সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব এগার) : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
২৭ মার্চ ২০২১ ২০:২৮

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৫০

 

আমার আশ্রয় জুটিয়াছে, অর্থ জুটিয়াছে। এখন আমার শরীরের অশেষ ক্লান্তি আর দুর্গন্ধ দূর করিতে হইবে। পোশাক যাহা পরিয়াছি তাহা আর পরিধানযোগ্য নহে। উদার রবিউল তাহার পাক জমিনের সবুজ রং এর এক প্রস্থ সালোয়ার, ঢোলা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, গেঞ্জি, তোয়ালে আমাকে উপহার দিয়াছে। এখন স্নান দরকার। আমার কক্ষ সংলগ্ন কোনো স্নানঘর বা টয়লেট নাই। ভবনটি চতুষ্কোণ আকৃতির, অনেকগুলি কক্ষ বিশিষ্ট দ্বিতল বাড়ি। নিচতলার পূজার ঘরটির সমস্ত মূর্তি, পূজার সকল নিদর্শন সরাইয়া তাহা এখন রাজাকারদের ঘর। বাড়িটির মধ্যস্থলে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত চত্বর। চত্বরের মধ্যস্থলে কারুকার্য খচিত একটি স্তম্ভের উপর তুলসি গাছ যেখানে মনোরঞ্জন বাবুর গৃহবধূরা সান্ধ্য প্রদীপ জ্বালাইতেন। চতুষ্কোণ ভবনের এক তালায়, দোতালায় রেলিং ঘেরা টানা বারান্দা। একতলা হইতে দোতালায় উঠিবার জন্যে দুই প্রান্তের মধ্যস্থলে দুইটি সিঁড়ি। আর একটি লক্ষনীয় বিষয়ভবনের প্রতি চতুষ্কোণে দুইটি করিয়া আধুনিক স্টাইলের টয়লেট ও বাথরুম। একটি পুরুষদের জন্যে, অন্যটি মহিলাদের জন্যে। দোতালার ঘরগুলিতেও হয়তো অ্যাটাচড বাথরুম, টয়লেট থাকিতে পারে তবে তাহা আমার দেখিবার উপায় নাই। কেননা দোতালায় উঠিবার দুই প্রান্তের দুইটি সিঁড়িপথের মুখে দুইজন বিহারী সশস্ত্র পাহাদার থ্রিনট থ্রি রাইফেল হাতে অলস ভঙ্গিতে সর্বক্ষণ চেয়ারে বসিয়া থাকে। রবিউল ছাড়া দোতালায় কাহারো যাইবার অনুমতি নাই। আমি অনুমান করিলাম সম্ভবত দোতালাতে কিছু ধৃত নারী এবং লুন্ঠিত অলঙ্কার ও দামি জিনিসপত্র আছে।

রবিউলের নানা ব্যস্ততায় সময় কম। সে আমার দেখ-ভালের সকল দায়িত্ব আনসার মোল্লা নামক খিদমতগারকে বুঝাইয়া দিয়া সার্কিট হাউজে চলিয়া গেল।

