সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
১৭ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৩৭

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:৩৯

ছবিঃ অমর মিত্র

 

উদ্ধবনারায়ণ এসেছে মার্জারিকা চতুরিকার গৃহে। অঘ্রান পূর্ণিমার রাতে তার ঘরে আসবে বলেছিল উদ্ধব, সে আর কোনো অতিথি নেয়নি। দুয়ার থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে কতজনকে। এর ভিতরে এক মগধী বণিকও ছিল। অনেক স্বর্ণমুদ্রা দিতে চেয়েছিল। সাহস হয়নি চতুরিকার যে তাকে ঘরে নেয়। উদ্ধবনারায়ণকে ক্রুদ্ধ করে সে এই এই নগরে থাকতে পারবে না, শেষে স্থান হবে উজ্জয়িনীর বাইরে বারবণিতা পল্লীতে। অথচ সেই মগধের বণিককে পান্থশালা থেকে অনেক ছলাকলা করে ডেকে এনেছিল বীট মহাপার্শ্ব, গণিকার প্রতিনিধি। বণিক মানুষটা নাকি অতি সজ্জন। মথুরা যাওয়ার পথে উজ্জয়িনীতে  যাত্রা-বিরতি দিয়েছিল। প্রচুর অর্থের অধিকারী। রুচিমান মানুষ। সাত ঘরে ঘুরিয়ে চতুরিকাকে শেষ পর্যন্ত পছন্দ করাতে পেরেছিল বীট মহাপার্শ্ব, চোখ মটকে চতুরিকাকে বুঝিয়েছিল দোহন করে নেওয়ার মতো ধনী।

উদ্ধব পূর্ণিমার রাতে আসেনি। প্রদিপদে এসেছে। উদ্ধব বলে, আচমকা তাকে নিয়োগ করা হয়েছিল মহাকাল মন্দিরে নজরদারি করার জন্য।

পূর্ণিমায় কত পুণ্যার্থী না আসে মহাকালে, তাদের মধ্যে মন্দ মানুষও থাকতে পারে, সেনাধ্যক্ষ কুমার বিক্রম তাকে দায়িত্ব দিয়েছিল মহাকাল পরিদর্শনে, রাজা রানীর যাওয়ার কথা ছিল মহাকালে, গন্ধবতী নদীতে ময়ূরপঙ্খী নাও সাজানো হয়েছিল, বীণা হস্তে প্রস্তুত হয়েছিল বাজিয়েরা, মন্দির প্রাঙ্গণে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল দুপুর থেকে, দেবদাসীরা নৃত্যের জন্য তৈরি হয়েছিল, গণিকা দেবদত্তা তো গিয়েছিল সন্ধ্যায়।

চতুরিকা জিজ্ঞেস করে, রাজা কখন গেলেন, রানী তাঁর দক্ষিণে ছিলেন না। বামে?

উদ্ধব বলে, পানপাত্র সাজাও দেখি।

চতুরিকা গরগর করে ওঠে, কাল আর আজ দু’দিনেরটা পুষিয়ে দিতে হবে সত্রীমশায়। 

উদ্ধব মনে মনে বলে, মগধী বণিকের সঙ্গে ফূর্তি মারাতেই পারতিস মাগি, চাঁদ ওঠার একপ্রহর বাদে তো চলেই এলাম মহাকাল থেকে, তখনো তো আসতে পারতাম, আসিনি, নতুন একটা মেয়েমানুষ পুরোহিতের কাছে থেকে পেলাম, পুরোহিতের বারবাড়িতে খুব ফষ্টিনষ্টি হলো, কিন্তু কচি মেয়েমানুষের ঝামেলা অনেক, এমন কেঁদে ভাসাল যে ইচ্ছেটাই মরে গেল, যদি শুনতাম মগধী বণিক ঢুকেছে তোর ঘরে, আজ তোর কপালে দুঃখ ছিল।

চতুরিকা বলে, দেবদত্তার ঘরে শ্রেষ্ঠা সুভগ দত্ত এলেন তো কত রাত্তিরে, দেবদত্তা মহাকাল থেকে ফেরার পর।

