সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (সপ্তম পর্ব) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৪২

আপডেট:
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৫২

 

মুরং নারী-পুরুষ একসঙ্গে পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় এবং বন-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। ওদের বিশেষ আকর্ষণ চাঁদনী রাত। ওরা চাঁদনি রাতের আয়োজন সাধারণত মিস করেনা। জঙ্গলের ভেতরের ফাঁকা জায়গায় খোলা আকাশের নিচে রাতভর নাচ-গান করে। সে কি তুমুল উৎসব! না দেখতে বোঝানো যাবেনা। 

- তুই কি করে গেলি ওখানে? 

- বাবা-মায়ের সঙ্গে। তারাই আয়োজন করেছিল এই উৎসব দেখার। আমি বায়না ধরলে বাবা-মা পেছাতে পারে না। কোনো না কোনোভাবে একটা ব্যবস্থা করে। তাছাড়া বাবারও এমন ঘুরে বেড়ানোর নেশা আছে। 

- তাহলে বুঝতে পারছি তুই বাবার পথ ধরে চলছিস। তোর ঘুরে বেড়ানোর নেশা তোর বাবার রক্ত। 

- এই থামতো রে, আশিকাকে মুরংদের পুরানের গল্প বলতে দে। 

আশিকা হাসতে হাসতে বলে, সারা রাত নাচ-গানের আগে ওরা নিজেদের বানানো মদ খায়। মদের নেশা নারী-পুরুষ সবার মধ্যে সমান। খেয়ে মেতে উঠে। ওদের উচ্ছ্বাস আর নাচের মাত্রায় মেতে ওঠা দেখে মনে হয়ছে এমন বনভূমিতে জীবনযাপন বেঁচে থাকার আর একটি অসাধারণ দিক। নাচের সঙ্গে তারা গান গেয়ে ভরিয়ে তোলে বনের সবটুকু। নিজেদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ভরিয়ে তোলে আকাশের দিকপ্রান্ত। 

- তুই একটা পুরাণের ঘটনা বলবি বলেছিলি আশিকা? 

- হ্যাঁ, হ্যাঁ বলবতো। ওদের জীবনের কতকিছু আমাদের জানার আছে! আমাদের জানতে হবে রে। 

- জানতে চাই, জানতে চাই। তুই বলতে শুরু কর। 

- মুরংদের ‘গো-হত্যা’ নামে একটি অনুষ্ঠান আছে। নাচ-গান করে একটি গরুকে মেরে ফেলা এই অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক ছবি। এর পেছনের গল্পটি আমাদের সামনে মিথ। কথিত আছে যে মুরং সমাজের কোনো ধর্মীয় বই ছিল না। একসময় সৃষ্টিকর্তা সবাইকে ডাকলেন তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় গ্রন্থ গ্রহণ করার জন্য। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সবাই নিজেদের লোক পাঠালো ধর্মীয় গ্রন্থ আনার জন্য। দেখা গেল মুরংদের পক্ষ থেকে কেউ সেখানে যায়নি। সৃষ্টিকর্তা মুরংদের কাছ থেকে কেউ আসেনি যখন জানতে পারলেন তখন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন। যখন কেউ এলোনা তখন সৃষ্টিকর্তা কলাপাতায় লেখা ধর্মীয় বিধি-নিষেধ একটি গরুর দ্বারা পাঠিয়ে দিলেন মুরংদের যিনি প্রধান তার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। গরু কলাপাতা মুখে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। অনেক পথ হাঁটতে হাঁটতে গরুর খিদে পেলো। শরীরিক ক্লান্তিতে চুপসে যাচ্ছিল দেখে কলাপাতটা চিবিয়ে খেয়ে ফেলল। ফলে মুরংদের কাছে আর ধর্মগ্রন্থ পৌঁছালো না। এটা জেনে মুরংরা গরুর উপর ভীষণ ক্ষেপে গেল। গরুর উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য শুরু করল গো-হত্যা। মুরংরা এই হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠান হিসেবে পালন করে। এর নাম ‘জুমলাং’। বিশেষ করে জুম চাষের পরে ফসল কাটার সময় এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। তাছাড়া ওদের গ্রামে কোনো ধরণের দুর্যোগ দেখা দিলে ওরা এই উৎসব পালন করে। তারা গরুটাকে এক জায়গায় বেঁধে রেখে নাচ-গান করে, মদপান করে উচ্ছ্বাসে উল্লাসিত হয়ে ওঠে। আর গরুটার দিকে তীর ছোঁড়ে। গরু মারার জন্য ছোট ছোট লোহার শলাকা ছুঁড়ে গায়ে গেঁয়ে গেঁথে ফেলে। এভাবে গরু মাটিতে পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে কেটে মাংস খাওয়ার জন্য রেডি করে। তাদের বিশ্বাস এই জুমলাং অনুষ্ঠান গ্রামের দুর্যোগ কাটিয়ে দেবে। কিশোর-কিশোরীরাও প্রবল নৃত্যে ভরিয়ে তোলে এই উৎসব। 

শীলা উচ্ছাসিত হয়ে বলে, ভালোইতো; নৃত্য-গীত, খাওয়া-দাওয়া মিলিয়ে উৎসব জনজীবনের সবাইকে একমাত্রায় রাখে।

