সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব দশ) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
২৪ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:৪৯

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:০২

ছবিঃ অমর মিত্র

 

রাজা গন্ধর্ব সেনের দুই রানী ছিল, দুই রানীর দুই পুত্র, তাছাড়াও ছিল গণিকা রসমঞ্জরী, রসমঞ্জরীর কথা জানতো খুড়িমা, এখন যার কথা শোনা যায় গণিকা দেবদত্তা, তারই মা, দেবদত্তা নাকি পরমাসুন্দরী অতি গুণবতী। বলল পদ্মাবতী, রেবার প্রতিবেশিনী, তারই বয়সী, স্বামীপুত্র ভরা সংসরে গরবিনী। বলতে বলতে তাম্বুল মুখে নিল। পিকদানিটিও হাতে করে এনেছে সে, তাম্বুল রসে ঠোঁট দুটি যে সব সময় রাঙা। 

কথাটা শুনল রেবা। দূরে বসেই শুনল। সে কাপড় রাঙাচ্ছিল গৈরিক রঙে। এরপর এই কার্পাস বস্ত্রে লতাপাতার ছাপ ফেলবে কাঠের ছাঁচ দিয়ে। এই কাজটি তাকে শিখিয়েছিল তার স্বামী। কার্তিককুমার কত কিছুই না জানত। কাঠের কাজ করত সুন্দর। তার হাতে তৈরি এই লতাপাতার ছাঁচ অপূর্ব প্রতিরূপ। কার্তিককুমার বলত, ঝরা পাতা, ঝরা ফুলের ছাঁচ তৈরি করবে, শীতে যখন পাতা ঝরতে শুরু করে, বাতাসে ঝরা পাতারা যেভাবে ওড়ে, অবিকল সেই ছাপ তুলবে রেশম বস্ত্রে, ওই বস্ত্র পরলে যেন মনে হয় বসন্ত আসছে। পাতা তো বসন্তের আরম্ভেও ঝরে। পত্র ঝরণের মায়া আনবে বস্ত্রে। কার্তিককুমার বলেছিল, যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে অমন বস্ত্র ছাপাই করে সে রেবাকে দেবে, নিয়ে যাবে রাজসভায় রানী ভানুমতীর জন্য। রেবার ঠোঁটের কোণে মলিন হাসির ভাব জাগল, সে এক সৈনিকের বউ, তার জন্য এবং রানীর জন্য একই রকম বস্ত্র! এ কখনো হয়, হতে পারে? সেই জন্যই কি মানুষটা যুদ্ধ থেকে ফিরল না। রেবা ঘুরে তাকায় গন্ধবতীর দিকে। গন্ধবতী উঠে দাঁড়িয়েছে।

পদ্মবতী, যাকে কথাটা বলেছে, সে হলো বুড়ি পার্বতী। এও প্রতিবেশিনী। তবে অনেক বয়স, স্বামী বেঁচে নেই, বহুকালের বিধবা। একটু কূটনি প্রকৃতির। আদি রসে উৎসাহ বেশি। পদ্মাবতীর কথায় বুড়ি পার্বতী বলল, পুরুষমানুষ যদি দশটা মেয়েমানুষ ভোগ না করে তবে সে কিসের পুরুষ, গন্ধর্ব সেনের আরো কত গণিকা ছিল, কোনো পূর্ণিমায়, উৎসবে স্বামীর মুখ দেখতে পেত না রানীরা, পুরুষমানুষ তো এমনই হয়।

না, না তা কেন, রাজারা এমন হন। পদ্মাবতী কথাটা বলে রেবার দিকে ফিরে সমর্থন চায়। রেবা জলে হাত ধুয়ে আঁচল মুছতে মুছতে গন্ধবতীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তুই উঠলি যে, কোথায় যাবি?