উদ্ধব মনে মনে বলে, আমার তো ওঁর দশা না, পুরুষ মানুষ, ধনসম্পত্তি অঢেল, দরকারে যবন দেশ থেকে খাঁটি যবনী নিয়ে আসতাম, দেবদত্তার প্রেমে পড়েছে শ্রেষ্ঠী, গণিকাও কেমন! গুছিয়ে নেবে, পারছে না।

চতুরিকা বলে, রাজা-রানীর কথা তো বললে না।

উদ্ধব দেখল আজ গণিকার লাস্য যেন বেশি। অলক্তরঞ্জিত পা দু’খানি মেলে ধরেছে উদ্ধবের সামনে। উদ্ধব ঈষৎ চঞ্চল হয়। চতুরিকার পায়ের পাতায় তর্জনী ছোঁয়ায়, বিড়বিড়িয়ে বলে, রাজা-রানী তো আসেননি।

সে কী, কেন? চতুরিকা না জানার ভান করে।

উদ্ধব জবাব দেয় না। রাজা-রানী নিয়ে আলোচনা এই গণিকাপল্লীতে বিধিসম্মত নয়। সে হলো রাজকর্মচারী, কার কী উদ্দশ্য তা সে জানে না। কে কোথায় বসে আছে গুপ্ত কথা শুনতে তা কে জানে। সে কোমর থেকে ক্ষুদ্র রেশম পেটিকা বার করে। চতুরিকার পায়ের কাছে রেখে দেয়। চতুরিকা দেখেও দ্যাখে না, আবার জিজ্ঞেস করে, রাজা-রানী যাননি?

উদ্ধব বিরক্ত হয়। গণিকার এই কৌতূহল ভাল নয়। তার কেমন সন্দেহ জাগে। সে আচমকা দৃষ্টি বদল করে চতুরিকাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। অঙ্গবিদ্যা প্রয়োগ করতে থাকে। গণিকার চোখদুটিকে নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করতে থাকে। কী বলতে চায় চতুরিকা? মগধী বণিককে ঘরে নেয়নি, তাতে কিছু প্রমাণ হয় না। সেটা হয়ত ছল। মেয়ে-মানুষের মতো কূটবুদ্ধি কে ধরে? একে মেয়েমানুষ, তায় গণিকা, এদের মতো চতুর কে হয়? মেয়েমানুষ অতি খল প্রকৃতির হয়, যত শক্তি ওই মাথার ভিতরে। মুনি-ঋষিরা কী বলে গেছেন, না নারীই বিপদের আধার। কী না করতে পারে মেয়েমানুষ, তাকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে অনায়াসে। ভাবতে ভাবতে উদ্ধবনারায়ণ সতর্ক হলো আরো। এই মেয়েমানুষ ফূর্তি ছাড়া কোন কাজে লাগে? উদ্ধব সন্দেহের চোখে চতুরিকাকে দেখতে থাকে। শ্যামবর্ণের যুবতী সম্পর্কে কী বলে গেছেন ঋষি পণ্ডিতরা? মনে পড়ে না উদ্ধবের, তবে সে ভেবে নেয় ভাল কথা তো বলেননি তাঁরা নিশ্চয়। সুন্তনী, সুনিতম্বিনী নারী কামের আধার, তার যদি এমন মেঘেরও মতো রঙ হয়। কামই তো সব সর্বনাশের গোড়া। উদ্ধব চতুরিকাকে পর্যবেক্ষণ করে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। এই গণিকা হস্তিনী প্রকৃতির, প্রবল কামুক, তাতে কিছু প্রমাণও অবশ্য করা যায় না। উদ্ধবের মনে হচ্ছিল যদি কিছু প্রমাণ করা যেত সন্দেহ সত্যি হতো, তাহলে কী লাভই না হতো। যদি সে ধরতে পারত চতুরিকা গণিকা কোনো চক্রান্তে লিপ্ত, তাহলে সোজা গণিকালয় থেকে বন্দিশালায়, বন্দিশালা থেকে দু’হাত ছেদন করে নগরের বাইরে। তার অবস্থান এক্ষেত্রে ভাল হতো রাজসভায়, পদোন্নতি ঘটত। তার ভাগ্যে কি তা হবে? একটা মেয়েমানুষ গেলে দশটা মেয়েমানুষ পাওয়া যাবে, কিন্তু চক্রান্তের হদিশ পাওয়া কি সোজা কথা? এই যে এতদিন সে রাজকর্মচারী হয়েছে, সত্রীর কাজ করছে, একজনও চক্রান্তকারীকে কি বন্দি করতে পেরেছে? পারলে তো হয়েই যেত। গম্ভীরার ওই কন্যাটি, গন্ধবতী তার পায়ে এসে মুখ ঘষত। ক্ষমতায় কী না হয়? রাজশক্তির চেয়ে বড় শক্তি কী আছে এই পৃথিবীতে?

