সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব সাত) : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:১২

আপডেট:
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৪০

 

ধুমায়িত পেয়ালার সামনে আমরা দুজন পাশাপাশি বসে। ওর কণ্ঠে অভিমানী সুর।

- শেষ পর্যন্ত তুমি এলে?

- হ্যাঁ, এলাম।

- আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আর আসবে না। মনে হয়েছিল তুমি রং-তুলি জগতের মানুষ হলেও আসলে তোমার হৃদয়ে রং নেই। তুমি হৃদয়হীন।

- এখনতো প্রমাণ হল আমি একেবারে হৃদয়হীন নই।

- নীল প্যান্ট, নীল শার্টের হে হৃদয়বান যুবক তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমার ঘরটা নীল উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেছে।

আমি হাসলাম। বললাম, আমি হলুদ প্যান্ট, হলুদ শার্ট আর হলুদ ক্যাপ পরে এলে আরো ভালো হত। তোমার ঘর বোধহয় রাত্রির হলুদ জোছনায় ভরে যেত।

জুলিয়াঁ খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, হ্যাঁ তা মন্দ হত না। দারুণ একটা রোমান্টিক চিত্রের আইডিয়া হতে পারত। ছবিটার ক্যাপশন দিতাম ‘হলুদ জোছনায় দুটি হলুদ পাখি’।

- আইডিয়াটা মাথায় থাকল। ছবিটা রিকশার পেছনে আঁকব।

- সত্যি বলছ তো?

- হ্যাঁ।

- দ্যাত্স গ্রেত। আচ্ছা এবার সত্যি করে বল, এতদিন আসোনি কেন?

- সময় পাইনি।

- আমাকে দেখার একটুও ইচ্ছে হয়নি?

আমি একটু দুষ্টুমি করেই বাংলায় বললাম, ‘চোখের আলোয় নাইবা দেখা হল তারে, যে আছে আমার মনের আলোর গভীরে।’

জুলিয়াঁ বিস্ময়ে বলে উঠল, ইউ আর স্পিকিং সামথিং ইন বেঙ্গলি! ত্রানসেত ইন ইংলিশ প্লিজ!

 

আমি অসহায় কণ্ঠে বললাম, মনের সব কথা অনুবাদ করে বলা যায় না। কবি রবার্ট ফ্রস্ট কী বলেছেন জানো না? পোয়েট্রি ইজ হোয়াট লস্ট ইন ট্রানসেশন, ইট ইজ অলসো হোয়াট লস্ট ইন ইন্টারপ্রেটেশন।

জুলিয়াঁ নাছোড়বান্দার মতো বলল, আই নো, আই নো। বাত ইউ উইল হ্যাভ তু তেল মি হোয়াত ইউ সেইদ?

আমি বিপাকে। তবুও ওর বিপুল কৌতূহল মেটাতে দুর্বল ইংরেজিতেই বললাম, দ্য অ্যাডোলেসেন্ট লেডি হু লিভস ইন দ্য এভরি থ্রব অব মাই হার্ট, ইট ম্যাটারস লিটিল ইফ আই মিস হার ইন দ্য লাইট অব মাই আইজ।

জুলিয়াঁ ভীষণ খুশি খুশি কণ্ঠে বলল, রিয়েলি! ইজ ইত ত্রু হোয়াত ইউ সেইদ? ও কে, আই আন্দারস্তান্দ হোয়াত ইউ সেইদ। মে বি ইত্স ইয়োর ফানি লাই। বাত আই দোনত মাইন্দ।

আমি আমার হাতের গিফট প্যাকেটটি ওর হাতে তুলে দিয়ে বললাম, এটা তোমার জন্যে, ছোট্ট সামান্য উপহার।

জুলিয়াঁ অসীম কৌতুহলে তক্ষুণি গিফট প্যাকেটটি খুলে নকশি কাঁথাটা দেখল। চোখে তার বিপুল বিস্ময়, আর মুগ্ধতা। উচ্ছ্বসিত আনন্দে চিৎকার করে বলল, ওহ কী অপূর্ব! কী সুন্দর! কাঁথার পরতে পরতে তোমাদের গ্রাম-বাংলার মানুষের জীবনের দৃশ্যপট! কে এমন সুন্দর সূচিকর্ম করেছে?

