সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
২১ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:১৮

আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:২৪

ছবিঃ অমর মিত্র

 

দু-ঢোক সুরাপানে উদ্ধবের নেশা হয়ে গেছে। ঝিম ঝিম করছে শরীর। ঘরের আলো তার চোখে এখন আরও উজ্জ্বল। পেটিকা উপুড় করে দিয়েছ চতুরিকা তার সাজানো শয্যায়। মণিরত্ন ঝকমক করছে। উদ্ধব সুরাপানেও সিধে হতে পারছে না। ঝিমঝিমে শরীর আরও কুঁকড়ে যাচ্ছে যেন। চতুরিকা অলঙ্কারের স্তূপ থেকে একটি রত্নখচিত কণ্ঠহার তুলে ধরল হাতে, এই হারের নাম জানো?

উদ্ধব মাথা নাড়ে। তার চোখে জল এসে যাচ্ছে যে। হায় চতুরিকা, এত গুণবতী তুমি তা কে জানত? মুগ্ধ দৃষ্টিতে চতুরিকার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে উদ্ধবনারায়ণ। এখন ঘর থেকে বেরোতে পারলেই হয়। বীট মহাপার্শ্বর কাছে জেনে নেবে আসল খবর। নেশায় চুর চুর উদ্ধবের মনে প্রেম জেগেছে সহসা। বিরহ তৈরি হচ্ছে। কতদূরের হয়ে যাবে গণিকা চতুরিকা, এরপর হয়ত দ্বারে দাঁড়াতে হবে তাকে। সেনাধ্যক্ষ যেমন আদেশ করবেন তেমন হবে। বড় ভয় লাগে তার সেনাধ্যক্ষ কুমার বিক্রমকে। সামনে দাঁড়ালেই পা ঠক ঠক করে কাঁপে। রাজার কাছে যেতে বুক হিম হয়ে যায়। রাজকর্মচারী হওয়ার আগে এমন হত না। সাধারণ নাগরিক হয়ে সে রাজসভায় হাজির হয়েছে কতবার। শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত’র কাছেও তো হেঁটেছে অনেকবার। এখন শ্রেষ্ঠীর সামনে অধোমুখে দাঁড়াতে হয়। রাজসভায় শ্রেষ্ঠীর প্রভাব অনেক। উদ্ধব ভয় পায়, এখন যদি শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত এসে দাঁড়ান দরজায়। উদ্ধবের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। 

চতুরিকা যে কণ্ঠহারটি তুলে ধরেছে, তার দিকে তাকাতে উদ্ধবের চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে। দ্বিপ্রহরের সূর্যের দীপ্তি যেন। হীরক খচিত রয়েছে যেন সোনার পাতে। চতুরিকা লাস্যময়ী হয়ে উঠছে ক্রমশ, হাতছানি দিচ্ছে উদ্ধবকে, বলল, এ হার কি গজমোতির?

মাথা নাড়ে উদ্ধব, জানে না সে। অবাক হয়ে শুনছে চতুরিকার কথা, সপ্তলহরী হার, গজমোতির হার, সীতাহার। চন্দ্রহারটি তুলে চতুরিকা ডাকে, কোমরে পরিয়ে দেবে? মেখলার বন্ধন শিথিল করে গণিকা তার কটিদেশ উন্মুক্ত করল। উদ্ধবের ভয় বাড়ল। চতুরিকা কি তাকে ফাঁদে ফেলতে চাইছে?  অবন্তীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান, সবচেয়ে ধনবান ব্যক্তির চোখে পড়া রমণীর সামনে বসে নেশা করছে সে। মহার্ঘ কটিদেশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। উদ্ধব পিছিয়ে আসে, আমি এবার যাব।

