সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এগার) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
২৮ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৫৯

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:০১

ছবিঃ অমর মিত্র

 

তাম্রধ্বজ এসেছে। পৌষের দ্বিপ্রহর নিঃশেষ প্রায়। রোদ ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে দশদিক থেকে। তাম্রধ্বজ এই কুটিরে পা দিল না। গন্ধবতীর পিতামহকে সঙ্গী করে সে চলে গেল পশ্চিমের পথে। আঙিনায় গন্ধবতী একা। কীরকম হতভম্ব হয়ে সে পথের দিকে তাকিয়ে থাকল। তাম্রধ্বজ এবং শ্বশুরমশায় ঢুকলেন না দেখে রেবা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। মেয়ের পাশে এসে দাঁড়াল, অস্ফুট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কোথায় গেলেন ওরা?

বোধহয় গম্ভীরা নদীর দিকে গন্ধবতী জবাব দেয়।

কেন, ওদিকে কেন? বলে রেবা টের পায় প্রশ্নটি নিজের কাছেই হয়ে গেল যেন। গন্ধবতী যে তিমিরে, সেও তো তাই। তারপর মনে পড়ে গেল ওদিকে গোধূমক্ষেত্র আছে। সেই ক্ষেত্র পরিদর্শনে গেল নাকি দশার্ণ দেশের গণক যুবকটি?

রেবা বলল, গণনা করে এসেছে নাকি?

কী জানি।

কী গণনা করল কে জানে? বিড়বিড় করতে করতে রেবা বলল, গণনায় যদি সামান্য ভুল হয় ফলাফল অন্যরকম হয়ে যেতে পারে

হুঁ। গন্ধবতী পথের দিকে তাকিয়েই আছে।

যা হয় হত, ভবিষ্যৎ জেনে লাভ কী?

গন্ধবতী মায়ের দিকে ফিরল, চাপা গলায় বলল ভয় করছে মা?

জানি না। রেবা নিশ্চুপ হয়ে গেল।

সুসংবাদও তো আসতে পারে। বিড়বিড় করে গন্ধবতী।

রেবা কথা বলছিল না! ধীরে ধীরে মেয়েও চুপ করে যায়। মা মেয়ে স্থির হয়ে পথের দিকে তাকিয়ে। রেবা বুঝতে পারছিল ফিরবে ওরা এখনই। ফিরবে এবং এই আঙিনায় দাঁড়িয়ে অরণ্যাচারী মানুষের মতো, নিষাদের মতো ওই মানুষটা ঘোষণা করবে যে সংবাদ তা মধুর হবে না। রেবা তো ভেবেই ছিল বছরখানেকের মধ্যে ফিরে আসবে কার্তিককুমার, যদি না হূণ দল তাকে বন্দি করে নিয়ে যায় দূর অঞ্চলে। হূণ জাতি অতি নিষ্টুর যোদ্ধা জাতি। হূণদের হাতে বন্দি যদি হয়ে থাকে, কী অপরিসীম কষ্ট না ভোগ করছে সে। আর যদি রাজকর্মচারী উদ্ধবের কথা সত্যি হয়, বুক হিম হয়ে যায় রেবার সে কথা ভাবলে। সে তো ভাবতেই পারে না লোকটা আর ফিরবে না। এই তো গেল উজ্জয়িনীর পথে। সন্ধ্যার অন্ধকারে শতভিষা নক্ষত্রকে দেখে তবে সে আঙিনা ত্যাগ করল। হাঁটতে উত্তরে। সব শুভ থাকলে, কী করে সে ফেরে না? কোন লিখন তার কপালে আঁকা হয়েছিল যার ফলে যুদ্ধ থেকে ফিরল না!

গন্ধবতী বলল, মা ওরা আসছে না কেন?

রেবা বলল, বেলা পড়ে আসে, প্রদীপ জ্বালা, শঙ্খধ্বনি কর, তুই চুল বাঁধবি না?

আর কখন? আচ্ছা মা, এমনও তো হতে পারে ধ্রুবপুত্র গেছে বাবার খোঁজেই।

চমকে উঠল রেবা, কী বলিস দুই, কী বলিস! আবেগে মেয়েকে জড়িয়ে ধরল, তাও কি সম্ভব?