আমি আমার কক্ষের সন্নিকটেই একটি বাথরুমে স্নানের জন্য প্রবেশ করিলাম। বাথরুমে বেসিন, আয়না, কমোড, পানির পাইপ লাইন, শাওয়ার সবই আছে। কিন্তু অপব্যবহারে, পরিচ্ছন্নতার অভাবে ভীষণ দুর্গন্ধময়। আমি বালতি ভরা পানি দ্বারা কোনোক্রমে স্নান সারিলাম। রবিউলের দেওয়া সালোয়ার, পাঞ্জাবি পরিলাম। তোয়ালে দ্বারা মাথা মুছিতে মুছিতে সহসা চোখে পড়িল বেসিনের একপ্রান্তে কাহারো ব্যবহৃত দুইটি পুরাতন ব্লেড পড়িয়া আছে। চকিতে আমার মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। আমি ব্লেড দুইটি আমার পকেটের টাকার গুচ্ছের মধ্যে গুঁজিয়া রাখিলাম। স্নান ঘরের বাহিরে আসিয়া দেখি বারান্দায় আনসার মোল্লা খিদমতগার আমার অপেক্ষায়। প্রায় চল্লিশ বছর বয়সী এই লোকটি দেখিতে বেটে খাটো, গায়ের রং মিসমিসে কালো, মোটা ভূঁড়ি, মুখে দাড়ি। চোখ দুইটিই শুধু বড় বড়, কিছুটা মায়াময় যে কারণে তাহাকে কিছুটা সরল বা নির্বোধ মনে হয়। পরনে লুঙ্গি, গায়ে ময়লা ফতুয়া। কোমরে লুঙ্গির উপর শক্ত করিয়া গামছা বাঁধা। আমি তাহাকে  প্রশ্ন করিলাম, আনসার মোল্লা, তুমি মানুষটা কেমন?

আনসার মোল্লা হাত কচলিয়া উত্তর দিল, জে আমি গরীব মানুষ।

- এইখানে কী কর? রাজাকারি?

- জে না, আমি বাবুর্চি, আপনাগের খাদেম।

- বাথরুম এত অপরিষ্কার কেন?

- জে এইডে তো সুইপারের কাম। ওরাতো হিন্দু। এইখানে ভয়ে কেউ আসতি চায় না। তাছাড়া এইহানের গার্ড সায়েবরা ছাড়া এইসব বাথরুম আর কেউ ব্যাভার করে না।

যে রাজাকার দুইজন অলস ভঙ্গিতে চেয়ারে বসিয়া ছিল আমি তাহাদেরকে শুনাইয়াই উগ্রস্বরে আনসার মোল্লাকে বলিলাম, আমি তোমাদের কমান্ডার স্যারকে বলব, যাহারা এইসব বাথরুম ব্যবহার করিবে তাহারা যদি নিজ দায়িত্বে বাথরুম পরিষ্কার না করে তাহাদেরকে কঠিন শান্তি দেওয়া হইবে। আনসার মোল্লা, তুমি এইটা সবাইরে জানায়ে সাবধান করে দিবা। উচ্চস্বরের এই নির্দেশবাণী শুনিয়া চেয়ারে বসা রাজাকার দুইজন তাহাদের অলস ভঙ্গি হইতে একটু নড়িয়া চড়িয়া একটু সতর্ক ভঙ্গিতে বসিল।

আনসার মোল্লা ঢোক গিলিয়া বলিল, জে স্যার।

- আমার খানা কি রেডি?

- জে স্যার। ডাইনিং রুমি টেবিলি সাজিয়ে রাখিছি।

- কী খাবার আছে?

- জে বাসমতি চালির ভাত, রুইমাছ, ডাল, গরুর গোস্ত।

- গুড।

আমি ডাইনিং হলে প্রবেশ করিলাম। বেশ বড়-সড় ডাইনিং হল। অন্তত একত্রে বারোজন একসাথে আহারের টেবিল ও কুশন চেয়ার। কাচের দেয়াল আলমারিতে সারি সারি সুদৃশ্য তৈজসপত্র, ফ্রিজ সবই আছে। বোঝা যায় মনোরঞ্জন বাবু শুধু বিত্তেই ধনশালী ছিলেন না, রুচিতেও বিত্তশালী ছিলেন। পরিবারের সকলের সুখ স্বাচ্ছন্দের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই প্রাচীন ও আধুনিকতার সংমিশ্রণে এই সুরম্য ভবনটি নানাবিধ আসবাবপত্র ও উপকরণে সুসজ্জিত করিয়াছিলেন। কিন্তু কর্মচারী রবিউলের বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি ধন, মান, জীবন সবকিছুই হারাইয়াছেন। তবে রবিউল তাহার পাপ, তাহার বিশ্বাসঘাতকতা ও নিষ্ঠুরতার শাস্তি অবশ্যই ভোগ করিবে। প্রকৃতির প্রতিশোধ বা নিয়তি বলিয়া একটা কথা আছে। নিউটনের বিজ্ঞান কথাও আছে, ‘এভরি অ্যাকশন হ্যাজ ইটস ইকুয়াল অ্যান্ড অপোজিট রিঅ্যাকশন’ যাহা অমোঘ সত্য বলিয়া প্রমাণিত।

