শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২২) : সেলিনা হোসেন
 প্রকাশিত: 
 ১ ডিসেম্বর ২০২২ ১৭:৩০
 আপডেট:
 ১ ডিসেম্বর ২০২২ ১৭:৩৬
                                
অঞ্জন মেয়েটিকে নিজের কোলে তুলে নেয়। শীতল হয়ে গেছে মেয়েটির শরীর। নিষ্প্রাণ দেহটির স্পর্শ ওকে শীতল করে দেয়। ও মেয়েটিকে বুখে জড়িয়ে ধরে। আমেনা বেগম মেয়েটিকে অঞ্জনের কাছ থেকে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। কান্নার ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে শরণার্থী শিবিরে। জোর কান্নার ধ্বনিতে চারদিক থেকে লোক এগিয়ে আসতে থাকে। আমেনা বেগম দ্রুত হেঁটে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। ডুবে যায় শরীর। চারদিকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে সবাই। অনেক মেয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। শরণার্থী শিবিরে পরিচিত হওয়া খালার জন্য কান্নার ধ্বনি আপনজনের আর্তনাদের বার্তা ছড়ায়। আমেনা বেগমের নিজের কেউ নেই। শরণার্থী শিবিরে আসার সময় পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হয় স্বামী আফজাল। মেয়েটিকে বুকে নিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নে মগ্ন ছিল। কিন্তু মেয়েটির মৃত্যু ওকে নিঃসঙ্গ করে দিলে বেঁচে থাকার স্বপ্ন ফুরিয়ে যায়। 
অঞ্জন ট্রানজিষ্টার হাতে নিয়ে নদীর ধারে থেকে ফিরে এসে গাছতলার নিচে বসে যায়। ওর বাবা আসেনা। দাঁড়িয়ে থাকে সবার সঙ্গে। অঞ্জন বিবিসি শোনার জন্য নব ঘোরায়। ভেসে আসে বিবিসির বাংলা বিভাগ থেকে কন্ঠস্বর। আর্জেন্টিনার লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। লেখক-বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে মিছিল করে। বাংলাদেশের শরণার্থীদের প্রতি সহযোগিতার জন্য আর্জেন্টাইন সরকারকে স্মারকলিপি প্রদান করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রী লুইস মারিয়া ডি পাবলো পারডোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সাহায্যে পাঠানোর দাবি জানান। ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে ছিলেন খ্যাতিমান সাহিত্যিকরা। 
সংবাদ শুনে বুক ভরে যায় অঞ্জনের। ভাবে, এভাবে বিশ্বের সব দেশ যদি সহযোগিতার হাত না বাড়ায় তবে শরণার্থীদের কষ্টের সীমা থাকবে না। ভারতের সহযোগিতায় বেঁচে থাকার প্রেরণা শক্ত হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ওর নিজের একটি অসাধারণ দিকদর্শন হবে। বাবার ডান হাত চেপে ধরে বলে, বাবা, আমি ঠিক করেছি যুদ্ধ করব। 
- তুইতো ডাক্তাররে বাবা। তুই মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রুষা কর। এটাওতো যুদ্ধেরই একদিক। 
- না বাবা, আমি এভাবে বসে থাকবনা। আমি যুদ্ধ করব। 
- না রে বাবা, তুই যুদ্ধে যাবিনা। তুই যুদ্ধে গেলে আমি মরে যাব। 
- কি যে বলেন না আপনি। আপনিতো জানেন আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ চলছে। 
শব্দ করে কেঁদে ওঠে অঞ্জনের বাবা। কাঁদতে কাঁদতে দুহাতে চোখ চেপে রাখে। পানি গড়ায় গালের ওপর। 
অঞ্জন বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, কাঁদবেন না বাবা। আশেপাশের সবাই এখানে এসে জড়ো হবে। ওরা আপনাকে অন্যরকম মানুষ ভাবুক এটা আমি চাইনা। আপনি বিবিসিতে শুনলেননা বিদেশী একজন সাহিত্যিক বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ভাবনাচিন্তা করে। 