খিলখিল করে হাসে চতুরিকা, কী হল নাগর তোমার, কাছে এস, সব আমাকে পরিয়ে দাও, দেখি এত গয়না গায়ে তুললে কেমন লাগে। পা বাড়িয়ে দেয় চতুরিকা, নুপুর পরিয়ে দাও, আমি সমস্ত গয়না পরে দেবদত্তার মতো নাচব, কেমন শিখেছি দ্যাখো।

উদ্ধব এবার কাঁপতে আরম্ভ করে। হায় মহাকাল! এ কোন ফাঁদে পড়ল সে? এত অলঙ্কার সে জীবনে দ্যাখেনি। মুহূর্তে মনের ভিতরে সন্দেহ জেগে ওঠে। চুরির মাল নয় তো? মনে করতে চেষ্টা করে নগরে এর ভিতরে কোনও চুরির ঘটনা ঘটেছে কি না। উজ্জয়িনী থেকে বিদিশা ফেরার পথে এক বণিকের সর্বস্ব অপহরণ করেছিল দস্যুদল। সেই জিনিস নয় তো? উদ্ধব দ্যাখে তার কোলের কাছে চতুরিকা তার পা দুটি বাড়িয়ে হাসছে। গণিকারও নেশা হয়ে গেছে। ঊরু পর্যন্ত উন্মুক্ত করে তাকে আহ্বান জানাচ্ছে চতুরিকা। উদ্ধব কাম সম্বরণ করে সন্দেহভরা গলায় জিজ্ঞেস করে, কে দিয়েছে এত অলঙ্কার?

খিলখিল করে হেসে শয্যায় লুটিয়ে পড়ে চতুরিকা, নাগরের হিংসে হচ্ছে?

এ তো অতুল সম্পদ, তুমি এর মূল্য জানো?

ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় গণিকা, কিছুই জানি না, কাল রাত থেকে শুধু পেটিকা উপুড় করছি এই বিছানায়, আর নাড়াচাড়া করছি, সোনায় সোনায় ঠোকাঠুকিতে অদ্ভুত এক ধ্বনি ওঠে, কী সুন্দর লাগে তা, রাত্তিরে আমি ঘুমোইনি পর্যন্ত, ভাবছি কখন আসবে আমার নাগর, সে আমাকে সাজাবে, এতো গয়না একা পরে কী হবে, যদি তুমিই না দেখ।

উঠে বসেছে গণিকা। ঊর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত, কটিদেশ থেকে শিথিল হয়ে মেখলা কোনোরকমে দেহের নিম্নদেশ ঢেকে আছে। উদ্ধব দ্যাখে যুবতীর ভিতরে কাম জেগে উঠছে। অধরে, স্তনে, কামভাব স্পষ্ট। উদ্ধবের সাহস একটু একটু করে বাড়ছে। এই গণিকা এত নির্বোধ নয় যে রাজা, সেনাধ্যক্ষ বা শ্রেষ্ঠীর উপঢৌকন দিয়ে তার সঙ্গে লীলা করার সাহস দেখাবে। এ নিশ্চয়ই চুরি করা মাল। আর তাই চতুরিকার এত রঙ্গ আজ। অন্যদিন দেহের সুতো সরাতে কত সাধনা করতে হয়। রতিলীলার সমস্ত সুখ গণিকার সহযোগিতা ব্যতীত পাওয়া সম্ভব নয়। শৃঙ্গার কর্মের এক অঙ্গ তো ওই সাধনা। অথচ আজ চতুরিকার অন্যরূপ। উদ্ধব সিধে হয়ে বসে। যদি চুরির মাল হয়, বিদেশী বণিকের জিনিস হয়, এই অলঙ্কার রাজসভায় গচ্ছিত করতে হবে। তা যদি করে সে, তবে তার পদোন্নতির সম্ভাবনা দেখা দেবে। ক্ষমতা বাড়বে। কিন্তু এত গয়না না গচ্ছিত করে সে যদি আত্মসাৎ করে তাহলেও লাভ কম নয়। গণিকার কপালে দুঃখ আছে এই অলঙ্কারের জন্য।

উদ্ধব জিজ্ঞেস করে, কী করে পেলে এত গয়না?