খাইতে বসিয়া আমি তাৎক্ষণিকভাবে একটি নাটকের ছক তৈরি করিলাম। পকেট হইতে একটি দশ টাকার নোট বাহির করিয়া আনসার মোল্লার দিকে বাড়াইয়া দিলাম। আনসার মোল্লা বোকার মতো আমার প্রসারিত টাকার হাত ও মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল। আমি বলিলাম, মোল্লা সাহেব, আমি নিজের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও খেতে বসলে খিদমতগারকে অগ্রিম কিছু বকশিস দিই। আর খাওয়া যদি মন মতো হয়, খিদমতগার বা বাবুর্চি আমাকে সন্তুষ্ট করে তাহলে তাকে আরো বিশ পঞ্চাশ বকশিস দিই। তা আমি কি এখন খেতে খেতে গল্প করতে পারি তোমার সাথে? আমি আবার গল্প ছাড়া খেতে পারি না। তুমি টাকাটা না নিলে আমার খাওয়াও হবে না, গল্পও হবে না।

 

আমি তাহাকে আরো দশ টাকা দিয়া বলিলাম, টাকাটা রাখো। নির্দোষ গল্পে পাপ নেই। তাছাড়া আমি তোমাদের কমান্ডার স্যারের বাল্যবন্ধু। আনসার মোল্লা সতর্ক কণ্ঠে বলিল, স্যার আমাগের গল্প করা নিষেদ আছে।

আনসার মোল্লা তাড়াতাড়ি টাকাটা নিয়া তার ফতুয়ার পকেটে গুজিল। আমি খাইতে খাইতে গল্প শুরু করিলাম।

- তোমার বাড়ি কনে মোল্লা ভাই?

- জে ঐ রুপাসো নদীর ওই পারে।

- আগে কী করতে?

- জে একটা হোটেলের বাবুর্চি ছিলাম। হোটেলডা এইসব ঝামেলায় পুড়ে গেল। আমি আর কী করি? প্যাটের দায়ে এইখানেই চাকরি নিলাম। স্যার, আমারে বেশি কিছু জিগোবেন না। মেহমানগের সঙ্গে কতা কওয়া নিষেদ আছে।

- তোমার রান্নার হাত বেশ ভালো। তা রোজই কি এই রকম মজাদার রান্না হয়?

নিষেধ সত্ত্বেও নিজের রান্নার প্রশংসায় আনসার মোল্লা বোধহয় খুশিই হইল।

বলিল, না তা হয় না। আপনি স্যারের বন্ধু বলে স্যারের নিদ্দেশে এট্টু সামান্য ইসপিশাল করলাম। কমান্ডার স্যারের জন্যি তার হুকুম অনুযায়ী যহন যেই রকম চান তাই করি।

আমি রুই মাছের কাঁটা বাছিতে বাছিতে হঠাৎ প্রশ্ন করিলাম, এই বাড়ির ঐ সব রাজাকার গার্ডের জন্যে কি আলাদা রান্না হয়?

- জে, সাধারণ রুটি, ডাল, ভাত, আর গরুর গোস্ত।

- আর দোতালায় যারা থাকে তাদের জন্যে?

