সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
১৪ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৪৯

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০২:১৩

ছবিঃ অমর মিত্র

 

রাজমহিষী ভানুমতীর প্রসাধন সম্পূর্ণ হলো প্রায়। বুড়ি দাসী নিপুণিকা তাঁকে পর্যবেক্ষণ করছে।

যদি কোথাও খুঁত থেকে যায়। রাজমহিষী দাঁড়িয়েছেন। দর্পণের সামনে। আজ শুক্লা চতুর্দশী। আজ কেন এই অভিসারিকার সাজ তা নিপুণিকার মাথায় ঢোকে না। আগামীকাল অঘ্রানের পূর্ণিমা। রাজা ভর্তৃহরি মহাকাল যাবেন এমন একটি কথা শোনা যাচ্ছে। এই রাজ অন্তঃপুরে অবশ্য যা শোনা যায় তা সত্য হয় না। আবার যা সত্য হয় তা শোনা যায় না। সত্য যা তা উচ্চারণে নানা বিপদ আছে। দাসী নিপুণিকা জানে চোখ বুঁজে থাকাই সবচেয়ে ভাল।  

রানী ভানুমতীকে দর্পণ দেখছে। দর্পণে তাঁর আয়ত চক্ষুর প্রতিবিম্ব। সেই চক্ষুতে মুকুলাভাব। এই ভাবটির কথা নিপুণিকা জেনেছিল রসমঞ্জরীর কাছে। চোখের পাতা অল্প অল্প কাঁপছে, দৃষ্টিতে অনুজ্জ্বলতা, কিন্তু এক গভীর আবেশ চারিয়ে গেছে। সুখে  আবিষ্টভাবে ফুটে উঠছে এখন ভানুমতীর ভিতর। নিপুণিকা শুধু দুটি চোখই দেখছে। সেই চোখে কখনো ললিতা ভাব, মধুর প্রসন্নতা, কখনো বিভ্রান্তির ভাব, প্রসারি দৃষ্টি। কখনো অর্ধমুকুলা, ঈষৎ সঞ্চরণশীল চোখের মণি, চন্দনের গন্ধ, কল্পনায় সুখদ অনুভবে বিহ্বল হচ্ছেন রানী। এই একটু আগে উন্মুক্ত স্তন চন্দনচূর্ণে আবৃত করতে করতে রানীর চোখে যে ভাব জেগে উঠেছিল তা যেন মদিরাচ্ছন্ন হলেই দেখা যায়। দু চোখের পাতা ভারী হয়ে চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছিল, চোখের মণি প্রায় আড়াল হয়ে গিয়েছিল। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দাসী নিপুণিকা দেখেছিল ভানুমতীর স্তনযুগল দৃঢ় হয়ে উঠেছে কামনায়। ভয়ও পেয়েছিল সে। রাজমহিষী কি আত্মরতিতে মগ্ন হলেন মনে মনে? হায় অবন্তীলক্ষ্মী!

এই অন্তঃপুরে নিপুণিকার বাস অনেকদিনের। আছে সে রাজা গন্ধর্বসেনের সময় থেকে। সে প্রসাধন নিপুণা।  প্রসাধনের সমস্ত কৌশল সে জানে। অসুন্দর কে সুন্দর করে তোলায় তার সিদ্ধি। সে এও জানে অসুন্দরকে সুন্দর করে তোলার চেয়ে সুন্দরকে আরো সুন্দর করে সাজানো কঠিন। সে দেখেছে সুন্দরী নারী সাজসজ্জায় যেন অসুন্দরই হয়ে পড়ে। রানী ভানুমতীর রূপের কাছে সমস্ত  প্রসাধন সামগ্রী, রত্নালংকার মিথ্যা হয়ে যায়। দাসী নিপুণিকার এই শিক্ষা গণিকা রসমঞ্জরীর কাছে। রসমঞ্জরী বলত যে সাজাবে নিজেকে সে যদি মনে এই ভাব আনে যে ঈশ্বরের জন্যই তার এই সাজসজ্জা, তার রূপ তবে বিকশিত হবে।  এই কথা আজ এই একটু আগে অবন্তীলক্ষ্মীকে স্মরণ করাতে খিলখিল করে হেসে উঠেছিলেন ভানুমতী, এসব কী কথা, ভগবান কি কখনো বলবেন আমি কত সুন্দর! আমি সাজছি যার জন্য সে’ই আমাকে দেখবে।

