সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব নয়) : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
১৩ মার্চ ২০২১ ১৯:০৯

আপডেট:
১৩ মার্চ ২০২১ ২১:৫৮

 

ছিমছাম ড্রইংরুম। বিলাসিতার বাহুল্য নেই। আমরা সবাই সোফায় বসলাম। ফ্যান ছেড়ে দিয়ে শ্যামশ্রী তার কপালের ঘাম মুছল শাড়ির আঁচল দিয়ে। বলল, উঃ বাবা যা বড্ড গরম পড়েছে। তারপর অন্দরমহলের উদ্দেশে কণ্ঠস্বর উঁচিয়ে বলল, মাসি, চার গ্লাস লেবুর শরবত, আর সন্দেশ পাঠাও। শিগগির।

বলে শ্যামশ্রী তার বসা সোফা থেকে উঠে এসে বসল নাজু আর ছোটনের মাঝখানে। নাজুকে আদর করে চিবুকে হাত দিয়ে বলল, তোমার নাম?

- নাজনিন।
- নাজনিন, কী সুন্দর নাম! যেমনি মিষ্টি মেয়ে তেমনি সুন্দর নাম। আর আমাদের কী যে ছাই নাম রেখেছে বাবা-মা। আমি কালো বলে শ্যামশ্রী-কী বিশ্রী!
তারপর ছোটনের হাত ধরে বলল, আহারে ছোটদা, তুমি কত রোগা হয়ে গেছ। তোমার বুঝি খুব অসুখ করেছে?
ছোটন মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ আমার খুব অসুখ।
শ্যামশ্রী ছোটনের মাথাটায় হাত বুলিয়ে বলল, তারাপ্রসন্ন দাদু খুব ভালো কবিরাজ। তুমি ওনার চিকিৎসায় নিশ্চয় ভালো হয়ে যাবে। আমি রোজ ভগবানের কাছে প্রার্থনা করব তিনি যেন তোমাকে সুস্থ করে দেন।
শ্যামশ্রীর অতি আদরে ছোটনের অস্বস্তি আর লজ্জা লজ্জা ভাব। শুধু বলল, থ্যাংকস।
শ্যামশ্রী অনর্গল কথা বলে চলল। এই বাড়িতে এখন সে আর তার বাবা থাকে। কাজের জন্যে আছে সবিতা মাসি। আর বাসার সব কাজের বদ কাজী হচ্ছে ঐ ট্যারা মুহুরি অবিনাশ সাহা।
আমি মৃদু হেসে বললাম, আপনি বলছেন মুহুরি। উনি যে বললেন, উনি ল’ অ্যাসিসটেন্ট। উনি ল’ পাশ।
- ল’ পাশ না ছাই। স্থানীয় একটা প্রাইভেট ল’ কলেজ থেকে ঘুষ দিয়ে একটা সনদ জোগাড় করেছে। তাই নিয়ে ওর বড়াই।
- আপনি দেখছি ওকে দেখতেই পারেন না।
- দেখার মতো মানুষ হলে তো দেখব। ওর মনে দুনিয়ার যত প্যাঁচ আর শয়তানী বুদ্ধি। বামন হয়ে চাঁদ ছোঁয়ার ইচ্ছে।
- আপনার মা কোথায়?
- আমার মা বেশ কিছুদিন ধরে আর্থারাইটিস আর অ্যাজমায় অসুস্থ। চিকিৎসার জন্যে আমার বড়দা প্রসূনের কাছে আছেন কলকাতায়। আমার বড়দা আবার কলকাতা মেডিকেল কলেজের জুনিয়র ডাক্তার। আমি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম কমের ছাত্রী। পড়াশুনা শেষ হলেই বাবা আমাকেও কলকাতায় পাঠাবেন বলেছেন।
- ভালোই তো।
- ভালো না ছাই। কলকাতায় আমার মন বসে না। আমার বাংলাদেশেই ভালো লাগে। দু নৌকায় পা দিয়ে থাকা আমার মোটেই ভালো লাগে না।
- তাহলে দু’পা একসাথে করে কলকাতাতেই স্থায়ী হয়ে যান।
শ্যামশ্রী হতাশ স্বরে বলল, তাই বোধহয় যেতেই হবে। বড়দা তার এক ডাক্তার বন্ধুর কথা বাবাকে বলে রেখেছে। বাবাও ইচ্ছে তেমনটাই। কিন্তু আমার এতটুকু ইচ্ছে নেই।
- কেন?
- কেন আবার? যাকে চিনি না, জানি না তাকে হুলুলু করে বিয়ে করতে হবে, পান পাতায় মুখ ঢেকে সারাজীবন তার কলাবৌ হয়ে থাকতে হবে? এ কেমন জীবন?
আমি হেসে বললাম, কলাবৌ, কচি কলাপাতার শাড়ি পরে আপনাকে দারুণ মানায়। প্রথম যেদিন দেখেছিলাম পথে কচি কলাপাতার শাড়িতে সেই দিনই আপনার ছবিটা আমার চোখের আলোয় বুকের ভেতর ভরে নিয়েছিলাম।
শ্যামশ্রী বিস্ময়ে বলল, তাই বুঝি? আহা আগে যদি জানতাম তাহলে আজ আমি আপনার অপেক্ষায় কচি কলাপাতা শাড়িটা পরে বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম।
আমি বললাম, আমারই কি জানা ছিল আজ আপনার সঙ্গে আমার এভাবে দেখা হবে? এ জন্যে আপনাদের ঐ অবিনাশ লোকটাকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয়। ও জোর করে ধরে বেঁধে না আনলে আপনার সঙ্গে তো দেখাই হত না।
শ্যামশ্রী আঁচলে মুখের ঘাম মুছে বলল, তা বটে। দূর্ভাগ্য কখনও কখনও সৌভাগ্যকেও ঘরে টেনে আনে।
গৃহকর্মী মধ্যবয়সী সবিতা মাসি আমাদের জন্যে ট্রেতে শরবতের গ্লাস, সন্দেশ, আপেল সাজিয়ে দিয়ে গেল। গরম আর কথায় কথায় গলা বেশ শুকিয়ে গিয়েছিল। তাই সবাই শরবতের গ্লাসটাই হাতে নিলাম।