উদ্ধব জিজ্ঞেস করে, বণিক কি মগধের ছিল, না পশ্চিমদেশীয় যবন?

চতুরিকা খিল খিল করে হাসে, খোঁজ নিয়ে দ্যাখো, মহাপার্শ্বর কাছে গিয়ে খোঁজ নাও কোন পান্থশালায় উঠেছে সে, বড় পছন্দ হয়েছিল আমাকে, শুধু তোমার জন্যেই ফিরিয়ে দিলাম, হ্যাঁ গো, বললে না রাজা-রানী কেন এলেন না?

উদ্ধবের ভিতরে সন্দেহ ঝিলিক দেয়, সতর্ক হয়, বলে, রানীর শিরঃপীড়া হয়েছিল।

কে বলল?

অন্তঃপুরের খবর, তুমি পেটিকাটি খুলে দেখলে না?

চতুরিকা হাত দিয়ে পেটিকাটি একধারে সরিয়ে দিয়ে অনাবৃত জংঘা, অলক্তরঞ্জিত পদযুগল এগিয়ে দেয় উদ্ধবের দিকে, খিলখিল করে হাসে, আমিও ওই মগধী বণিককে বললাম, শিরঃপীড়া হয়েছে, শরীর অসুস্থ, ভান করলাম, তাতে সে কী করে আসে?

উদ্ধব অবাক হয়ে চতুরিকাকে দেখছে। কী বলতে চায় চতুরিকা তা যেন ধরেও ধরতে পারছে না। চতুরিকার দিকে ঝুঁকে তার পুষ্ট ঊরুর উপর হাত রাখে বস্ত্রের উপর দিয়ে। বিড়বিড়িয়ে বলে, কী হয়েছে রাজঅন্তঃপুরে, কে জানে তা, সন্তানহীন রাজার জন্য অবন্তী দেশ ছারখার হয়ে গেল, দ্বিতীয়বার বিবাহও করল না রাজা, এ কি ঠিক হলো?

আচমকা এই কথায় চতুরিকা অবাক হয়ে উদ্ধবনারায়ণকে দেখছে। সহসা এই কথার মানে? বললই বা কেন? তার কথার সঙ্গে রাজা-রানীর তো কোনো সম্পর্কই নেই।

উদ্ধব বলে, এ বড় কু-লক্ষণ, সন্তানহীন রাজা কি রাজ্যে সুখ-সমৃদ্ধি আনতে পারবেন, এসব কথা তো হাটে মাঠে শুনি, দেখছ না কীরকম অনাবৃষ্টি চলছে, রাজার কোনো অধিকার নেই সিংহাসনে বসে থাকার।

চতুরিকার চোখের মণি জ্বলজ্বল করে ওঠে। ওষ্ঠাধারে জেগে ওঠে হাসির রেখা, সে বলে, ঠিকই তো রাজার দায়িত্ব অনেক, বৃষ্টি নেই, যাগযজ্ঞ হচ্ছে কই?