এসব কথা বলোনা মা, মহাকাল আছেন।

দু’হাত জোড় করে মহাকালকে স্মরণ করে ভানুমতী বলেছেন, থাকুন মহাকালেশ্বর, তাঁকে প্রমাণ করি, কিন্তু আমার রূপ তাঁরই জন্য যাঁর কথা আমি ভাবি।

কী খেয়াল হয়েছে আজ আবন্তীলক্ষ্মীর, যিনি সাজসজ্জা ত্যাগ করেছেন প্রায়, আজ সাজতে বসেছেন। দুপুর থেকে একটু একটু করে নিপুণিকা যেন নির্মাণ করেছে এই সৌন্দর্যলক্ষ্মীকে। কবরী সাজিয়েছে, কণ্ঠহার, সুবর্ণবলয়, কানপাশা, চন্দ্রহার, বাজুবন্ধে সাজিয়েছে অবন্তীর রানীকে। পদযুগল অলক্তরাগে রাঙিয়েছে। চন্দনচূর্ণে রাজমহিষীর গাত্রবর্ণে সোনার আভা ফুটিয়েছে। রাজমহিষীর বয়স হয়েছে। সেই চতুর্দশী কন্যাটি এখন আরো চতুর্দশ বৎসর অতিক্রম করতে যাচ্ছে এই অবন্তীদেশে। সেই স্নিগ্ধ পূর্ণিমার রূপটি এখন যেন সর্বগ্রাসী  হয়ে উঠেছে। বুড়ি দাসী নিপুণিকা কতটা সময় ধরে ভানুমতীর শরীরের উত্তাপ টের পেয়েছে। অথচ এই বয়সে তো শরীরকে শীতল করতে হয়। শীতল হয়েও আসে দেহটি। অবন্তীর রানী অবন্তী দেশের গৃহলক্ষ্মী, সর্বাঙ্গে এত আগুন বয়ে বাঁচবেন কী করে তিনি?

নিপুণিকা টের পেয়েছে  অঘ্রানের এই শীতল প্রকৃতিতে চন্দন প্রলেপেও স্নিগ্ধ হয়নি  রানীর বরতনু। দাসী দেখেছে  ভানুমতীর বক্ষবাস বিদীর্ণ করে স্তনযুগল বিস্ফোরিত হয়ে যাবে যেন। মনের চিহ্ন তো শরীরে ফোটে। ক্ষণে ক্ষণে অবন্তীলক্ষ্মীর প্রীতিময় ললিতা দৃষ্টি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। আঁখিপল্লব, আঁখিতারা থেকে মুছে যাচ্ছে স্নিগ্ধতা। আচমকা আঁখি তারা ঘূর্ণমান, দ্রুতসঞ্চরণশীল হয়ে যাচ্ছে, আঁখি পল্লব ঊর্ধ্বমুখী। এ ভাবের সঙ্গে অপরিচিত তো নয় বুড়ি দাসী। বারংবার রানীর মনে কী জেগে উঠছে কে জানে? কী কল্পনা করছেন তিনি তা তাঁরই জানা। বুড়ি দাসীর ভাবতেও ভয় লাগে। চোখ বুঁজে থাকলেই নিশ্চন্ত হওয়া যায়।

ভানুমতী ঘুরে দাঁড়ালেন দাসীর দিকে, সাময়িক বিভ্রান্তি কেটেছে তাঁর, মুখে ফুটে উঠছে প্রসন্ন হাসি, ঠিক আছে তো?

নিপুণিকা তাকিয়ে আছে রানীর দিকে। তার দৃষ্টি মেখলার নীবিবন্ধনে, নাভিদেশে। সে অস্ফুটস্বরে বলল, শীত করছে না মা তোমার?