শ্যামশ্রী খুব সাধাসাধি করল সন্দেশ খেতে। অনেক সাধাসাধিতে নাজু এক টুকরো সন্দেশ খেল। আর ছোটন এক টুকরো আপেল। আমি শুধুই শরবত। এই খাওয়া দাওয়ার মধ্যেই শ্যামশ্রীর আচমকা প্রশ্ন, আপনার সেই বিদেশিনী বন্ধুর কী খবর?
ওর প্রশ্ন শুনে নাজুর চোখ বড় বড়। আমি শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললাম, বিদেশিনী তার স্বদেশে।
- যোগাযোগ হয় না বুঝি?
বললাম, হয় চিঠিপত্রে, ছবি আঁকা-আঁকির ব্যাপারে, আমার ছবি প্রদর্শনী আর প্যারিস যাবার বিষয়ে।
- আপনি প্যারিস যাবেন? আহারে কী সুন্দর দেশ! কত বড় আইফেল টাওয়ার! কত সুন্দরী সেই বিদেশিনী!
কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলল, বিদেশিনী কত ভাগ্যবতী। সে কোন সুদূরে থেকেও আপনার কত কাছে। অথচ দেশের এই কালো মেয়েটি কাছে থেকেও অদেখা কতদূরে। ঠিকানা তো বোধহয় বলেছিলাম। কিন্তু যাকে ঠিকানা দিলাম তার একদিনও এতটুকু ইচ্ছে হয়নি একবার খোঁজ নিতে।
আমি বললাম, খোঁজ নিতে এলে তো আরো বিপদ হত। মহল্লার মানুষের লাঠিপেটা, রিকশা ভাংচুর, তিন বছরের জেল, পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা ...

