সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

বধির নিরবধি (পর্ব সাত) : আসিফ মেহ্‌দী


প্রকাশিত:
১২ অক্টোবর ২০২০ ২১:৪১

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০৬:৫৮

 

(দেশসেরা দুই ফান ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’ ও ‘রস+আলো’তে লেখার সুবাদে আসিফ মেহ্‌দী রম্যলেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন আগেই। ‘বেতাল রম্য’ নামের প্রথম বইয়েই তিনি লাভ করেন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। তারপর একে একে প্রকাশিত তাঁর প্রতিটি বইয়ে ব্যঙ্গ আর হাসির সঙ্গে গভীর জীবনবোধের প্রতিফলন ঘটিয়ে তিনি শুধু পাঠকপ্রিয়তাই লাভ করেননি, তাঁর বইগুলো উঠে এসেছে বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায়। সেগুলোর মধ্যে 'বধির নিরবধি', ‘মায়া’, ‘অপ্সরা’, ‘তরু-নৃ’ অন্যতম। এছাড়া এনটিভিতে প্রচারিত তাঁর লেখা নাটক ‘অ্যানালগ ভালোবাসা’-র বিষয়বস্তুর জীবনঘনিষ্ঠতা দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়েছে। ‘ন্যানো কাব্য’ নামে একটি বিশেষ কাব্যধারার প্রবর্তক আসিফ মেহ্‌দী কবিতা প্রেমীদের কাছে ন্যানো কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পঁচিশ।)

পর্ব সাত


হতদরিদ্র লোকটি মাটিতে উবু হয়ে পড়ে আছেন। মাথার খুলি ফেটে ঘিলু বের হয়ে গেছে। সারাশরীর রক্তাক্ত। টানাহেঁচড়ায় বিবস্ত্র দশা। পেইন্টিংয়ের নিচে লেখা, ‘গণধোলাই’। তাহমিদ ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছে। দেশখ্যাত চিত্রকর সৈয়দ সাজিদ হক-এর আঁকা এই ছবি যে ভালোগোত্রীয় কিছু হয়েছে, তা নয়। রক্তের রং বেশি লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, পিটুনির ফলে নিহত লোকটির রক্তে হিমোগ্লোবিন বেশিমাত্রায় ছিল। সাজিদ হক হয়তো ভুলে গেছেন, কোনো ক্ষেত্রেই অতিরঞ্জন ভালো না!

ছেলেবেলা থেকেই টুকটাক লেখালেখি করে তাহমিদ। বড় হতেহতে তা নেশায় পরিণত হয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য পেশা প্রয়োজন। স্বাধীনভাবে নিজের লেখালেখির কাজটা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো প্রাইভেট বা সরকারি চাকরিতে সে যুক্ত হওয়ার চেষ্টাই করেনি। প্রফেশনের প্রতি তার ফোকাস নেই; প্যাশনের প্রতিই যত আগ্রহ। লেখালেখির পাশাপাশি তার আরও দুটো প্যাশন আছে-নানা স্থানে ঘুরে বেড়ানো এবং ছবি তোলা। তাই সে খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী সাজিদ হকের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করে। এ কাজের সুযোগ হঠাৎ এসেছিল তাহমিদের জীবনে। এটিকে বেছে নেওয়ার পেছনে তার কিছু উদ্দেশ্য ছিল। সেগুলো পূরণ হচ্ছে ধীরেধীরে। যেমন-ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ ঘোরার সৌভাগ্য তার হয়েছে। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সাজিদ হক প্রকাশনীকে বলে দেওয়ায় বিশাল সুবিধা পাওয়া গেছে। প্রকাশনা নিয়ে আর কোনো চিন্তাই করতে হয়নি বলা চলে। ফটোগ্রাফির চর্চাও চালিয়ে যেতে পারছে তাহমিদ। সাজিদ হকের ব্যক্তিগত ফটো তাকে তুলতে হয় বলে সে ফটোগ্রাফি কোর্স করারও সুযোগ পেয়েছে। এছাড়া লেখালেখি বিষয়ক কর্মশালা, নানা চিত্রশালায় অংশ নিতে পারছে তাহমিদ। এতসব সুযোগ সাজিদ হকই করে দিচ্ছেন। 