কোথায় শীত, এবার বৃষ্টি হয়নি, শীতও হবে না।

উত্তরের বাতাস শুরু হয়েছে, মহাকাল যদি যাও মাথা ঢেকে পশমবস্ত্র গায়ে দিয়ো।

শীতও নেই! বিড়বিড় করলেন ভানুমতী।

বুড়ি দাসী বিহ্বল চোখে রানীর দিকে তাকিয়ে আছে। কী রূপ অবন্তীলক্ষ্মীর, রূপ যেন আরো গভীর হচ্ছে দিনে দিনে, হেসে বলল নিপুণিকা, তুমি যেন আরো সুন্দর হয়েছ মা।

ভানুমতীর দু চোখে ঘোর এল এই কথায়। চাহনি তির্যক হলো। বাঁকা হাসি ফুটল তাঁর মুখে, বললেন, সে কি তোর হাতের গুণ, না আমার?

দাসী নিপুণিকা সাহস করে বলল, তোমার স্বামী, অবন্তীর রাজার হাতের গুণ মা।

থাম দাসী থাম, তুই অধিকার ছাড়িয়ে যাচ্ছিস।

মুখখানি ম্লান হয়ে গেল নিপুণিকার। কী যে হয়েছে রাজ অন্তঃপুরে খেই ধরতে পারে না সে। সে যে কথাটা বলেছে সেই কথাটা তো বলতে হয়। রসমঞ্জরী তো সেইরকমই শিখিয়ে দিয়েছিল। পতি প্রশংসা কোন নারী না শুনতে চায়।

রাজরানী দর্পণের সামনে নিজেকে যেন নানা কোণ থেকে বিকশিত করে তুলছেন। দর্পণের সামনে নিজেকে মেলে ধরেছেন বারবার। ঘুরে কী মনে হলো, বললেন, দর্পণ যদি না থাকত, কী করত মানুষ?

বুড়ি দাসী জবাব দেয় না। কথা না বলে চুপ করে থাকাই তো বুদ্ধিমতীর কাজ। ভানুমতি দিন দিন খেয়ালী হয়ে পড়েছেন, উদাসীন। কখন কিসে ক্ষুব্ধ হন রানী তা বোঝাই দায়।

ভানুমতী দুটি হাতের নানা বিভঙ্গে নৃত্যের মুদ্রা ফোটাতে ফোটাতে বললেন, দর্পণই আমার পুরুষ, পুরুষ মনে হয় না দর্পণকে? কীভাবে গ্রাস করে নেয়।

দাসী নিপুণিকা কিছুই বোঝে না। সে রাণীর লীলায়িত ভঙ্গি দেখছিল। দর্পণের সামনে শরীর ও গ্রীবা আন্দোলিত করছেন, পদ যুগলের নানা বিন্যাসে দেহে ফুটে উঠছে মধুর ভঙ্গিমা, বিড়বিড় করলেন রানী, দর্পণের জন্যই আমার সাজ, নিজেকে নিজে দেখি আমি।

নিপুণিকা বলল, আমি এবার যাব?

না, যাবি কেন? ঘুরে দাঁড়ালেন ভানুমতী, বসে পড়েছেন আসনে। কী যেন ভাবছেন, তারপর আচমকা বললেন, এবার সাজ খুলে দে।

কেন? চমকে উঠল দাসী।

স্বর্ণতিলক খুলে দে। মাথায় হাত দিলেন ভানুমতী।

দাসী অবাক হয়ে অবন্তীর রানীর দিকে তাকিয়ে। রানী বলছেন, সাজ তো হলো, কিন্তু কেন হলো, তার চেয়ে বরং... হ্যাঁ’রে নিপুণিকে কেন সেজেছি আমি?