ছেলের বুক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় বাবা। এভাবে নিজেকে শক্তিহীন মানুষ ভাবতে চায়না। মাথা সোজা করে সামনে তাকালে পুরো যশোর রোডের এমাথা ওমাথা দেখার জন্য মাথা ঘোরায়। তারপর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ভারতের এই জায়গা আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে উল্লেখ থাকবে। 
- শুধু এ জায়গা কেন বাবা? যত জায়গায় শরণার্থী আছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে সেসব জায়গা এবং আমাদের মা ইন্দিরা গান্ধী আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসকে ধারণ করেছেন। আজ থেকে আমি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকেও মনে রাখবো। তিনি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিজয়ী করার জন্য নিজের দেশের সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। নিজের দেশের জ্ঞানী-গুণী মানুষদের জড়ো করেছেন আমাদের স্বাধীনতার লাভের পক্ষে। 
অঞ্জন কথা শেষ করলে কথা বলেনা ওর বাবা। বুকের ভেতরে গুমগুম শব্দ তাকে ¤্রয়িমান করে রাখে। দেশে যুদ্ধ করতে গলে যদি শহীদ হয় -। ভাবনার জায়গা নিঃশেষ হয়ে যায়। বুকের ভেতর দম আটকে থাকে। পরক্ষণে সুবাতাস বইতে থাকে বুকের ভেতর। ছেলে স্বাধীনতার জন্য প্রাণদানকারী মানুষ হবে। দেশ-জাতি ওকে স্মরণ করবে। তাহলে কেন যুদ্ধ করবেনা? যুদ্ধ না করলে স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হবে কিভাবে? কথাবিহীনভাবে নিজেকে ধমকায়। মনে মনে নিজেকে বলে, আমারওতো যুদ্ধ করা দরকার। শুধু শরণার্থী মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা কি দেশের জন্য প্রেম? ধমক দিয়ে নিজের বোধকে চাঙ্গা করে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। ভাবে, শরণার্থী হয়ে বেঁচে থাকা একটা দিক, স্বাধীনতার জন্য জীবন দেয়া আর একটা দিক। সবকিছু মেনে নিয়ে বেঁচে থাকার সত্যকে তুমুল করে তুলতে হবে। স্বাধীনতা লাভ সহজ কথা নয়। হঠাৎ মনে হয়, পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কি? বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ- একসঙ্গে বলতে হবে। নিজের বুকের ভেতরের প্রতিক্রিয়ায় উদ্ভাসিত হয় চেহারা। 
অঞ্জন বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, বাবা কি ভাবছেন? 
- ভাবছি, স্বাধীন দেশ মানে বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ। ভাবছি, তিনি কি বেঁচে আছেন? 
- ঠিক বলেছেন। আমাদেরকে এই ভাবনায় ডুবে থাকতে হবে বাবা। আপনি খুবই সুন্দরভাবে ভেবেছেন। 
তখন দুটো ছেলেমেয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটে। অঞ্জন উঠে গিয়ে কাছে নিয়ে আসে ওদের। জিজ্ঞেস করে, তোরা কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? 
ছেলেটি বলে, আমরা শুধু নুন দিয়ে ভাত খেয়েছি সেজন্য কাঁদছি। মা কোনো তরকারি রাঁধতে পারেনি। 
মেয়েটি বলে, কালকে আমরা ভাত খেতে পারবনা। আমাদের কাছে চাল নাই। আমার মাও কাঁদছে।
এই কথা বলে দুজনে আবার হাউমাউ করে কাঁদে। অঞ্জন ওদের মাথায় হাত রেখে বলে, কাঁদিসনা সোনারা। ভাত খেয়ে পেট ভরেছে? 