উদ্ধব বলে, রাজার সুশাসন নেই।

চতুরিকা বলে, তাই তো, অবশ্য তা বোধহয় অন্তঃপুরে।

অবন্তীর মানুষের সুখ নেই, ঘুমও নেই। 

চতুরিকা মাথা দোলায়, কই আমার তো খুব ঘুম হয়।

অবন্তীর সিংহাসন এবার অন্যের হাতে যাবে, কে যোগ্য বলো দেখি, সেনাধ্যক্ষ না নগরের সবচেয়ে ধনী, শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত, একজন শ্রেষ্ঠী যদি সিংহাসনে বসেন ব্যবসা-বাণিজ্যের খুব উন্নতি হবে, দেশের অবস্থানও ভাল হবে, ধনী ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে যাবে

চতুরিকার মুখের ভাব বদল হলো। বিস্মিত হয়েছে সে। বিস্ময় শেষ হতেই হি হি করে হেসে ফেলে কী কী যে বলো তুমি, তুমি  বড় চালাক, আমার নাম চতুরিকা, আর তুমি হলে চতুর চূড়ামণি সত্রীমশায়, আমাকে পরীক্ষা করতে এসেছ ফূর্তির কাজে এসে, অবন্তীর অধিপতির তুল্য গুণবান রাজা এই ভূ-মণ্ডলে নেই, তিনি কবি মনের মানুষ!

উদ্ধবের মুখের রং বদল হয়ে গেছে। ইস কী ভুলই না করল? তার কৌশলটি যেমন প্রকাশ করে দিল চতুরিকা গণিকার কাছে, তেমনি আরো জানিয়ে দিল নগরে কী সব কথা উঠছে। সে এসেছে আনন্দ করতে। গত রাতটি খুব খারাপ গেছে। ধর্ষণে সুখ আছে বটে, কিন্তু সেই সুখ ধুয়ে গেছে মেয়েমানুষটির বিলাপে। তার চেয়ে এখানে এলে অনেক ভাল হতো। কী আশ্চর্য! সে গণিকাকে পরীক্ষা করতে গেল কেন? গণিকা কি রাজ সিংহাসনের দাবীদার? না সিংহাসনের বসার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে মনে? ওই যে চতুরিকা তার পদযুগল থেকে অনাবৃত অঙ্গ ঢেকে নিয়েছে মেখলায়। উত্তরীয়তে আড়াল করেছে দেহখানি। উদ্ধব বোঝে তার দানে ভুল হয়ে গেছে। গণিকাই তাকে পরীক্ষা করল এত সময়। 

উদ্ধব হাসতে চেষ্টা করে, পরীক্ষা করব কেন, তুমি পানপাত্রে সুরা ঢাল দেখি, ওই পেটিকাটি খুলে দ্যাখো চতুরিকের জন্য কী এনেছি আমি, মগধী বণিকও দিত না এই অলংকার।

কী এনেছো, চন্দ্রহার?

খুলেই দ্যাখো না।

কণ্ঠহার, বাজুবন্ধ?

খোল না কেন?

স্বর্ণতিলক, পায়ের নুপুর, মাথার মুকুট, সোনার বলয়?

আহা দ্যাখোই না।

চতুরিকা অবহেলায় পেটিকা উন্মোচন করে। ভিতর থেকে মুক্তোর কণ্ঠহার বেরিয়ে আসে, সে অবহেলার সঙ্গে মুক্তোগুলি পর্যবেক্ষণ করে।