পেয়েছি! চতুরিকা ভাঙে না।

কে দিয়েছে তা জানতে হবে তো আমাকে, আমার কর্তব্য হলো খোঁজ রাখা।

চতুরিকা বলল, সব জানতে হবে?

উদ্ধবের সন্দেহ গাঢ় হয়, জানতে তো হবেই, কে দিতে পারে এত গয়না?

চতুরিকা বলে, নাই বা জানলে।

উদ্ধব টের পায় লুকোতে চাইছে চতুরিকা। লুকোতে দেবে না সে। জেরা করে বার করে আনবে সত্যি কথা। জানতেই হবে। উদ্ধব বলে, এ কি চুরির মাল?

তার অর্থ?

ভিনদেশী বণিকের সর্বস্ব লুঠ করে নিয়েছিল দস্যুদল, এইতো দীপাবলীর পরের ঘটনা, যা জানা গেছে এইরকম পরিমাণ গয়না ছিল সঙ্গে।

চতুরিকা কথাটির কোনও গুরুত্বই দেয় না, বলে, আমি কি দস্যুতা করেছি, নাকি তুমিই হলে আসল দস্যু, আমি কি তোমাকে চিনি না নাগর?

চতুরিকার এই কথায় যে যৌনতার ছোয়া তাতে উদ্ধব টলে না, সে বোঝে গণিকা তাকে রূপ আর কামে ভুলাতে চাইছে। ভুলবে কেন উদ্ধব? সে রাজকর্মচারী। রাজশক্তির আরও অধিকার নিতে চায়। এ তার গোপন বাসনা। সে বলল, আমার সন্দেহ হচ্ছে।

চতুরিকা এবার বিরক্ত হয়, কিসের সন্দেহ?

তা তুমি বুঝতে পারছনা, কে দিয়েছে এত গয়না এক্ষুনি বলো।

চতুরিকা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চন্দ্রহার নিয়ে উন্মক্ত কটিদেশে স্থাপন করতে করতে বিড়বিড় করে, এমন হবে জানলে আমি নিজেই সাজতাম একা একা, রাজকর্মচারীর রস নেই, তুমি কেমন মানুষ, শুনবে কে দিয়েছে, শুনলে অবাক হবে।

দুই ভ্রু কুঁচকে উদ্ধবনারায়ণ তাকিয়ে আছে গণিকার দিকে। তার ভিতরে আবার সঙ্কোচ তৈরি হচ্ছে। কে দিয়েছে, কে দিতে পারে? অপহরণের কল্পনা অন্তর্হিত হলো। আবার ভয় জেগে উঠল ভিতরে। চতুরিকা তাকে পরীক্ষা করছে নাকি? তাহলে সেই কথাই সত্যি যা সে আগে ভেবেছে। অপহৃত সম্পদ হলে চতুরিকা গোপন করত।

চতুরিকা বল, এক ধনাঢ্য ব্যক্তির উপঢৌকন এইসব।

গা হিম হয়ে আসে উদ্ধবের। আর জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না কে সেই ধনাঢ্য। চতুরিকা সরে আসে তার কাছে। দু-হাত বাড়িয়ে আকর্ষণ করে উদ্ধবনারায়ণকে। উদ্ধব যেন সাড়হীন, নিশ্চল পাথর যেমন হয় তেমনি। চতুরিকার স্পর্শে উদ্ধবের ভিতরে কোনো রোমাঞ্চ জাগে না। তার কর্ণকুহরে চতুরিকার মুখ। ওষ্ঠের স্পর্শ পাচ্ছে উদ্ধব, তার কর্ণমূলে চতুরিকার জিহ্বার ছোঁয়া। উদ্ধবকে কঠিন আলিঙ্গনে বাঁধে গণিকা, চাপা গলায় বলে, শুনলে তুমি অবাক হবে।

