সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

র্ঝনাধারার সংগীত (পর্ব এগার): সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
২৪ মার্চ ২০২১ ১৯:১২

আপডেট:
১৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:০৫

 

- কি গল্প শুনবে? তোমরাতো ছোট বাচ্চা না যে গল্প শুনবে? রাজা-রানী-ভূত-প্রেতের গল্প শুনবে?
- তোমাদের পাহাড়ে রাজা-রানী আছে?
- আছেতো। থাকবেনা কেন?
- তাদের রাজ্য কি?
- পাহাড়ি বনজঙ্গল। যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে দেখ যে কত বড় রাজ্য এখানে।
- রাজা-রানী কে? কোথায় থাকে।
- রাজা-রানী আমরা সবাই।
ওরা তিনজন উচ্ছ¡সিত হাসিতে মাতিয়ে তোলে পাহাড়ি এলাকা। আশিকাসহ অন্যরাও হাসতে থাকে।
হাসি থামলে আশিকা গড়গড়িয়ে বলে, আমরা তোমাদের এলাকার গল্প শুনব। গাছপালা-পশুপাখির গল্প। ঘরের গল্প। এখানে বাস করা মানুষের গল্প।
- ও বাব্বা, তোমাদের ইচ্ছাতো অনেক বড়। এত গল্প শোনাতে তো আমাদের মাস গড়িয়ে যাবে। তোমরা কি থাকতে পারবে এতদিন? আমরা তোমাদের রাখতে পারবনা। নিজেদের ভাত নিজেরা খাবে।
মঞ্জুরি হাততালি দিয়ে বলে, তোমাদের এমন সরাসারি কথা শুনতে খুব ভালোলাগছে। তোমাদের নাম বলতো বোনেরা?
- আমি পুঞ্চন। আমি সুংতন। আমি দীপুতা।
তিনজনে নাম বলে কলসি ঝাঁকিয়ে বলে, জল খেতেও আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। তোমাদের মতো ঘুরে বেড়ানো আমাদের হয় না। 
সেঁজুতি এগিয়ে এসে পঞ্চুনের কলসির উপর হাত রেখে বলে, তোমরাতো ঘুরে বেড়ানোর এমন অপূর্ব জায়গায় বাস করো। তোমাদের আর ঘুরে বেড়ানোর দরকার নেই। 
- চলো আমরা ওই দিকে বনের পাশে গিয়ে বসি। তোমাদের এলাকায় বসে দেশের স্বপ্ন দেখি। 
- বাব্বা, তোমরা একতিছু ভাব কেন? আমরা এতকিছু ভাবিনা। বেঁচে থাকার জন্য নানারকম চিন্তা আমাদেরকে দুঃখে ভরে রাখে।
- আমরা চাই তোমাদের কোনো দুঃখ থাকবে না। তোমরাতো আমাদের সোনার মানুষ।
- হয়েছে, হয়েছে, অনেক বলেছ। আর কিছু বলতে হবেনা। চলো বসে পড়ি। একটুপরে বাড়ি গেলে অসুবিধা নাই। আমাদের বাবা-মা বকাবকি করবেনা।
ছেলেরা বলে, আমরা তাহলে কারবারির দোকানে যাই। তোরা আড্ডা দে।
থাংপু বলে, আমি গাড়ি নিয়ে চলে যাব। আপনারা কীভাবে ফিরবেন?
- আমরা বাসে যাব।
- ঠিক আছে। দরকার হলে আমাকে ফোন দিবেন। এখন কারবারির কাছে গিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। গাইড ছাড়া যেতে পারবেন না। উনি সব ঠিক করে দেবেন। রাতে থাকতে চাইলে সে ব্যবস্থাও করে দিবেন।
- থ্যাঙ্কু থাংপু। আবার দেখা হবে কখনো। তোমার সঙ্গে সময় কাটিয়ে আমাদের খুব ভালোলেগেছে। 