- আমাদের গ্রামের মেয়েরা, গৃহবধূরা।

- এমন সুন্দর ডিজাইন ওদের কে করে দেয়?

- করে ওদের মন। পুরোনো দু’তিনটি শাড়ি পরতে পরতে জোড়া দিয়ে ওরা নিজেদের ভাবনা-চিন্তায়, কাঁথার ওপর নকশা তোলে, বিভিন্ন রং এর সুতোয় চিত্র ভাবনা ফুটিয়ে তোলে।

- এক্সসেলেন্তে! এক্সসেলেন্তে! কাঁথা নয় একটা ভালোবাসার গাথা।

বলতে বলতে জুলিয়াঁ চাদরের মতো করে কাঁথাটা নিজের গায়ে জড়াল। নিজেকে দেয়াল আয়নায় মুগ্ধ চোখে দেখল। তারপর আমার হাত ধরে টেনে ওঠাল। বলল, লুক। দ্যাখো আমাকে। হাউ বিউতিফুল দু আই লুক। তারপর আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি কিছু বুঝে উঠবার আগেই আমার ঠোঁটে ওর দুটো ঠোঁট গাঢ় চুম্বন যেন চুম্বকের মতো আটকে রাখল। আমার নিঃশ্বাস প্রাণ, বন্ধ হয়ে আসল ওর উষ্ণ নিঃশ্বাসের তাপে। আমি পুড়ে যাবার আগেই আস্তে আস্তে নিজেকে বন্ধনমুক্ত করলাম ওর আগ্রাসী আলিঙ্গন আর চুম্বনের চুম্বক থেকে। সোফায় বসে পড়লাম ওকে আর দ্বিতীয়বার এই সুযোগ না দিতে।

জুলিয়াঁ গাঢ় কণ্ঠে বলল, প্যারিতে প্রতিরাতে আমার এই কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুম যেতে যেতে তোমার কথাই ভাবব।

তারপর উচ্ছ্বসিত নর্তকীর মতো ও নাচতে থাকল নকশি কাঁথাটা মাথার ওপরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উড়িয়ে। ফ্রেন্স ভাষায় গাইতে থাকল,

        ‘প্য মাঁপরত, সি ভু মেমে উভূম্য দেতে সতে জ ভূজ এম।’

আমি বুঝতে পারলাম ও গাইছে, ‘তুমি আমাকে ভালোবাসো অথবা ঘৃণা কর তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি তোমাকে ভালোবাসবই।’

ও আবার গাইল, ‘কোয়া ক্য ভু ফসীয়ে জ ভূজ এমেরে তু জুর।’

অর্থাৎ-‘যা-ই ঘটুকনা কেন আমি তোমাকে সব সময় ভালোবাসব।’

আমি সোফাটাতে বসে ঠা-া কফিতে চুমুক দিতে দিতে ওর নৃত্য-গীত, কাঁথা গাথা শুনতে লাগলাম।

জুলিয়াঁকে শেষ বিদায় জানিয়ে আমি এখন আমার রিকশায় আরমানিটোলার পথে। রিকশা চালাচ্ছি আগের মতো দুরন্ত গতিতে নয় খুব শ্লথ গতিতে। মনটা উদাস বা অবসন্ন হলে যা হয়।

জুলিয়াঁ আমার রিকশায় শেষবারের মতো বেড়াতে চেয়েছিল। আমি বলেছি, না জুলিয়াঁ, আমার দেহ মন আজ তুমি অন্যরকম করে দিয়েছ। আমি এখন রিকশা চালিয়ে আনন্দ পাব না।

জুলিয়াঁ আবার আমাকে কফি পানে সেধেছিল। কিন্তু আমি পান করিনি। বলেছি, তোমার চুম্বনের স্বাদ আমার ঠোঁটে। কফি পান করে সেই স্বাদ আমি মুছে ফেলতে চাই না।

ও আমার কাছে বিদায় চুম্বন আশা করেছিল। আমি ওর হাত আর কপালে চুমু দিয়ে বলেছিলাম, বিদায় চুম্বন নয়। প্রথম চুম্বনের স্বাদে আর স্মৃতিতে আমাকে ভরে থাকতে দাও।

