সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পনের) : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
২৪ মে ২০২১ ১৭:৪৮

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:০৯

 

এখন সকাল প্রায় দশটা। নাজনিন বাইরে গেছে তার কিছু কেনাকাটা বা অন্যকাজে। ওর ছেলেমেয়েরা স্কুলে। বাসায় শুধু আমি, গৃহকর্মীরা আর আমার নার্স লতিফা যার সার্বক্ষণিক সেবা-শুশ্রুষায় আমাকে নিতান্ত বাধ্য হয়েই দিনের পর দিন আমাকে অতিবাহিত করতে হয়। আমি আমার কক্ষে অলসতা উপভোগে কিছু বাংলা কবিতার বইয়ের পাতায়, সাহিত্যের বনভূমিতে এক নতুন আগন্তুকের মতো বিচরণের চেষ্টা করছিলাম। একুশ বছর ধরে বাংলা উপন্যাস, গল্প, কবিতার সঙ্গে আমার পাঠ সংযোগ নেই। এতকাল ধরে বাংলা ভাষার চর্চা না থাকায় এই ভাষার রস, রূপ, মাধুর্য আমি এখন আর আগের মতো উপভোগ করতে পারি না। মাত্র একুশ বছরের মধ্যে নিজের মাতৃভাষা ভুলে যাওয়া, প্রিয় পরিজনদের ভুলে যাওয়া বড় লজ্জার বিষয়।

লাইব্রেরি কক্ষের দেয়ালের র‌্যাকগুলিতে ইংরেজি আর বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস, কবিতার বইয়ে ঠাসা। দেশি-বিদেশি সব বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিকদের বইয়ে সমৃদ্ধ। র‌্যাকের একটি অংশে ছোটনের ছবি, ছোটনের নিজের যত প্রিয় বই নাজনিন গভীর মমতায় সাজিয়ে রেখেছে। এই বইগুলির মধ্যে আছে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ, উপন্যাস সমগ্র এবং গীত বিতান। আরো আছে জীবনানন্দ দাসের কাব্য সমগ্র, সুকান্ত সমগ্র, সুকুমার রায়ের ছড়াগ্রন্থ এবং সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত সন্দেশসহ আরো কিছু বই। বইগুলি অনেক পুরাতন, পাতাগুলি বিবর্ণ হলুদ। আমি র‌্যাক থেকে গীত বিতান হাতে নিতেই একটা স্মৃতির গন্ধ আমার নাকে ভেসে এল। এইসব বইগুলি ছোটন ক্লাস টেনে পড়ার সময় স্কুলের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ও কবিতা আবৃত্তিতে প্রথম হওয়ায় ওকে আমি উপহার দিয়েছিলাম। লেখাপড়ায় ও ছিল মেধাবী, কিন্তু স্বভাবে ছিল চাপা, বয়সের তুলনায় গম্ভীর।

আমি ওর অতি গম্ভীরতার কারণেই মাঝে মধ্যে বকতাম। খেলাধুলা, স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ওকে চাপাপাচি করতাম। আমার বকাবকিতেই ও নিতান্ত বাধ্য হয়ে বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ও শুধু কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল কোন কবির কোন কবিতা আবৃত্তি করব? আমি বলেছিলাম তোর যেটা ভালো লাগে, যেটা তোর কণ্ঠে মানাবে সেটাই করবি। কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ এটা আবৃত্তি করতে পারিস। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেছিল শামসুর রাহমানের অতি পুরাতন কবিতা-‘দুঃখ তার লেখে নাম’। ও আবৃত্তি নয় যেন পৃথিবীর সব দুঃখ নিয়ে স্বর্গীয় পাখির মতো গান গেয়েছিল। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ। সবার চোখেই পানি। আবৃত্তি শেষে সবাই ভুলে গিয়েছিল হাততালি দিতে। শ্রোতাদের মন, শ্রোতাদের চোখের পানি ও দেখতে পায়নি। হাততালি না পাবার দুঃখে ও মাথা নিচু করে মঞ্চ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। অন্যান্য অনুষ্ঠান শেষে আবৃত্তিতে প্রথম হবার ঘোষনায় যখন ওর নামটি ঘোষিত হল তখন আরমানিটোলার স্কুলের সারামাঠ, দর্শক, শ্রোতাদের সানন্দ উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। আমার চোখেও তখন দুঃখ নয়, আনন্দের অশ্রু। অশ্রু চিকচিক করে উঠেছিল আমাদের বাবা নিরস, কঠিন ফজলুল হাসানের দু’চোখে।

পুরস্কার পাবার পর এক সময় ওকে আমি বলেছিলাম, সাবাস ছেলে। তবে তুই ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটা আবৃত্তি করলেও প্রথম পুরস্কারই পেতি। স্বাধীনতা তুমি’র বদলে দুঃখ তার লেখে নাম কবিতাটি বেছে নেবার কারণ কী বলবি?