কার? বিহ্বল উদ্ধবনারায়ণ কর্তব্য ঠিক করতে পারছে না।

চতুরিকা ফিসফিস করে নামটি উচ্চারণ করতেই উদ্ধবনারায়ণ ছিটকে সরে আসে চতুরিকার আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে। শয্যা থেকে নেমে ঘরের কোণে গিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হাঁপায়। প্রদীপের আলোয় চতুরিকা ঝলমল করছে। গলায় দিয়েছে রত্নখচিত স্বর্ণহার, কপালে স্বর্ণতিলকা। চতুরিকা সেজে উঠছে। কী আশ্চর্য! তার ভয় সত্যি হলো? সে কোথায় এসেছে? অধোমুখে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে উদ্ধব। কী অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়েছে এই সামান্য যুবতী। যৌবনের এত শক্তি? এই গণিকা তো কোনো বিদ্যাই জানে না, তবুও বশ করতে পেরেছে যাকে, তার কথা ভাবতেই উদ্ধব কেঁপে ওঠে। এতক্ষণে জানা গেল। উদ্ধব বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় গণিকার দিকে। এ কি সেই চতুরিকা যে উদ্ধবের প্রহারে তার প্রিত আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য হয়েছে। এ কি সেই গণিকা যে উদ্ধবের যাবতীয় বিকৃত রুচিতে সায় দিয়েছে দিনের পর দিন। কামলীলায় উদ্ধব যেমন আচরণ করতে বলেছে সে করেছে দাসীর মতো। উদ্ধবের মনে হয় সে ভুল করে নগরের এই শ্রেষ্ঠ গণিকার ঘরে ঢুকে পড়েছে। তার যতটা ক্ষমতা, তাতে তার ফূর্তির উপায় হতে পারে নগরের উপান্তে গড়ে ওঠা বারাঙ্গনাপল্লী। সে এখানে এল কীভাবে?

চতুরিকা ঝলমল করতে করতে এগিয়ে আসে। আরো গয়নায় নিজেকে সাজিয়েছে চতুরিকা। প্রদীপের আলো তার সমস্ত অঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। উদ্ধব নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার ভয় করছে চতুরিকার দিকে দৃষ্টি ফেলতে। এই গণিকা তো তার ভোগ্য নয়, যার ভোগ্যা তার কাছে নতজানু হয়েই তো রাজশক্তি আস্বাদ পেয়েছে সে। যদি জানতে পারে সেই ব্যক্তি, উদ্ধবের পরিণাম হবে গম্ভীরার সেই যুবকের মতো, যে অবন্তী দেশ ছেড়ে চলে গেছে। অবন্তীতে প্রবেশ করলেই, এই নগরে পা দিলেই তাকে যে করে হোক বন্দিশালায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবে উদ্ধব। তার আগেই গন্ধবতীকে বিবাহ করে গৃহবন্দি করবে। উদ্ধবের মাথায় ঝিলিক দিল একটি চাতুরী। এই গণিকার নাগর ছিল সে তিনদিন আগেও। চতুরিকাকে দিয়েই গন্ধবতীকে বিবাহ করার ব্যবস্থা পাকা করতে পারে সে। চতুরিকা যদি তার নতুন নাগরকে বলে, তার কথা ফেলতে পারবে না শিবনাথ।