জানে না নিপুণিকা। রানীতো সেজেই থাকবেন। সন্ধ্যায় রাজা আসবেন এই অন্তঃপুরে। তিনি কি সাজসজ্জাহীন রাজমহিষীকে দেখবেন? রানী দুলছেন অনুচ্চ এক আসনে বসে। হাতের আঙুলে নানা মুদ্রা রচনা করে চোখের সামনে মেলে ধরছেন। এর কয়েকটি চেনে দাসী। কাম-রতি আকাঙ্ক্ষার মুদ্রা তৈরি করছেন রানী দু হাতে দশ আঙুলের মুদ্রায়। নেত্র, ভ্রূ, নাসা, অধরে ফুটে উঠছে আকাঙ্ক্ষা। দাসীবুড়ি তো অনেক  চেনে ভানুমতীকে। কিন্তু আগে যতটা তল পেত রানীর মনের এখন তা পায় না। আশ্চর্য। বিবাহের পর কনখল থেকে অবন্তীতে আসা সেই সদ্য যুবতীর ছায়া হয়ে থেকেও তাকে সাজাতে বসতে হয়নি কখনো। রতিবিলাসী সেই রাজবধূর শরীর স্পর্শ করতে হতো না। কনখল রাজপুত্রী তাকে দাঁড় করিয়ে নিজে সাজত। আবার কখনো স্বামীকে দিয়ে নিজেকে সাজাত। কী উৎসাহ ছিল তখন। সমস্ত দিনই যেত প্রসাধেন। এই অন্তঃপুর হয়ে থাকত চন্দনগন্ধময়। এত বছরে সব বদলে গেছে। আলস্য হয়েছে সন্তানহীনা রানীর সঙ্গী। খেয়ালি রানী কখন কী করবেন তার জন্য ত্রস্ত থাকতে হয় দাসীকে।

ভানুমতী বললেন, দাসী আজ আমার সাজ কেন?

দাসী নিপুণিকা চুপ করে থাকে, বিড়বিড় করে কয়েকদণ্ড পরে, মহাকাল তো আগামীকাল যাওয়ার কথা। 

ভানুমতী বললেন, মহাকাল আমায় বঞ্চনা করেছেন শুধু।

বুড়িদাসীর জোড় হাত কপালে উঠল, তা কেন মা, তুমি যে রাজপুত্রী, রাজরানী তা তো মহাকলের ইচ্ছায়, তুমি পতিভোগ্যা, অবন্তীরাজের চোখের মণি, মহাকাল তোমাকে কত দিয়েছেন?

ভানুমতী দু হাত তুলে স্বর্ণতিলক মুক্ত করেন কপালকে। ঘুরে তাকান দর্পণে, বিড়বিড় করেন, সব  দিয়েছেন মহাকাল, আবার কিছুই দেননি, আমি তো নিঃস্ব নিপুণিকে।

বুড়ির চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন হলো। সন্তানের কথা বলছেন রানী। সন্তানহীনা কিন্তু তাতেও রাজার প্রেমে কোনো খাদ নেই। অবন্তীরাজ ইচ্ছে করলে আবার বিবাহ করতে পারতেন। কই, করেননি তো। এতেই তো ধরা যায় তাঁর ভালবাসা কত নিবিড়।

ভানুমতী বললেন, এখন আর হয় না, তাইতো নিপুণিকে।

দাসী নিপুণিকা বলল, কেন হবে না মা?

রাজবৈদ্য ব্যর্থ হলো, যাগযজ্ঞে কিছু হলো না, শত ব্রাহ্মণের আশীর্বাদেও কিছু হলো না, অন্নহীনে অন্ন দিয়েও কিছু হলো না, কী হবে নিপুণিকে?

নিপুণিকা চুপ করে আছে। কী বলবে সে। নিজেও তো কম অবাক হয়নি। এত কিছুতেই সন্তান হয় না? একি নিস্ফলা গাছ? সে তো রানীর কানে কম মন্ত্র দেয়নি, মিলনের দিনক্ষণ জেনে এসেছে অবন্তীর প্রাচীনাদের কাছ থেকে, চাঁদের অবস্থান, নক্ষত্রের অবস্থান মিলিয়ে রাজা রানী শয্যায় গেছেন। তবু ব্যর্থ হয়েছে মিলন। নগরীর বারাঙ্গনা পল্লী থেকে সব সুলুক জেনে এসেছে নিপুণিকা, কিছু হয়নি। রাজা ভর্তৃহরি তো শৃঙ্গারপটু, রতি বিলাসী, তা সে শুনেছে রানীর কাছে, তবুও সব ব্যর্থ হয়েছে।

ভানুমতী জিজ্ঞেস করলেন, নতুন কোনো উপায় জেনেছিস তুই?

