সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১২) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০১:৩৭

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ২১:৫২


বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ফুলগাছটির দিকে তাকিয়ে থাকে অঞ্জন। এই সময়টুকু ওর কাছে বড় ধরনের বিনোদন। ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে জারুলগাছটি। বেগুনি রঙের চমৎকার ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকা ওর কাছে এক মনোরম দৃশ্য। নিজেকে বলে, নিজেকে আনন্দে ভরিয়ে রাখার জন্য এমন দৃশ্য নিজেই তৈরি করে ও। কারো দিকে তাকিয়ে থাকে না সুন্দর দৃশ্যের জন্য।
প্রথম দিকে মা ওর দাঁড়িয়ে থাকা দেখে বলতেন, কী হয়েছে রে? এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন অঞ্জন?
-মাগো এই ফুলের দৃশ্য নিয়ে কলেজে যাব।
-এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখতে হয়?
-প্রাণ ভরানোর জন্য তো দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
-পাগলামি করার আর জায়গা পাস না।
-এটা আমার পাগলামি না মা।
-তুই এত মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করিস যে, তা দেখে আমার মন ভরে যায়, কিন্তু এমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার মন খারাপ হলো।
-না, মা মন খারাপ করবেন না। মন খারাপ হলেও ঘরে থাকবেন, আমাকে বলবেন না। আমি ঠিকমতো পড়ালেখা করব।
-আয়, ঘরে আয়।
-না, আমি যাব না।
-কলেজে যাবি না?
-এখান থেকেই চলে যাব। এই যে আমার কলেজের ব্যাগ রেখেছি এখানে।
খালিদা খাতুন কথা না বলে ঘরে চলে যায়। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলে ঠাস করে শব্দ আসে অঞ্জনের কানে। ও বুঝতে পারে মা খুব রাগ করেছে। নইলে এত জোরে দরজা বন্ধ করত না। ও গাছের কান্ডে জড়িয়ে ধরে দাঁড়ালে বুকের ভেতর বাবা-মায়ের স্মৃতি ভেসে ওঠে। ও এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। স্কুল থেকেই খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশোনা করত। পড়ায় ফাঁকি দিয়ে সময় নষ্ট করত না।
বাবা-মা জানত তাদের ছেলেটি মেধাবী ছেলে না। ক্লাসে ফার্স্ট হতো না। কিন্তু খুব খারাপ রেজাল্ট করত না। ঠিকমতো পড়ে পরীক্ষা দিত। বাবা-মা ওর ওপর খুব খুশি ছিল। ক্লাসে দশজনের মধ্যে থাকত। খালিদা খাতুন প্রায়ই বলত, ছেলেটি বড় হয়ে বড় জায়গায় উঠবে।
মায়ের এমন আশাবাদী চিন্তা অঞ্জন বুকে ধারণ করত।
বলত, মা আমি বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই।
-বাবারে, তুই যা হতে চাইবি আমি আর তোর বাবা তা করব তোর জন্য। তুই এগিয়ে যা। তোর কোনো পিছুটান থাকবে না। তুই বড় হয়ে দাঁড়ালে তা আমাদের গৌরব হবে। অঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলে, আমার জন্য দোয়া করো মাগো।
-এটা কি তোর বলতে হবে রে সোনার ছেলে। দোয়া তো সব সময় করি। তোর বাবাও করে। তোর বাবা তো তোকে ছাড়া আর কিছু ভাবে না। যা কিছু চিন্তা তা সব তোর জন্য।
-মাগো, এইসব আমি বুঝি। আপনাদের দিকে তাকালে বুঝতে পারি আপনাদের দৃষ্টি আমার শরীর ছুঁয়ে বুকের ভেতর ঢুকে যায়। আমি তখন বাইরে গিয়ে আনন্দে লাফালাফি করি।
খালিদা খাতুন গভীর আনন্দে ছেলের মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে। বেঁচে থাকার সুন্দর ছবিগুলো হƒদয়জুড়ে ধারণ করে রাখলে মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয় অবসরের বিনোদনে। দু’জনেই একই ভাবনায় আলোড়িত হয়। ভাবে আজকে সময়ের হিসেব দরকার নেই। জড়িয়ে ধরে রাখাই বড় সময়। যতক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখা যায়, ধরে রাখা হোক। মা-ছেলের নিঃশ^াস ভাসে বাতাসে। দু’জনের কেউ কাউকে ছাড়ে না। তখন তোজাম্মেল বাসায় ঢোকে।
মা-ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, তোদের দেখে মনে হচ্ছে আনন্দের খবর আছে। অঞ্জন আনন্দের খবর কী রে?
-বাবা, আপনাকে জড়িয়ে ধরা আমার আনন্দের খবর।
-বলিস কী রে? শুভ খবরটা বল আমাকে।
-মা বলবেন। আমি বাইরে গেলাম। কলেজে যাচ্ছি।