একহাত দূরে দাঁড়িয়ে চতুরিকা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। কামার্ত হয়ে উঠেছে গণিকা। এমন কখনো হয়? হয়েছে? যতবার ভোগ করেছে উদ্ধব, তাকেই তো সক্রিয় হতে হয়েছে প্রথমে। এই গণিকাকে জাগাতে হয়েছে। কতবার এর অনিচ্ছায়ও ধর্ষণ করেছে উদ্ধব। কিন্তু এখন কী দেখছে! চতুরিকার আঁখিতারার নিমীলিতভাব, ওষ্ঠাধরের রসবতী হয়ে ওঠা, শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে যুগলবক্ষের কম্পন তো তার শরীরে উদ্বেলতাই প্রকাশ করছে। যখন গণিকা তার হাতের মুঠো থেকে সরে গেছে, তার অধিকারমুক্ত হয়েছে তখন কি না সে তার দিকে কামভাবে তাকাচ্ছে। উদ্ধব মাথা নিচু করে। চোখ বন্ধ করে। এখন চতুরিকার দিকে কামভাবে তাকানো অপরাধ। যে রাজশক্তির অংশ হয়ে গেছে চতুরিকা তার নতুন গুণগ্রাহীকে পেয়ে, তা উদ্ধবের কাছে অকল্পনীয়। উদ্ধব তার কোনো কথাই মনে রাখতে চায় না। যে গণিকা তার ভোগ্যা ছিল, সে  গণিকা যেন এ নয়, অন্য কেউ। উদ্ধব যার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে হলো এই নগরের শ্রেষ্ঠ পুরুষদের একজনের চোখের মণি। উদ্ধব বরং চতুরিকার অনুগ্রহ ভিক্ষা করবে এরপর। চতুরিকার অনুগ্রহ পেলে সে এই নগরের শ্রেষ্ঠ মানুষের অনুগ্রহ পাবে। জীবন তার ধন্য হবে।

খিলখিল করে হেসে ওঠে চতুরিকা, ভয় পেয়েছো নাগর?

উদ্ধবের গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না, সে একটি কথাও বলে না। অধোমুখেই টের পায় তার সঙ্গে যেটুকু ব্যবধান ছিল চতুরিকার তা যেন লুপ্ত হয়ে গেল। গণিকা দু-হাতে তাকে কঠিন আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে। এই স্পর্শ অন্যরকম। ফুলের গয়নায় সজ্জিতা গণিকার স্পর্শে অভ্যস্ত উদ্ধবের মনে হয় গায়ের ছাল-চামড়া যেন ছিঁড়ে যাবে চতুরিকার গায়ের গয়না ঘষাঘষিতে। উদ্ধবের মনে হয় রক্তমাংসের নারী নয়, সোনার মূর্তি যেন তাকে কঠিন পেষণে মেরে ফেলবে এবার। স্তন, ঊরু থেকে যুবতী গণিকার সমস্ত অঙ্গ যেন ধাতু নির্মিত হয়ে গেছে। অলঙ্কারে অলঙ্কারে ঘর্ষণে আশ্চর্য এক ধ্বনি উঠছে। এ ধ্বনির সঙ্গে পরিচিত নয় উদ্ধব। ঘরের পাথুরে মেঝে থেকে উঠে আসা শৈত্যপ্রবাহে উদ্ধবের গায়ের রক্ত যেন বরফ হয়ে গেছে। কী সর্বনাশ! এতদিনের অপমানের শোধ নিতে চাইছে যেন গণিকা চতুরিকা। যে শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত’র উপঢৌকন নিয়ে বসে আছে, সে কেন উদ্ধবনারায়ণের  সঙ্গ চাইবে? উদ্ধবের মনে হলো সে আলিঙ্গন-মুক্ত হয়ে চতুরিকার পায়ে মাথা ঠেকায়। ক্ষমা চেয়ে নেয়। শ্রেষ্ঠী শুনলে খুশি হবে। শ্রেষ্ঠীর ভোগ্যা গণিকাও তো উদ্ধবের ভজনার পাত্রী। চতুরিকার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে উদ্ধব এবার পালাবে, তার আগে মুক্তাহারটি উদ্ধার করতে পারলে হতো। ওটি শুধু শুধু গেল। এইসব অলঙ্কারের কাছে ওই মুক্তোহারের মূল্য কী? উদ্ধব মুখ তুলে দ্যাখে তার দেওয়া মুক্তাহারটি চতুরিকার স্তন ঘিরে আছে। ওইটিও পরেছে গণিকা। কিছুই ছাড়বে না।

চতুরিকা বলে, নাগর আমাকে নুপুর পরিয়ে দেবে না?