নিজের প্যাশন চর্চার এসব সুযোগ পাওয়ার পরও তাহমিদ যখন আপন মনকে প্রশ্ন করে সন্তুষ্ট কিনা, তখন মন যেন অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে দেয়! তাহমিদের ধারণা ছিল, শিল্পীর ব্যক্তিগত সহকারী হলে সে তার শিল্পচর্চার মূল্যায়ন পাবে, অনেক কিছু শিখতে পারবে। আদতে ঘটেছে উল্টো। প্রতিনিয়ত সে হাড়েহাড়ে অনুভব করছে, কোনো ব্যক্তিবিশেষের চাকরি করা ভয়াবহ একটি ব্যাপার। চাকর হয়ে থাকতে হয় চব্বিশ ঘণ্টা! একজন মানুষের খায়েশ মেটাতে গিয়ে নিজের ইচ্ছাগুলো পায়েসের মতো গুলিয়ে যায়। এটি সত্য, এ চাকরি তাকে বেশ কিছু সুবর্ণ সুযোগ দিয়েছে। চিত্রশিল্পী সৈয়দ সাজিদ হক বিশ্বখ্যাত। সেকারণে তাহমিদের ভাগ্যে জুটেছে বিদেশভ্রমণ। এসব অভিজ্ঞতার ঝুলির টইটম্বুর অবস্থা; অথচ এ চাকরির জন্যই সাধনা করে লেখার মতো নিরবচ্ছিন্ন সময় তার পক্ষে ম্যানেজ করা সম্ভবই হচ্ছে না!

আজ তাহমিদের ছুটির দিন। ভেবেছিল লেখার কাজে হাত দেবে। যে-ই লিখতে বসেছে, তখনই তার ডাক পড়ল। ছুটে আসতে হলো সাজিদ হকের বাসায়। যে রুমটিতে সে অপেক্ষা করছে, সেটির দেয়ালজুড়ে সৈয়দ সাজিদ হকের আঁকা অনেকগুলো পেইন্টিং। বেশিভাগই নগ্ন নারীদেহ নিয়ে। বিষয়টি তাহমিদের মনে বরাবরই ভাবনার উদ্রেক করে-যৌনতা ছাড়া কি শিল্প হয় না? জীবনের তো আরও কতশত রং-রূপ-রস আছে। সবকিছু বাদ দিয়ে শিল্পীরা কেন যেন যৌনতাকে বেশি তুলে ধরেন! রুমে ঢোকার সময় চোখে পড়ে, দরজার ওপরে এ রুমের একটি নাম সাঁটা আছে-‘মৌনালয়’। ছবিগুলো দেখে তাহমিদের মনে হচ্ছে, কক্ষের নাম ‘যৌনালয়’ হলে ভালো হতো।

প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে তাহমিদ। সৈয়দ সাজিদ হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসা ভিআইপিগণের ওয়েটিং রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয় মৌনালয়। তাহমিদ অনুভব করতে পারছে, আজকে কোনো বিশেষ কারণে তাকে তলব করা হয়েছে। কারণটা তার জানা না থাকলেও সেই ‘কারণ’-এর কারণেই যে সে ভিআইপির মর্যাদা পাচ্ছে, এটি সহজে অনুমান করতে পারছে। অনুমান ও অভিমান-এ দুটোতে তাহমিদ বেশ দক্ষ। 

মৌনালয়ের এক কোনার একটি ছবি দেখে তাহমিদ হতবাক। ছবির নিচে লেখা, ‘অন্ন-বস্ত্রহীন মোনালিসা’! বিখ্যাত মোনালিসার ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে প্রচণ্ড পরিশ্রমের সঙ্গে। ছবিতে সেই শ্রমের ব্যাপারটি স্পষ্ট। শেষমেশ যা দাঁড়িয়েছে, সেটির প্রতি যারাই দৃষ্টি বাড়িয়েছে, তাদেরই শ্রদ্ধা হারিয়েছে এই ছবি। ভিআইপি কক্ষে বসেও তাহমিদের মধ্যে সুখানুভূতির বদলে ভর করেছে চুকানুভূতি, যেখানে চুকা অর্থ অস্বস্থিকর ও অসহ্যকর টক!

আড়ালে-আবডালে অন্য চাকরি খুঁজছে তাহমিদ। আরেকটি চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত এটি ছাড়া যাবে না। বেকার অবস্থায় সমাজ-সংসারে কোনো ‘আকার’ পাওয়া যায় না। কারণ, সমাজ-সংসারে আকার পেতে টাকার প্রয়োজন! তাছাড়া মানুষের একজোড়া অদৃশ্য পাখা আছে। মনের খিদে মেটানোর জন্য তাকে সেই পাখা ঝাপটে মাঝেমাঝে উড়তে হয়। টাকা না থাকলে উড্ডয়নের জন্য অত্যানুকূল মন-মেজাজাবস্থা তৈরি হয় না। গোপনে চাকরির চেষ্টা চালাচ্ছে তাহমিদ কিন্তু এখনো পছন্দসই চাকরি কপালে জুটেনি। জুটেছে খানিক অভিজ্ঞতা। সব চাকরিতেই সে সমস্যা খুঁজে পাচ্ছে-কোনোখানে বারোরকম মানুষ, আবার কোথাওবা চৌদ্দরকম পরিস্থিতি!