এ ধরণের প্রশ্নে আনসার মোল্লা চমকিয়ে উঠিল। ভীত কণ্ঠে বলল, স্যার এইসব বেকায়দা আলোচনায় কঠিন নিষেদ আছে। এইহানে দেয়ালেরও কান আছে। আমি জানে মারা পড়ব স্যার।

আমি মাছের মোটা কাটা চুষিতে চুষিতে বলিলাম,

- না, না তুমি বিপদে পড়বে এমন কোনো কথা, প্রশ্ন করব না। এই আমি যা বলতে চাইছিলাম মানে এইখানে তো প্রায়ই নতুন নতুন মেহমান আসে, আর্মি স্যাররা আসেন তাদের মেহমানদারি, আদর-আপ্যায়নের জন্যে কিছু স্পেশাল খানা-পিনা তো করতেই হয়। নাকি মোল্লা মিয়া?

মোল্লা তাহার দাড়ি চুলকাইয়া বলিল, তা করতি হয় বটে। কিন্তু ...

 

আমি বাম হাত পকেটে ঢুকাইয়া আরো একটি দশ টাকার নোট মোল্লার হাতে গুঁজিয়া দিলাম। মোল্লা সন্ত্রস্তভাবে এদিক ওদিক তাকাইয়া নোটটা পকেটে ভরিয়া নিম্নস্বরে বলিল, স্যার, যাগের কতা আপনি বলতি চাচ্ছেন তারা হলেন দুই পাচ দিনির মেহমান। কেউ খায়, কেউ খায় না। তাগের জন্যি আলাদা বেবস্তা নাই।

আমি এবার এক টুকরা গরুর মাংস মুখে দিয়া প্রশ্ন করিলাম, উপরে এখন কয়জন মেহমান? হিন্দু না মুসলমান?

মোল্লা হাতজোড় করিল। অর্থাৎ সে আর বলিতে চায় না।

আমি গরুর মাংসের একটা নরম কচকচি হাড় চিবাইতে চিবাইতে বলিলাম, ভাবছিলাম, তুমি মানুষটা নেহাত ভালো। একেবারেই গোবেচারা। গরীব মানুষ। খাওয়া শেষে তোমাকে পঞ্চাশ দেব। তা তুমি যদি না বলতে চাও তা আর কী করা। থাক এসব কথা। তোমার বাড়িতে কে আছে?

- জে বউ, একটা মেয়ে আর একটা ছোট ছেলে আছে। বুড়ো     মা আছে।

- তোমার মেয়েটার বয়স কত?

- এই সাড়ে তেরোয় পড়িছে।

- সেই মেয়েটারে কেউ যদি হঠাৎ তুলে আনে? এইখানে দুই দিনের মেহমান হিসাবে রাখে?

আমার এই কথায় মোল্লার কালো মুখটি ভয়াবহ আতঙ্কে যেন বেগুনি হইয়া গেল। তোতলাইতে তোতলাইতে বলিল, স্যার এডা আপনি কি কচ্ছেন? একী সব্বনেশে কতা!

আমি বললাম, মোল্লা, এইটাই এই সময়ের চরম সত্য কথা।

মোল্লা টেবিলের নিচে আমার পা জড়াইয়া ধরিয়া আর্তকণ্ঠে বলিল, স্যার, স্যার আমার এই সব্বনাশডা য্যান না হয়। কেউরে য্যান আপনি না কন আমার সাড়ে তেরো বছরের এট্টা মায়ে আছে।

আমি বললাম, পা ছাড়ো। সোজা হয়ে দাঁড়াও। যা জিজ্ঞেস করব     সত্য বলবা।

মোল্লা এখন আমার পাতানো ফাঁদে। সত্য কথা তাহাকে বলিতেই হইবে, আমি যাহা বলিব তাহা সে পালন করিতে বাধ্য থাকিবে।

মোল্লা সন্ত্রস্ত কণ্ঠে জানাইল, উপরে একটি গোপন কক্ষে একটি মাত্রই মেয়ে আছে তার নাম অঞ্জনা, এই বাড়ির মালিক মনোরঞ্জন বাবুর কনিষ্ঠা কন্যা।

মোল্লা আরো বলিল, কমান্ডার স্যারের ইচ্ছে তারে মুসলমান বানায়ে বিয়ে করবেন। হিন্দুরে মুসলমান বানায়ে বিয়ে করতি পারলি নাকি বেহেশত নসিব হয়।

আমি বলিলাম বেহেশত নসিব হবে কি না হবে তা আল্লাহ জানেন। তোমার কি মনে হয়, তোমাদের কমান্ডার ওই মেয়েটারে এইভাবে আর্মির হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন?