ছোটন গম্ভীরভাবে উত্তর দিয়েছিল, বড়দা, স্বাধীনতা কি সত্যিই আমরা পেয়েছি? কিছু দৃশ্যকল্প কিছু আবেগী কথা, কিছু রূপক শব্দ ব্যবহার করলেই স্বাধীনতার আসল চিত্র ফুটে ওঠে? বুকের ভেতরে সত্যি সত্যিই স্বাধীনতার গান বেজে ওঠে? বড়দা, আমাদের ভেতরে, বাইরে, ঘরে, সংসারে, কাঁথায়, বিছানায়, মায়ের আঁচলে এত দুঃখ সেইসব দুঃখের সাথে আমি কবিতার দুঃখগুলো মিশিয়ে আবৃত্তি করেছি, সবার চোখে পানি আনতে পেরেছি এটাই আমার বড় পুরস্কার।

ক্লাস টেনের একটা ছাত্র শামসুর রাহমানের ‘দুঃখ তার লেখে নাম’ আর ‘স্বাধীনতা তুমি’ এই দুটি কবিতা নিয়ে এমন গভীর অনুভূতিতে কথা বলবে এটা আমার বড় আশ্চর্য লেগেছিল। আবৃত্তিতে প্রথম হবার জন্যে পুরস্কার হিসাবে ওকে একসেট করে জীবনানন্দ দাস, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ উপহার দেওয়া হয়েছিল। আর পরে আমি দিয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ, উপন্যাস সমগ্র, গীত বিতান এবং সুকান্ত সমগ্র। এত বই পেয়ে ও ভীষণ অবাক! চোখে খুশির ঝলক। বইগুলোর নতুন গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ও শুধু বলেছিল, তোমার কষ্টের টাকায় এতসব বই কিনতে খরচ করলে? আমি হেসে বলেছিলাম, বইগুলো যদি পড়িস, তোর মাথায়, বুকের ভেতর জমা করিস তাহলেই বুঝব আমি অপব্যয় করিনি। মার্ক টোয়েনের এ কথা তো জানিস, বই কিনে, বই পড়ে, কেউ নিঃস্ব হয় না।

এখন ছোটন নেই। ছোটন চলে গেছে আমাদের নিঃস্ব করে। তার বইগুলো পড়ে আছে জীর্ণপাতার মতো স্মৃতি হয়ে। আমার দেওয়া সব বইয়ের বিবর্ণ পাতায় অস্পষ্ট আলোর মতো ওর নিজের হাতের লেখা বড়দার এই উপহার আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।

আমার এতকালের চরপড়া শুকনো চোখ দুটো হঠাৎ করে কেমন যেন ঝাপসা হয়ে গেল। আমি ওকে প্রশ্ন করলাম, ছোটন তুই এখন কোথায়? জীবনানন্দ যেন ওর হয়ে ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলেন,

‘রয়েছি সবুজ মাঠে ঘাসে
আকাশে ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে।’

ছোটন কিংবা জীবনানন্দের স্মৃতিমগ্নতা থেকে আমার চৈতন্য ফিরে এল ভেজানো দরজাতে কারো মৃদু টোকায়। আমি ইয়েস বলার পর লতিফা দরজার বাইরে থেকেই নম্রস্বরে বলল, স্যার ড্রইয়রুমে একজন ভদ্রমহিলা অপেক্ষা করছেন আপনার সাথে দেখা করার। তিনি নাকি আগেই ম্যামের সাথে কথা বলেছেন এবং তার অনুমতি নিয়েছেন। আমি কি ওনাকে অপেক্ষা করতে বলব?

আমি বিরক্ত হলেও বিরক্ত প্রকাশ করলাম না। বললাম, অপেক্ষা করতে বল।

বাংলাদেশে আমার হঠাৎ আসা এবং অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে থাকার সংবাদটি গৌরবে গৌরাবান্বিত আমার মুখ পাতলা বোন নাজনিনের কল্যাণে চাউর হয়েছিল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবার কাছে দোয়া চাওয়া হয়েছিল। টিভি চ্যানেলগুলি ও সংবাদপত্রের অনেক সাংবাদিক ভিড় জমিয়েছিল আমার সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহের জন্যে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কাউকে অনুমতি দেয়নি আমার ধারে কাছে ঘেষতে এবং আমার অসুস্থ চেহারার ছবি তুলতে। সাংবাদিকরা নাজনিনের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু আমার সম্পর্কে যা জানার তা জেনেছে। ইন্টারনেট ঘেটে আমার আঁকা কিছু ছবিও প্রকাশ করেছে। কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসার পর টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্রের সাংবাদিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের কয়েকজন অধ্যাপক, শুভানুধ্যায়ী আমাকে প্রায়ই দেখতে এসেছেন। নাজনিন প্রথম প্রথম তাদের সাদরেই আপ্যায়ন করেছে বড়দাকে নিয়ে তার আবেগ ও শ্রদ্ধার কারণে। তার বড়দা যে হেলাফেলার শিল্পী নয়, সে একজন বিশ্ব সমাদৃত শিল্পী এই ভাবনাতেই সে ঢালাও অনুমতি দিয়েছে সাংবাদিক ও শিল্প বোদ্ধাদের। সাংবাদিক ও শিল্পবোদ্ধারা আমার দীর্ঘ প্রবাস জীবন, সহসা দেশে ফিরে আসা এবং আমার চিত্র ভাবনা, মনোজগত, আমি ইমপ্রেশনিস্ট নাকি সুরিয়ালিস্ট, অ্যাবস্ট্রাক্ট, সেমি অ্যাবস্ট্রাক্ট কোন ফরম্যাট আমার প্রিয়, তেল রং না জল রংএ আমি বেশি স্বচ্ছন্দ, বিশ্বের ছবির জগতে আমি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে এই শিল্প মাধ্যমে কী কী কাজ করেছি, কোন ছবিটি বেশি সমাদৃত হয়েছে, আমি জাতির জনকের ছবি এঁকেছি কিনা এইসব নানা অবান্তর প্রশ্নে আমি জর্জরিত হয়ে পড়ি, অসুস্থ হয়ে পড়ি। সময়ে, অসময়ে সবার উৎপাতে আমার বিরক্তি ও অসুস্থতা লক্ষ করে নাজনিন তার উদারতার রাশ টেনেছে। গার্ড আর কেয়ারটেকারকে কড়া হুকুম দিয়ে রেখেছে তার পূর্ব অনুমতি, দিনক্ষণ ছাড়া কেউই আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবে না। খুব যাচাই বাছাই করে মাঝে মধ্যে দু’একজনকে স্বল্প সময়ের জন্য আমার পূর্ব অনুমতি নিয়ে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়। আমি তা মেনে নিয়েছি অযথা উৎপাতের হাত থেকে রক্ষা পেতে।