উদ্ধব ক্লান্ত গলায় বলে, দিতে আঁজ্ঞা হোক, নুপুর জোড়া কোথায়?

হি হি করে হাসতে থাকে চতুরিকা, তাকে দু’হাতে ঝাঁকানি দেয়। কানের কাছে ফিসফিস করে, আমি তোমারই আছি সত্রীমশায়, আচ্ছা সোনার গয়না কি শরীর গরম করে? কাল রাত থেকে যতবার নাড়াচাড়া করেছি এসব ততবার দেহ যেন আগুন হয়ে উঠেছে, কিন্তু তোমার কী হলো, শোনো গো, এইসব গয়না শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত’র  উপঢৌকন কিন্তু আমাকে তো নয়, শ্রেষ্ঠী দিয়েছিলেন দেবদত্তা সখীকে গতরাত্রে, দেবদত্তা সখী সব দান করে দিয়েছে আমাকে, শোনো গো, দেবদত্তা রাজ-অনুরাগিনী, রাজা ভর্তৃহরির প্রেমে পড়েছে দেবদত্তা, রসমঞ্জরীর মেয়ে, কিন্তু শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত তো ছাড়বে না তাকে, সে নাকি রাজার চেয়েও বেশি ধনী, দেবদত্তাকে সোনায় মুড়ে দিয়েছে...।

উদ্ধব চমকে গেছে। কী নির্বোধ সে! গণিকা দেবদত্তা যে শ্রেষ্ঠীর ভোগ্যা তা কি অজানা তার?  গম্ভীরার সেই ধ্রুবপুত্র তো তাই অবন্তী দেশ ছেড়ে চলে গেল। তার তো আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল। কিন্তু তাই বা করবে কী করে? দেবদত্তার পাওয়া গয়না চতুরিকার অঙ্গে ওঠার কারণ কী? বলছে চতুরিকা। অলঙ্কারে বিতৃষ্ণা দেবদত্তার, আবার তা যদি হয় শ্রেষ্ঠীর দেওয়া। শ্রেষ্ঠীকে সহ্যই করতে পারে না। শ্রেষ্ঠীর দেওয়া অলঙ্কারকে সে অবহেলায় দান করে দিয়েছে চতুরিকাকে।  দেবদত্তা বলেছে, ওই গয়না তার কাছে ভীষণ ভার। ওই ভার সহ্য করতে পারবে না। শ্রেষ্ঠীকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করার সাহস তার নেই, এইভাবে গোপন প্রত্যাখ্যানে নিজেকে শুদ্ধ করতে চেয়েছে সে। 

উদ্ধব ধীরে ধীরে চতুরিকার কাছ থেকে সরে এসে তীব্র দৃষ্টিতে তাকে বিদ্ধ করতে থাকে। এত ছলাকলার কারণ কী? উদ্ধবের ভিতরে রোষ জাগে। চতুরিকা বলে যাচ্ছে কীভাবে মধ্যরাতে শ্রেষ্ঠী চলে যাওয়ার পরে গোপনে দেবদত্তা তার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। তার সঙ্গে দ্যুতক্রীড়ায় বসেছিল শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত। বার বার পরাস্ত হয়ে এক একটি করে অলঙ্কার পরিয়ে দিয়েছিল দেবদত্তাকে।  অলঙ্কারের ভারে শিরঃপীড়া আরম্ভ হয়েছিল দেবদত্তার। তার অঙ্গ নাকি জ্বলছিল অলঙ্কারের স্পর্শে। উদ্ধবের ভিতরের রোষ তীব্র হয় চতুরিকার কথা শুনতে শুনতে। মনে মনে সে নিজেকে তিরস্কার করতে থাকে। ক্রোধে সে কাঁপতে থাকে। মনে মনে বলে, এই কথাটা আগে বলতে পারিসনি মাগী, শতবার তার পায়ে মাথা ঠেকালাম আমি মনে মনে, কতরকম ভাবলাম! উদ্ধব ঝাঁপিয়ে চতুরিকার কেশ আকর্ষণ করে তাকে শয্যায় নিয়ে ফেলে, মুখে বলে, কথাটা আগে বলতে হতো ছেনাল মাগী, এতটা সময় নষ্ট হলো।

উদ্ধবের পরিবর্তনে ভীত হয় চতুরিকা। কাঁপতে আরম্ভ করেছে সে। তার শরীরের কামনা আচমকা মিলিয়ে গেছে। উদ্ধবনারায়ণের প্রকৃত রূপ যেন আরো আরো বেশি প্রকৃত হয়ে উঠেছে এখন। চতুরিকা কী বলতে গেলে উদ্ধব তার মুখে উত্তরীয়র একটা অংশ গুঁজে দেয়। এইভাবে গতকাল সে ধর্ষণ করেছে একটি কিশোরী কন্যাকে, যে ছিল সম্পূর্ণ কুমারী, যার আঘ্রাণ তার আগে কোনো পুরুষেরই নেওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।

কী করছ? চতুরিকা উদ্ধবের পেষণমুক্ত হতে চায়। তার গলা দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোয়। উদ্ধবনারায়ণ গর্জন করে ওঠে, বলে, এইভাবে কাল রাতে একটা মেয়েছেলেকে বশ করেছি, বুঝলি চতুরিকে।

চতুরিকার সমস্ত শরীর এলিয়ে যেতে থাকে। তার সমস্ত কল্পনা যা গতরাত থেকে সে নির্মাণ করেছিল একা একা তা ভেঙে যেতে থাকে। এতবার পুরুষ সঙ্গ করার পরও ধর্ষিতা হতে হতে চতুরিকার চোখে জল এসে যায়।

অনেকটা সময় পরে উদ্ধব ক্লান্ত হয়। চতুরিকার মুখ থেকে গোঁজা উত্তরীয় বের করে এনে তার নগ্ন, ধর্ষিতা, শরীর দেখতে থাকে। হাঁপায় উদ্ধবনারায়ণ, হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, এও একপ্রকার শৃঙ্গার, রতিক্রিয়ার এও এক উপায়, বুঝলি চতুরিকে, এভাবেই নাগর তৃপ্ত হয়।

চতুরিকা মুখ তোলে না। উদ্ধব তার সমস্ত অঙ্গে লেপ্টে থাকা সোনার গয়নাগুলি নেড়ে-চেড়ে দেখতে থাকে, বলে, রাগ করিস নে চতুরিকে, আমি এইরকম, এভাবে যে শরীর তৃপ্ত হয় তা গতকাল আবার দেখেছি। কিন্তু সে মেয়েমানুষটা কেঁদেই সব ফূর্তি শেষ করে দিয়েছিল, তুই তো তেমন করিসনি।

চতুরিকা ওঠে শয্যা ছেড়ে। শীত করছিল তার। একটি পশম চাদর গায়ে দিয়ে শয্যার অন্যপ্রান্তে গিয়ে বসে। উদ্ধবনারায়ণ বলছে এবার অন্য কথা। রাজার সেনাপতি কুমার বিক্রম তার পদোন্নতি ঘটাবে শীঘ্রই। তখন সে চতুরিকাকে এত অলঙ্কারে নিজেই মুড়ে দিতে পারবে। আজ চতুরিকা তাকে তৃপ্ত করেছে। তার ছলনায় সে সফল হয়েছে। ছলাকলা না জানলে কিসের মেয়েমানুষ। কত রমণী ভোগ করেছে সে, আজকের মতো এত তুষ্ট কখনো হয়েছে কি? হয়েছে নিশ্চয়ই, কিন্তু আজও কাটল চমৎকার। সে সবই জানত। চতুরিকা তো সামান্য গণিকা, তার উপরে উদ্ধবের ভোগ্যা। এ কথা তো রাজ-সেনাপতি, শ্রেষ্ঠী সবাই জানে। রাজাও জানে গণিকা চতুরিকা আসলে উদ্ধবেরই রক্ষিতা। সবটা বুঝতে পেরেও উদ্ধব নাকি অভিনয় করছিল। এই অভিনয়ও তো শৃঙ্গারের অঙ্গ। এতটা সময় এই অভিনয় না করলে ধর্ষণের ইচ্ছা জাগত কী করে তার ভিতরে? গতরাতের অপূর্ণ কামনা পূরণ হতো কী করে? সে যেভাবে রতিকর্ম করেছে আজ, তা তারই উদ্ভাবিত এক পদ্ধতি। উদ্ধব এইভাবে তার ধর্ষণের পক্ষে যুক্তি সাজায়। ধর্ষণটিও অভিনয়। হাসে উদ্ধব। তারপর চতুরিকার মুক্তকেশ আকর্ষণ করে আবার বলে, প্রাচীনকালে রাজপুরুষরা এইভাবে  রমণী আকর্ষণ করত, রমণীদের এই যে দীর্ঘকেশ, খোপা সাজানো, এইসবই তো পুরুষ যাতে তাকে সহজে আকর্ষণ করতে পারে সেইজন্য। চতুরিকাকে টেনে নিজের কোলে এনে ফেলে উদ্ধব, পশম চাদরের ভিতরে দুটি হাত প্রবেশ করিয়ে তার অলঙ্কার অনুভব করতে করতে বলে, চতুরিকে, আর কে জানে এই গয়নার কথা?

বিহ্বল, বিষাদময়ী গণিকা মাথা নাড়ে।

কেউ জানে না তো?

চতুরিকা কোনোক্রমে বলে বায়সপক্ষীও নয়।

উদ্ধব চতুরিকার গায়ের গয়না খুলতে খুলতে বলে, সযত্নে রক্ষা করতে হবে এই গয়না, শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত দিয়েছেন তাঁর প্রিয় গণিকাকে, তা তোর ঘরে  রাখা ঠিক হবে না মার্জারিকে, এখন চতুর্দিকে নানা গোলমাল, কী থেকে কী হয়, আমাকে ভাবতে হবে তো তোর কথা, তোর যদি কিছু হয় এই গয়নার জন্য তাহলে আমিও কি ছাড়া পাব, শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত বড় কঠিন মানুষ, তাঁর কানে যদি যায়...।

কোমরের চন্দ্রহার খুলতে থাকে উদ্ধবনারায়ণ। খুলতে খুলতে বলে, আজ তো তাম্বুল দিলি না চতুরিকে, তোর মুখের তাম্বুল আমার প্রিয়, দাঁড়া গয়না আমি পরাইনি এইজন্য, খুলতে তো হবেই, নিজের পরানো গয়না নিজে খুলি কী করে?

প্রদীপের বুকের তেল ফুরিয়ে এসেছে। দপ্ দপ্ করছে আলো। চতুরিকার শীত করছে। উদ্ধবনারায়ণের হাত কী ঠান্ডা! যেন মরা মানুষের হাত। কাঁপতে লাগল চতুরিকা। দু-চোখ বন্ধ করে কাঁপছে সে শীতে। তার গায়ের গয়না খুলতে খুলতে উদ্ধবনারায়ণ ভুল করে তার কোমল অঙ্গ না ছিঁড়ে ফেলে। ভয় করতে লাগল গণিকার।

চলবে

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top