মোল্লা হতাশ কণ্ঠে বলিল, আমার তা মনে কয় না। আর্মির কাছে গোপন খবর চলে গেছে। মেয়েডার আয়ূ আর বড়জোর পাঁচ সাত দিন। তারপর চলে যাবি গল্লামারির খালে।

গল্লামারির খাল খুলনা বেতার কেন্দ্রের সামনে গল্লামারি বিলের রাস্তার প্রান্তে। এটা পাকি আর্মিদের তৈরি বধ্যভূমি। দৈনিক শত শত লোককে সেখানে বধ করা হয়।

আমিও হতাশ কণ্ঠে বলিলাম, তাহলে আর কী করা যায়? যার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। তা মেয়েটা গল্লামারি খালের ভোগে চলে যাবে বলে তার খানা-দানাও বন্ধ করে দিয়েছে নাকি?

- না, না তা দেই নাই। রোজ সকালে ডিম, রুটি, নাশতা দিই, দুইপরে মাছ, ভাত দিই। রাত্তিরেও কলা, দুধভাত দিই।

- মেয়েটা খায়?

- কোনোদিন খায়, কোনোদিন খায় না? এই দশায় কেরু কি গলা দিয়া ভাত নামে!

- আজ দুপুরে খাবার দিয়েছ?

- না এখনো দিই নাই। আপনার খাওয়া শেষ হলিই দেব।

- খাবার কে দিয়ে আসে?

- আমিই দিয়ে আসি। ঘর বাইরিরতে তালাবন্ধ। একটা চাবি কমান্ডার স্যারের কাছে, আর একটা চাবি ঐ ঘরের পাহারাদারের কাছে থাকে। আমি খাবার নিয়ে গেলি পাহারাদার চাবি দিয়ে ঘর খুলে দেয়। আমি আগের এঁটো থালা ফেরত নিয়ে নতুন খাবার থালা দিয়ে আসি। ব্যস ঐ পর্যন্ত।

- মেয়েটিকে দেখে তোমার মায়া হয় না?

মোল্লা দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, মায়া করে কী লাভ স্যার! কতজন হ্যানে আয়েছে, কতজন গিয়েছে। কত কান্দাকাটি ... কিডা শোনে কেডা বুঝে। স্যার আমরা হলাম হুকুমির দাস, বুবা, কালা, আন্ধা। সব দেখে শুনেও আমাগের উপায় নেই। আমরা এমন চিপার মধ্যি যে রা করার উপায় নেই। কতায় কয়, আপনি বাঁচলি বাপের নাম।

আমি খাওয়া শেষ করিয়া হাতমুখ মুছিলাম। তারপর বলিলাম, মোল্লা, একটা প্লেটে ঐ মেয়েটার জন্যে এক প্লেট খাবার সাজাও।

মোল্লা একটা পরিষ্কার প্লেটে ভাত, রুই মাছ দিয়া খাবার সাজাইল। আমি পকেট হইতে একটা একশো টাকার নোট দিয়া মোড়ানো ইতঃপূর্বে সংগৃহিত পুরাতন ব্লেড দুইটি থালার ভাতের নিচে গুঁজিয়া দিলাম। মোল্লা নির্বোধ চোখে আমার কা- দেখিতেছে। আমি ওর নির্বোধ বা অবাক চোখের পর্দা ঢাকিতে ওর হাতে ঐ একশো টাকার নোটটা গুঁজিয়া দিলাম। বলিলাম, লুঙ্গির খোঁটে গুঁজে রাখো। তারপর এইভাবে থালা নিয়ে গার্ডের সাথে মেয়েটির ঘরে যাও।