গন্ধবতী বলল, জল আনতে যাই ই”দারায়।

যাবি রে যাবি। পদ্মাবতী হি হি করে হেসে পিকদানিতে পিক ফেলল, এখনই ইঁদারায় গিয়ে একা বসে থাকবি, ও রেবা, ওর ভাল সম্বন্ধই তো এসেছে।

রেবা জবাব দিল না। আকাশে তাকায়। পৌষ মাসের পক্ষকাল কেটে গেছে। সূর্যদেবের উত্তরায়ণ শুরু হয়ে গেছে বেশ ক’দিন। রোদের তাপ এখনো বাড়েনি বটে, আর দু’পক্ষ কাটলেই ধার বাড়বে। তেমনই তো হয়ে থাকে।

এবার অবন্তীদেশে শীতের কামড় অন্যান্য বৎসরের তুলনায় কম তীব্র। উত্তরদেশ থেকে শৈত্য বয়ে আনা বাতাস গতবারের চেয়েও যেন হীনবল। এই দেশে এই সময়ে রাতের তাপমাত্রা অনেক নেমে আসে, শীত প্রবল হয়। রাতে শীত যেমন প্রবল, দিনমানে সূর্যের কিরণে সব দিক পরম উষ্ণতায় ছেয়ে যায়। এ বছর দিনমানের উত্তাপ আছে, কিন্তু তাতে জারিত হওয়া যেন নেই। রোদ আছে তার উজ্জ্বল নেই। কেমন ঘোলাটে ভাব যেন রোদের ভিতর। আকাশের নীলেও যেন ধূসরতা মিশে গেছে। অবন্তীদেশের মানুষের কাছে এই সময়ের রৌদ্র অতি প্রিয়। দুপুরে রৌদ্রসেবন করতে করতে মানুষ গল্প করে। গল্পের জন্য দুপুরটি এই দেশের রমণীদের কাছে প্রশস্ত। রেবার আঙিনায় তিন প্রতিবেশিনীর গল্প হচ্ছিল। 

রেবা আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে পদ্মবতীকে জিজ্ঞেস করে, গোধূম হয়েছে?

পদ্মবতী মাথা নাড়ে, যেমন তোদের জমিতে হয়েছে, ও খুড়িমা এখন কখনো হয়নি গো, গোধূম ক্ষেত দেখে এস, দেখে আয় রেবা।

দেখেছে রেবা। গোধূম বপন করা হয়েছিল কার্তিকের শেষে। গতবার তবু কিছু জন্মেছিল, এবার অধিকাংশই অঙ্কুরিত হয়নি। মাটিতে জল নেই বলছিলেন শ্বশুরমশায়। এই সময়ে গোধূম ক্ষেত সবুজ হয়ে থাকে। সেই সবুজতা ধূসর হয়ে গেছে যেন। এখানে ওখানে খণ্ড খণ্ড মলিন সবুজ গোধূমপুঞ্জ বাকি অংশে, ধূসর কৃষ্ণ মৃত্তিকা। কী চেহারা হয়েছে দশদিকের। কাপাস বনের গাছগুলি হতশ্রী। অবন্তীদেশের এমন বিষাদময়ী রূপ দ্যাখেনি মানুষ। বসন্তে ফুল ফুটবে তো?

রেবা গোধূমের কথা তুলল প্রসঙ্গ বদলাতে। কিন্তু বুড়ি পার্বতী আবার প্রসঙ্গেই ফিরে যেতে চাইল, বলল, গন্ধর্বসেনের ভোগের স্পৃহা ছিল, অবন্তীর রাজা ভর্তৃহরির তা নেই।

উনি তো নাকি কবি? জিজ্ঞেস করল পদ্মাবতী রেবাকে।

রেবা বলল, তাই তো শুনেছি।

মহাকবি ভাসের মতো?

তা তো জানিনা।

পদ্মাবতী বলল, স্বপ্ন বাসবদত্তম তো মহাকবি ভাসেরই রচনা শুনেছি।

গন্ধবতী এবার যোগ দিল কথায়, হ্যাঁ, জানো খুড়িমা, স্বপ্ন বাসবদত্তম নাটকে একজন আছেন পদ্মবতী, তিনি বৎসরাজ উদয়নের মহিষী, মগধের রাজার ভগিনী।

পদ্মাবতী অবাক হয়ে বলল, আমি তো জানি ওটি উজ্জয়িনীর রাজা প্রদ্যোৎ  মহাসেনের কন্যা বাসবদত্তা আর বৎসদেশের রাজা উদয়নের কাহিনি, আছে নাকি পদ্মাবতী?