ড্রইংরুমে যাবার আগে দেয়ালের বিশাল আয়নাটির দিকে আমার চোখ পড়ল। ১৯৯৭ সালে পাঁচ ফুট সাড়ে সাত ইঞ্চির যে মানুষটি ঘন কালো চুলের চব্বিশ বছরের যৌবন নিয়ে এই দেশ ছেড়েছিল এখন তার মাথা ভর্তি সাদা চুল, মুখে অযতেœ বর্ধিত সাদা দাড়ি, গোঁফ। একুশ বছর আগের সেই মানুষটিকে এখন আর চেনার উপায় নেই। সে এখন ছেচল্লিশ বছরের সাদা চুলের এক অচেনা অকাল বৃদ্ধ। নাজনিন আমাকে বলেছে আমার সন্নেসী মার্কা চেহারা দেখে ওর ছেলেরা ভয় পায়। সুতরাং আমার চুল, দাড়ি, গোঁফ ছেঁটে একটু ভদ্রস্থ হতে হবে। এর জন্যে সেলুনে যেতে হবে না। হেয়ার ড্রেসারকে কল দিলেই বাসায় এসে খুব যতেœর সাথে আমার হেয়ার ড্রেসিং করবে। নানা অজুহাতে আমি তা এড়িয়ে যাচ্ছি। চুল, দাড়ি কাটছাঁটে আমার দারুণ অনীহা। পৃথিবীর প্রায় সব বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিকদের মনে একটা আলাদা স্বাতন্ত্রবোধ জন্মায়। নিজেদের চেহারায়, স্বভাবে একটা ভিন্ন পরিবর্তন আপনা আপনিই এসে যায়। তার আর ইচ্ছে হয় না নিজেকে সাজাতে বা চলচ্চিত্র নায়কদের মতো রমণীমোহন হতে। এই দেহ তো আসলে মাটির। মাটির দেহে জীবন। দেহ থেকে জীবন পাখি যখন উড়ে যাবে অনন্তের ঠিকানায় তখন মাটির দেহ মাটিতেই মিশে যাবে কিংবা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আমি তো জানি আমার জীবন পাখিটা এখন সময়ের সুতোর রেখায় দাঁড়িয়ে দুলছে উড়ে যাবার অপেক্ষায়। সে কথা শুধু আমি জানি আর কেউ নয়।

দরজায় টোকা দিল কেউ আমাকে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনতে। নার্স লতিফা বাইরে থেকেই বলল, স্যার ড্রইংরুমে ভদ্রমহিলা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, তিনি অপেক্ষা করবেন না কি চলে যাবেন?

আমি আয়নার সামনে থেকে সরে এলাম। আমার পরনে এখন যে পোশাক তা পরে কোনো অপরিচিতা মহিলার সামনে যাওয়া যায় না। পোশাকের ব্যাপারেও আমি সব সময়েই ক্যাজুয়াল। ঘরে, বাইরে সবখানেই। নাজনিন সেটা জানে। তবুও আমার পরার জন্যে একগাদা শার্ট, প্যান্ট, লুঙ্গি, ফতুয়া, গেঞ্জি কিনে এনে দিয়েছে।

এখন আমার পরনে লুঙ্গি, গায়ে ফতুয়া, চোখে সরু সোনালি ফ্রেমের গোল চশমা। চেহারাটা সন্নেসীর মতোই উল্লুঝুল্লু। যারা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তাদের মনে আমার সম্পর্কে একটা বিরূপ ধারণা সৃষ্টির জন্যে এই বেশই যথার্থ। সুতরাং এখন আমার পোশাক পাল্টানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।

আমি ড্রইয়রুমে প্রবেশ করতেই অপেক্ষারত মহিলা এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন যেন আমি তার সামনে প্রাগৈতিহাসিক একটি প্রাণী অথবা ভিন্ন গ্রহের এলিয়েন। তিনি উঠে দাঁড়াতে ভুলে গেলেন, সৌজন্যবশত সালাম দিতেও ভুলে গেলেন। তাতে আমি মনে কিছু করলাম না। মৃদু হেসে বললাম, আমি এইটাই। আমার দুটি ভাগ্নে বলে, আ অ্যাম পিকিউলিয়ার, রিডিকুইলাস।