আজ বিকেল আর সন্ধ্যায় আমার জীবনে দু’দুটো অভাবিত ঘটনা ঘটে গেল দু’টি মেয়েকে নিয়ে তাদের একজন শ্যামশ্রী আর একজন জুলিয়াঁ। কেন জানি না এখন জুলিয়াঁ নয়- শ্যামশ্রী নামের ঐ শ্যামলা মেয়েটির কথা মনে পড়তে লাগল। তাকে কী বলা যায়? সে কি বনলতা সেন ‘মুখ তার শ্রাবস্তির কারুকার্য’? নাকি সে ওমর আলীর সেই কবিতার মতো।

        “.... আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;

        সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে,

        রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা।

        সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে হরিণীর মতো

        মায়াবী উজ্জ¦ল দু’টি চোখে, তার সমস্ত শরীরে

        এ দেশেরই কোনো এক নদীর জোয়ার বাঁধ-ভাঙা;

        হালকা লতার মতো শাড়ি তার দেহ থাকে ঘিরে।”

জুলিয়াঁ চলে গেছে প্রায় সপ্তাহ খানেক আগে। কিন্তু একটা স্মৃতির পালক ফেলে গেছে সেই গানের কথার মতো

        ‘উইড়া যায়রে হংসপঙ্খী পইড়া রয়রে ছায়া

        দ্যাশের মানুষ দ্যাশে যাইব কে করিব মায়া।’

জুলিয়াঁর সঙ্গে আমার ক’দিনেরই বা পরিচয়? ঢাকায় তার একমাস অবস্থান কালে তার সাথে আমার দেখা সর্বসাকুল্যে মাত্র তিনদিনের। মাত্র তিনদিনের মধ্যেই কি কাউকে চেনা যায়? বোঝা যায়? ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়? জুলিয়াঁ বিদেশিনী। সোনালি চুলের রূপবতী নারী। তাকে দেখে কেউ মুগ্ধ হওয়া স্বাভাবিক। আমিও মুগ্ধ হয়েছিলাম একথা অস্বীকার করব না। কিন্তু সে আমাকে প্রথম দর্শনেই ভালোবাসবে এবং আমিও তার ভালোবাসার জন্যে পাগল হয়ে যাব এটা কখনোই ভাবিনি। কিন্তু বিদায়ের শেষ দিনে সে এক অলৌকিক পরীর মতো তার উজ্জ¦ল ডানা ঝাপটে আমাকে আলিঙ্গনে, চুম্বনে বিবশ করে ফেলেছিল। আমাকে ঘিরে বারবার উদ্দাম নৃত্য আর গান-‘প্য মাঁপরত সি ভু মেমে উ ভু ম্য দেতে সতে জ ভূজএম তুমি আমাকে ভালোবাসো অথবা ঘৃণা কর তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি তোমাকে ভালোবাসবই।

জুলিয়াঁর চলে যাওয়াতে আমি অবশ্য বিচ্ছেদের অনলে পুড়ছি না। তবে মনে কিছুটা অস্থিরতা। আসলে একুশের বয়সটাই একটা ভীষণ  উত্তেজনা, আবেগ আর অস্থিরতার বয়স। ইচ্ছে করে শুধু ভালোবাসতে, ভালোবাসা পেতে ভালোবাসা দিতে। মনে হয়, কোনো নারীর ভালোবাসা না পেলে এ জীবন অর্থহীন, বৃথা, কন্টকময়।

আমি অবশ্য জীবনের কঠিন বাস্তবতায় আবেগ, ভালোবাসা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি, উত্তেজিত হইনি। কিন্তু এখন আমার মনে একটু সাময়িক অস্থিরতা। এই অস্থিরতা প্রশমিত করতেই আমি আমার রিকশা নিয়ে এক সকালে উপস্থিত হলাম খলিল চাচার রিকশা পেইন্টিং এর আস্তানায়।

হঠাৎ করেই আমার এই অনির্ধারিত আসায় খলিল চাচা অবাক। বললেন, কি ভাতিজা, এই সাত ছক্কালে রিকশা লইয়া হাজির! কিছু কাম করবা নি?