আছে, শুনবে তা?

বুড়ি পার্বতী বলল, ওই দ্যাখ বৎসরাজেরও দুই বিয়ে, আমাদের রাজা একটির বেশি মেয়েমানুষের দিকে তাকাবেন না, নিঃসন্তান তবুও বিয়ে করবেন না আর।

রেবা বলল, থাক খুড়িমা, রাজার কথা থাক।

থাকবে কেন, রাজা যদি নিঃসন্তান হয় রাজ্যের কি মঙ্গল হয়?

থাক, ওসব কথা বলার আমরা কে রেবা ভয় পায়।

বুড়ি পার্বতী বলে, আমরা না বললে কে বলবে, ওই যে আছে এক গণিকা দেবদত্তা, তার দিকেও নাকি রাজার মন নেই, মেয়েমানুষ নিয়ে থাকে না এমন লোক কি পুরুষ হয়?

কেন, রাজমহিষী পরম রূপবতী।

তার চেয়ে রূপবতী ওই গণিকা, তার নাকি অশেষ গুণ, ও রেবা তুই কি জানিস তা?

রেবার মুখ অন্ধকার হলো। বুড়ির লক্ষ্য কী তা ধরা যাচ্ছে। পদ্মাবতী অতটা ধরতে পারে না। খোলা প্রকৃতির সে। সে জিজ্ঞেস করে, গণিকার কী গুণ খুড়িমা?

বুড়ি ফোকলা দাঁতে হাসে, কী আবার গুণ, পুরুষ মানুষ বশ করে তারা, কত রকম জানে সব, তুই কি নাচতে জানিস, কাব্য জানিস, বীণাবাদন জানিস?

জানি না, কিন্তু ওরা জানল কী করে?

জানতে হয় ওদের, নাহলে পুরুষমানুষ ওদের ঘরে সর্বস্ব ঢেলে দেব কেন, কিন্তু অবন্তীর রাজার এ কী হলো, রাজা আটকুড়ো থাকলে, দেশেরও তাই হবে।

পদ্মাবতী ফিরল গন্ধবতীর দিকে। মেয়েটি পথের দিকে তাকিয়ে উদাসী। ওর উত্তরীয় ধরে টানল পদ্মাবতী, কী বলছিলি বল না, উদয়ন আর বাসবদত্তার কাহিনী, বাসবদত্তা, তো অবন্তীরই রাজকন্যা ছিল, তাই না?

গন্ধবতী বলল, তুমি কি জানো না সে কাহিনী?

পদ্মাবতী বলল, জানি কিন্তু ভুলে যাই, বললে মনে পড়ে, অনেকে খুব মনে রাখতে পারে, যেমন তুই, আমি পারি না।