শ্যামশ্রী বাধা দিয়ে বলল, থাক এসব ফালতু অজুহাত দিতে হবে না। একবার এসেই বললে হত শ্যামশ্রী আমি এসেছি। আমি বলতাম, ও আপনি এসেছেন! কী ভাগ্য আমার! বসুন, আমি কলাপাতা রং এর শাড়ি পরে আসি।
নাজনিন আর ছোট ওর কথা শুনে হেসে উঠল। সেই হাসির মধেই আমি বললাম, শ্যামশ্রী, আমি আমার রিকশার পেছনে সেই বিদেশিনীর ছবি আঁকিনি। যার ছবি এঁকেছি সে এখন আমার সামনে বসে।
নাজু বলে উঠল, আমার মা কিন্তু ছবিটা খুব-ই পছন্দ করেছে। বলেছে ...
আমি নাজুর দিকে চোখ পাকিয়ে ধমকে উঠলাম, নাজু?
শ্যামশ্রী নাজুর হাতটা ধরে অনুনয়ের স্বরে বলল, এই মেয়ে বলোনা গো মা কী বলেছেন? প্লিজ, প্লিজ ...
নাজু দুষ্টুমির ভঙ্গিতে বলল, বলেছেন তুমি খুউব... না বলব না। এখন বড়দার সামনে বলব না। বড়দা আমাকে পিট্টি দেবে।
শ্যামশ্রী নাছোড়বান্দা। সে নাজুকে আঁকড়ে ধরল। বলল, প্লিজ নাজু, লক্ষ্মী দিদি আমার।
নাজু কৃত্রিম গম্ভীর স্বরে বলল, তুমি খুউব ... কুশ্রী।
শ্যামশ্রী ঝর্ণাধারার মতো হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, মা ঠিক বলেছেন, ঠিক বলেছেন। আমি সত্যিই কুশ্রী, হতবিচ্ছিরি।
ছোটন আর নাজুকে নিয়ে বাসায় ফিরতেই নাজুর চাপা আনন্দ যেন উপচে পড়তে চায়। ছোটন খুব-ই ক্লান্ত। ও বিছানায় শুয়ে পড়ল। আমি কবিরাজের দেওয়া ওষুধগুলো বাবা আর জয়ীমাকে বুঝিয়ে দিলাম ওকে সময় অনুযায়ী নিয়ম মতো খাওয়াতে এবং আবার এক সপ্তাহ পরে যেতে হবে নতুন ওষুধ আনতে।
ছোটন ক্লান্তস্বরে বলল, হ্যাঁ এক সপ্তাহ পরে আমি একাই যাব ওষুধ আনতে। তবে বড়দার সঙ্গে নয়। ঐ লালবাগে বড়দার যাওয়া চলবে না।
বাবা, জয়ী মা অবাক। কেন রে? কী হয়েছে?
নাজু দুষ্টুমি করে বলল, মা অবাক কা- ঘটেছে। বড়দার রিকশার পেছনে আঁকা ঐ ছবির আসল মেয়েটির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছে। কী যে মিষ্টি চেহারা!
মা অবাক কণ্ঠে বললেন, তাই নাকি? কোথায় পেলি ওকে? কোথায় দেখা হল?
নাজু বলল, ঐ তো কবিরাজ বাড়ির পাশেই ওদের বাড়ি।
আমি বিব্রত। বাবা তো এসব কিছুই জানেন না। আমি নাজুকে ধমকে থামাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নাজু তার সব আনন্দ, আমাদের সব নাজেহাল অবস্থা এবং সবশেষে মেয়েটির সঙ্গে সব গল্পের কথা বাবা আর জয়ী মা’র সামনেই অনর্গল বলে গেল দক্ষিনা বাতাসের মতো। আমি লজ্জাবনত মাথায় বসে রইলাম।
বাবা বললেন, যাক যা হবার হয়েছে। এরপর থেকে আমিই যাব ছোটনকে নিয়ে কবিরাজ বাবুর কাছে। লালবাগে তিমুর যাবার দরকার নেই। আর তোমাদেরও বলছি, তোমাদের কারো দরকার নেই তিমুর রিকশায় চড়ে এ ধরণের অবাঞ্ছিত ঘটনার জন্ম দেওয়া।
কথাটা বলে বাবা উঠে গেলেন। নাজু হতাশ কণ্ঠে জয়ী মা’কে প্রশ্ন করল, বাবার এ কেমন আদেশ হল মা? আমরা না হয় বড়দার রিকশাতে না-ই-বা চড়লাম। তাই বলে বড়দা একা কেন লালবাগে যেতে পারবে না? ঐ শ্যামশ্রী দি যে বড়দার পথ চেয়ে অপেক্ষা করবে?
জয়ী মা শান্ত কণ্ঠে বললেন, অপেক্ষা করলে করবে। কিন্তু তাই বলে তো সব জেনে শুনে তিমুকে আমি কি বলব যা তুই যা। লালবাগের ঐ লাল আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দে।
নাজুর কণ্ঠে তবুও ক্ষীণ প্রতিবাদের সুর। মা, তুমিই তো বলেছিলে যদি এমন একটা মিষ্টিমুখ মেয়ের সন্ধান পাই ....
জয়ী মা ধমকে উঠলেন। বললেন, নাজু বেশি ডেঁপোমি করিসনে। কী বলেছিলাম, না বলেছিলাম তা নিয়ে তোর এখন ভাবনা -চিন্তার দরকার নেই। বড়দের কথার মধ্যে ছোটদের এত বেশি কথা বলতে নেই। বুঝেছ আমার সোনা মেয়ে?
নাজু থমথমে কিংবা আহত মুখভঙ্গি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম।
যায় যায় দিন করে দশ বারো দিন চলে যায়। আমি আমার কোচিং ক্লাসের টিউটরি, আলিয়ঁজ ফ্রসেঁজে ফ্রেন্স ভাষা শিক্ষা এবং ছবি আঁকা-আঁকি নিয়ে ব্যস্ততায় মগ্ন হয়ে পড়ি। ছোটনের জ্বরের প্রকোপ এখন কিছুটা কম। বাবা ছোটনকে নিয়ে নিজেই আসা-যাওয়া করেন কবিরাজ বাড়ি আরোগ্য নিকেতনে। কবিরাজ তাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলেছেন, অবস্থার উন্নতি হচ্ছে, আরো হবে। তবে ধৈর্য্য ধরতে হবে। তিনি শরীর থেকে বিষ বিতাড়নে আগের দেওয়া ওষুধের সাথে আরো কিছু বিশেষ ওষুধ দিয়েছেন। তার বিধান মতে এক্ষুণিই খেতে হবে। অন্য কোনো অ্যালোপ্যাথি নয়।

এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ খবর বা বিষয় নয়। রাত্রে আমি বাসায় ফেরার পর ছোটন প্রায় মধ্যরাত্রে আমাকে ডাকল, বড়দা?
আমি আমার বিছানা থেকে উঠে ওর কাছে গেলাম। ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলাম প্রবল জ্বরে ও কাঁপছে। সারা শরীর যেন আগুনে পুড়ছে। আমি কাউকে এই গভীর রাত্রে ডেকে হৈ চৈ করতে চাইলাম না। কলতলা গিয়ে বালতি ভরা পানি আর মগ নিয়ে এসে ওর মাথায় নিচের বালিশ সরিয়ে অয়েলপেপার বিছিয়ে দিয়ে মগ ভরে ভরে অবিরাম পানি ঢালতে লাগলাম। সেই সঙ্গে হাত তোয়ালে ভিজিয়ে ওর শরীর স্পঞ্জ করতে লাগলাম। কবিরাজের নির্দেশ অমান্য করেই ওকে দু’টো প্যারাসিটামল আর একটা কড়া ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিলাম। ফিস ফিস করে বললাম, ছোটন তোকে যে এই ওষুধ খাওয়ালাম তোর জ্বরটাও নামানোর জন্যে। কাউকে বলিসনে।

ছোটন জ্রবঘোরে বলল, আমি জানি বড়দা এইসব কবিরাজি পাঁচন, জড়িবুটি খেয়ে আমার কোনো লাভ হবে না। আমি এখন জীবনের শেষ পর্যায়ে। জানি মৃত্যু সুনিশ্চিত। কিন্তু মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। শুধু দুঃখ হয় এই যৌবনের শুরুতে আমি কিছুই করতে পারলাম না। কবি হেলাল হাফিজের কবিতার কথাই শুধু পড়ে গেলাম।
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় ...’ এই সব কথাই মিথ্যে হয়ে গেল। আমি কোনো মিছিলে যেতে পারলাম না, বিদ্রোহ, বিপ্লবে উচ্চকিত স্বরে শ্লোগান দিতে পারলাম না, পুলিশের রাইফেলের গুলি খেতে পারলাম না, আমার বাবার মতো যুদ্ধে যেতে পারলাম না। একটা জড়জন্তুর মতো এই বিছানায় শুয়ে থাকি। বড় কষ্ট নিয়ে শুয়ে থাকি আলো থেকে অন্ধকার গহ্বরে চলে যাবার অপেক্ষায়।
আমি ছোটনের মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে ওকে সাহস আর সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বললাম,
- ছোটন, সবার জীবন একরকম হয় না। প্রত্যেকের জীবন আলাদা, বাঁচা, মরা আলাদা। এত অস্থির হোসনে। তুই ভালো হয়ে উঠবি। নিশ্চয়ই ভালো হয়ে উঠবি। এই তো তোর জ্বর কমে আসছে। তুই ঘুমো। তোর জ¦র নিরানব্বইতে নেমে না আসা পর্যন্ত আমি পানি ঢালতেই থাকব। কাল সকালে তুই যখন ঘুম থেকে জেগে উঠবি, দেখবি তোর শরীর তখন কেমন হালকা ঝরঝরে।
ছোটন হাসল। বলল, তাই যেন হয় বড়দা। তোমাদের ছেড়ে যেতে এই মুহূর্তে আমার মন চায় না। আমি মৃত্যু চাই। তবে একটা মহৎ মৃত্যু চাই। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডাই লাইক আ স্ট্রিট ডগ।
আমি ওর মুখে আঙুল চাপা দিয়ে বললাম, ছি: এসব কী কথা বলছিস? এমন করে এসব মৃত্যুর কথা আর বলিসনে। আমরা সবাই যে তোকে বড় বেশি ভালোবাসি।