তোমার মনে হয় না একথা?

রেবা নিরুত্তর। আশ্চর্য এই কথাটি কেন মনে হয়নি? এই কথাটি মনে এলে তো মা মেয়ে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে পারে। এ এক অলীক কল্পনা মনে হয়, কিন্তু অসত্য নাও তো হতে পারে। ধ্রুবপুত্রের রক্তে তো ক্ষত্রিয় যোদ্ধার রোষ। বহু যুদ্ধের স্মৃতি! সে তো নিজেও বলত তাই। গণিকার হাতে অপমানিত ধ্রুবপুত্র হয়ত দেশ ত্যাগ করেছে ওই কারণেই। অন্নের ঋণ শোধ করতে সে বেরিয়ে পড়েছে কার্তিককুমারের খোঁজে। এ এক আশ্চর্য কল্পনা। এই কল্পনা আপাতত নিরুদ্বিগ্ন করল রেবাকে। মনে মনে কী যেন ভেবে নেয় সে। মেয়েকে ছেড়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। যেতে যেতে ভাবে, যে কথা বলল মেয়ে তা অলীক হবে কেন? তাই-ই সত্যি। সত্যি সত্যি। কুটিরের কোন অংশে যেন লুকিয়ে আছে এক তক্ষক। তার ডাক শোনে রেবা।

প্রদীপ জ্বলল। শঙ্খধ্বনির ভিতরে প্রবেশ করল তাম্রধ্বজ। এক অবর্ণনীয় গোধূলির মায়া দশদিক ব্যাপ্ত করে রেখেছে এই সময়। নিঃশেষ হয়েও যেটুকুও পড়ে আছে তা যেন প্রাচীন এই পৃথিবীর গায়ে জড়িয়ে থাকা আলো। রেবা কুটিরের গায়ে দাঁড়িয়ে দেখল ধূলি-ধূসরিত পা দুটি মেলে দশার্ণদেশীয় যুবকটি বসেছে জলচৌকির উপরে। পাশে জলপাত্র রেখেছিল সে। জলপাত্রে হাত দিল না তাম্রধ্বজ, বলল, আবার তো ফিরতে হবে।

আপনি এই ঠান্ডায় বসবেন আঙিনায়? শিবনাথ বলে।

তাম্রধ্বজ বলে, কোথায় ঠান্ডা?

পা দুটি ধুয়ে বসলে ক্লান্তি যাবে।

তাম্রধ্বজ জলপাত্র হাতে কেতকীর বেড়ার গায়ে রাখা প্রস্তরখণ্ডে দাঁড়িয়ে চোখমুখ ধোয়। পা ধোয়। মানুষটা কীরকম যেন! অচঞ্চল। ঠোঁটের কোণে হাসি এল গন্ধবতীর।  এতটা পথ এসেছে, নিজেকে শুদ্ধ করবে না? ভাবল একরকম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত করল আর এক রকম। আসলে সে বসতে চাইছে এই কুটিরে। তার ইচ্ছা আছে। তা প্রকাশ না করতে পেরে বিপরীত কথা বলল বোধহয়।

পা ধুয়ে শুষ্ক বস্ত্রে মুছে তাম্রধ্বজ এসে বসল আবার জলচৌকিটিতে। শিবনাথ  বলল, হিম পড়বে দাওয়ায় উঠুন।

না এই আকাশতলই ভাল, হিম তেমন পড়ছে না।

অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হল উঠোনে। তাম্রধ্বজ গায়ের পশম চাদরটি মাথায় টেনে নিল, বিড়বিড় করে বলল, ঠিক তো ছিল না আসার, আচমকা মনে হল যাই, কেন যে মনে হল!