অপেক্ষার দেড় ঘণ্টা হয়ে গেছে। সাজিদ হকের খবর নেই। তাহমিদের মধ্যে যখন বিরক্তি বাসা বাঁধতে শুরু করেছে, তখন বাসার গৃহপরিচারক ছেলেটি ফ্রুট কেক ও চা দিয়ে গেল। চা খাওয়ার সময় হঠাৎ ছবিগুলোর একটি উপকারি দিক তাহমিদের মাথায় খেলে গেল। পেইন্টিংগুলো তার অন্তর্নিহিত কবিসত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলছে! তার মধ্যে নানা অদ্ভুত প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে! অনেকটা ‘প্রশ্নপুস্তক’ কাব্যগ্রন্থের মতো। নোবেলজয়ী কবি পাবলো নেরুদার শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘প্রশ্নপুস্তক’ শুধু প্রশ্ন দিয়েই ভরা। চুয়াত্তরটি কবিতার সিরিজে তিনশ ষোলোটি প্রশ্ন। যেমন-

‘আমায় বলো, গোলাপ কি নগ্ন?

নাকি ওইটাই তার একমাত্র পোশাক?’

‘এমন কিছু কি আছে দুনিয়ায়

দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা ট্রেনের চেয়ে যা বিষণ্নতর?’

‘যদি সব নদীর জল মিষ্টি হয়;

তবে সমুদ্র তার লবণ পায় কোথায়?’

মৌনালয়ের ছবিগুলো দেখে তাহমিদের ততটা ভালো না লাগলেও সেগুলো তার মনে এ ধরনের প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। হতে পারে, এটিই এই আঁকাআঁকির সার্থকতা! তাহমিদের মনে ‘প্রশ্ন’ জট পাকাচ্ছে-ছোট প্রশ্ন, মাঝারি প্রশ্ন, হরেক রকম প্রশ্ন!

এক.

ছেলেধরা সন্দেহে ‘অমানুষ’ তকমা সেঁটে

তাকে গণপিটুনিতে মারল যারা,

তাদের কি আমি মানুষ বলব?

দুই.

কিশোরী মেয়েটিকে যে পুরুষ ধর্ষণ করল,

সে তার পরিবারের নারীদের কোন চোখে দেখে?

তিন.

বাসড্রাইভারের এলোপাতাড়ি চালানোর জন্য,

আজ যে জীবন্ত প্রাণগুলো ছটফট করে মৃত হলো

তার কি কোনো বিচার হবে?

সাজিদ হক এলেন পাকা দুই ঘণ্টা পর। তাকে দেখে তাহমিদ দাঁড়াতে উদ্যত হলো। তিনি বললেন, ‘দাঁড়াতে হবে না, বোসো। একটা ছবিতে ডুবে ছিলাম। তাই একটু দেরি হয়ে গেল। আমি দুঃখিত।’ 

‘না, ঠিক আছে স্যার।’

‘শহরে শ্রাবণ চলে এসেছে। তাই তোমাকে ডাকা।’

তাহমিদ ঠিক বুঝতে পারছে না, কথা কোনদিকে এগোচ্ছে। জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে তাকে ডাকা হয়েছে। এখন নিশ্চয়ই বলা হবে না, শ্রাবণ চলে যাচ্ছে, লাঠিসোঁটা নিয়ে তাকে ঠেকাও! মিছিল-মিটিং-জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে শ্রাবণ ঠেকানো কর্মসূচি! শ্রাবণ গুনগুনিয়ে চলে যাবে, ভাদ্র ভনভনিয়ে চলে আসবে-এটিই প্রকৃতির নিয়ম। মানুষের নিয়ম মোকাবিলা করা যায়, প্রকৃতির নিয়ম মাথা পেতে নিতে হয়-কথাগুলো মনেমনে ভাবল তাহমিদ। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করায় নিজের মধ্যে সে কিছুটা অস্থিরতা বোধ করছে।

সাজিদ হক বললেন, ‘আমি প্রত্যেক শ্রাবণের একটি বিশেষ দিনে আমার কোনো একজন ভক্তকে নিজের আঁকা ছবি উপহার দিই। এটা আমার এক ধরনের শখ বলতে পারো। শখের দাম লাখ টাকা। সেই লাখ টাকার শখ পূরণ করি কয়েক টাকার ছবি দিয়ে! তুমি বিষয়টা এত বছর জানোনি, কারণ এতে তোমাকে ইনভলভ করিনি। এবার ভাবছি তোমার মাধ্যমেই আমার শখটা পূরণ হোক। কী বলো?’