নিপুণিকা বলে, অবন্তীর আটকোশ পশ্চিমে, গম্ভীরা পার হয়ে আরো দূরে পাহাড়ের কোলে এক সিদ্ধা যোগিনী এসেছে মা, পরামর্শ নেবে?

ভানুমতী ধীরে ধীরে কণ্ঠহারটি খুলছেন, বক্ষবাস শিথিল করলেন। দু চোখ নিমীলিত তাঁর। ঘুমেই যেন ঢলে পড়ছেন রানী।

দাসী বলল, উনি বৈশালী দেশ থেকে এসেছেন, দূর উত্তরপুবের লোহিত্য নদ ছাড়িয়ে প্রাগজ্যোতিষপুরেরও দূরে গিয়ে তন্ত্রমন্ত্র শিখেছেন, উনি হয়ত পারলেও পারতে পারেন।

ভানুমতী চোখ খুললেন, তোকে এসব কে বলল?

দাসী এদিক ওদিক তাকায়। রাজ অন্তঃপুর নিরাপদ, তবু দেওয়ালেরও কান আছে; চাপা গলায় বলে, আমি গিয়েছিলাম মা, বড় মধুর তাঁর ভাষণ, বয়স অনেক হবে, শতবর্ষ হতে পারে দ্বিশতবর্ষও হতে পারে, শুনেছি প্রাগজ্যোতিষপুরে কামদেবের অধিষ্ঠান, কাউকে সন্তানবতী করে তোলা ওই যোগিনী মায়ের কাছে কোনো কাজই না, তুমি যাবে মা?

তুই কবে গিয়েছিলি?

গত করশু, একাদশীর দিন।

বলিসনি তো?

কী বলব মা, আমার বড় কষ্ট লাগে, অবন্তীর রানী নিপুত্র, খোঁজ পেয়ে আমি গেলাম, তা উনি তোমার সাক্ষাত চান, না দেখলে তো হবে না।

উনি আসতে পারবেন না? সামান্য উৎসাহের ভাব জেগেছে রানীর মুখে।

কী করে আসবে মা, বামুন পণ্ডিতরা ঘেন্না করে, বজ্রযানী, পাষণ্ড ধর্ম পালন করেন উনি, মানুষের ঘরে যান না।

রানী নিশ্চুপ। বুড়ি দাসীর কথা মিথ্যে নয়। যোগিনীকে ঢুকতেই দেবে না দ্বাররক্ষী। নগরে যদি প্রবেশ করতে হয় তো অন্ধকারে, লুকিয়ে। পাষণ্ড ধর্মের যোগিনীরা কখনো লোকালয়ে আসেন না। তাঁদের কাছে যেতে হয়।

ভানুমতী বললেন, যদি আমি যাই?

ত্রস্ত হয় বুড়ি দাসী, কী করে যাবে মা, গেলে তো খুবই ভাল হয় পাঁচটি তাম্বুল, পাঁচটি গুবাক, এক মুঠো সরিষা, পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে প্রণাম করলেই হবে।

কবে যাব বল, কোন তিথিতে?

বুড়ি বিড়বিড় করে, যাবে, গেলে কি অজানা থাকবে মা?

উনি অদৃশ্য হতে পারেন না, শুনেছি যোগিনীরা যোগ বলে অদৃশ্য হন, তিরস্করণী বিদ্যা জানেন না?

সে বিদ্যা কী মা?