গণনা করেছেন? শিবনাথ বলে।

সম্পূর্ণ তো হয়নি, কাল সকালে বেরোলেই ঠিক হত, কিন্তু দিন মানে তো আকাশের তারারা লুকিয়ে থাকে, হারিয়ে থাকে, রাতের আকাশ অনুপম, রাত্রিকালে যখন ফিরব, তারা লক্ষ্য করে ফিরতে পারব, আর কী যেন! তাম্রধ্বজ কথা খুঁজে পায় না।

কথাটিতে গন্ধবতী মনে মনে হাসল। ধ্রুবপুত্র বলত, কোন দূরে অপরান্ত সমুদ্র আছে। গভীর রাত্রে অর্ণবপোতগুলি পথ খোঁজে আকাশের তারা দেখে। ধ্রুবনক্ষত্র দেখে। এই গম্ভীরা, উজ্জয়িনী কি মহাসমুদ্র যে তারা দেখে রাত্রিকালে তাকে ফিরতে হবে? রেবা উবু হয়ে বসেছে দাওয়ায়। শিবনাথ আর একটি জলচৌকিতে বসে তাম্রধ্বজের মুখোমুখি। গন্ধবতী অনেকটা দূরে। কথা শোনা যাচ্ছে দু’জনেরই।

তাম্রধ্বজ বলল, এই গম্ভীরা নদীটি আমার খুব মনে ধরেছে, বেতস লতা এই শীতে শুকিয়ে মরে গেছে বটে, বর্ষায় নীল হয়ে থাকে লতাগুলি তাই না?

হুঁ। বলল শিবনাথ।

গন্ধবতী কীরকম বিহ্বল হয়ে আকাশে তাকায়। উত্তর আকাশে ধ্রুবতারার দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করেছে সে। অন্ধকারে তাম্রধ্বজের কথা শোনা যাচ্ছে। কী আশ্চর্য! এই কণ্ঠস্বর যেন আগে শুনেছে সে। কী গম্ভীর, কী মায়াময়, যেন ধ্রুবপুত্র কথা বলছে। সত্যিই কি তেমন? হয়ত গম্ভীরাকুলের বেতসবনের কথা বলল, তাই। এই নদী, বেতসবন, আকাশ, নদীতীরের জোয়ার ক্ষেত; নদীর উপরে ব্যাপ্ত মেঘপুঞ্জে মুগ্ধ ছিল ধ্রুবপুত্র। তাম্রধ্বজ কি জানে তা? জেনেছে তা? কী করে জানবে? যতটুকু জানে, সে তো গন্ধবতীই। আর কেউ না। তাহলে গণনায় কি ধ্রুবপুত্রের মুখ দেখতে পেয়েছে তাম্রধ্বজ? সে কি দেখেছে বর্ষার মেঘের নিচে ধ্রুবপুত্র দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীরা তীরে। বকের উড়াল দেখছে অপরাহ্নে। তাম্রধ্ব কি তার জ্যোতির্বিদ্যায় এসব দেখতে পেয়েছে? অবাক হয়ে থরথর করে কাঁপছে গন্ধবতী। ধ্রুবতারার দিকে তাকিয়ে অন্ধকারে তার চোখদুটি সজল হয়ে উঠছে। কী করে দেখল তাম্রধ্বজ ওইসব দিনগুলিকে? বেতসলতা গম্ভীরার স্রোতে ভেসে যেতে চাইছে। গম্ভীরার জলে মেঘ শুয়ে আছে। এ কোন কালের কথা? কোন যুগের স্মৃতি? সেই যে মেঘ উধাও হল কত বৎসর আগে, তারপর তার আর দেখা নেই।  ধ্রুবপুত্রও যেন সেই মেঘের সঙ্গে উধাও হয়ে গেছে অবন্তীদেশ থেকে, যেন বহুকাল আগে বর্ষার পর সে আবার ফিরল উজ্জয়িনী, তারপর ফিরল চৈত্র পূর্ণিমার সকালে। সে কোন চৈত্র পূর্ণিমা? হায় কতকাল যে কেটে গেছে তারপর!

তাম্রধ্বজ বলল, গৃহত্যাগের দিনটির কথা মনে আছে?

চমকে তাকায় গন্ধবতী আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে। শিবনাথ তাম্রধ্বজের কথা শুনে ঘুরে তাকায় গন্ধবতীর দিকে। গন্ধবতী দাওয়ায় বসে থাকা মায়ের দিকে তাকায়। অন্ধকারে মা রেবা মাথা নিচু করে আছে।

শিবনাথ জিজ্ঞেস করল, কার কথা বলছেন?