আমিও ভালোবাসি বড়দা, তোমাদের সবাইকে বাবাকে। জয়ী মা’কে, তোমাকে, নাজুকে। কাউকে ছেড়ে যেতে আমার মন চায় না। তবু তো যেতে হবে। কিন্তু যাবার আগে যদি তোমার বিয়েটা দেখে যেতে পারতাম।

- আমার বিয়ে! আরে পাগলা, আমি কি এখন বিয়ে করব? আমি তো প্যারিস যাবার স্বপ্নে দিন গুনছি।
- বড়দা, স্বপ্ন আর একজনও দেখছে মনে হয়।
- কে?
- লালবাগের ঐ মেয়েটি শ্যামশ্রী। আজও সকালে বাবার সঙ্গে আরোগ্য নিকেতনে যাবার পথে দেখলাম ওই মেয়েটিকে তুমি আসবে এই রকম একটা ব্যাকুল প্রতীক্ষায় দোতালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তুমি আমার সঙ্গে নেই দেখে ওর চোখ যেন একটা কালো মেঘে ঢেকে গেল। ও চলে গেল ভেতরে। ফেরার সময় আর ওকে দেখিনি। মনে হয়, ও তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছে।
আমি হেসে বললাম, ধুৎ, যত্তসব আজগুবি কল্পনা তোর! দু’এক দেখাতেই কি মানুষের ভাব-ভালোবাসা হয়? ও সব কথা না ভেবে তুই এখন ঘুমো।

ছোটনের জ্বরের প্রকোপ এখন অনেকটা কম। ও চোখ বন্ধ করে বলল, বড়দা আমি যেন ওর ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। মেয়েটা খুব কল্পনাপ্রবণ, ভেরি ইমোশনাল। ওর জীবনে অনেক কষ্ট, দুঃখ আছে। কিন্তু সে কষ্ট, দুঃখ তুমি দিয়ো না।
আমি বললাম, আমি কাউকে ইচ্ছে করে দুঃখ দেব না। তবে কেউ ইচ্ছে করে দুঃখ-কষ্ট পেতে চাইলে আমি তার ভাগীদারও হব না। আর কথা নয়, ঘুমো।
আমার অবিরাম ঢালা পানিস্রোতের মধ্যে ছোটন এক সময় ঘুমিয়ে গেল। আমি সকাল না হওয়া পর্যন্ত ওর পাশে বসেই রইলাম, তারপর কখন যে ওর পাশেই ঘুমিয়ে গেলাম জানি না।
সকালে জয়ী মা এসে দেখলেন আমরা দু’ভাই ভেজা ঠান্ডা পানির বিছানায় গলা জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছি।
জয়ী মা’র চোখেও অনন্ত পানির নিঃশব্দ ধারা।
[পিতা ফজলুল হাসানের পুরাতন ডায়েরি ও কাগজ কলমের কিছু ছেঁড়া লেখালিখি।]
এতো সেই কবেকার কথা, আমার মা’য়ের চোখে উষাকালের মৃদু আলোয় দেখা আমাদের দুই ভাইয়ের এক যুগলবন্দি স্মৃতি ছবি যা কুয়াশার মতোই অস্পষ্ট। ছোটন কোনকালে মিশে গেছে ধুলিতে আর আমি জীবষ্মৃতের মতো পড়ে আছি হাসপাতালের এক সাদা ঘরে। সাদা শয্যায় এক কালো অন্ধকার ঘরে যাবার অপেক্ষায়। অথচ আমি বাঁচতে চাই, প্রবল তৃষ্ণায় চিৎকার করে উঠতে চাই, আমার অসমাপ্ত জীবনের কিছু পাপ, কিছু ইতিহাসের কথা বলতে চাই, লিখতে চাই। তবু তা আমি পারছি না। আমাকে শবদেহ ভেবে স্মৃতির কিছু বিষপিঁপড়ে আমার সর্বাঙ্গে ছুটে বেড়াচ্ছে, হুল ফুটিয়ে তাদের খাদ্যকণা খুঁজছে। বড়কষ্ট, বড় যন্ত্রণা। এই বিষ পিঁপড়েগুলো আমার শরীর থেকে ঝেঁটিয়ে ফেলতে আমার চাই রং, তুলি, ইজেল, ক্যানভাস ... না ... না ...