অদৃশ্য হয়ে থাকা।

উনি কি জানবেন না, সব জানবেন, এসব তো ওঁর কাছে কিছুই না।

তবে অদৃশ্য হয়ে আসুন।

দাসী নিপুণিকা বিপদে পড়ল। একথা তো তাহলে গিয়ে বলতে হয় যোগিনীকে। কিন্তু যোগ বলে অদৃশ্য হয়ে থাকলে কি অপ্রকাশিত থাকবে তাঁর উপস্থিতি। বামুন, পুরোহিতরাও তো এসব পারেন শোনা যায়। দ্যুলোক ভূলোক তাঁরা দেখেত পান, বলেন তো স্বর্গ মর্ত্যের কিছুই তাদের অজানা নেই। শেষে না নিপুণিকাই দায়ী হয়ে পড়ে। তার শিরচ্ছেদ না হয়। দ্বাররক্ষী জানবে না, রাজা জানবে না, মন্ত্রী সেনাপতি কেউ জানবে না অন্তঃপুরে বাইরের মানুষ ঢুকে যাবে! এর চেয়ে রানীমার যাওয়াই ভাল। রাজাকে বলুন উনি, দশদিক জানিয়ে রানী যাবেন যোগিনীর কাছে। দাসী নিপুণিকা যাবে তাঁর পদসেবা করতে করতে।

রানী বললেন আবার, যোগিনীরা কত কিছু জানেন, বশীকরণ জানেন, তন্ত্রমন্ত্র, যাকে আমি চাই, তাকে যদি না পাই তো পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন যোগিনীরা, তাই না!

নিপুণিকা বলল, হয়ত তাই।

শুনেছি এমন হয়। বলতে বলতে রানী তাঁর কবরী থেকে পুষ্পমাল্য খুলে দিতে লাগলেন। কুন্দফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে গেল পাথুরে মেঝেয়। রানী তাঁর খোপা ভেঙে দিতে উদ্যত হলে নিপুণিকা হা-হা করে ওঠে। কী করছ মা, এত সময় ধরে খোপা বাঁধা হলো, এত সাজ হলো, সব ভেঙে দিচ্ছো, কঞ্চুকিকে খবর দিই, রাজার কাছে যাক, তিনি আসুন।

ভানুমতী হাত তুললেন, থাক, রাজা কী আমার সাজ দ্যাখেননি?

তাঁর মতো মানুষ এই অবন্তীদেশে আছেন আর, সত্যই তিন অবন্তীর অধীশ্বর, তিনি গণিকা দেবদত্তার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন বারবার, আর কোনো নারীর দিকে ফিরে তাকান না, তাঁরই তো সব, তোমার মতো সৌভাগ্যবতী কে আছে বলো, সতীন এল না ঘরে, দ্বিতীয় বিবাহে বিধান দিল বামুন পুরোহিতরা, কই তিনি তো......

থাম নিপুণিকে থাম, এত সৌভাগ্য আমার সহ্য হয় না।

নিপুণিকা অবাক হয়ে দ্যাখে রানী তার সাজসজ্জা ত্যাগ করতে উদ্যত। বিড়বিড় করছেন ভানুমতী, গণিকা দেবদত্তার কাছে গেলেই তো বাঁচি, তিনি যদি আর একটি বিবাহ করেন তবে তো বাঁচি, আমাকে দোষী হতে হয় না।

দাসী বুড়ি বলল, গণিকার ছলাকলা আছে, জানে অনেক কিছু, কিন্তু তোমার তুল্য তো তার রূপ নয় মা, তোমার কাছে সে তো কুরূপাই।

আচমকা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন ভানুমতী। কাঁপতে আরম্ভ করেছেন তিনি। শির উপরে নীচে চালিত হতে থাকে, আঁখিতারা, অস্থির হলো, আঁখিপল্লব অচঞ্চল, কণ্ঠস্বর কর্কশ হয়ে ওঠে, থাম তুই, গণিকার সঙ্গে আমার তুলনা করছিস, আমি কনখল দেশের রাজপুত্রী, গণিকা তো গণিকাই বটে।

দাসী বুড়ি ভীত হয়। দুটি হাত জোড় করে রানীর পায়ে মাথা নামায়, কেঁদে ওঠে, তুমি তো দেবী, অবন্তীর লক্ষ্মী, অপরাধ ক্ষমা করো মা, আমি ওকথা বলতে চাইনি।