যে গৃহত্যাগ করেছিল।

আমার পুত্র কার্তিককুমার যুদ্ধে গিয়েছিল, সে তো গৃহত্যাগ করেনি।

গৃহত্যাগ করেছিল তো ধ্রুবপুত্র। তাম্রধ্বজ বলে।

হ্যাঁ, সে গিয়েছিল প্রায় দুই বৎসর হলো, চৈত্র-পূর্ণিমার রাতে।

তখন আকাশের চাঁদ কোথায় ছিল?

শিবনাথ মাথা নাড়ে, সকলের অজ্ঞাতে সে গৃহত্যাগ করেছিল, যদি জানা যেত তাহলে তো তার নিরুদ্দেশে যাওয়া হত না।

তাম্রধ্বজ বিড়বিড় করল কী যেন, তারপর আচমকা ডাকল রেবাকে, মা খাদ্যদ্রব্য কিছু আছে? 

গন্ধবতী শিহরিত হয়ে তার মায়ের কাছে ছুটে গেল। কানে কী শুনল? অন্ধকারে তাম্রধ্বজের কথায় বিভ্রান্ত হচ্ছে সে। এ ডাক কি সেই ধ্রুবপুত্রের নয়? দূর থেকে পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরে সে তো এইভাবেই ডাকত রেবা মাকে।

শিবনাথ উঠে দাঁড়িয়েছে, আমরা খুবই লজ্জিত, আপনি ক্ষুধার্ত?

এক পাত্র গোদুগ্ধ দিলেই হবে। তাব্রধ্বজ অন্ধকারে রেবার দিকে ফিরে কথাটি বলল। রেবা শশব্যস্ত হয়ে ওঠে। আহারে, নিজ মুখে খেতে চেয়েছে। আঙিনা এক কোণে পাতা উনানের ধারে গিয়ে বসল সে। গন্ধবতীকে চাপাস্বরে নির্দেশ দিয়ে। ঘরের ভিতরে রাকা প্রদীপটি হাতে গন্ধবতী পাকশালে যায়। দুধের পাত্রটি নিয়ে বেরিয়ে আসে অন্ধকারে। স্তিমিত পায়ে আঙিনায় নামে। 

রেবা ঘুরে ঘুরে তাম্রধ্বজের দিকে তাকাচ্ছে। তার মুখে জেগে উঠেছে অপত্যস্নেহ। কতটা পথ হেঁটে এসেছে, ক্ষুধার্ত হতেই পারে। ঠিক যেন ধ্রুবপুত্র। দীপের আগুন থেকে শুকনো ডালপালা জ্বালিয়ে উনানে দুধের পাত্র বসিয়ে গালে হাত দিল রেবা। তার পাশে উবু হয়ে বসে আছে গন্ধবতী। উনানের আগুন লকলকিয়ে উঠল। যেটুকু শীত লাগছিল তা ঝপ করে নেমে গেল। তাম্রধ্বজ আস্তে আস্তে গুছিয়ে কথা বলে। তাম্রধ্বজের কথায় কান পেতে আছে মা ও মেয়ে।

তাম্রধ্বজ বলল, এ বড় আশ্চর্য ঘটনা, কেন অনাবৃষ্টি তা জানা যাচ্ছে না, তবে শোনা যায় কোনো বিশেষ কারণে প্রকৃতির রূপ বদল হয়, যখন কোনো পুণ্যবান মহাপুরুষ জন্ম নেন পৃথিবীতে, দেবতারা যখন মর্ত্যে নামেন তখন পৃথিবী শস্যশালিনী হন, সুবৃষ্টি হয়, মানুষের ভাল হয়।

শিবনাথ বলে, এ তো কোনো রূপবদল নয়, এ যে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।

তাম্রধ্বজ বলে, দুই আষাঢ়ে দুই বৎসরাধিক বৃষ্টি হয়নি, এই মাঘে বৃষ্টি হতে পারে, বৃষ্টির সময় যায়নি, এমন কি কখনো হয়নি, বর্ষা ঋতুতে তেমন বৃষ্টি হল না?