বললাম, হ্যাঁ চাচা, আমার নিজের কাম। আপনার দেয়া রিকশাটার পেছনটা অনেকদিন ধরে খালি পড়ে আছে। কিছু একটা এঁকে ঐ খালি জায়গাটা ভরতে চাই। এখন আপনি অনুমতি দিলে...

বাধা না দিয়ে খলিল চাচা বলে উঠলেন, অয় ভাতিজা, তুমি আঁকবা তার লেগ্যা আমার পারমিছন লাগবো ক্যান? আঁকো, আঁকো। ছারাদিন তুমার খুঁছিমতোন আঁকো।

আমি রং, তুলি নিয়ে অনেকক্ষণ রিকশার পেছনে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবছি কার ছবি আঁকব? কোন রূপবতী নারীর সুন্দর হাসিমুখ দিয়ে রিকশার এই শূন্যস্থান পূর্ণ করব? সিদ্ধান্ত নিলাম জুলিয়াঁর মুখ। আমার নিজের রিকশার পেছনে ঐ বিদেশিনী হবে রম্ভা কিংবা উর্বশী যে ছবি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না, আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না।

জুলিয়াঁর মুখটা যতবার মনে করি, তুলির আঁচড় টানি কিন্তু কী আশ্চর্য! জুলিয়াঁর মুখের অন্তরাল থেকে উঁকি দিয়ে হেসে ওঠে ওমর আলীর সেই কবিতার মুখকচি কলাপাতা শাড়িপরা শ্যামলরঙা সেই মেয়েটির মুখযে বলেছিল আমি শ্যামশ্রী।

 

দিনভর একটা গভীর আচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে আমি যার ছবি আঁকলাম সে জুলিয়াঁ নয়সে মুখ শ্যামশ্রী’র।

খলিল চাচা এই পরিচিতি মুখ দেখে অবাক হলেন। বললেন, এ যে এক্কেবারে নয়া মুখ দেখতাছি! কোন ফিলিমের নায়িকা? নাম কী?

আমি হাসলাম। বললাম, চাচা এই মেয়ে কোনো ফিল্মের নায়িকা নয়। ওকে আমি একদিনই দেখেছি পথে।

খলিল চাচা আরো বিস্মিত কণ্ঠে বলল, মাত্তর একদিন দেইখাই আঁইকা ফেলাইলা! তামছা কর আমার লগে! নিশ্চয় তুমার লগে ওর জান পহচান হইছে?

আমি প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বললাম, না চাচা না। মাত্র একদিনই দেখেছি পথে। পথের দেখা পথেই শেষ।

খলিল চাচাকে কিছু সত্য গোপন করেছি। মেয়েটি তার নাম ঠিকানা বলেছিল। কিন্তু নাম, ঠিকানা বললেই তো তার কাছে হুট করে যাওয়া যায় না। তার সাথে দেখা হওয়াটা এখন একটা ভাগ্যের ব্যাপার। আর তার সাথে দেখা হলেই যে আমার ভালোবাসাবাসি হবে তা ভাবাটাই তো হাস্যকর। আর আমি যদি জুলিয়াঁর সাহায্য-সহযোগিতায় প্যারিসে চলে যাই তাহলে এই শ্যামল রঙা শ্যামশ্রী এই রিকশার পেছনে একটা স্মৃতি-ছবি হয়েই থাকবে। প্যারিসে জুলিয়াঁকে এড়িয়ে যাওয়া হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। সে তো আমাকে তার গানেই শুনিয়েছে-

        ‘কোয়া ক্য ভু ফসীয়ে জ ভূজএমেরে তু জুর’

        যাই ঘটুক না কেন আমি তোমাকে সব সময় ভালোবাসব।

বিকেল বেলায় বাসায় ফিরে এলাম শ্যামশ্রীকে নিয়ে অর্থাৎ আমার ত্রিচক্র বাহনে সওয়ার হয়ে। বাইরের শিউলি গাছটার কা-ের সাথে তাকে শেকলবন্দি করে শ্যামশ্রীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বললাম, আপাতত বন্দি হয়ে থাকো হে মেয়ে আমার হৃদয়ে তারপর তোমাকে খুঁজব তোমাকে এই এক কোটি মানুষের ঢাকার শহরে।

আমার পেছনে হঠাৎ ছোটনের কণ্ঠস্বর, বড়দা, ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে ফিস ফিস করে কী বলছ?