উদয়ন আর বাসবদত্তার কাহিনী গন্ধবতী শুনেছিল ধ্রুবপুত্রের কাছে। ধ্রুবপুত্র সেই কাহিনী শুনেছিল গন্ধবতীর পিতামহ শিবনাথের কাছে। গন্ধবতী যতটুকু শুনেছিল, সব অবিকল মনে রেখেছে। সেই যে বৎসরাজপুত্র উদয়ন বীণাবাদন শেখাতেন উজ্জয়িনীর রাজপুত্রী বাসবদত্তাকে। তারপর দু’জনে উজ্জয়িনী থেকে অন্তর্হিত হয়ে বিবাহ করলেন। লাবাণক-এ হলো এক ভীষণ অগ্নিকাণ্ড, তখন বৎসরাজ গেছেন মৃগয়ায়। অগ্নিকাণ্ডে বাসবদত্তা আর বৎসদেশের মন্ত্রী মারা গেলেন। বৎসরাজ বিলাপ করতে লাগলেন অবন্তিকা বাসবদত্তার জন্য...। ধ্রুবপুত্র গম্ভীরার কূলে বসে এক অবরাহ্নে এই কাহিনী বলেছিল। ঘোষবতী বীণার কথা বলেছিল। সেই বীণা বাজাতেন বাসবদত্তা। সেই বীণা পাওয়া গেল কুরচি বনে, রেবা নদীর তীরে। উদয়ন যেন শুনতে পেলেন ঘোষ রাগে বীণা বেজে চলেছে। গন্ধবতীর মনে পড়ে এ কাহিনী বলতে বলতে ধ্রুবপুত্রের চোখে জেগে উঠত কী বিহ্বলতা! ধ্রুবপুত্র বলত, উদয়ন আর বাসবদত্তা জানতেন না, তাঁদের পরিণয়ে সম্মত ছিএলন অবন্তীর রাজা প্রদ্যোৎমহাসেন আর রাজমহিষী। বড় আঘাত পেয়েছিলেন তাঁরা যখন বাসবদত্তা উজ্জয়িনী ছেড়ে চলে গেল উদয়নের সঙ্গে। তাঁরা রাজপুত্র রাজকন্যার ছবি আঁকিয়ে পুরোহিত ডেকে মিলন ঘটিয়েছিলেন। এমনও কী হয়? সত্যি হয়? সেই বিবাহ, সেই মিলন কি শাস্ত্রসিদ্ধ? গন্ধবতী মনে মনে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। দু চোখ বন্ধ করে ধ্রুবপুত্রের মুখখানি মনে করতে থাকে। ধ্রুবপুত্র যেন বৎসরাজ উদয়ন। গন্ধবতী নিজেকে মনে মনে বাসবদত্তা কল্পনা করে। মিল নেই, কোনো মিল নেই এ কাহিনীতে, ধ্রুবপুত্র কি মনে রেখেছে তার কথা? তাও রাখেনি হয়ত।

পদ্মাবতী ডাকল, চুপ করে আছিস কেন?

বুড়ি পার্বতী বলল, বাসবদত্তার গল্প কে না জানে, থাকে, বলি কি অবন্তীর রাজা কী রকম মানুষ, রাজা বোধহয় পুরুষ না।

আহ্ কী বলছ খুড়ি মা, রাজ-নিন্দা পাপ!

বর্ষা হয়েছে শেষ কবে, বারো বারো চব্বিশ মাস কেটে গেছে, রাজা নিঃসন্তান বলেই এদেশে মেঘ নেই, কথাটা কি মিথ্যে, জোয়ার হল না, গোধূম হবে না, বলি মানুষ খাবে কী?

রেবা বলল, উনি হুন দমন করেছেন।

পার্বতী বলে, হুনরা নাকি আবার আসবে?

বুকটা ধক করে ওঠে, রেবা মুখ নিচু করে বলল, জানিনে তো।

এই ধ্রুবপুত্র নাকি হুন রাজ্যে পালিয়েছে? বুড়ি পার্বতীর দিকে তাকায়, ও মেয়ে দুই কিছু জানিস, সে বেটা গেল কোথায়?

গন্ধবতী বলে, সে জানেনা। মুখ ঘুরিয়ে নেয় সে। চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে

তুই জানিস না, তা জানবিই বা কী করে, সেই গণিকা জানে?

গন্ধবতী কাঁপছিল, জবাব দেয় না।

গণিকাকে দেখেছিস, ও মেয়ে? বুড়ি ডাকল, কত সুন্দরী সে, খুবই হবে, নাচ গান নিয়ে যারা  থাকে, তারা সুন্দর হয় যে কেন?

কী জানি কেন হয়, শুনি তো যেমন রূপ তেমন গুণ। তাম্বুল রসে ঠোঁট রাঙাতে রাঙাতে বলল পদ্মবতী বলতে থাকে, আমি গেল শ্রাবণী পূর্ণিমায় মহাকাল গেছিলাম, তখন এক গণিকাকে দেখেছিলাম খুড়িমা, ওই আমার গণিকা দেখা।

দেবদাসী?