‘জি, অবশ্যই।’ মনেমনে তাহমিদ খুব বিরক্ত।

‘তোমাকে দিয়েই চিটাগাংয়ের এক ভক্তকে ছবিটা দেব।’ এই কথায় আঁতকে উঠল তাহমিদ। মনেমনে আওড়াল, ‘বলে কী ব্যাটা! চট্টগ্রাম যেতে হবে এইসব নাঙ্গাপুঙ্গা ছবি বগলদাবা করে!’ মনে যা-ই বলুক, মুখে ‘না’ বলার উপায় নেই। সাজিদ হক জেদি মানুষ। হয়তো শিল্পী বলে বেশি আবেগের দোলাচালে থাকেন। ‘না’ শুনতে পারেন না একদম। তাছাড়া কখন তার মুডের সুয়িং কোনদিকে থাকে, বোঝা মুশকিল। 

সাজিদ হক বলে চললেন, ‘বর্ষাকালে পাহাড়-সমুদ্রের নগরে গেলে মন ফুরফুরে হয়ে যায়। আমার ব্যস্ততা না থাকলে আমি নিজেই যেতাম। কিন্তু আজ রাতেই রওনা দিতে হবে বলে পারছি না। কালকেই সেই বিশেষ তারিখ কিনা!’

দ্বিতীয়বারের মতো চমকে উঠল তাহমিদ। বলে কি এই ভামবুড়ো! ছুটির দিনে ঘুম থেকে তুলে এনে বলছে আজই তাকে চট্টগ্রামে যেতে হবে! তাও আবার বুড়োর অদ্ভুত এক ইচ্ছা পূরণ করতে! মনেমনে এমন চাকরির মৃত্যু কামনা করে তাহমিদ। চাকরির গলা টিপে ধরার কোনো সুযোগ থাকলে তাহমিদ হয়তো তাই-ই করত। ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হলেও মুখে কিছু বলার উপায় নেই। তাহমিদ চুপ রইল; তবে থেমে নেই সাজিদ হক। বললেন, ‘আমার এবারের ভক্তের বাসা চট্টগ্রামের হালিশহরে। এই কাগজে নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর লিখে দিয়েছি। আর এ ছবিটা তার জন্য।’

তাহমিদ এতক্ষণে খেয়াল করল, সুন্দরভাবে প্যাকেট করে একটি পেইন্টিং সঙ্গে নিয়ে এসেছেন সাজিদ হক। তার কাছ থেকে ছবির প্যাকেট এবং নাম-ঠিকানা লেখা চিরকুটটি নিল তাহমিদ। সাজিদ হক উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘তোমার ট্যুর আনন্দঘন ও স্মৃতিময় হোক, এই কামনা করছি। যাওয়ার আগে সাহিলের সঙ্গে একটু দেখা করে যেও।’

‘জি আচ্ছা।’

রুম থেকে চলে গেলেন সাজিদ হক। কাজের কথার বাইরে খুব বেশি কিছু বলার অভ্যাস তার নেই। সাজিদ হকের পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট সাহিল। তার টাকা-পয়সার হিসাব রাখেন এই ব্যক্তি। তাহমিদ সাহিলের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি দশ হাজার টাকা হাতে তুলে দিলেন। ‘হঠাৎ বৃষ্টি’র মতো এ যেন ‘হঠাৎ টাকার বৃষ্টি’! তবে সাহিলের মুখভঙ্গি ও চাহনি দেখে মনে হলো, লোকটা যেন নিজের টাকা দিচ্ছেন! তাহমিদ প্রথম থেকেই দেখে আসছে, সাহিল সুবিধার লোক না। প্যাঁচ সৃষ্টিকারী মানুষজনের সঙ্গে বেশিক্ষণ না থাকাই উত্তম। তা নাহলে কিছুক্ষণ পর নিজেকে আবিষ্কার করতে হয় কোনো অপ্রত্যাশিত প্যাঁচের মধ্যে। তাহমিদ টাকা হাতে পেয়ে আর কোনো কথা বাড়াল না। সাহিলের রুম থেকে সোজা বেরিয়ে এল। টাকা দেওয়ার কারণ সহজেই অনুমেয়। ভক্তের কাছে ছবি পৌঁছে দেওয়ার খরচবাবদ তাকে এই টাকা দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া সবই তো টাকার খেলা। সেই খেলার এবারের খেলোয়াড় তাহমিদ।