চমকে পিছন ফিরে ওর দিকে তাকালাম। ওর চোখে কৌতুহলী দৃষ্টি। মুখে মৃদু হাসি।

আমি বিব্রতভাবে বললাম, না কিছু না রে। আজইতো আঁকলাম। রংটা এখনো কাঁচা।

ছোটনের মুখে দুষ্টুমির হাসি। বলল, রংটা পাকা হবে কতদিনে?

কাল সকালের মধ্যেই। রং এ স্টিকি টাইপের একটা কেমিকেল ব্যবহার করেছি। তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে।

ঘরের দরজা খুলে নাজু ছুটে এল হরিণীর মতো লাফাতে লাফাতে। রিকশার পিছনে ছবিটা দেখেই ও যেন একটু থমকে গেল। এ কোন মেয়ের ছবির সাথে বড়দার ছবি? ওর চোখে যেন এক আশ্চর্যের পদ্মকুঁড়ি ফুটে উঠল। এ কার মুখ! এ কোনো ফিল্মের নায়িকা নয়। সুচিত্রা, কবরী নয় এতো এক অচেনা মেয়ে! ও বড়দা, তোর সঙ্গে এ তুই কার ছবি এঁকেছিস? বলতে বলতে সে মা’র উদ্দেশে চিৎকার করে ডাকল, মা, মা শিগগির বাইরে আসো। দ্যাখো বড়দা আজ তার নিজের রিকশার পেছনে কার ছবি এঁকেছে?

আমি পড়লাম মহাবিপদে। হঠাৎ দেখা শ্যামশ্রীর ছবি এঁকে এমন মুশকিলে পড়ব তা আগে ভাবিনি। শুধু যদি শ্যামশ্রীর ছবিটা থাকত তাহলে এমন বিপদ আর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হত না। কিন্তু শ্যামশ্রীর সঙ্গে তো রোমান্টিক ভঙ্গিতে উত্তম কুমারের আদলে আমার ছবিও সেটাই বিপদ।

মা এলেন বাইরে। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন আমার সদ্য আঁকা ছবিটা। তারপর বললেন, বাইরে এভাবে হৈ চৈ না করে সবাই ঘরের ভেতরে এসো।

মায়ের নির্দেশ মতো আমরা সবাই বাড়ির ভেতরের বারান্দায়। মা’র চোখে তীক্ষ্ম প্রশ্ন,

- তোর সঙ্গে ঐ মেয়েটি কে?

আমি অসহায়ভাবে মাথা নাড়লাম। অর্থাৎ জানি না।

মা ধমকে উঠলেন, মিথ্যে বলবি না। বল ও কে?

- বললাম তো আমি জানি না।

- তুই জানিস না তো কে জানে?

আমি নিরীহ কণ্ঠে বললাম, নাজু জানে।

নাজুর চোখ বিস্ফারিত। চিৎকার করে বলল, আমি! আমি জানি! এ কী বলছিস তুই?

- হ্যাঁ সত্যি বলছি ঐ মেয়েটা নাজুদের স্কুলের হেড মিসট্রেস।

নাজু যেন আকাশ থেকে পড়ল। আবার চিৎকার করে ঊঠল, মা, বড়দা একটা আস্ত মিথ্যুক। আমাদের স্কুলের হেড মিস্ট্রেস সরলা দেবী ইয়া মোটা, চোখ দুটো ভাটার আগুন, গলায় বাঘের গর্জন। বয়স পঞ্চাশ।

মা ধমকে উঠলেন, থাম তুই। মিসট্রেসের নামে এত বদনাম করতে নেই। তারপর আমাকে বললেন, তিমু তুই এতকাল ধরে ছবি আঁকছিস, কতশত নায়ক-নায়িকাদের ছবি আঁকছিস তা নিয়ে কোনো কোনোদিন কোনো প্রশ্ন করিনি। দুষ্টুমি না করে সত্যি করে বল, এই মেয়েটা কে?

(চলবে)

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব তিন)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পাঁচ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ছয়)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা





আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top