দেবদাসী না খুড়িমা, গণিকাই।

তারাও তো তাই। বুড়ি বিড়বিড় করে।

সে কী, তা হবে কেন, তাঁরা মহাকালের সেবা করেন, গণিকা তো তা করে না, যা বলছিলাম সেই গণিকা কিন্তু তেমন সুন্দরী নয়। আমাদের মতোই শ্যামবর্ণ তার, চোখদুটি আবার বিড়ালির মতো, দেখে মনেই হবে না গণিকা, তবে সাজ খুব উগ্র, তা হোক, তাকে দেখে মনে হবে না কিন্তু সে গুণবতী, নৃত্য, বীণাবাদন জানে

কাকে বলতে দেখতে কাকে দেখেছিস তুই? বলল বুড়ি পার্বতী।

না খুড়িমা, সবাই বলল গণিকা।

কী নাম তার?

তা তো জানতাম, ভুলে গেছি।

দেবদত্তাকে দেখিসনি তো?

না তো, সে শুনেছি পরম রূপবতী, কাঁচাসোনার মতো রং তার।

কে বলেছে? বুড়ি জিজ্ঞেস করে।

কে আবার বলবে, শোনা কথা।

কার কাছে শুনেছিস?

ভুলেই গেছি, কেউ না কেউ বলেছে।

তোর স্বামী?

জিভ কাটে পদ্মাবতী, সে এসব কথা বলে! বলে না, তবে বলতেও পারে, আমার মনে নেই, সে তো গণিকালয়ে যায় না।

তবে যায় কোথায়?

তাতো জানি না।

যার নিশ্চয়।

পদ্মাবতী হি হি করে হাসে, গেলে কি বলবে?

বুড়ি পার্বতী বলে, তোর খুড়ো মানুষটা বলত, কিছুই গোপন করত না আমার কাছে, সেই তো বলে রসমঞ্জরীর কথা, আমি বললাম বীণাবাদন শিখব।

পদ্মাবতী হি হি করে হাসে আবার, শিখলে?

বুড়ি মাথা নাড়ে, ঘরের বউ ওসব শিখে কী হবে, বলল সেই মানুষ।

খুড়ো কি রসমঞ্জরীর কাছে যেত?

বুড়ি মাথা নাড়ে, তা কী করে যাবে, রসমঞ্জরী ছিল রাজার গণিকা, সে বলত তার কথা।

তুমি শুনতে?

হ্যাঁ, শুনতে শুনতে কী রকম যেন মনে হতো, সে যেত বারাঙ্গনা পল্লীতে, আমি  একবার রামগিরি গিয়েছিলাম কার্তিকেয়র মন্দিরে, যেতে দেখেছিলাম বারাঙ্গনাপল্লী, উজ্জয়িনীর পুবদিকে আছে, বিজন এলাকায় নিঃঝুম হয়ে আছে, তখন বিহানবেলা তো, সব ঘুমিয়েছিল, কী হতশ্রী চেহারা!

রেবা হাত তুলল, থাক না এসব খুড়িমা, মেয়েটা রেয়েছে।

রয়েছে তো রয়েছে, মেয়ে কি শিশু, বয়স হয়নি?

রেবার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। গন্ধবতী আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। একটু দূরে। তার সমস্ত শরীর কেমন শক্ত হয়ে যাচ্ছে দাদি বুড়ি আর খুড়িমার আলাপ শুনতে শুনতে। উঠে এল বটে, কিন্তু কৌতুহল তো হচ্ছিলই। দোটানায় পড়ে গেছে সে দূরে দাঁড়িয়ে বুড়ি পার্বতীর উচ্চকণ্ঠ বর্ণনা শুনতে লাগল বারাঙ্গনাপল্লীর বুড়ি বলছে সেদিন তার খুব কষ্ট হয়েছিল গো-শকটে যেতে যেতে। স্বামীর জন্যই কষ্ট। মানুষটা এই বারাঙ্গনাপল্লীতে আসে ফূর্তি করতে। তাদের যদি অনেক সম্পদ থাকত, ধনী হতো যদি তারা, তাহলে কি বারাঙ্গনাপল্লীর ভোক্তা হতো তার স্বামী? বুড়ির কথা শুনতে শুনতে ভুলো-মনা পদ্মাবতী বলে, তার স্বামী যায় না কোথাও। তা শুনে অবিশ্বাসীর কী হাসি।