- ঠিক বলেছিস। 

- মুরংদের এই উৎসব দেখতে আমরা যাব। 

খিলখিলিয়ে হাসে শীলা আর ফাল্গুনি। 

- তোদের সঙ্গে আমিও যাব।

- যাবিইতো। আমরাতো একা যেতে পারবনা। 

- কথা, তো এটা না। কথা হলো বেড়াতে গেলে দলবল না থাকলে ভালোলাগেনা। 

- ঠিকরে আশিকা। বেড়াতে বেড়াতে তোর অনেক জ্ঞান বেড়েছে। 

- এই খবরদার, ঠাট্টা করবিনা। 

- মোটেই ঠাট্টা করিনি। কি সুন্দর করে একটা কাহিনী বললি।

- এটা শুধু কাহিনী না, ওদের বিশ্বাস। 

- ঠিক, ঠিক। তোর মতো আমরা বুঝতে পারিনা। 

- ওই দেখ আমার মা আমাকে হাত নেড়ে নেড়ে ডাকছে। বাবাও আছে সঙ্গে। আমি গেলাম। 

আশিকা পাথর থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড়ে চলে যায়। বাবা-মায়ের কাছে এলে আতিকুর হেসে বলে, তুই বেশ এনজয় করছিস মা। 

- হ্যাঁ, বাাব। তোমরা করছ না? 

হামিদা বানু বলে, আমর মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে তোদের মতো দৌড়ঝাঁপ করতে পারছিনা বলে। 

- মাগো -

- থাক, বয়সের কথা বলতে হবেনা। তোর আনন্দ থেকে নিজেও আনন্দে ভরে রাখব নিজেকে। চল ঘরে যাই। তোর বাবা একটা নতুন চিন্তা করেছে। আমিও পছন্দ করেছি। 

- কি চিন্তা বাবা-

- তোর মায়ের আর আমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। হাঁটার কথা চিন্তা না করে আমরাতো অতি উৎসাহে চলে এসেছি। এখন ঠিক করেছি মেরিন ড্রাইভে চলাচল করে যেসব গাড়ি সকালে তার একটি ভাড়া করে কক্সবাজার চলে যাব। 

- ঠিক আছে বাবা। খালামানিকে বলা হয়েছে মা? 

- হ্যাঁ, ও নিজেও যাবে আমাদের সঙ্গে। 

- যাক, ভালোই হয়েছে। 

- তোর মনে দুঃখ থাকবেনা? 

- না বাবা দুঃখ রাখব কেন? তোমরা না এলে তো আমার আসা হতোনা। হাঁটতে কষ্ট নেই আমার। তোমাদের সঙ্গে আসা আমার আনন্দ। সমুদ্র-সৈকতে হাঁটা আমার আনন্দ। 

আতিকুর বলে, কালকে আমরা কিছুক্ষণ সমুদ্র-সৈকতে কাটিয়ে তারপর বাসে উঠব। 

- ঠিক আছে আব্বু- 

আশিকা মাকে জড়িয়ে ধরে। আদর করে। কপালে মাথা ঠেকিয়ে বলে, তোমার শরীর খারাপ হলে আমার মনে হয় আমি বাঁচবনা। 

- চল, ঘরে চল। 

আশিকা বাবা-মা দুজনের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে। সমুদ্রের কলকল ধ্বনি তিনজনকে একই আনন্দে ভাসায়। একই অনুভবে পরদিন তিনজনে ফিরে আসে ঢাকায়। স্মৃতির ঘেরাটোপে ঘুরতে ঘুরতে আশিকা নিজের চারদিক জমিয়ে তোলার পারে ক্লান্তি অনুভব করে। ভাবে, মনের উপর চাপ বেশি হয়ে গেছে। স্মৃতিতো মানুষের সারাজীবনের সঞ্চয়। শুধু একসময়ে এতবড় পরিসরে স্মৃতিকে তুলে আনা ঠিক নয়। নানা সময়ে ছোট ছোট করে তুলে আনাই আনন্দের। এই অনুভবে আশিকা ক্লান্তি কাটিয়ে উঠে রান্নাঘরে মায়ের কাছে যায়। 

- মা, তুমি না বলেছিলে পুডিং বানাবে। হয়েছে কি? 

- হয়েছে রে মা। ওই যে ওখানে রেখেছি তুই তুলে নিয়ে খা। 

- হুররে পুডিং- পুডিং

আশিকা রান্নাঘরের আর একপাশে রাখা পুডিংয়ের প্লেটটা নিয়ে মাথার উপর তুলে এক মুহূর্ত হুররে হুররে করে বাটি-চামচ নিয়ে পুডিং তুলে খেতে শুরু করে। হামিদা বানু হাসতে হাসতে বলে, তোর এই উচ্ছাস আমার খুব ভালোলাগেরে মা। 

- মাগো তুমি আমার হাতে এক চামচ খাও। 

মাকে খাইয়ে দেয় আশিকা। হামিদা বানু মেয়ের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ স্বরে বলে, তোর দেয়া পুডিং আমার পেটে যায়নি, ওটা মনে গেছে। 

- ওহ, মাগো, তুমি কি সুন্দর করে বললে। 

- সবতো তোর কাছ থেকে শিখি মা রে। 

- নাগো, আমি তোমার কাছ থেকেই এইসব কিছু পেয়েছি। তোমার সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ ছিল না? 

- হয়েছে থাম থাম। 

- ঠিক আছে, আমি পড়ার টেবিলে যাই। 

- তোর বাবা কি করছে দেখতো। 

- দেখছি, বাবা হয়তো কিছু পড়ছে। 

আশিকা বাবার কাছে এসে দাঁড়ায়।  

 

ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (প্রথম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (দ্বিতীয় পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (তৃতীয় পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (চতুর্থ পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (পঞ্চম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (ষষ্ঠ পর্ব)

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top