 

গার্ডের অগোচরে মেয়েটাকে চোখের ইশারায় হাতের আঙুলে ভাতের নিচে রাখা ব্লেডের সামান্য অংশ দেখিয়ে দেবে। তারপর খুব স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে আসবে।

আনসার মোল্লা ভীতভাবে প্রশ্ন করিল, মেয়েডারে আপনি মরতি কন স্যার?

আমি বলিলাম, আমি কাউরে মারতে চাইনে। ও বাঁচবে না মরবে সেইটা ওর ইচ্ছে। ওর এইভাবে বেঁচে থাকার চাইতে মরাই ভালো। মোল্লা, সাবধান করে দিচ্ছি এই কথা যেন দুই কান না হয়? কোনোভাবে ফাঁস না হয়। যদি ফাঁস হয় তাহলে আমি তোমাকে ফাঁসিয়ে দেব। মনে রেখ তোমার সাড়ে তেরো বছরের একটি মেয়ে আছে। প্রথমেই তুমি মারা পড়বা, তারপর তোমার মেয়েটি। আনসার মোল্লা, তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কী বলছি?

আনসার মোল্লা ভীতভাবে মাথা নাড়িল।

আমি বলিলাম, তাহালে যাও মেয়েটাকে খাবার দিয়ে এসো। খাবারটা দিয়ে এসে আমাকে জানাবে কাজটা ঠিকমতো করেছ কিনা এবং তোমার ইঙ্গিত মেয়েটি বুঝেছে কিনা?

- জে স্যার।

- হ্যাঁ, আর একটা কথা, খাবার দিয়ে এসে কাছাকাছি কোনো ওষুধের দোকান থেকে আমার জন্যে একপাতা প্যারাসিটামল আর একপাতা ঘুমের ওষুধ যা পাও তাই নিয়ে আসবা। আমার মাথা ধরেছে, ঘুমোতে হবে। কাগজ কলম নিয়ে এসো, আমি ওষুধের নাম লিখে দেব। বুঝলে?

- জে স্যার।

বিশ্রামের অজুহাতে নিজ কক্ষে আসিয়া আমি একটা আশঙ্কায়, অস্থির উত্তেজনায় সময় অতিবাহিত করিতে লাগিলাম আনসার মোল্লার অপেক্ষায়। আমি জীবন বাজি রাখিয়া একটি ভয়াবহ খেলায় লিপ্ত হইয়াছি। আনসার মোল্লা আমার সঙ্গে নির্বোধ লোভীর ভান করিতেছে কিনা অথবা সে সত্য সত্যই নির্বোধ তাহা বুঝিবার জন্য আমাকে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইবে।

এসময় আমার ভেজানো দরজায় টোকা পড়িল। আমি বলিলাম, মোল্লা, ভিতরে আসো।

মোল্লা একটুকরা কাগজ ও একটা পেন্সিল হাতে প্রবেশ করিল। ওর হাত কাঁপিতেছে। চোখের ইঙ্গিতে উপরের দিকে অঙুলি নির্দেশ করিয়া আমার নিঃশব্দ প্রশ্ন, দিয়েছ?

মোল্লা হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়িল।

মুকাভিনেতার মতো আমার হাতের নিঃশব্দ প্রশ্ন, ভাতের নিচে ব্লেড? ও দেখেছে?

মোল্লার আবারও হ্যাঁ সূচক নিঃশব্দ উত্তর।

- গার্ড টের পায়নি তো?

মোল্লা না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়িল।

চলবে

 

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব তিন)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পাঁচ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ছয়)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব সাত)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আট)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব নয়)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব দশ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top