হয়েছে, কেন হবে না, আগে পরে হয়েছে, আষাঢ়, শ্রাবণ পার করে প্রোষ্টপদ-এ বৃষ্টি হয়েছে। একটি ফসল মরে গেছে, আর একটি ফসল জন্মেছে, বৃষ্টি শেষ কবে হয়েছে তা মনে নেই, গেল মাঘের আগের মাঘে বৃষ্টি হয়েছিল একদিন, তখন মনে হয়েছিল প্রকৃতি সদয়, সেই বোধহয় শেষ বর্ষা, গেল শ্রাবণে দু-চার ফোঁটা নেমেছিল, আষাঢ়ে কিছুই না, তারপর সব শূন্য।

তাম্রধ্বজ বলল, দশার্ণ দেশেও তেমন বৃষ্টি হচ্ছে না, সংবাদ পেয়েছি, এ বড় কঠিন সময়, তবে মনে হয় এ কোনো ইঙ্গিতও, এই পৃথিবী সবিতা নক্ষত্রের অধীন, মানুষের জীবনও তাই, উজ্জয়িনীর জ্যোতিষীরা বলছেন আকাশের নতুন এক তারার কথা!

কোন তারা! চমকে আকাশে মুখ তুলল শিবনাথ।

এখনো হয়ত তার উদয় ঘটেনি, কী জানি!

গন্ধবতী, রেবা শুনছিল তাম্রধ্বজের কথা। দুধ ফুটে উঠেছে। আঁচল দিয়ে পাত্রটি উনান থেকে নামিয়ে রাখল রেবা। ঘন দুধের গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। দুধ একটু আগে উথলে উঠেছিল। এ বড় শুভ লক্ষণ, সমৃদ্ধি, সুখের ইঙ্গিত।

শিবনাথ বলল, আপনি কি গণনা করেছেন?

আমার জানা প্রয়োজন গৃহত্যাগী কোনদিকে গিয়েছেন এই গম্ভীরা ত্যাগ করার সময়।

ধ্রুবপুত্র?

হ্যাঁ, তিনি তো প্রায় দুই বৎসরের মতো নিরুদ্দিষ্ট, কার্তিককুমার পাঁচটি বৎসর, তাঁকে যতটা না স্পষ্ট দেখব, তার চেয়ে অনেক স্পষ্ট হবেন ধ্রুবপুত্র।

চমকে ওঠে শিবনাথ, স্পষ্ট দেখবেন মানে?

মনশ্চক্ষে দেখছি তো, আমি তাঁর জন্মপিত্রকা ধরে গ্রহ-নক্ষত্র বিচার করে দেখেছি যেন বেতস বনে তিনি দাঁড়িয়ে, আকাশে ঘন মেঘ।

কী বলছেন আপনি?

দুধের পাত্র এল। দুধ হাতে পাত্রটি মুখের কাছে তুলে তাম্রধ্বজ নিঃশেষ করে দিল সবটা। অন্ধকারে উঠে হাত মুখে জল দিয়ে এসে বসল আবার পুরনো জায়গায়, বলল, উজ্জয়িনীর জ্যোতিষীরা যা বলেন তা আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু আচার্য বৃষভানু সত্যিই আকাশমণ্ডল চেনেন, তিনি গ্রহ নক্ষত্রের দৃশ্য, অদৃশ্যমানতা ও মানুষের জীবনের উত্থান পতন এই দুইয়ের এক শৃঙ্খলা খুঁজে বের করেত চাইছেন, তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন অনবরত, সমস্ত রাত প্রায়ই জেগে থাকেন।

শিবনাথ বলল, কিন্তু আপনি কি সত্যই দেখেছেন?

আমি তাঁর গৃহত্যাগের সঠিক মুহূর্তটি জানতে চাই, দেখুন তাঁকে অনুভব করা কোনো আশ্চর্য ঘটনা নয়, আচার্য বৃষভানুর মতো আমিও আকাশমণ্ডল এবং মানুষের জীবন, দুইয়ের এক সম্পর্ক খুঁজে বেড়াচ্ছি, আচার্যর শিষ্য আমি।

কী ভাবে তা জানা সম্ভব?