পছন্দ হয়েছে তো মার্জারিকে? উদ্ধব চতুরিকার গণ্ডদেশ স্পর্শ করে।

ধীরে ধীরে মাথা দোলায় চতুরিকা, এ আমার প্রয়োজন নেই।

চমকে ওঠে উদ্ধবনারায়ণ। বলে কি গণিকা? সে কি তাকে চাপ দিয়ে আরো কিছু নিতে চায়? মুক্তোর হার পছন্দ হবে না তো কী পছন্দ হবে? তাহলে মগধী বণিক ছিল এখানে? ঢুকেছিল ভিতরে? সবটাই লুকোচ্ছে তার কাছে চতুরিকা। আবার সন্দেহ জাগে উদ্ধবের মনে। সন্দেহ করাই তার পেশা। সন্দেহ করতে পারলে সে খুশি হয়। এ সন্দেহ যদি সত্যি হয়, ভিনদেশী বণিকের সঙ্গে রাজার বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে গণিকা, তার পদোন্নতি হবেই। এমন মেয়েমানুষ কত জুটবে। কার্তিকপূর্ণিমার মেলায় যেমন পশুপাখি জোটে, তেমনি জোটে মেয়েমানুষ, মেলাতেও বিক্রি হয়, এমনিতেও মেলে।

চতুরিকা বিড়বিড় করে, মহালতা, চন্দ্রহার, স্বর্ণতিলক, বাজুবন্ধ, বলয়, নুপুর কণ্ঠহারই বা কত রকমের! সব অলঙ্কারের নামও জানিনে আমি, তুমি দেখবে সত্রীমশায়?

সন্দেহ ঘনীভূত হলো। উদ্ধব তার সন্দেহভরা চোখে চাতুরিকাকে লক্ষ্য করতে থাকে। সন্দেহ করতে পারলে তার সুখ। সন্দেহ গভীর হলে সে যেন কাম-জর্জরিত হয়ে ওঠে। সর্ব অঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়। দুই ঠোঁট শুকিয়ে যায়। জিভের জলে ঠোঁট ভেজায় উদ্ধবনারায়ণ। মনে মনে বলে, হে মহাকাল, সন্দেহটা যেন সত্যি হয়। নারী অবলা জীব, তাকে সন্দেহ করতে পারার চেয়ে সুখ আর কিছুতে নেই। কল্পনা করল উদ্ধব, গণিকা চতুরিকা রাজার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে বন্দি হয়েছে। বন্দিশালায় সাত শকুন দিয়ে খাওয়াবে বিশ্বাসঘাতিনীকে, ধর্ষণ করাবে রক্ষীদের দিয়ে। রাজার বিরুদ্ধ চক্রান্ত! তার চেয়ে বড় পাপ কী আছে? গণিকা,  মেয়েমানুষকে শাস্তি দেওয়া কত সুবিধে। পণ্ডিত, ব্রাহ্মণেরা তো বলেইছেন গণিকাকে বিশ্বাস করা যায় না। উদ্ধবের শ্বাস প্রশ্বাস গাঢ় হলো উত্তেজনায়। যদি সত্যি হয় সন্দেহ, তাহলে গণিকা চতুরিকার দুটি কানই কেটে নেওয়া যাবে। এই কাজ করতে পারলে অবন্তীর রাজসভায় তার মর্যাদা বাড়বে, গণিকালয়ে তার সেবিকার সংখ্যা বাড়বে। সন্দেহ সত্যি হবেই, না হলে যে চতুরিকা বিনামূল্যেই তাকে দেহ দিতে অভ্যস্ত, একটি দু’টি স্বর্ণমুদ্রা পেলে বর্তে যায়, সে কিনা একশত মুক্তার লহরী মেলানো কণ্ঠাহার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কী অপরূপ এই মুক্তাহারের গড়ন, দীপাবলীতেই দেওয়ার ইচ্ছে ছিল উদ্ধবের। সংগ্রহ করা হয়নি। বিনামূল্যে সংগ্রহ তো করতে হবে। এই কণ্ঠহার, এই দেবছন্দ সে আর একটিও সংগ্রহ করতে যাচ্ছে গন্ধবতীর জন্য। উদ্ধব সন্দেহে উদ্বেল হয়ে ওঠে। এখন কৌশলে নামটি জেনে নিতে হবে, কে হয়েছে চতুরিকার নতুন নাগর। কোন বিদেশী? সে কি এখনো আছে এই নগরে? দুজনকে একসঙ্গে বন্দি করতে পারলে তার কপাল খুলে যাবে। কই, যে সব অলঙ্কারের কথা বলছে চতুরিকা, কোথায় তা? কী বলছে গণিকা, না পূর্ণিমার রাতে সে এত অলঙ্কার পেয়েছে যে সমস্ত দেহই আবৃত হয়ে যাবে। ফুলের অলঙ্কার তো দূরের কথা, গায়ে আবরণও লাগবে না। এত রকমের কণ্ঠহার পেয়েছে সে, তাতে তার বুক ঢেকে যাবে, হি হি করে হাসছে চতুরিকা, বক্ষবাসের প্রয়োজন হবে না যেন। সে যেন রাজার রত্নভাণ্ডারের সব পেয়ে গেছে গত রাত্রিতে। সোনায় মুড়ে যাবে তার দেহ। অপেক্ষা করছিল উদ্ধবের জন্য, তার কাছেই সাজবে সে ওই অলঙ্কারে।