 

সকাল থেকেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। রিকশা নিয়ে ইনা যাচ্ছে কলাবাগানের দিকে। এখন পর্যন্ত দাদাজানের জ্ঞান ফিরেনি। অবস্থা খুব সংকটাপন্ন। ইনার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নানা চিন্তা। কী অদ্ভুত লীলাখেলা! পঞ্চাশ বছর আগের একটি কথার মর্যাদা দিতেই বুঝি এতটা বছর বেঁচে আছেন দাদাজান! কেমন ছিল সেই ক’টা দিনের গল্প-অন্যভুবনে, অন্য আলো-হাওয়ায়! কতটা বেদনা জড়িয়ে আছে দুটো আত্মার বিচ্ছেদের মুহূর্তটির মাঝে? এমন চিরঅতৃপ্ত আত্মাদের কথা স্মরণ করেই কি প্রকৃতি আজও অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে? রিকশাঅলা থেমে যাওয়ায় ইনার কল্পনায় ছেদ পড়ল। রিকশা থেমেছে বাসস্ট্যান্ডে।

বাসের টিকিট কিনতে ইনা এসেছে কলাবাগানে। তার কাছে আজকের দিনটি অন্যদিনের মতো না। পড়াশুনা ছাড়া কোনো কাজে বাইরে গেলে তার সঙ্গে কেউ না কেউ থাকে। কোনো বান্ধবী থাকে; নয়তো থাকে শোভন। দাদাজানের ব্যাপারটিতে শোভনকে জড়াতে চায় না ইনা। আজ রাতে বাসে চড়ে সে একাই চট্টগ্রামে যাবে। জীবনে প্রথমবারের মতো একাকী ঢাকার বাইরে যাবে। ছোটবেলায় ইনা তার বাবা-মায়ের সঙ্গে নানাজানের বাড়ি সিরাজগঞ্জে গেছে কয়েকবার। নানাজান ও নানুর মৃত্যুর পর সেই যাওয়াও বন্ধ হয়েছে প্রায় এক যুগ আগে।

ইনা এসি বাসের পাশাপাশি দুটো সিটের টিকিট কিনল। পাশের সিটে কে না কে বসবে-এসব চিন্তা করে শেষমেশ এই ব্যবস্থা নিল। স্বাধীনমতো আরামে যাতায়াত করে সে প্রথম একাকী বাসযাত্রাকে স্মরণীয় করে রাখতে চায়। এসবের মাঝেও বারবার দাদাজানের কথা মনে পড়ছে। মনেমনে ইনা প্রার্থনা করল, অত্যন্ত প্রিয় এই মানুষটি এবারের যাত্রায় যেন বেঁচে যায়। সুদীর্ঘ অপেক্ষার পর লক্ষ্যের এত কাছে পৌঁছানো তার দাদাজান যেন বিজয়ের ফিতা স্পর্শ করতে পারে। ইনার চোখ ছলছল করে উঠল।   

হাসপাতালে আছেন সুহান, দিলারা ও রনি। সকালে রুহান অফিসে চলে গেছে আর প্রীতি চলে এসেছে বাসায়। জরুরি কাজের কথা বলে ইনা দুপুরের আগে বেরিয়েছে। কাউকে বুঝতে দেয়নি যে দাদাজানের দেওয়া একটি রোমাঞ্চকর কাজ সম্পন্ন করতে ইনা বদ্ধপরিকর এবং এটিই তার বাইরে বেরোনোর মূল কারণ। বাসের টিকিট সংগ্রহ করে বাসায় ফিরল সে। ব্যাগ গুছিয়ে নিল। মাত্র একদিনের জন্য যাওয়া। তাই বেশি কিছু নিল না। অবশ্য রিটার্ন টিকিট কাটেনি ইনা। সবকিছু যদি হিসেবমতো না হয়, তাহলে আরও সময় থাকতে হতে পারে। ইনা ঠিক করেছে, চট্টগ্রামে যাওয়ার কথা একদম শেষ মুহূর্তে বাবা-মাকে জানাবে। আগে জানালে তারা বাধা দিতে পারেন, যা ইনার অপছন্দ। কারণ, বাধা আগ্রহ-উদ্দীপনাকে মুহূর্তেই আধা করে ফেলে। 

(চলবে)

আসিফ মেহ্‌দী
কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী

 

বধির নিরবধি (পর্ব এক)
বধির নিরবধি (পর্ব দুই)
বধির নিরবধি (পর্ব তিন)
বধির নিরবধি (পর্ব চার)
বধির নিরবধি (পর্ব পাঁচ)
বধির নিরবধি (পর্ব ছয়)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top