তবু ভদ্রমহিলা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। হয়তো তিনি এতকাল নাজনিনের কাছে যে চিত্র শিল্পীর কথা শুনেছেন, আমাকে নিয়ে মনে স্বপ্নের যে চিত্রটি কল্পনা করেছেন আমি সেই চিত্রের বিপরীত এক অদ্ভুত মানুষ।

তারপর তিনি এক অদ্ভুত কা- করলেন। আঙুল দিয়ে নিজের ভ্রু ঘষলেন অর্থাৎ ভ্রুটা আঁকা নয়। আঙুলে কোনো কালো দাগ নেই। ঠোঁটের কোণে কালো তিলটাও একটু ঘষলেন। সেটা নকল নয়আসল। কপালের ওপর ছড়িয়ে পড়া চুলের গুচ্ছ টানলেন। পরচুলা নয় আসল। তার এই আচরণে আমি বিস্মিত হলেও মৃদু হাসলাম। এবার ভদ্রমহিলা হঠাৎ করেই আমাকে প্রশ্ন করলেন, বলুন তো আমি দেখতে কেমন?

তার প্রশ্নে আমি আমার গোল্লা চশমাটা গায়ের ফতুয়ার একপ্রান্ত দিয়ে মুছে চোখে দিলাম। আমি জীবনে বহু সাক্ষাৎকার দিয়েছি। মানুষের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। আমাকে হঠাৎ করে চমকে দিতে, আমাকে বিভ্রান্ত করতে অনেকেই আমাকে উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে থাকে। আমি জানি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রশ্নকর্তাদের উত্তর কীভাবে দিতে হয়। এই মহিলা অভিজাত শ্রেণির। নিঃসন্দেহে অপরূপ।কোনো প্রসাধান ছাড়াই তিনি যেন অগ্নিগোলাপ।

তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, বলুনতো আমি দেখতে কেমন?
আমি বললাম, আমি বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিচারক নই। একজন কুৎসিত মানুষের ছানিপড়া চোখের কাছে প্রশ্ন করতে নেই কে সুন্দর?
- ছানিপড়া চোখে এই মুহূর্তে যা দেখছেন সেটাই বলুন।
- রূপবতীদের সৌন্দর্য বর্ণনার জনে পৃথিবীতে লক্ষ ভাষার লক্ষ কোটি কবিতা আছে, উপমা আছে।আপনি কোন ভাষায় কী উত্তর পেলে খুশি হবেন?
- আপনি বাংলা ভাষায় এক কথায় বলুন।

এবার আমি যেন কিছুটা বিপাকে। সব মেয়েই শুনতে চায় সে সুন্দরী, সে মায়াবতী। সবচেয়ে কালো মেয়েটিও শুনতে চায়, ‘কালো সে যত কালোই হোক দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।’ আমি বললাম, মাদাম, আমার বাংলা ভাষা-জ্ঞান এখন খুব দুর্বল। আমি কবি নই, গল্পকার নই। আমি চিত্রকর। আমি কথা বলি রং-তুলিতে, ক্যানভাসে। আমার ছবিই আমার কথা।
- বিষয়টি আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন কথার চতুরতায়। আমি শুধু আমার সম্পর্কে আপনার মুখের কথা জানতে চাই।
আমি চোখে যেন মুগ্ধতায় আলো জে¦লে বললাম, একসেঁলত লা প্লেন ন্যূন্।
রূপবতী তার কণ্ঠে বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, ফ্রেন্স ভাষা আপনার মতো না হলেও যৎসামান্য জানি। ‘আমি পূর্ণ চাঁদের মতো’-এসব ফালতু স্তুতি শুনতে আসিনি। আপনার মতো শিল্পীর কাছে তো নয়ই।
আমি কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। যেন কিছু ভাবছি। ভাষা খুঁজে পাবার চেষ্টা করছিকী বলা যায় অসম্ভব বুদ্ধিমতী এই রূপসীকে? মহিলা সাগ্রহে তাকিয়ে আছেন, অপেক্ষা করছেন আমার উত্তরের অপেক্ষায়। আমি তার অপেক্ষা আর নৈঃশব্দের দেয়াল ভেঙে বললাম, আমি আজ সকালে এক জনপ্রিয় কবির কবিতা পড়ছিলাম। সেই কবির ধার করা কথাতেই বলতে হয়-‘যেহেতু আকাশের সমস্ত নীল নক্ষত্রের প্রগাঢ় উদ্দীপনার বয়স আঠারো, যেহেতু সমস্ত পৃথিবীর রূপসী নারী জ্যোৎস্না এবং অগ্নুৎপাতের বয়স আঠারো ... তুমি আঠারো।’

রূপবতী এবার জলতরঙ্গের মতো হেসে উঠলেন। বললেন, হে শিল্পী, কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর ভালোবাসার বয়স হয়তো আঠারো ছিল, তার নায়িকার বয়স আঠারো ছিল। কিন্তু আমি তো তার কবিতা নই। তবুও আমি তার হাড়-পাঁজরার আড়ালে, তার কবিতার অন্তরালে লুকিয়ে থাকে যে বিষাদ, আমি সেই বিষাদ যার নাম লিসা, বয়স আঠারো নয় ছত্রিশ।
আমি আমার দু’হাত মাথার পেছনে আবদ্ধ করে তার উপরেই যেন ভর করে হেলান দিলাম। মুদ্রিত চোখে, ক্লান্ত কণ্ঠে সরাসরি প্রশ্ন করলাম, ছত্রিশের রূপবতী আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন?
- লিসা থেকে মোনালিসা হতে।

এবার আমি চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলাম। বললাম, তা-ই! কিন্তু এখানে আমার রং-তুলি নেই, ক্যানভাস নেই। আমি শূন্য হাতে এসেছি, শূন্য হাতে চলে যাব।

রপবতী বললেন, রং-তুলি, ক্যানভাস যা যা প্রয়োজন সব আমি দেব। শুধু আপনার অবসর থেকে এক টুকরো সময় দেবেন। এই সময়ের মূল্য হিসাবে আপনি যত টাকা চান আমি তা-ই দেব।
- আপনার বুঝি অনেক টাকা?
- হ্যাঁ অনেক। কত অনেক তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। টাইকুনরা হিসাব করে টাকা খরচ করে না।
লিসার কথায় আমার বেশ আনন্দ মেশানো কৌতুহল হল। প্রশ্ন করলাম, নাজু আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু?
- হ্যাঁ সেই কলেজ জীবন থেকে।
- নাজু তো ছিল খুব গরীব ঘরের মেয়ে। পুওর গার্ল। ওর সাথে তো আপনার শ্রেণির মানুষের বন্ধুত্ব হবার কথা নয়!

লিসা প্রতিবাদী কণ্ঠে তীব্রস্বরে বললেন, শ্রেণি দিয়ে বন্ধুত্ব হয় না। বন্ধুত্ব হয় হৃদয় দিয়ে। আমরা যখন একসাথে কলেজে পড়তাম মে বি শি ওয়াজ পুওর বাট ভেরি রিচ ইন হার মেরিট। শি ওয়াজ ভেরি চার্মিং, উইথ অ্যান অ্যাট্রাকটিভ পারসোনালিটি। শি হ্যাজ এ বিগ হার্ট। আই অলওয়েজ ইউজড টু লাইক হার। আমাদের বন্ধুত্ব এখনও অটুট। আরো একটা কথা যা আপনার জানা নেই তা হচ্ছে ওর হাজব্যান্ড রাজিব ইজ মাই কাজিন। আমার মাধ্যমেই ওদের পরিচয়, ভালোবাসা এবং বিয়ে।
বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার ইতিহাস শোনার পর আমি বললাম, ইটস নাইস টু নো দ্যাট। তবে আপনার আর নাজুর মধ্যে যদি ভালোবাসা অটুট রাখতে চান দেন প্লিজ ফরগিভ মি।
- মানে? আপনি তাহলে আমার ছবি আঁকবেন না?
- আপনার মতো রূপবতীর ছবি আঁকার জন্যে বাংলাদেশের অনেক নামী দামি শিল্পী আছেন।
- আমি সেইসব নামী দামি শিল্পীদের চিনি। তাদের কাছে যাবার ইচ্ছে নেই। আমি শুধু আপনার কাছে এসেছি।
- আপনি একটা ভুল মানুষের কাছে এসেছেন। আমি যখন প্যারিতে ছিলাম, এত কষ্ট আর দারিদ্রের মধ্যে ছিলাম তা বলার মতো নয়। হতাশায় মাঝে মধ্যে মনে হত আমি ভ্যানগঁগের মতো শুধু কান নয়, হাতের আঙুলগুলোও কেটে ফেলি, পথের ধারে বেহালা বাজিয়ে ভিক্ষে করি। আঙুল কাটিনি বটে কিন্তু অর্থলোভে কোনো নারীর নগ্ন ছবি আঁকিনি। যা এঁকেছি তা আমার হৃদয় থেকে, আমার শিল্পচেতনা বোধ থেকে।

আমার কথায় লিসা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠলেনযে হাসি বিদ্রুপের হাসি। হাসতে হাসতে বললেন, চেতনাবোধ! সব চেতনাবোধের ছবিতে, কবিতায়, গল্পে কি শিল্পরূপ থাকে? না, থাকে না। তবে এক শ্রেণির শিল্প-সাহিত্য বোদ্ধা, সমালোচকরা অশ্লীল ছবি, অশ্লীল সাহিত্যের মধ্যে এক অনন্য শিল্পরূপ খুঁজে নেন। ওরা বলেন, নবোকভের ললিতা, সমরেশ বসুর প্রজাপতি এক অনন্য সাহিত্য। অজন্তার গুহার দেয়াল জুড়ে নর-নারীর নগ্ন মিথুন দৃশ্য শিল্পীদের স্বপ্নের কবিতা। তাইমুর সাহেব, আপনি কি বুকে হাত দিয়ে শপথ করে বলতে পারবেন আপনি কতটা পবিত্র? আপনার মধ্যে কোনো লোভ নেই, পাপ নেই? আপনি অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকেছেন, সেরা সেরা ছবি এঁকেছেন। কিন্তু আপনার গুপ্ত লোভ আর পাপের ছবি ক’টা এঁকেছেন?

আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম, এঁকেছি। জীবনে দুটো মাত্র ছবি এঁকেছি। একটা হল ‘ব্লু কোশ্চেন ফ্রম দ্য ব্লু আইজ অব এ নিউবর্ণ থ্রোন আউট বেবি’ আর একটি হল ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’। দুটোই পুরস্কৃত।
লিসা বলে উঠলেন, হ্যাঁ ঐ দুটো ছবিই আমি দেখেছি। প্রথম ছবিটি ব্লু কোশ্চেন সদ্যোজাত অবৈধ শিশুটি ডাস্টবিনে পড়ে আছে নীল চোখে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে-তার চোখে অবাক প্রশ্ন। তার পাশে কেউ নেই, আছে শুধু একটা ভয়াল কুকুর, তার একমাত্র পাহারাদার-সে ঘেউ ঘেউ শব্দে গলা উগরে গালি দিচ্ছে হৃদয়হীন মানুষের সমাজকে, মানুষের সভ্যতাকে। আর দ্বিতীয় ছবিটি প্লেজার অ্যান্ড পেইন মোস্ট ডার্টিয়েস্ট পিকচার আই হ্যাভ এভার সিন। গোলাকার চাঁদের মধ্যে দুই কুকুর, কুকুরির সঙ্গম দৃশ্যের পরবর্তী অধ্যায় দে অয়্যার লকড আফটার সেক্স। তাদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে। কিন্তু তারা পারছে না। ইজ ইট এ পিকচার? এর মধ্যে শিল্প কোয়?

আমি বললাম, শিল্প তাদের যন্ত্রণায়। আপনি কি লক্ষ করেননি তাদের দেহের উর্ধ্বদেশ চাঁদে, নিম্নাংশ চাঁদের নিচে পৃথিবীতে। আফটার প্লেজার নাউ দে গট পেইন। তারা না পারছে চাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে, না পারছে পৃথিবীতে ফিরে আসতে। একটা শূন্যতায় মুখ তুলে ওরা আর্তনাদ করে বলছে, ওহ্ গড উই আর লক্ড। প্লিজ আনলক আস। সেভ আস।

লিসার কঠিন প্রশ্ন, ছবিটা আপনি কোন শুদ্ধ, শিল্প-চেতনাবোধ থেকে এঁকেছিলেন বলবেন কি?

আমি বললাম, ওটা আমি এঁকেছিলাম আমার হতাশা আর যন্ত্রণাবোধ থেকে, নিজের প্রতি ঘৃণা থেকে। আমার মনে হয়েছিল আমার বা আমাদের জীবনটা ঐ কুকুর-কুকুরির মতোই অনিশ্চিত, নগ্ন, নির্লজ্জ। আমাদের সভ্যতা, সততা, মূল্যবোধ ধ্বংসের মুখোমুখি। কুকর যা করে তা রাস্তায় প্রকাশ্যে করে। আর আমরা সভ্যতা, ভব্যতার মুখোশ পরে যা অন্তরালে করি তা পথের কুকুরদের চাইতেও নিম্নগামী, রুচিহীন। কিন্তু এর পরিণতি কী? এই প্রশ্নটাই আমি তুলে ধরেছি আমার প্রতিবাদের প্রতিকী বাস্তববাদী চিত্রে। আমরা এমন একটা সমাজ ও সময়ে বসবাস করছি যেখানে ভোগানন্দ শেষে বন্দি অবস্থায় অসহ্য যন্ত্রণায় মুক্তি জন্যে কাঁদছি। রবীন্দ্রনাথের মতো আর্তকণ্ঠে প্রাণপণ চিৎকারে গান গাইছি-‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে ...’। কিন্তু মুক্তির চাবিটা কোথায়? শিল্প, সভ্যতার চাবি হারালে তা কি সহজে খুঁজে পাওয়া যায়?

লিসা ধৈর্য্য সহকারে আমার কথা শুনলেন। তারপর বললেন, এতক্ষণ ধরে আপনার ডার্টি পিকচারের স্বপক্ষে যে ব্যাখ্যান গাইলেন তা কি আপনার নিজের নাকি আর্টস ক্রিটিকদের?
- আর্টস ক্রিটিকরা কি ভেবে আমার ঐ ছবিটাকে পুরস্কৃত করেছিলেন তা এখন আমার মনে নেই। আমি যা বললাম, তারাও হয়তো ঐ রকম একটা কিছু ভেবেছিলেন।
- এ ডার্টি থিং ইজ অলওয়েজ ডার্টি। এর মধ্যে দুর্গন্ধময় বর্জ আছে। শিল্প নেই। অথচ আপনার এক বন্ধু, শিল্প সমালোচক আপনার ডার্টি পিকচারের মধ্যে শিল্পরূপ খুঁজেছেন, নানা যুক্তি আর তত্ত্ব দিয়ে ছবিটা এক মহার্ঘ সৃষ্টি বলে আখ্যা দিয়েছেন।
- আমার বন্ধু? আর্টস ক্রিটিক? কে তার নাম বলবেন কি?
- মাদাম জুলিয়াঁ।

জুলিয়াঁর নামটা আমাকে প্রথম একটু ধাক্কা দিলেও বিস্মিত হলাম না। নাজু লিসার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সুতরাং পুরাতন কাহিনির স্মৃতিচারণে জুলিয়াঁর নামটা লিসার অজানা নয়। লিসা আবার বললেন, আপনার ঐ ছবিটার রঙিন ফটোসহ একটা আমেরিকান ম্যাগাজিনে .... কী যেন নাম? .... স্যরি এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না সেখানে একটা আর্টিকেল লিখেছিলেন। আপনার ঐ যে কীসব শিল্প চেতনাবোধ নিয়ে, যন্ত্রণা নিয়ে যা বললেন তিনি এই ধরণের কথাই লিখেছিলেন। খুব হাইলাইট করা হয়েছিল আপনাকে। চাঁদের মধ্যে কুকুর-কুকুরির সঙ্গম নিয়ে কত তত্ত্ব, কত শিল্পকথাআমার খুব হাসি পেয়েছিল।
- হাসি পেয়েছিল কেন? আমার প্রশ্ন।
- জুলিয়াঁ ছিলেন আপনার অনুরাগী বন্ধু, আপনার প্রেমিকা। সুতরাং তিনি তো আপনার পক্ষে সব যুক্তি খাড়া করে প্রশংসাই করবেনই।
- ফ্রান্সে যে কয়জন আন্তর্জাতিক মানের চিত্র সমালোচক, চিত্র গবেষক আছেন জুলিয়াঁ তাদের মধ্যে একজন। কিন্তু আমি এ পর্যন্ত যে সব ছবির জন্যে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছি তার কোনোটাতেই জুলিয়াঁ জুরি বোর্ডের সদস্য ছিলেন না, আমার পুরস্কৃত ছবিগুলির সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। আপনি যে পত্রিকায় আমার ছবি সম্পর্কে তার আলোচনা পড়েছেন তা আমি পড়িনি। তবে এ কথা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই যে সে আমার অনুরাগী বন্ধু ছিল। তার আগ্রহের কারণেই আমার প্যারিস যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। আমার রিক্শ পেইন্টিং নিয়ে আমাকে খুব হাইলাইট করেছিল।

লিসা মৃদু হেসে বললেন, সখী ভালোবাসা কারে কয়! তা মাদাম জুলিয়াঁ এখন কেমন আছেন?
আমি উপরের দিকে আঙুল তুলে বললাম, তার দেহ থেকে আত্মার মুক্তি ঘটেছে। আশা করি তিনি ভালো আছেন।
লিসা এবার যেন একটু ধাক্কা খেলেন। বিষণœ কণ্ঠে বললেন, স্যরি। নাজু এটা আমাকে বলেনি।
আমি বললাম, নাজু জানে না।
লিসা আবার দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, আ অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি। আমি আমার ইমপেশেন্ট মুডে আপনাকে অনেক বাজে কথা বলে ফেলেছি। না জেনে, না বুঝে অনেক কটু মন্তব্য করেছি। আসলে যার যার দুঃখ তার তার। আমরা কেউ কারো গোপন দুঃখ বুঝতে চাই না, শুনতে চাই না, শেয়ার করতে চাই না।
আমি বললাম, এখনতো আমরা পরষ্পরের অনেক দুঃখ-কথা শুনলাম। নাকি ‘আরো কিছু আছে বাকি’?
লিসা প্রবল আপত্তি বা অনুনয় ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। বললেন, আছে, বাকি আছে। দয়া করে আমাকে আর একটু সময় দিন। প্লিজ।
- বলুন।
- আমার দুঃখ মানুষের নয় একজন মেয়ে মানুষের দুঃখ, যে তার দুঃখ, যন্ত্রণার বৃত্তে বন্দি হয়ে আছে। হার লাইফ ইজ লক্ড। সে অবিরাম নিঃশব্দ কান্নায় প্রার্থনা করছেহে প্রভু মুক্তি দাও, মুক্তি দাও। তার চিৎকার আপনার চাঁদের কুকুরের মতো।