গন্ধবতী আকাশ দেখতে দেখতে গৃহের সীমানায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে কেতকী বনের গায়ে। এখন তার কানে কথা আসছে না। কখনো কখনো উচ্চকিত হাসির শব্দ ভেসে আসছে। বীণাবাদন, নৃত্য এসব কি শেখা যায়না? গণিকা ব্যতীত কারো অধিকার নেই ওই বিদ্যায়? ধ্রুবপুত্র যে বীণাবাদন, নৃত্যের অনুরাগী তা তো সে জানতেই পারেনি। এখন মনে হচ্ছে ওই গুণে গুণবতী না হলে.....? বুক হা হা করে করে ওঠে গন্ধবতীর।

রেবা ডাকল, ও সুগন্ধা ওখানে দাঁড়ালি কেন?

খুব শক্ত মেয়ে গন্ধবতী, ফিরে তাকায়, বলল, এমনি মা

পদ্মাবতী ডাকল, এদিকে আয়, এসব জানতে হবে বৈকি।

কী জানছে সে? জানছে কেন ধ্রুবপুত্র দেবদত্তা গণিকার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিল। সে তো পুরুষমানুষের ইতিহাস শুনছে যেন। এক নারীতে তাদের তৃপ্তি নেই। পুরুষের প্রকৃতিই এমন। গৃহবধূ গৃহে থাকবে, সন্তানের জন্ম দেবে, পুরুষ ঘুরবে এ নারী থেকে ও নারীতে। ধ্রুবপুত্রও কি তাই? কেমন হবে সে ভবিষ্যতে? গন্ধবতীর দুচোখ ভিজে যায় ধীরে ধীরে। তার সাড় নেই। দুচোখ অশ্রুধারা নেমে আসছে বুকের উপর। কল্পনায় সে দেখতে পাচ্ছে সব। গণিকায় আসক্ত হয়েই তো ধ্রুবপুত্র তার কাছ থেকে সরে গেল। সেই চৈত্র পূর্ণিমার রাতে, চাঁদ যখন পশ্চিমপারে ঢলেছে, ধ্রুবপুত্র গম্ভীরার জলে দাঁড়িয়ে। কত ডাকল সে। মোহাচ্ছন্নের মতো উঠে এল বটে, কিন্তু হাঁটল উত্তরপূর্বদিকে। তার দিকে ফিরেও তাকাল না। গন্ধবতীর গায়ে হাত রাখল রেবা, কী হলো?

কী সব বলছ তোমরা?

আমি কিছু বলছি না।

আমার বাবাও কি ওই রকম ছিল মা?

রেবা মাথা নাড়ে, তিনি তো ছিলেন যোদ্ধা, হূণ দমনে গিয়ে পথ হারিয়েছেন, বীর তিনি, তিনি কেন যাবেন ওসব জায়গায়, তাঁর প্রকৃতিই ছিল আলাদা।

এই কথা শুনতে শুনতে গন্ধবতী দেখতে পাচ্ছিল দূরে তার পিতামহকে। শিবনাথ তার সঙ্গে একজনকে নিয়ে আসছে। গন্ধবতী উত্তরীয়তে চোখ মুছল। তাম্রধ্বজ? হ্যাঁ সেই তো। অরণ্যচারী ব্যাধের মতো চেহারা মানুষটার, কিন্তু কী ঠান্ডা প্রকৃতি। একদিনই এসেছিল সে। সেই দীপাবলীর সময়। গন্ধবতীর বুক কাঁপল। খোঁজ এনেছে তাহলে ধ্রুবপুত্রের। খোঁজ এনেছে বাবার? গন্ধবতী বলল, মা সেই তাম্রধ্বজ, গণনা করেছে নিশ্চয়, ও মা।

গন্ধবতী দেখল ভীত রেবা সরে যাচ্ছে আঙিনা থেকে। গৃহের অভ্যন্তরের অন্ধকারে লুকোল তার মা। সে একা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। দশার্ণ দেশীয় জ্যোতির্বিদের জন্য।

পদ্মাবতী আর বুড়ি পার্বতী কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যাচ্ছে আঙিনা থেকে।

চলবে

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top