এ কী কাণ্ড! বিস্ফারিত হয়ে যায়। উদ্ধবের দুই চোখ। উত্তাপ বাড়ছে শরীরে। চতুরিকা কি গণিকা হওয়ার যোগ্য? নৃত্য যা জানে, তা কিছুই না। খাঁটি রসিকের হাতে ধরা পড়লে কবে ও এই নগরের বাইরে চলে গিয়ে বেশ্যাবৃত্তি করত। আছে সে গণিকা দেবদত্তার অনুগ্রহ নিয়ে, আর উদ্ধবনারায়ণের কৃপায়। উদ্ধব সে কথা কি স্মরণ করায় না তাকে? বারবার বলে না কি সেনাধ্যক্ষের কৃপাধন্য সে, সে কৃপা করছে বলে চতুরিকা আছে। হ্যাঁ, এই গণিকার যৌবন অতি মোহময়। এই যৌবন ভোগের পক্ষে অতি উত্তম। কিন্তু যৌবন কার না থাকে, যৌবনে কে না সুন্দরী হয়, কুকুরী পর্যন্ত। যুবতী নারী তো ভোগেরই বস্তু। তার নিজের কি অভাব আছে যুবতীর? রাজশক্তির অংশ সে। এসব এমনিই জোটে, গত রাতে যেমন জুটেছে। মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের চেলা জোগাড়ে বুড়ো বামুন পর্যন্ত ইচ্ছেমত ভোগ করতে পারে, প্রবীণ পুরোহিত না হয় বাদই থাকল। চতুরিকাকে অত অলঙ্কার কে দিল? ও কি তার যোগ্য? শুধুই শৃঙ্গার কর্মের জন্য, রতি নিপুণতার জন্য এত পাওয়া যায়?

চতুরিকা উঠেছে। ভিতরের ঘর থেকে একটি রেশম পেটিকা বয়ে এনে মেঝেয় ফেলেছে। ধাতু আর পাথরের সংঘাত হয়ে বিচিত্র এক শব্দ শোনা গেল। চমকে ওঠে উদ্ধব। ঘুরে তাকায়। অর্গল রুদ্ধই আছে। এই রেশম পেটিকাই তো খুব দামী। এ তো যে কোনো মানুষ ব্যবহার করে না। সাধারণ নাগরিক এই পেটিকা ভরে অলঙ্কার দেবে? তাহলে সুর্যোদয় পশ্চিমে হতো।

উদ্ধব শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করে, সব অলঙ্কার?

হ্যাঁ খুলে দ্যাখো।

স-অ-অ-ব! বিস্ফারিত দুই চোখ নিয়ে উদ্ধব গণিকাকে দ্যাখে। এখন একেবারে নিরাভরণ, শুধু পুষ্প অলঙ্কারে সেজেছে চতুরিকা। সে পেটিকার দিতে তাকায় না। দুহাতে চতুরিকাকে আকর্ষণ করে, সব সোনাদানা, মণিরত্ন?