- হ্যাঁ, ভরেছে। এখন আর খিদা নাই। 
- তাহলে আর তোরা কাঁদবিনা। 
দুজনে একসঙ্গে বলে, কাঁদব, কাঁদব। কালকে তো কিছুই খাওয়া হবেনা। 
- আমি তোদের জন্য চাল যোগাড় করার চেষ্টা করব। দেখি পাই কিনা। যা, তাঁবুতে যা। 
- না, তাঁবুতে যাবনা। গাছের নিচে বসে থাকি। এখানে বসে থাকতে আমাদের খুব ভালোলাগে। 
- তোদের নাম কি? 
- আমার না হাশেম। আমি ফাতেমা। 
দুজনে একটুখানি দূরে গিয়ে ঘাসের ওপর বসে পড়ে। তাকিয়ে থাকে সামনে। দেখতে পায় ওদের বয়সী তিনজন কাঁদতে কাঁদতে হাঁটছে। কখনো কাশতে কাশতে আকাশের দিকে তাকায়। অঞ্জন উঠে গিয়ে ওদের হাত ধরে টেনে এনে ওদের কাছে বসায়। 
- কাঁদছিস কেন তোরা? 
- অল্প ভাত খেয়েছি। পেট ভরেনি। আবার খিদা পেয়েছে। মায়ের কাছে গেলে মাতো কিছু খেতে দিতে পারবেনা। 
- আয় বস এখানে। 
- আমরা ওদের কাছে গিয়ে বসি। 
তিনজনে এগিয়ে যায় হাশেম আর ফাতেমার দিকে। কাছে গিয়ে বসে পড়ে। 
হাশেম বলে, দুলালরে কাঁদছিস কেন? 
- খিদে পেয়েছে। 
- আমরাও নুন দিয়ে ভাত খাওয়ার জন্য কেঁদেছিলাম। আর কাঁদবনা। 
দুলাল বলে, আমরাও আর কাঁদবনা। তোদের কি মনে হয় রে বেলাল আর লাকী? 
- আমরাও আর কাঁদবনা। 
দুজনে দুহাতে চোখের পানি মোছে। 
- ঠিক বলেছিস তোরা। হাশেম, চল আমরা রাস্তায় খেলি। 
- কি খেলব? 
- লুকোচুরি। 
- চল, ভালোই হবে। 
পাঁচজন দৌড় দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। অঞ্জন তাকিয়ে থাকে। নিজের শৈশবের কথা মনে হয়। এমন দীর্ঘ রাস্তাতো ওর শৈশবে ও দেখেনি। শহরের জীবনে রাস্তা মানে গাড়ি-রিকশা-লোকজনের হাঁটাহাঁটি। শিশুরা ওখানে কোনো ঠাঁই পেতনা। শিশুদের জন্য খেলার মাঠ ছিল। সেই মাঠে অনেকদিন একা একা দৌড়াদৌড়ি করেছে। সবুজ ঘাসের ওপর দৌড়াতে ওর খুব ভালোলাগত। মনে হতো এমন সবুজ রঙের নরম ঘাস দিয়ে জীবন সাজাবে। নিজের জীবনের চারদিকে এমন ঘাস লাগাবে। কিন্তু কিভাবে লাগাবে? পড়ালেখা দিয়ে। ওর পড়ালেখা হবে ওর জীবনের সবুজ ঘাস। অঞ্জন এমন ভাবনা নিজের বোধের জায়গায় রেখেছিল। কিন্তু বেঁচে থাকার এই পর্যন্ত সবুজ ঘাসের চিন্তা ও মাথায় তেমনভাবে থাকেনি। এখন ছেলেমেয়েদের দৌড়াতে দেখে সবুজ ঘাসের ভাবনা মাথায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এসব ভাবনার মাঝে দেখতে পায় ক্যামেরাম্যান রঘু রাই আসছে। কোথাও কোথাও দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। ওর তোলা ছবি দেখে বিস্মিত হয় অঞ্জন। এত নিখুঁত ছবি একটি সময়কে ধারণ করে ইতিহাসের দিকচিহ্ন হবে। মাথায় পোঁটলা-পুটলি নিয়ে স্রোতের মতো হেঁটে আসছে মানুষ। ওদের পেছনে মৃত্যুর তাড়া, সামনে শরণার্থী শিবিরের কষ্টকর জীবন। সবকিছু ছাপিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন। নিজেদেরকে মুক্তিযোদ্ধার প্রেরণায় ধারণ করার মানসিক ভরসা। রঘু রাইয়ের ছবি দেখে নিজের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ইতিহাস সংরক্ষিত হচ্ছে, এই চেতনায় অঞ্জন খুব অনুপ্রাণিত হয়। রঘু রাইকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ায়। কাছে এলে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছেন? 
