে। ‘আমার মনে হয় তুমি তোমার প্রেমিকাকে নিয়ে পালিয়েছিলে বিয়ে করবে বলে তারপর তাকে ফেলে তার টাকা নিয়ে ভেগেছ তাই না? ’

বরুণ ঢোক গিলে মাথা নাড়ল।

-তাকে কোথায় ফেলে এসেছ?
-ক-কক্সবাজার
-বা বা বেশ রোমান্টিক জায়গায় ফেলে এসেছ মনে হচ্ছে। বরুণ নামের লোকটা হঠাৎ হাউ মাউ করে কেঁদে প্রফেসরের পা চেপে ধরল ‘স্যার ভুল হইছে মাফ করে দেন... লোভে পরে কাজডা করছি ।’

-মেয়েটাকে কোথা থেকে উঠায়ে এনেছ? প্রশ্নটা মারুফ করে
-স্যার কৈলাশপুর গ্রাম সাং লক্ষিপুর
-তুমি মেয়েটাকে ভালবাসতে?
-জি স্যার ছোট কাল থেকে
-ব্যাগে কত টাকা আছে?
-স্যার তিন লাখের মত...
-ছোট কালের ভালবাসা মাত্র তিন লাখের কাছে হেরে গেল?
-স্যার লোভে পরে এই কাজ করসি... স্যার মাফ করে দেন...
-মেয়েটার কাছে ফোন আছে?
-জি স্যার
-তুমি যখন পালায়া আসলা মেয়েটা ফোন করেছিল?
-জি স্যার করেছিল অনেকবার আমি ধরি নাই।
-এখন ওকে একটা ফোন দাও। বরুণ বাধ্য ছেলের মত ফোন দিল কয়েকবার। ওপাশে ফোন ধরল না।
-স্যার সাবিনা ফোন ধরে না।
-তার কাছে টাকা পয়সা কিছু আছে নাকি সব নিয়ে আসছ?
-সব নিয়ে আসছি
-বাহ দারুন প্রেমিক তুমি দেখছি। আচ্ছা ঠিক করে বলতো তুমি মেয়েটাকে কারো কাছে বিক্রি করে আসনিতো,,, ?
-স্যার...

সাবিনা বিছানায় উপুর হয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। রাত দুটার মত বাজে সে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ঠিক তখন দরজায় নক হল। নিশ্চয়ই বরুণ ফিরেছে। পাগলের মত ছুটে গিয়ে দরজা খুললো সাবিনা। দরজার বাইরে তিনটা অচেনা লোক দাড়িয়ে আছে। তারা তাকে ঠেলে ঢুকে গেল ঘরের ভিতর।

-বাহ বরুণতো ভাল জিনিষ রাইখা গেছে আমগো লাইগা!
-সুন্দরী চল
-আপনারা কারা?
-আমরা তোমার ভাসুর। বলে লম্বা লোকটা খ্যা খ্যা করে হাসল। তারপর এগিয়ে এসে সাবিনার নিতম্বে হাত দিয়ে কাছে টানল। ফিস ফিস করে বলল ‘বরুণ কি কাম বানায়া ফেলছে?’

-ওস্তাদ টাইম শর্ট, এখন এইসব বাদ দেন
-তোরা নিচে গিয়া গাড়ী স্টার্ট দে আমি ওরে নিয়া আসতাছি
-না ওস্তাদ এখন না চলেন। গাড়ী কিন্তু আরেক জায়গায় ট্রিপে যাইব
-ধুর মান্দারপোরা তোগে দিয়া হইব না।

সাবিনা একটা আর্তচিৎকার দিল। তাতে লোক তিনটার মুখের পেশীতে কোন পরিবর্তন আসল না। তারা তাকে ধরে টেনে হিচরে নিয়ে একটা ছয় সিলিন্ডারের জীপে টেনে  তুললো। লম্বা লোকটা তার কানের কাছে ফিস ফিস করল ‘ঐ মাইয়া একদম মুখ বন্ধ, টু শব্দ করলে মাথা ফুটা কইরা দিমু, তোর লাইগা অনেক ট্যাকা দিছি তোর ডার্লিং বরুণরে...!’ 

(চলবে)

একা এবং একা - পর্ব এক
একা এবং একা - পর্ব দুই
একা এবং একা - পর্ব তিন
একা এবং একা - পর্ব চার
একা এবং একা - পর্ব পাঁচ
একা এবং একা - পর্ব ছয়
একা এবং একা - পর্ব সাত
একা এবং একা - পর্ব আট
একা এবং একা পর্ব- নয়

একা এবং একা - পর্ব দশ
একা এবং একা - পর্ব এগারো
একা এবং একা - পর্ব বারো
একা এবং একা - পর্ব তের
একা এবং একা - পর্ব চৌদ্দ
একা এবং একা- পর্ব পনের)

 
লেখক: আহসান হাবীব
কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা
 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top