ভানুমতী ধীরে ধীরে প্রসন্ন হলেন। ভীতা দাসী কয়েক হাত দূরে সরে গেছে আবার। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভানুমতী দুহাত পিছন দিকে বাঁকিয়ে খোপা বাঁধতে লাগলেন। স্ফীত বক্ষ শ্বাস প্রশ্বাসে কাঁপছে। খোপা বাঁধতে বাঁধতে রানী গ্রীবা বাঁকিয়ে দেখলেন দাসী বুড়িকে, চাপা গলায় বললেন, তুই যা, সেনাপতি বিক্রমকে খবর দে, আজ সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে দ্যুত ক্রীড়া বসব আমি।

দাসী নিপুণিকা এই ভয় পাচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিল এমন হতে পারে। কী কারণে এতসাজ তা টের পাচ্ছে সে এখন। অনুমান মিথ্যে হলো না। সে দেখছে রানী অভিসারিকার সাজে সাজছে আবার।

ভানুমতী বললেন, না হয় আমি যাব তাঁর ওখানে, তুই খবর দে।

দাসী একপা একপা করে পিছিয়ে দরজার মুখে পৌঁছে দাঁড়িয়ে থাকে। সে এই অন্তঃপুর দেখেছে বহুকাল ধরে। অন্তঃপুরের খবর তার মতো কে জানে। মহারাজ গন্ধর্ব সেন অন্তঃপুরে রাজমহিষীকে রেখে উদ্যানের প্রান্তে সমুদ্র ঘরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন গণিকা রসমঞ্জরীকে। দেখেছে গন্ধর্ব সেনের দুই মহিষীর মলিন মুখ। গন্ধর্ব সেন উদ্যানে দোল দিচ্ছেন ছোট মহিষীকে, বড় রানী, ভর্তৃহরির জননী চোখের জল ফেলছেন ঘরে বসে। অবন্তীরাজ গন্ধর্ব সেন সদ্য যুবতী রানীর সঙ্গে জলক্রীড়ায় মত্ত, বড়রানী কূলদেবতা শিবের চরণ মাথা ঠেকিয়ে বসে আছেন সব সময়। রাজমহিষীদের রোষ দেখেছে সে, দেখেছে আবার অপমানিতা রানীদের। রানী দুইজনে একসঙ্গে চলেছে গণিকাগৃহে, দাসী নিপুণিকা তাদের পথ দেখাচ্ছে দু’জনেই অবগুণ্ঠনে মুখ আড়াল করে। রসমঞ্জরীর কাছে গেছে তারা স্বামী ভিক্ষা করতে। রসমঞ্জরীর রূপে গুণে তারা বিস্মিতা, অভিভূতা। রসমঞ্জরীর কাছে তারা শিখে নিল পুরুষ বশের নানা কৌশল, শৃঙ্গার কর্মের অজানা পদ্ধতি। গণিকারা যা জানে, অন্তঃপুরবাসিনীরা তা জানে না। জানতে পারে না। জানার উপায়ও নেই।

রানী আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, গণিকা দেবদত্তা, সে সত্যিই কত গুণবতী?

জানি না মা, আমি কিছুই জানি না।

তুই যা, খবর দে কুমার বিক্রমকে, যা এই ফুলের মালাটি নিয়ে যা, বলবি আমি দংশন করেছি এর পাপড়ি, তাই ঝরে গেছে দু-একটি, বলবি এ আমার গলার মালা, এই বুকের তাপ লেগেছে এতে, যা নিপুণিকে, বুড়ি যা বলবি কেউ যেন না শোনে, বলবি যদি না আসেন তিনি, আমার চোখের কাজল রেখা ধুয়ে যাবে।

দাসী বুড়ি কী করে। ফুলমালাটি তার গায়ের চাদরের নীচে আড়াল করে মন্দচরণে অন্তঃপুর থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। অন্তঃপুর কত বড়। কত ঘর। কোন ঘরে বসবেন রানী আর তাঁর দেওর কে জানে। দাসী বুড়ির মুখে কোনো প্রতিক্রিয়ার চিহ্ন নেই এখন। এসব তার কাছে নতুন কী? এই ক’দিন আগে গণিকা দেবদত্তার পত্র সেই তো পাঠিয়েছিল রাজার কাছে।

চলবে

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top