তাম্রধ্বজ বলল, এই যে পৌষমাসের আকাশ, এ আকাশে সপ্তঋষিরা কেউ নেই, তাঁরা অদৃশ্য, তার মানে কি তাঁরা চিরকালের মতো নিরুদ্দিষ্ট?

তা কেন হবে, আশ্বিনে তাঁরা তো উত্তর-পশ্চিমাকাশে ছিলেন।

অস্তগামী ছিলেন, কার্তিকে অস্ত গেছেন, আবার মাঘেই দেখা দিতে থাকবেন উত্তর-পূর্ব আকাশে, তারপর থেকে ক্রমশ প্রকাশিত হবেন, এ এক শৃঙ্খলায় বাঁধা, প্রতিটি মানুষ যদি নক্ষত্ররাজি, গ্রহের অধীন হয়ে থাকেন, তাঁদের জীবনেও এইরকম উত্থান পতন, উদয় অস্ত আছে ধরা যেতে পারে।

জ্যোতিষীরা তো তাই বলেন।

বলেন নিশ্চয়, কিন্তু ব্যাখ্যা দিতে পারেন না, যদি আকাশকে সম্পূর্ণ ধারণ করতে না পারি মাথার ভিতরে, তাহলে ব্যাখ্যা কীভাবে দেব, শুনুন, আচার্য বৃষভানু অদৃশ্য সপ্ত-ঋষিদের দেখতে পান, তাঁর দৃষ্টি মহাব্রহ্মাণ্ড ছাড়িয়ে আরো অসীমে প্রসারিত হয়, তিনি আমাকে তা শিখিয়েছেন, যে তারা রাতের আকাশে অদৃশ্য সেই তারা কোথায় আছে তা জানতে চাইছি আমি, যে অগস্ত্য ঋষি দক্ষিণ দিগন্তে জেগে উঠবেন চৈত্রে, তিনি কীভাবে এগিয়ে আসছেন কল্পনা করুন দেখি, সমস্ত ঋতুতে অগস্ত্য আকাশে না থাকলেও মহাব্রহ্মাণ্ডে আছেন নিশ্চয়, নিরুদ্দিষ্ট নক্ষত্রকে খুঁজে বার করা যদি যায় তো মানুষটিকে খোঁজা যাবে না? মানুষের জীবনেও তো প্রকৃতির মতো ঋতুচক্র রয়েছে, মার্গশীর্ষ অগ্রহায়ণে যে জীবন আরম্ভ, কার্তিক মাসে তার শেষ, যতদিন বাঁচে একটি মানুষ তার ভিতরেই এই ঋতুগুলিকে ভাগ করে দেওয়া যায় যদি, শৃঙ্খলাটিক স্পষ্ট ধরা যাবে। বলতে বলতে থামল তাম্রধ্বজ, নিম্নস্বরে, বলল, আমি কি স্পষ্ট করতে পারছি আমার কথা?

গন্ধবতী, রেবা অবাক হয়ে দেখছিল তাম্রধ্বজকে। গন্ধবতীর দিকে তাকিয়ে রেবা নিম্নস্বরে বলল, কখন গেছে ধ্রুবপুত্র তা কে জানে, চাঁদ তখন কোথায় ছিল?

গন্ধবতী মায়ের গলা জড়িয়ে বুকে মুখ রাখল, আমি জানি।

জানিস?

হ্যাঁ জানি।

তাহলে বল ওঁকে, উনি মহাজ্ঞানী!

রেবার হাত ধরে গন্ধবতী এগিয়ে যায়, ধরা গলায় বলল, আমি জানি।

জানো! উঠে দাঁড়ায় তাম্রধ্বজ, বল তাহলে, চাঁদ কোথায় ছিল, কোনদিকে গেলেন তিনি, বল, আমি এবার যাব, শীতও বাড়ছে ক্রমশ।

স্থিরদৃষ্টিতে তাম্রধ্বজ তাকিয়ে আছে গন্ধবতীর চোখের দিকে। অন্ধকারে তাম্রধ্বজের চোখে তারার আলো। গন্ধবতী ওই দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে মাথা নামায়।

 

চলবে

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দশ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top