সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

র্ঝনাধারার সংগীত ( দশম র্পব ) : সেলিনা হোসনে


প্রকাশিত:
১৭ মার্চ ২০২১ ২২:২৬

আপডেট:
১৮ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৫৯

 

- তোর সঙ্গে আমরাও ধন্য হলাম আশিকা। এ দেখা শুধু দেখা নয়। পরিবেশ নিয়ে জীবনের অভিজ্ঞতা।
- সবাই সবাইকে ধন্য করেছি। আমার একার কোনো কৃতিত্ব নেই।
- আছে, আছে। তুইতো আয়োজক। আয়েজনের উদ্যোগ বড় প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয় কাজটি তুই করিস। তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব আমার সারাজীবনের মনে রাখার ছবি।
- থাংপু ভাই আমাদের আদুপাড়া পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে?
- আরও একঘন্টা। মুরংদের ঘরবাড়ি দেখেন সামনে।
- আমরা এখানে একটুক্ষণের জন্য নামতে চাই।
- নেমে কি করবেন? থাংপু জিজ্ঞেস করে।
- তোমাদের পাড়াটা ঘুরেফিরে দেখতে চাই। আসিফ নরম সুরে বলে, এমন সুন্দর পাড়াটা না দেখে ঢাকায় গেলে মনে খুব দুঃখ হবে থাংপু।
- দুঃখ হবে? কি বলেন, দুঃখ হবে কেন?
- নিজের দেশের মানুষকে ঠিকমতো না দেখতে পাওয়ার দুঃখ।
- আপনারাতো নিজেদেরটা বোঝেন। আমাদের দুঃখ বোঝেন না। বুঝলে আমাদের এত কষ্ট করে থাকতে হবে কেন? আপনাদের মুখে দুঃখের কথা শুনলে আমার রাগ হয়।
- তা ঠিক বলেছ থাংপু। তোমাদের এরকম কথা শুধু কথা না। প্রতিবাদও।
সবাই সাড়া দিয়ে বলে, হ্যাঁ ঠিক বলেছে। ওদের দিকে আমাদের সরকারের আরও নজর দেয়া দরকার।
- আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠী আমাদের গর্ব। ওদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আমাদের সম্পদ।
- আপনারা এসব কথা মুখেই বলেন। কাজে তো কিছু করেন না। করলে আমাদের শিল্পীরা অনেকদূর এগিয়ে যেত।
- থাংপু ভাই আপনি আমাদের উপর রেগে যাচ্ছেন। আপনি শান্ত হন।
- না, শুধু শুধু আপনাদের উপর রাগব কেন? আপনারাতো মাত্র ছয়জন আমাদের এখানকার ঝর্ণা দেখতে এসেছেন। সুন্দর ঝর্ণা দেখে আপনারা আনন্দ নিয়ে বাড়ি যান।
- থাংপু ভাই সুন্দর কথা বলেছেন। আপনাকে ভালোবাসা জানাই আমরা।
ছয়জন একসঙ্গে বলে। কন্ঠস্বরে গাড়ির ভেতরে হাসির সঙ্গে কন্ঠস্বরের সঙ্গীত প্রবাহিত হয়। স্লোগানের মতো বলে, থাংপু ভাই, থাংপু ভাই জয় হোক আপনার। আদিবাসী মানুষেরা সবাই আমাদের আপনজন।
- শুনে খুব খুশি হলাম। আনন্দে ভরে গেল মন।
- আমাদেরকে একটি পাড়া দেখান থাংপু ভাই। আমরা একটু নেমে হাটাহাটি করি। সবার সঙ্গে কথা বলি। আমরা তো জানি যে বান্দরবান আদিবাসী জনগোষ্ঠী অনেক বেশি।
- হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি থেকে আমাদের এখানে নানা জাতিগোষ্ঠীর আদিবাসী বাস করে। আপনাদেরকে নিয়ে তমথই পাড়ায় থামব। আপনারা আমাদের কারবারির সঙ্গে কথা বলবেন। কারবারি আপনাদেরকে চা খাওয়াতে পারে। নাও খাওয়াতে পারে। সেজন্য আপনারা কিছু মনে করবেন না।
- না, আমরা কিছু মনে করব না। আমার ব্যাগে কেক-বিস্কুট আছে সেটা আপনাদের কয়েকজনকে খাওয়াব। আশিকার কথায় অন্যরা বলে, আমরাও শুকনো খাবার এনেছি। সেগুলো একসঙ্গে করে আমরা সবাই মিলে খাব।
থাংপু খুশি হয়ে বলে, ভালোই হবে। আমাদের আড্ডা জমবে।
- হুররে- হুররে - বান্দরবান হুররে। জয় হোক বান্দরবানের। সবাই হাতের তালি দিতে দিতে হাসিতে ভরিয়ে রাখে জিপের ভেতর।
সেঁজুতি বলে, আমার ব্যাগে কমলা আছে। সেগুলোও খাওয়া যেতে পারে।
- ঠিক আছে দুটো কমলা হলেই হবে। আমরা একটা করে কোষ খাব।
আশিকা রয়েসয়ে খরচ করার চিন্তা করে। সবার ব্যাগেই খাবার আছে। কিন্তু দিন অনুযায়ী রেখে খেতে হবে। হিসেবে ভুল করলে হবে না। যাওয়ার পথে খাবার নিয়ে যেন আর সমস্যা না হয়। অবশ্য রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কেনা যাবে। এত ভাবনার কি আছে, আশিকা নিজেকে শাসন করে।
আরও কতক্ষণ পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া পথে এগিয়ে যায় জিপ। একসময় একজায়গায় থেমে থাংপু বলে, এটা থমথই পাড়া।
- আশিকা চারদিকে তাকিয়ে বলে, কতগুলো ঘর আছে এখানে?
- বত্রিশটা। ছোট ছোট ঘর। সবার ঘরেই ছেলেমেয়ে আছে। বনের শুকনো ডাল কুড়িয়ে রান্না করে সবাই।
- তোমরা কি খেতে ভালোবাস থাংপু ভাই?
- পছন্দ করে তো খাওয়া হয় না। যা জোটে তাই খাই। ভাত-ডাল শুকনো মরিচই বেশি খাওয়া হয়। ঝর্ণায় মাছ পেলে মাছ রান্না হয়। বনমোরগ পেলে রান্না হয়। আর শাক-লতাপাতাতো আছেই। পেট ভরে যায়। শুধু দরকারের সময় ওষুধ নাই। এটাই আমাদের বড় সমস্যা।
- আসলে এই দুর্গম এলাকায়তো ডাক্তার থাকবে না। আপনাদের ঔষধি গাছপালা আছে না?
- হ্যাঁ, আছে। আমাদের একজন বুড়ো আছে যে গাছপালা খুব বোঝে। ছোটখাট অসুখে আমাদের তেমন অসুবিধা হয় না। তিনি আমাদের গাছগাছালির ওষুধ খাওয়ান। বড় অসুখ হলে চট্টগ্রাম হাসপাতালে যাই।
- ঠিক কাজ করেন। বনৌষধি খাওয়ার খুব দরকার।
- ঠিক বলেছিস রে আশিকা। আমাদের পার্বত্যভূমির বাসিন্দাদের এই ওষুধ তাদেরকে সতেজ রাখে।
আশিকা থাংপুর দিকে তাকিয়ে থাকে। ও বুঝে যায় যে লোকটি বেশ সচেতন। লেখাপড়া তেমন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। কিন্তু মাথা টাইট। বোঝার শক্তিতে জোয়ান। ওকে স্যালুট করতে হয়। কিন্তু আশিকা কিছু বলার আগে গাড়ি এসে থমথই পাড়ার কাছে থামে। পাহাড়ের আশেপাশে রাস্তার চারদিকে কিছু দোকানে বিক্রি হচ্ছে চা। কিছু দোকানে রাখা আছে নানা পণ্য। মুরংরা বিভিন্ন দিকে চলাচল করছে। কেউ এক নজর গাড়ির দিকে তাকায়। কেউ গ্রাহ্য না করে চলে যায়। ছোট ছেলেমেয়েরা দৌড়ে আসে গাড়ির কাছে। দলবেঁধে দাঁড়ায়। সবার মুখের দিকে তাকায়। কেউ হাসে কেউ চুপ করে থাকে। একজন জিজ্ঞেস করে, তোমরাতো শহরের লোক। এখানে কেন এসেছ?
আশিকা সবার মাথা ছোঁয়। ওদের সামনে গিয়ে হাসে। বলে, আমরা তোমাদেরকে দেখতে এসেছি। তোমরা কেমন আছ?
- আমরা ভালো আছি। তোমাদেরকে দেখে আমাদের খুশি লাগছে।
- বাহ্ তোমরাতো খুব লক্ষ্মী ছেলেমেয়ে। তোমার নাম কি সোনামণি?
- আমি নানকি। ও থংচুপু। আমরা দুই ভাইবোন।
- আমরা সবার নাম জানব। তোমাদের নাম জেনে তোমাদেরকে মনে রাখব। তোমাদের দেখে আমার প্রাণ জুড়িয়ে গেল।
- তোমার নাম কি দিদি?
- আশিকা।
- আশিকা - আশিকা। সহজ নাম। ডাকতে ভুল হবে না।
আশিকা দুজনকে জড়িয়ে ধরে।
একজন বলে, নাম কেন জানবে? এত নাম কি মনে রাখতে পারবে?
- পারব। পারব। ভুলে যাওয়ার আগে সবার নাম লিখে রাখব। তাহলে আর ভুল হবে না। দেখ পারি কিনা?
- মোটেই পারবে না। তোমরাতো দুদিন পরে চলে যাবে। তোমাদের সঙ্গে আমাদের আর দেখা হবে না।
ইউনুস জোর দিয়ে বলে, হবে। হবে। তোমরা আমাদেরকে পেয়ে খুশি হয়েছ সেজন্য আমরাও খুশি। আমরা এখানে যতজন এসেছি সবাই মিলে তোমাদেরকে ঢাকায় বেড়াতে নিয়ে যাব।
আশিকা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, ঠিক বলেছিস রে। আমরা এই কাজটা করতে পারি। ওদেরকে শহর ঘুরিয়ে দেখাব।
নানকি বলে, আমরা যাব না। আমাদের বাবা-মাও যেতে দেবে না। যখন আমরা বড় হব তখন যাব।
- ঠিকতো? যাবিনা? তোরা দাঁড়া আমি ছবি তুলব।
ছেলেমেয়েরা গোল হয়ে দাঁড়ালে সবাই মোবাইলে ছবি তোলে। ছবি তুলে ওরা খুশি। নানকি বলে, দ্রিম দ্রিম। সব ছেলেমেয়ে হাততালি বাজায়। শরীর দুলিয়ে নাচের ভঙ্গি করে। থংচুপু বলে, তোমরা আমাদের জন্য কি এনেছ?
সুহাস ওদের কাছে এগিয়ে যায়।
- তোমাদের জন্য আমরা বিস্কুট এনেছি। আর ওই যে চায়ের দোকান তোমাদেরকে ওখানে নিয়ে চা খাওয়াব।
- হ্যাঁ, চা-বিস্কুট খাব। চা বিস্কুট খেতে আমরা অনেক ভালোবাসি। তোমরা আমাদের অতিথি। আমরা তোমাদেরকে কিছু খাওয়াতে পারবনা।
- থাক, থাক এসব কথা বলতে হবে না রে। তোরা যা খেতে চাইবি আমরা তোদেরকে তা খাওয়াব।
- না, আমরা চাইবনা। আমরা চেয়ে খাই না।
- বাব্বা, তোরাতে তুখোড় ছেলেমেয়ে। ঠিক আছে, আমরা ঠিক করব যে তোদেরকে আর কি খাওয়াব। চল, চল যাই।
ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুহাস, ইউনুস, মঞ্জুরি, সেঁজুতি চায়ের দোকানে যায়। হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে বেঞ্চে বসে। পা নাড়াতে থাকে। বাচ্চাদের এমন খুশির আমেজ উপভোগ করে সবাই। দোকানে ওদের নিজেদের কি খাবার আছে সেসবের অর্ডার দেয়, যেন ছেলেমেয়েদের খুশির জোয়ার বেড়ে যায়। ওদের স্মৃতিতে থাকবে শিশুকালে বাঙালিরা এখানে এসে ওদেরকে খাইয়েছিল। এই স্মৃতি মনে রেখে গল্প করবে অন্যদের সঙ্গে। সুহাস দোকানের সব খাবার কিনে ছেলেমেয়েদের সামনে নিয়ে আসে। থালা ভরে ওদেরকে খেতে দেয়। ওরা উচ্ছ্বসিত হয়ে খেতে শুরু করে।
সুহাস, ইউনুস, মঞ্জুরি, সেঁজুতি ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা চারজনই ভাবে যে, এ এক অন্য দৃশ্য। বিশে^র কোথাও এই দৃশ্য দেখা যাবে না। আপন ভুবনের নতুন রঙে ডুবে যাওয়া এমনই। ওরা ওদের মাথায় হাত রেখে আদর করে। থালায় খাবার তুলে দেয়। ওরা ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে মুখে খাবার তুলে নেয়।
আশিকা রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকায়। শুধু তাকায় না। যেদিকে দেখার চিন্তা সেদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে যায়। দৃশ্যের রদবদল ঘটে। ও মানুষ আর প্রকৃতির সংযোগ বুঝতে চেষ্টা করে। আসিফ এসে পাশে দাঁড়ায়। ও দূর থেকে আশিকাকে দেখছিল। ও এদিক, ওদিক ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, হাত নাড়ছে, পাখির ডাক শুনে তালি দিচ্ছে, নিজেও পাখির মতো ডাকার চেষ্টা করছে। সেই শব্দ ভেসে যাচ্ছে বাতাসে। জিজ্ঞেস করে, কি দেখছিস রে?
- এই সবুজের মাঝে নিজেকে দেখছি। এ এক মহান জগৎ। নিজেকে খুঁজে ফিরছি সবখানে।
- কিভাবে খুঁজছিস?
- এতকথা বলতে পারবনা। খোঁজার আনন্দ নিজের মধ্যেই থাকুক। আর কিছু জিজ্ঞেস করবি না।
আসিফ হাসতে হাসতে বলে, বনে এসে নিজেকে দেখা? তুই বাপু ভাবতেও পারিস। তোর মতো এমন চিন্তা আমরা করতে পারিনা রে আশিকা।
আশিকা চোখ বড় করে বলে, বন হয়েছে তো কি হয়েছে? আমার কাছে বন, মরুভূমি, সাগর সবই সমান। যেখানে যাই না কেন নিজেকে নতুন করে দেখার সুযোগ পাই। এটা আমার নিজের সঙ্গে খেলা।
- ভালোইতো। ওই দেখ শুকনো ডালপালা নিয়ে তিনটি মেয়ে আসছে। ওদেরকে খুব সুন্দর লাগছে। শহরের দৃষ্টিতে ওরা সুন্দরী না। আমার সামনে ওরা বনের সৌন্দর্য। গায়ে আছে কালোর দুত্যি। যৌবন টানটান। কোথাও ফুটো নেই।
- এভাবে ওদের দিকে তাকাবি না আসিফ। ওদের মাথার খড়ির বোঝা নিয়ে তোর মাথা ভাঙবে।
- সৌন্দর্য দেখার ইচ্ছা কার নেই? তুই আমাকে শাসন করছিস কেন?
- শাসন তো করতেই হয়। মেয়ে দেখলেই তোদের মাথা ঘুরে ওঠে। বদমাইশির আর জায়গা পাসনা।
- খবরদার এভাবে কথা বলবিনা আশিকা।
আশিকা ওর প্রশ্নের জবাব দেয় না। এগিয়ে যায় মেয়েদের দিকে। ওরা থমকে দাঁড়ায়। আশিকাকে বলে, তোমরা কারা? কোথায় থেকে এসেছ? কেন এসেছ?
- আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। তোমাদের এখানে বেড়াতে এসেছি। তোমাদের এখানে কতকিছু যে আছে তা দূরে থেকে জানতে পারিনা। দেখে আনন্দে মন ভরে যাচ্ছে।
তিনজনই খিলখিলিয়ে হেসে বলে, আমাদের এখানকার ঝর্ণা দেখতে এসেছ?
- শুধু ঝর্ণা না। পুরো এলাকা দেখতে এসেছি।
- যাও যাও। দেখতে যাও। অনেক মজা পাবে। ঝর্ণার জলে মাছ আছে।
আসিফ দুহাত তুলে বলে, থাম থাম। আমরা ঝর্ণার পানিতে মাঝ দেখতে আসিনি শুধু। আমরা তোমাদেরকেও দেখতে এসেছি।

 

ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (প্রথম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (দ্বিতীয় পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (তৃতীয় পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (চতুর্থ পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (পঞ্চম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (ষষ্ঠ পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (সপ্তম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (অষ্টম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত ( নবম পর্ব)

 

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top