জ. আই বে সৈন দ’ স্তিল-আমার একটা কলম প্রয়োজন ... জে ভেউক্স এচরিরে কুয়েল্কুছলে ... আমি কিছু লিখতে চাই ...। এখানে কি কাগজ কলম আছে? ওহে ডাক্তার, নার্স, আমাকে কিছু সাদা কাগজ আর একটা কলম দাও। আমি আমার কথা বলতে চাই, কিংবদন্তীর কথা বলতে চাই ... আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলতে চাই ...
টেবিলের ওপর সাদা কাগজ আর কলম
যেন ওরা প্রেমিক- প্রেমিকা বন্ধু আজীবন
অথচ তারা এক অদ্ভুত নিয়মে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন
একজন হাতবন্দি, অন্যজন মুক্ত খাতার পাতায়
সাদা দুপুরের খররৌদ্র।
জানা নেই হাতটা কলম দিয়ে কি লিখবে?
কবিতা? নষ্ট সময়ের নষ্ট সংবাদ? টিভি নাটকের খসড়া,
নাকি তৈলাক্ত সম্পাদকীয়?
আজ সত্য সাহস নেই, নূর হোসেন নেই
নেই তার বুকের দেয়াল লিখন,
সময়ের ওপার থেকে সুকান্তের পুরাতন ঘন্টাধ্বনি বাজে
অথচ নদীর শ্মশান ঘাটে তার চিতাভূমে চাঁদ রুটি
কোনকালে জ্বলেপুড়ে ছাই ...
আসাদের রক্ত-ছাপা ছেঁড়া শার্ট,
বিদ্রোহের লেখা-জোকা যতসব বই-খাতা, ছেঁড়া পাতা
আঠায় আঠায় জোড়াতালি মারা
কোনো এক বালকের সুতো কাটা স্বপ্নঘুড়ি
উড়ে গেছে পাখি হয়ে দিক্ চিহ্নহীনতায় ...।
খাতার সাদা পাতা বলে, কলম তুমি লিখ।
যাহারা স্মৃতির অতীত তাহাদের তুমি ডাকিয়ো না।
তুমি নতুন কিছু লিখ।
কলম বলে, কী লিখিব? লিখিব কি যাহা সত্য তাহা অনায়ত্ত?
যাহা মিথ্যা তাহাই মোহনীয় প্রজাপতি, স্বর্ণপত্র?

সাদা পাতা বলে, না, এই যে শায়িত প্রৌঢ় যে একদা শিশু ছিল, বালক ছিল, যুবক ছিল, প্রেমিক ছিলতাহার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নী সকলের পরিচয় লিখ। একটি কাহিনি শুধু একটি বৃক্ষ নয়-তাহার শিকড়, কা-, শাখা-প্রশাখা, পত্র-পুষ্প সবকিছুই কাহিনির অন্তর্গত, অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিষয়টি স্মরণে রাখিয়াই লিখ।

কলম ক্ষণকাল চিন্তা করল। তারপর লেখা শুরু করল এইভাবে।

এই প্রৌঢ় তাইমুর হাসান, পিতা মোহাম্মদ ফজলুল হাসান, সাকিন, খালিশপুর, খুলনা। কাহিনির প্রথম পর্বগুলিতেই তাইমুরের জীবনকথা, তাহার পিতা-মাতা, ভ্রাতা-ভগ্নী, তাহাদের কর্মকা-, জীবনধারা উন্মোচিত হইয়াছে। শুধু পিতা ফজলুল হাসান ও মাতা জয়ীতা বা জয়তুন্নেসা সম্পর্কে যৎসামান্য আভাস দেওয়া হইয়াছে। জয়ীতা বাড়ির জয়ীমা এবং ফজলুল হাসান সম্পর্কে যদি কিছু না বলা হয় তাহা হইলে এই কাহিনি অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে, অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে উপন্যাসের সকল চরিত্র, ঘটনা ও স্মৃতিসমূহ।

চলবে

 

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব তিন)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পাঁচ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ছয়)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব সাত)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আট)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top