থাংপু মাথা নাড়ায়। হাতের মুঠিতে উপার্জনের টাকা। হাসি ছড়িয়ে চারদিকে তাকায়। অন্যদের হাসিমুখ দেখে। মনে হয়, কষ্ট করে বেঁচে থাকার এটাই আনন্দ। এসব ভাবনা নিয়ে থাংপু গিয়ে বসে জিপে। ছেলেরা কারবারির দোকানের দিকে যায়। মেয়েরা বনের ধারে চলে যায়।
জমে ওঠে মেয়েদের নানা গল্পগাঁথা। বেশিরভাগই নিজেদের গল্প। শৈশব থেকে শুরু করে বড় হয়ে ওঠার নানা কথা হয়। সবকিছুই গল্পের মতো কথা। পুঞ্চন বলে, আমরাতো আমাদের গল্প ছাড়া আর কোনো গল্প জানিনা।
- আমরাতো তোমাদের আরও গল্প শুনব বোনেরা।
- অনেক কথাতো বললাম। এর বেশি আমাদের বলার নাই। আর কি গল্প শুনবে?
- আমরা তোমাদের প্রেমের গল্প শুনব। গল্পের মতো বলে ফেল।
হা-হা করে হাসে নানকিং, পুঞ্চন, দীপুতা ও সুংতন।
- আমাদের চারজনের কারো প্রেম হয়নি এখনও। আমরা কাউকে পছন্দ করে প্রেম করার কথা ভাবি নাই।
- বল কি, আর কতদিন অপেক্ষা করবে? তোমাদেরকে দেখেতো মনে হচ্ছে প্রেমের বয়স হয়েছে। তাহলে কিসের অপেক্ষা?
- অপেক্ষা করব কেন? আমরা অপেক্ষা করি না। যখন যাকে ভালোলাগবে তার কাছে নিজের মন উজাড় করে দেব। সাড়া পেলে প্রেম হবে, না পেলে হবে না। তোমাদের প্রেম হয়েছে?
আশিকা মাথা নেড়ে বলে, না আমাদেরও প্রেম হয়নি। আমরা ঘুরেফিরে সময় কাটাচ্ছি। লেখাপড়া শেষ হলে প্রেম করব।
- তোমাদের কাউকে ভালোলাগে নি? তোমরাতো অনেক মেশামেশি কর।
- না, এখনো পছন্দ হয়নি। পছন্দ করতে চাইলে করতে পারতাম। আমরা ইচ্ছা করে করিনি। 
- তাহলে তোমাদেরওতো বয়স হয়েছে। তোমরা আমাদের মতো সময় কাটাচ্ছ। পছন্দতো হবেই। 
- হবেইতো, হবে।
মাথা নাড়ে সবাই। আবার যখন আসব প্রেমিকদের নিয়ে আসব। কিংবা স্বামী-স্ত্রী হয়ে আসব।
- সাবাস, বোনেরা। তখন আমরা তোমাদেরকে অনেক জায়গায় ঘুরাব। 
- এমন বনের মধ্যে হেঁটেচলে বাস করা কি খুব আনন্দের সুংতন?
- হ্যাঁ, আনন্দেরতো বটেই। ভয়েরও আছে। তবে আমাদের ভয় বুনো পশুদের নিয়ে। মানুষ নিয়ে না।
- তাহলেতো তোমরা ঠিকই আনন্দে আছ।
- চলো তোমাদেরকে নিয়ে বনের ভেতরে হেঁটে আসি।
- চলো। আশিকা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। লাফালাফি করে। বলে, তোমাদের সঙ্গে আমাদের বোনের বন্ধুত্ব নিয়ে আমরা শহরে যাব। আবার আসব। আমাদের আসতেই হবে। 
সবাই মিলে একসঙ্গে বনে ঢোকে। পাশাপাশি হাঁটা যায়না। ঘন বনে গাছের সারি রাস্তায় হাঁটার ফাঁক তৈরি করেনা। একজন একজন করে পার হতে হয় শূণ্য জায়গা। কোথাও কোথাও ফাঁকা জায়গা আছে। আশিকার মনে হয় এমন মগ্ন চৈতন্যে হেঁটে যাওয়া পথে বেঁচে থাকার সুষমায় দৃষ্টি মেলে রাখা যায়। এই পাহাড়ি বনভ‚মি ওদের মানসিক প্রশান্তি পূর্ণ করে দেয়। এই হাঁটা কখনো কখনো উড়ে যাওয়ার মতো হয়ে যায়। যেন পাখির ওড়ার বাসনা তৃপ্ত হয়। 

কিছুক্ষণ হাঁটার পরই নানকিং হাঁটতে হাঁটতে বলে, আমাদের জলের ঘড়াগুলো এখানে রেখে যাই। ঢাকনাতো আছে। ময়লা পড়বে না। রাখ তোরা সবাই। এই ভারী বোঝা নিয়ে আর কতদূর হাঁটব বনের ভেতর।
চারজনই বনের ভেতরের বড় গাছের নিচে কলসগুলো রেখে দেয়। একসঙ্গে গুছিয়ে রাখে। 
- আমরা এভাবে জল টানিনা। মাঝে মাঝে কলস নিয়ে যাই। কিন্তু বেশিরভাগ সময় বোতলে জল ভরে পিঠের ঝুড়িতে ভরে টেনে নিয়ে যাই।
- এসব ছবি ঢাকার পত্রিকায় দেখতে পাই। খুব সুন্দর লাগে। এমন দৃশ্যতো আমাদের চারপাশে নাই।
- তাহলে কি আমরা তোমাদের কাছে ছবির মানুষ?
- তোমাদের বন-পাহাড়-আকাশ-মেঘ-ঝর্ণা সবিতো আমাদের সামনে ছবির মতো। এর মাঝে তোমরা যখন কোনো কাজের জন্যও হাঁটো তাও আমাদের সামনে ছবির মতো লাগে। মনে হয় তোমরা বিধাতার সেরা মানুষ। তোমাদেরকে আপন চিন্তায় বানিয়েছে বিধাতা।
- কিন্তু আমাদের হাতের কাছে জল নেই কেন? প্রতিদিনের খাবারের জন্য এত কষ্ট করতে হয় কেন?
নানকিং হাত দিয়ে দীপুতার মুখ চেপে ধরে বলে, এসব কথা থাক রে। আমাদের বোনেরা আমাদেরকে নিজেদের কল্পনার ছবি বানিয়ে দেখছে। বানাক, যেভাবে খুশি সেভাবে দেখুক। শুনতে তো ভালোই লাগছে।
হাসির ধ্বনি ছড়িয়ে যায় চারদিকে। সুংতন হাসতে হাসতে বলে, আমাদেরকে দেখে ওরা কাগজে ছবি আঁকবে। আঁকুক। এঁকে পুরস্কার পাক।
- তোমরাতো বেশ মর্ডান মেয়ে দেখছি। দারুণ কথা বলে আমাদেরকে মাতিয়ে তুলেছ।
- ওই দেখেন জল আনছে আমাদের মেয়েরা।
- দূর থেকে এসব জল আনতে হয়। যারা সাঙ্গু নদীর ধারে থাকে তারা নদী থেকে নেয়। যারা দূরে থাকে তারা ঝর্ণা থেকে নেয়। বোতল আর পটে আমরা জল টানি পিঠের ঝুড়িতে করে। ওই ঝুড়িও আমরা নিজেরা বানাই।
- তোমরা অনেক কাজ কর বোনেরা। কাজের ভেতরে তোমাদের পাহাড়ি এলাকা ভরিয়ে ফেল। 
- হ্যাঁ, কাজতো করতে হয়। কাজ না করে আমাদের কোনো উপায় নেই। ভাত ভাওয়াবে কে আমাদেরকে? নিজের পেটতো নিজেদের ভরাতে হবে। আমরা কাজ না করে বসে থাকতে পারিনা।
- তোমাদের কাছ থেকে আমরা কাজের শিক্ষা নিলাম।
- তোমরাতো বসে বসে দিন কাটাও। তোমাদের আবার কাজ কি?
ওরা সবাই নিশ্চুপ থাকে। কেউ আর কথা বাড়ায় না। ওরা চারজন বুঝতে পারে বাঙালি মেয়েরা ওদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করবে না। তাহলে বন্ধুত্ব থাকবে না। মৃদু হেসে নানকিং বলে, তোমরা বেশ ভালো মেয়ে। বন্ধুত্ব রাখতে জান।
- তোমরাও বন্ধুত্ব রাখতে জান। সেজন্য আমাদের প্রশংসা করলে।
সবার মিলিত হাসিতে ঝমঝম করে বনের পরিবেশ। আশিকা, মঞ্জুরি, সেঁজুতির একসঙ্গে চিৎকার করে বলে, এখানে এসে আমাদের আনন্দের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তোমাদের পেয়ে আমরা ধন্য হয়েছি।
- বাব্বা, কত কথা। আমরা এতকথা বলতে পারিনা।
- আমরাও কথা বেশি বলব না। আমরা সবাই মিলে ঘুরে বেড়াই। আমাদের সময় কাটানো বনের মতো হয়ে থাক।
- চল যাই, বনের অনেক ভেতরে যাই।
দীপুতা বলে, ওই দেখেন বান্দুং আসছে। সঙ্গে আছে ওর ছোট্ট ছেলে।
মঞ্জুরি লাফিয়ে উঠে বলে, ওহ মাই গড, ছেলেটা দেখি শূকরছানার পিঠে বসে আছে। এমন দৃশ্য দেখা হবে তাতো আমরা ভাবতেও পারিনি।
- দারুণ, দারুণ। দারুণ দৃশ্য। বাচ্চাটি কেমন বীরের মতো বসে আছে। আশিকা, সেঁজুতি, মঞ্জুরি চেঁচামেচি করে।
- মনে হচ্ছে শূকরছানাটি ওর ঘোড়া। ও ঘোড়ায় চড়ে বনে ঘুরছে। দরকার হলে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করতেও যাবে।
- বাবা, আপনারাতো ওকে নিয়ে অনেক কথা বললেন। শুনতে খুব ভালোলাগলো। কোনো কোনো মা ছেলেমেয়েদের এভাবে নিয়ে যায়। ঘরে রেখে যেতে সাহস করে না। ওরা যদি একা একা বনের ভেতর চলে যায় কিংবা পাহাড়ের ঢালুতে গড়িয়ে পড়ে সেই ভয়ে।

দীপুতা বলে, দিদি আমি এখন যাই। ঘরে জলের ঘড়া রেখে শামুক খুঁজতে যাব। মা বলেছে শামুক রান্না করবে।
- কোথায় খুঁজবে?
- ওই দেখ ছোট ঝর্ণাটার পাশে। ওখানে অনেক শামুক পাওয়া যায়। আমিও মায়ের রান্না শামুক দিয়ে ভাত খেতে খুব ভালোবাসি।
- ঠিক আছে তুই যা দীপুতা। আমরাও আসছি। দিদিদেরকেতো কিছু খাওয়াতে পারলাম না। কি খাবি রে দিদিরা?
- আমরা তোমাদের ঝর্ণার জল খাব। আর কিছু না। আমরাতো কোনো দিন ঝর্ণার জল খাইনি। এখানে যখন এসেছি ঝর্ণার জল না খেয়ে যাব না।
- তা ঠিক, ঠিক বলেছিস আশিকা।
সেঁজুতি ওর কথায় সায় দেয়। ঝর্ণার জলের টেস্ট কি শহরের পানির চেয়ে আলাদা হবে?
- না টেস্ট করে কেমন করে বুঝব।
মঞ্জুরি ওকে থামায়।

চলবে

 

ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (প্রথম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (দ্বিতীয় পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (তৃতীয় পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (চতুর্থ পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (পঞ্চম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (ষষ্ঠ পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (সপ্তম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (অষ্টম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত ( নবম পর্ব)
র্ঝনাধারার সংগীত (দশম র্পব )

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top