অঞ্জন চলে গেলে, বাবা-মা দু’জনে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওকে আর দেখা না গেলে তোজাম্মেল চোখ ফেরায় খালিদার দিকে। মৃদুস্বরে বলে, অঞ্জনের পরে আমাদের দুটো ছেলেমেয়ে হয়ে মরে গেল। আমাদের ভাগ্য খারাপ। আরও দুটো ছেলেমেয়ে থাকলে ঘর এমন শূন্য থাকত না। চলো আমরা দু’জনে বিছানায় যাই। আমি আরও বাচ্চা চাই। তুমি না করতে পারবে না।
-বাচ্চা হলে তো এতদিনে হয়ে যেত। হলো না তো। বিছানায় তুমি তো আমাকে ছেড়ে দাওনি। আমিও চেয়েছি বাচ্চা হোক। হলো না। নতুন করে আর ভাবতে হবে না।
-না, আমি ভাবব। চেষ্টা করে যাব। আমি বাচ্চা চাই।
-আমাকে দিয়ে না হলে তুমি কি আবার বিয়ে করবে?
-বাজে কথা বলছ কেন?
-বাজে কথা না। তোমাকে যাচাই করছি।
-খবরদার! বাড়াবাড়ি করবে না।
-তুমি আমাকে শাসাচ্ছ কেন?
-মোটেই শাসাচ্ছি না। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
-এটা কি ভালোবাসার কথা হলো?
-তুমি গ্রহণ না করলে আমি স্যরি খালিদা। এসো, দরজা বন্ধ করো। তোমার ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করে রাখে। আমি মনে করি তোমাকে আমার জীবনে পেয়ে আমি ধন্য।
তোজাম্মেল দু’হাতে বউকে জড়িয়ে ধরে। খালিদা উপভোগ করে তার প্রাণের টান। দু’জনে শোবার ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তোজাম্মেল স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলে, বিছানা তো তোমার কাছে নদী? আজকেও কি তাই মনে করছ?
-করব না কেন? একশবার করছি। বিছানার আবেগ থেকে আমি নিজেকে আলাদা করব না। আমরা এখন নদীতে ডুবসাঁতার দেব। ডুবসাঁতারে ভেসে যাবে কামনার ঘোলা জল।
-ঘোলা জল কেন?
-এটাই আমার কাছে মজার কথা। আমি অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করব না।
-বুঝেছি, বুঝেছি। তুমি কি কবিতা লিখতে চাও?
-সন্তানের জš§ আমার কাছে কবিতা। তুমি তো জানো তা। এখন কথা বন্ধ করো। এসো ডুবসাঁতারে চলে যাই।
হা-হা করে হাসে তোজাম্মেল। হাসতে হাসতে বলে, তোমার ভাষা শুনে খুব মজা পাই। সেজন্য ডুবসাঁতার আমার খুব আনন্দের।
খালিদা হাসতে হাসতে বলে, আনন্দে নিজেকে তৈরি করে ফেলেছি। চলো ডুবি।
-ওহ দারুণ। তোজাম্মেলও নিজেকে ডুবিয়ে ফেলে।
বিশাল হয়ে ওঠে শরীর। দু’জনের আকর্ষণে বিশাল হয়ে ওঠে শরীর। স্রোতের তোড়ে মেতে ওঠে বিছানার শরীর। নিঃশব্দ হয়ে যায় ঘর। বিছানার নড়াচড়া শব্দ মাত্র না, তা আনন্দের ঢেউ। দু’জনে সে ঢেউয়ে ডুবে যায়। কত সময় পেরিয়ে যায় সে খবর ওরা রাখে না। ডুবসাঁতার শেষ হলে খালিদা বলে, আমি উঠব না। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব।
-আমিও থাকব।
তোজাম্মেল কাত হয়ে খালিদাকে জড়িয়ে ধরে বলে, চলো ঘুমাই।
-না, ঘুমাব না। ভাবনার নদীর পাড় দিয়ে হাঁটব। দেখব নদীর ভেতর থেকে একটি শিশু উঠে আসে কিনা। সেই শিশু পেলে ওকে বুকে নিয়ে নদীর পানির ওপর দিয়ে হেঁটে যাব। দেখব তুমি দাঁড়িয়ে আছ নদীর অপর পাড়ে। আমাকে দেখে তুমি ছুটে এলে আমার কাছে। গিুটিকে কেড়ে নিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলে। বললে, ডুবসাঁতারে পাওয়া মেয়েটি-
-থাক, থাক আর বলতে হবে না। এখন আমি নিঃসঙ্গ মুহূর্ত চাই। তোমার শরীর আমার ভালোবাসার নদী। দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে শারীরিক অনুভবের মাত্রা বাড়াই।
-তোমার শরীর আমার ফসলের ক্ষেত। আমি এখন এই ক্ষেতের আল দিয়ে অনুভবে হেঁটে যাব। শুধু বাতাস আমাকে ভালোবাসার পরশ দিয়ে যাবে। সেই পরশ এখন তুমি। খালিদা তোজাম্মেলকে চুমু দিয়ে বলে, আজকে আমাদের মনের দরজা খুলে গেছে। আমরা যে কত কিছু ভাবছি। কবিতা লেখার ভাবনা।
তোজাম্মেল আর কথা বলে না। ঘরের নিস্তব্ধতা প্রগাঢ় হয়ে যায়। দু’জনে চোখ বুঁজে রেখে অনুভবের মাত্রাকে গাঢ় করে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।
চলবে

 

শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৩)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৪)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৫)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৬)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৭)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৮)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৯)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১০)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১১)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top