দ্যাখোই না তুমি। খিলখিল করে হাসে চতুরিকা, সমস্ত জীবনেও এত গয়না জোগাড় করতে পারতাম না, তুমি আমি কেউ দেখিনি।

মনে মনে বলে উদ্ধব, তুই না দেখিস, আমি যে দেখব না ভবিষ্যতে একথা তুই বলিস কী করে মাগি! বিড়বিড় করতে করতে উদ্ধব চোরা চাহনি দিয়ে পেটিকার খোলামুখ একঝলক দ্যাখে। ঘরে প্রদীপের আলো, পেটিকাটিতে আলো পৌঁছচ্ছে না, কিন্তু পেটিকার ভিতর থেকে যেন আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে। এই তো শেষ রাত্রি! এত অলঙ্কার যে পেয়েছে চতুরিকা, বিনিময়ে এমন কিছু করেছে যা অপরাধ। অপরাধ ব্যতীত এ জিনিস জোটে না। উদ্ধবনারায়ণ আরো তপ্ত হয়ে উঠে চতুরিকার বক্ষবাস ছিঁড়ে ফেলে। আর্তনাদ করে ওঠে চতুরিকা, কী করছ, আহ্, তুমি এতো ব্যস্ত কেন, পানপাত্র সাজাই, সুরা পান করো। চতুরিকা জোর করে উদ্ধবের আকর্ষণ মুক্ত হয়ে পানপাত্রে সুরা ভরতে থাকে। তখন উদ্ধব সতর্ক হয়ে পেটিকাতে হাত দেয়। হাতে যেন আগুনের ভাপ লাগে। দু’হাত ভরে অলঙ্কার পেটিকামুক্ত করে মেঝেয় রাখতে থাকে।  চতুরিকা যা বলছিল, এ যে তার চেয়ে বেশি। এই অলঙ্কার কে দিতে পারে? আচমকা উদ্ধবের গা ঠান্ডা হয়ে আসে। সন্দেহের উল্টো কিছুও তো হতে পারে? হয়ত রাজা, রাজা ভর্তৃহরিই এই গণিকাতে মুগ্ধ হয়েছেন। গত রাত্রে রাজা মহাকালে যাননি, তাহলে কি এখানে এসেছিলেন? কী সর্বনাশ! তহলে তো তার স্থান হবে বন্দিশালায়। রাজার গণিকার ঘরে কোন সাহসে ঢুকেছে সামান্য রাজকর্মচারী উদ্ধব? নাকি এসেছিলেন সেনাধ্যক্ষ কুমার বিক্রম? নাকি শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত? এঁদের ভোগ্যা যে রমণী, সে তো নিজেই একটি রত্ন বিশেষ। এত অলঙ্কারের চেয়েও তার দাম বেশী। উদ্ধব কুঁকড়ে যায় অলঙ্কারের বিভায়। ভীত চোখে একবার তাকায় গণিকার দিকে। সে নিজেই টের পায়নি এই গণিকার দাম। এত পেতে পারে? সে অতি নির্বোধ, যদি সন্দেহের কোনো কারণ থাকে তো চতুরিকা কি এই  পেটিকা তার সামনে নিয়ে আসত, এত অলঙ্কার দেখাতো তাকে? অধোবদনে বসে আছে উদ্ধবনারায়ণ। তার আগেই বোঝা উচিত ছিল। এখন তার মাথাটি গণিকার পায়ে ঠেকিয়ে পালিয়ে যেতে হবে এখান থেকে। যদি রাজার কাছ থেকে, সেনাধ্যক্ষ বা শ্রেষ্ঠীর কাছ থেকে ডাক আসে চতুরিকার? বক্ষবাস ছিন্ন করেছে সে। কী ভীষণ অপরাধ! এই অপরাধে তার দক্ষিণ হস্ত কেটে ফেলার আদেশও হতে পারে।

চতুরিকা সুরাপাত্র তার দিকে বাড়িয়ে ধরেছে, উত্তরীয়তে ঢেকে নিয়েছে উন্মুক্ত বক্ষ। ঝুঁকে পড়েছে তার সামনে, ডাকছে, কী হলো নাগর, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি সত্রীমশায়?

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top