- ভালো। একটা অন্যরকম ছবি তুলেছি। তোমাকে দেখাব। 
রঘু রাই ক্যামেরা থেকে ছবি বের করে। ছবি দেখে চেঁচিয়ে ওঠে অঞ্জন, ওহ দারুণ ছবি। 
- আমিও তাই মনে করি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী একটি শরণার্থী শিবির দেখতে গিয়েছিলেন। দেখ তিনি গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার মনে হয়েছে যারা ভিড়ের মধ্যে পেছন থেকে তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলনা তারা গাছের উপর উঠেছে তাঁকে দেখার জন্য। তিনি গাছের দিকে তাকিয়ে ওদেরকে দেখে হাসছেন। আমার নিজেও ছবিটি তুলে প্রাণ জুড়িয়ে গেছে। 
অঞ্জন ক্যামেরা বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে, তিনি শরণার্থীদের বাঁচিয়ে রাখার আনন্দে আছেন। আমি অনেককে বলি, তিনি আমাদের মা। মায়ের আদর ভেসে উঠেছে তাঁর হাসিমুখে। 
অঞ্জন ক্যামেরার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের পলক পড়ে না। ভাবে, শরণার্থীদের নিয়ে এ এক অসাধারণ ছবি। রঘু রাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে ওর চোখ ছলছল করে। তারপরও মৃদু হেসে বলে, এই ছবি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের প্রধান দিক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। 
- তুমি বেশ আবেগাড়িত হয়ে গেছ অঞ্জন। 
- হবইতো। আমি তোমার বন্ধু। এমন একটা সুন্দর ছবি তুলেছ তুমি। তিনি কত সুন্দরভাবে হাসিমুখে গাছের ডালের দিকে তাকিয়ে আছেন। শরণার্থীরা তাঁর গলায় ফুলের মালা দিয়েছে। 
- বাব্বা,তুমি খুব নিখুঁতভাবে ছবিটা দেখছ। আস তোমার একটা ছবি তুলি। তুমি আর তোমার বাবা গাছের নিচে পড়ে আছ। পেছনে শরণার্থীদের তাঁবু। 
- হ্যাঁ, ত্যাঁ, তোল বন্ধু। এটাও তোমার আর এক ধরণের ছবি হবে। 
রঘু রাই হা-হা করে হাসে। হাসতে হাসতে বলে, শরণার্থীদের জীবন আমার ছবির রূপরেখা। এই শরণার্থী শিবির আমি নানা মাত্রায় দেখতে থাকি। তারপর যেটা পছন্দ হয় তখন সেই ছবিটি তুলি। 
- তুমি যে একটি শিশুর মুখ আর বুক নিয়ে হাঁ করে কান্নার ছবিটি তুলেছ সেটা দেখতে আমার মনে হয়েছিল ও শুধু একা না, শরণার্থী শিবির জুড়ে পড়ে থাকা মানুষের মুখ। এই কান্না বেঁচে থাকার সত্য। ছবিটা দেখার সময় আমার মনে হয়েছিল ওটা আমার মুখ। হাজার হাজার মানুষের মুখ।
- বাব্বা, তোমার ভাবনার সীমা নাই। এখন ছবি তুলব। 
অঞ্জন প্রথমে বাবার মাথার চুল এলোমেলো করে দেয়। তারপর নিজের মাথার চুল এলোমেলো করে গাছের নিচে চিৎ হয়ে পড়ে। রঘু রাই ছবি তোলে। অঞ্জনকে ছবি দেখিয়ে চলে যায়। 
অঞ্জন বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন তাঁবুতে যায়। কার কি খাবার আছে সেসব খোঁজ করে। একজন তীক্ষè গলায় বলে, খোঁজ করে কি করবে? চাল-ডাল দিতে পারবে?