লিসার এইসব আবেগী কথায় আমি বড় ক্লান্ত বোধ করলাম। বললাম, যার এত রূপ, এত ঐশ্বর্য তার কেন এত দুঃখ? সে কেন লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে আমার মতো দ্বিতীয় শ্রেণির ডার্টি শিল্পীকে দিয়ে ছবি আঁকাতে চায়? আমার মনে হয় তার দুঃখ-বিষাদ একটা বিলাসীতা।
লিসা অস্থিরভাবে উঠে দাঁড়ালেন। জানালার কাছে গেলেন, আবার আমার সামনে এসে বসলেন। প্রশ্ন করলেন, নবোকভের ললিতা নিশ্চয় পড়েছেন?
অতীতে পড়েছিলাম। অতশত মনে নেই। তা আপনি কি ঐ ললিতার দুঃখ, কামনা, বাসনা?
- না, না। আমি ললিতা হতে চাইনি বলেই মোনালিসা হতে আপনার কাছে ছুটে এসেছিলাম। অথচ আপনি একটুও বুঝতে চাইলেন না, জানতে চাইলেন না আমার ইচ্ছে বিলাসীতা নয়, ললিতার কামনা বাসনার ক্ষুধা নয়। দেখবেন কি কতখানি চাপা যন্ত্রণা আমার চোখে, আমার বুকের ভেতরে? আমি কি আমার দেহ এই শাড়ির আড়াল থেকে একটু একটু উন্মোচিত করব?
আমি আতঙ্কিত কণ্ঠে বাধা দিয়ে বললাম, না, না।
লিসা নিজেকে সংযত করে বললেন, ভয় নেই তাইমুর সাহেব। আমি এখানে নাটক করতে আসিনি। আমি এখন পর্যন্ত ললিতার মতো কোনো কর্ম করিনি। দেহের তাড়নায় নিজেকে নষ্ট করিনি। কিন্তু আর কতদিন? কতদিন মানুষ এভাবে একা বাঁচতে পারে? বেঁচে থাকা সম্ভব?
- আপনি এত অসুখী কেন? নিজেকে একা, নিঃসঙ্গ ভাবেন? আপনার অর্থ-বিত্ত, স্বামী, সন্তান আছে নিশ্চয়? তবুও ...
লিসা অস্থিরভাবে চিৎকার করে উঠলেন, কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু নেই। পাঁচ বছর আগে কার অ্যাক্সিডেন্টে আমার বারো বছরের ছেলেটি স্পট ডেড, মাই হাজব্যান্ড ওয়াজ সিরিয়াসলি ইনজিয়র্ড। আমি মাথায় প্রচ- আঘাত পেয়েছিলাম। আই ওয়াজ সো শক্ড ... আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল ... সাইকো পেশেন্ট হিসাবে আমার দুটো বছর যে কোথা দিয়ে চলে গেছে আমার কিচ্ছু মনে নেই। আই লস্ট এভরিথিং ...
- আপনার স্বামী? আমার প্রশ্ন?
- হি সারভাইভ্ড। কিন্তু তার এখন জীবন কাটে একটা নিঃশব্দ যন্ত্রণায়। সময় কাটায় ব্যবসা-বাণিজ্যের সাম্রাজ্যে। হি লস্ট হিজ সন, লস্ট মি, লস্ট হিজ সেক্সুয়াল এবিলিটি, আর্জ, লাভ এভরিথিং ...। নাউ হোয়াট ক্যান আই ডু?
আমি বললাম, পৃথিবীতে প্রতিদিন কত তুচ্ছ কারণে প্রতিনিয়ত স্বামী, স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটছে। আপনারা কেন দুঃখের খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকছেন? সমস্যার সমাধান তো আপনাদের দু’জনের হাতেই। নয় কি?
লিসা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, হ্যাঁ তা ঠিক। ও আমাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল, বার বার বলেছিল। কিন্তু আমি নিইনি।
- কেন?
- আমাদের বিয়েটা ছিল ভালোবাসার, জীবনটা ছিল ভালোবাসার, আমাদের ছেলেটা ছিল ভালোবাসার ফসল। সেই ছেলেটার স্মৃতি বুকে ধারণ করেই আমি মুক্তি নিতে পারিনিকিছুতেই পারিনি। আমি নিশ্চিত জানি আমিই এখন ওর অর্থহীন জীবনের একমাত্র বন্ধন, স্মৃতি ছায়া। আমি মুক্তি নিলেই ও আত্মহত্যা করবে ... করবেই .... বলুন, আমি কী করব? কী করতে পারি ...?
বলতে বলতে লিসা যেন কান্নায় ভেঙে পড়তে চাইলেন। কিন্তু কাঁদলেন না। নিজেকে সংবরণ করার অদ্ভুত দক্ষতা তার। চোখ দুটোতে টলটলে জল, ঠোঁট দুটো কাঁপছে কষ্টেকিন্তু আশ্চর্য রকমের সংযত।দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ এই রূপবতীর মতো রূপসী ছিল না। তবু সে শত শত বছর ধরে তার রহস্যময় হাসি আর তিলের সৌন্দর্যেই অদ্বিতীয়া মানুষের হৃদয়ে চির ভাস্বর।
দ্য ভিঞ্চি বেঁচে থাকলে কী করতেন আমার সম্মুখে বসা এই রূপবতীকে দেখলে? দ্বিতীয় মোনালিসার ছবিটি কি আঁকতেন? যার চোখে টলমল জল, কিন্তু স্থির। এক ফোটাও গড়িয়ে পড়ছে না। গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে চাপা যন্ত্রণায়। কিন্তু আর্ত প্রকাশ নেই সেই যন্ত্রণার।
এই অবস্থায় আমি লিসাকে কী বলব? যা বলবার তাতো বলেই দিয়েছি। তবু শান্তস্বরে, অসহায় কণ্ঠে বললাম, লিসা আপনি নিশ্চয় শুনেছেন আমি ভীষণ অসুস্থ। এই যে আমার দুটি হাতের দিকে তাকান। দেখুন আঙুলগুলো কেমন বাঁকা, কোকড়ানো। মনে হয় কুষ্ঠ রোগীর আঙুল এগুলো। এই আঙুল দিয়ে আমার আর তুলি হাতে নেবার শক্তি নেই, সাধ্য নেই। আমি যদি আপনার ছবি আঁকার চেষ্টা করি সেটা আপনার বা দ্বিতীয় মোনালিসার ছবি হবে না। কারণ আমি দ্য ভিঞ্চি নই।
লিসা উঠে দাঁড়ালেন। দীর্ঘশ্বাস আর আক্ষেপ ভরা কণ্ঠে একটা কবিতার মতোই বললেন, আমি মোনালিসার মতো অমর হতে চেয়েছিলাম আপনার রং-তুলিতে। ছবিটা আঁকা শেষ হলেই আমি আত্মহত্যা করতাম, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নিতাম। কিন্তু তা আর হল না। আমি অমর হতে পারলাম না, কারণ আমার লিয়নার্দো দ্য ভিঞ্চি নেই।

চলবে

 

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব তিন)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পাঁচ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ছয়)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব সাত)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আট)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব নয়)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব দশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব এগার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব তের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চৌদ্দ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top