- চেষ্টা করে দেখব। 
- থাক, এতকিছুর দারকার নাই। ঢং দেখানোর জায়গা নাই। শুধু ডাক্তারী কর। কেউ যেন বিছনায় পড়ে চিল্লায়না। ওষুধের ব্যবস্থা কর। 
- আচ্ছা যাই। 
অঞ্জন আর দাঁড়ায়না। চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই মুখোমুখি হয় হাসনা বানুর। 
- কি খুঁজতে এসেছেন ডাক্তার সাহেব? 
- দেখতে এসেছি সবাই কেমন আছে? 
- এই দেখাতো শুধু চোখের দেখা হবে। আপনিতো ওষুধ আনতে পারবেন না। 
- আমি ঠিক করেছি ওষুধ জোগাড় করার চেষ্টা করব। 
- হ্যাঁ, ভালো চিন্তা করেন। আমিও জোগাড় করার জন্য আপনার সঙ্গে থাকব। যখনই বলবেন আমি আপনার সঙ্গে কাজ করব। শরণার্থী হওয়ার কষ্ট পাচ্ছি বলে কাজ না করে শুধু বসে থাকব, এটা আমি ভাবিনা। 
- আপনি তো অসুস্থ মানুষকে সেবা করেন। 
- তাতো করবই। অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলা আমাদের দায়িত্ব না? সবাইকে সুস্থ করে আমরা একসঙ্গে স্বাধীন দেশে ঢুকব। আর যুদ্ধে শহীদ হওয়া সবাইকে মাথায় রেখে স্বাধীন দেশের কারুশিল্পী হব। 
- বাব্বা হাসনা বানু, আপনিতো অনেক কথা বললেন।  
- শুধুই কথাই বললাম। যুদ্ধ করতে তো পারলাম না। 
- আপনি অসুস্থদের সেবা করেন, এটাও যুদ্ধ। কেউ যদি পড়ে থেকে মরে যায় সেটা হবে যুদ্ধের খারাপ দিক। আমাদের চোখের সামনে কেউ পড়ে থাকতে পারবেনা। আমরা অসুস্থতার মতো শত্রুপক্ষকে মেরে কাহিল করব। নইলে যুদ্ধ অসুস্থতা আমাদের জীবন নিয়ে দৌড়াবে।
শব্দ করে হাসে হাসনা বানু। হাসতে হাসতে বলে আপনিতো বেশ গুছিয়ে সুন্দর কথা বললেন। 
- আমরাতো আর বেশি দিন এখানে থাকবনা। আমাদের স্বাধীন দেশে ফিরে যেতে হবে। চারদিক থেকে যুদ্ধের খাবর পাই। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ভালোভাবে যুদ্ধ করছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মেরে দাবড়াচ্ছে। আমাদের ইন্দিরা গান্ধী মা সবরকম সহযোগিতা দিচ্ছেন। আমার মনে হয় আমাদের আর বেশিদিন লাগবেনা।
চলবে
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৩)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৪) 
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৫)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৬)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৭) 
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৮)
 শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৯)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১০)
 শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১১)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১২) 
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৩)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৪)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৫)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৬)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৭)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৮)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৯)
 শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২০) 
 শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২১)
বিষয়: সেলিনা হোসেন

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: