সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ষোল) : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২১ ১৯:১৪

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০৭:০৪

 

আমার কক্ষের দেয়ালে একটা বিশালাকৃতির স্মার্ট টিভি আছে। তবে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো আমি তেমন একটা দেখি না। প্রথম প্রথম দু’এক সময় দেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু টিভি খুললেই দেশের যাবতীয় উন্নয়ন নিয়ে গলাবাজি, আর টকশোর নামে এক অদ্ভুত হাস্যকর অনুষ্ঠান সেখানে কিছু রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের অতীত, বর্তমান নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া, রগড়া। আমার মাথা ঝিম ঝিম করে। আমি টিভি বন্ধ করে দিই। ডাক্তারেরও অবশ্য নিষেধ আছে আমি যেন কোনো উত্তেজনামূলক অনুষ্ঠান না দেখি, কোনো টক শো নয়, থ্রিলার জাতীয় কোনো সিনেমা নয়, এমনকি ফুটবল, ক্রিকেটও নয়। মিস্টার বিনের হাসির ছবি দেখতে নিষেধ নেই, প্রিয় গান শুনতে নিষেধ নেই। আমি দুপুরে কখনো কখনো টিভিতে সংযোজিত ইউটিউবে অতীত দিনের বাংলা ছায়াছবি, লতা, সন্ধ্যা, হেমন্ত, মান্নাদের সেই সব স্বর্ণালি দিনের স্বর্ণকণ্ঠের গান শুনি। শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে যাই বুঝতে পারি না।

এখন প্রায় বিকেলেই রাজিব, নাজু আর আমি দোতালার ব্যালকনিতে বসে চা পান করি, নানান গল্প করি। নিচে প্রাঙ্গণের ছোট্ট মাঠটায় রাশা আর পাশার ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা দেখি। আনন্দে হাততালি দিই, ওদের উৎসাহ দিই বটে কিন্তু প্রাচীর ঘেরা এই আঙ্গিনাতে এই সীমাবদ্ধ খেলা, নিয়ম শৃঙ্খলায় বন্দি বালক দুটির জন্যে আমার বড় দুঃখ হয়। ওদের মুক্ত স্বাধীনতা নেই, বন্ধু নেই, প্রাণভরে ছুটে বেড়াবার অবারিত সবুজ মাঠ নেই। ওরা যখন বড় হবে তখন ওদের জীবনে শৈশবের কোনো স্মৃতির বাতিঘর থাকবে না। কিন্তু এ কথা নাজু বা রাজিবকে বলতে পারি না।

রাজিব এক সময় নিজেই অপরাধী কণ্ঠে বলে, বড়দা, আ অ্যাম স্যরি যে আপনাকে আমরা যথেষ্ট সময় দিতে পারছি না, কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে পারছি না। আমাদের ছেলে দুটোও প্রাণভরে বেড়াতে না পেরে ফার্মের মুরগি হয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যেতে পারলে ভালো লাগত।

নাজু বলল, হ্যাঁ তা ঠিক। বড়দা তুমিই বলো, আমরা কোথায় যেতে পারি? নেপাল, শ্রীলংকা বা মালদ্বীপের? উত্তর দিতে আমার দেরি হয়। এক সময় বলি, নাজু এই ঢাকা শহরে আরমানিটোলার মাহুতটুলিতে আমাদের সবার জন্ম, আমাদের বড় হয়ে ওঠা। আমাদের বাবা ফজলুল হাসানের, মা জয়ীতার গ্রাম ছিল, নদী, জলা-জঙ্গল ছিল, যুদ্ধ দৃশ্যের ভেতর দিয়ে দু’জনের হাত ধরাধরি করে ছুটে চলা ছিল।

নাজু, আমার সেইসব দিনের দৃশ্যে, নদী, জলা-জঙ্গলে, গ্রামে ছুটে যেতে মন চায়। কিন্তু আমাদের কোনো গ্রাম নেই। কোথায় যাব আমরা?

এখন গভীর রাত। আমি বিছানায় শুয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সোনালি দুঃখ’ গল্পটির গভীরে ডুবে গিয়েছিলাম। গল্পটি অসাধারণ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপস্থাপনাটিও অসামান্য, হৃদয়স্পর্শী।

“আমি একজন সামান্য কবি। হে প্রভুগণ, আমি আপনাদের সভায় এসেছি, যদি অনুমতি পাই, আমি আপনাদের আজ দু’জন নারী-পুরুষের ভালোবাসার গান শোনাব। ভালোবাসার জন্যই মানুষ পৃথিবীতে জন্মায়, কিন্তু এই যে, দু’জন এদের মতো এমন তীব্র-মধুরভাবে আর কেউ বোধহয় ভালোবাসেনি। ... আপনারা জানেন ভালোবাসা হচ্ছে আগুনের মতো, যাতে কোনও পাপ স্পর্শ করে না। আপনারা অন্তর দিয়ে বুঝতে পারবেন, এই দুই হতভাগ্য প্রেমিক-প্রেমিকা প্রেমের শক্তিতে কী করে পাপ-পূণ্য ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আহা, ওদের গান শুনলে যে মানুষ পাহাড়ের মতো কঠোর ব্রহ্মচারী তারও বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে ঝরণা। অপ্রেমিকও প্রেমিক হয়। সুখভোগ, আমোদ-আহ্লাদে ডুবে আছে যে মানুষ, এই গান শুনে সেও এক মুহূর্ত থমকে যায়, তার মনে পড়ে জীবনে কী যেন বাকি রয়ে গেল, বুকের মধ্যটা উদাস উদাস হয়ে যায়। ... এই পৃথিবীতে যে জন্মালুম, জীবনটা ঠিক মতো বাঁচা হল তো? না কি এই জীবন মনের ভুলেই কেটে গেল। ভালোবাসাহীন জীবনই তো ভুল জীবন।... ভালোবাসা মানেই তো দুঃখ, তবু মানুষ ভালোবাসতে চায়। ... জীবনে ভালোবাসাই একমাত্র দুঃখ, যেখানে মানুষ ইচ্ছে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ...।”

‘সোনালি দুঃখ’ পড়তে পড়তে আমার মন উদাস হয়ে যায়। চোখে ঘুম নেই, শুধু দুঃখ জল। ভাবি, আমারও এই জীবন ভালোবাসাহীন ভুল জীবন। মনের ভুলেই কেটে গেল অর্থহীন এক জীবন।

আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পায়চারি করি। জুলিয়াঁর কথা ভাবি, শ্যামশ্রী নামের এক বিস্মৃত মেয়ের কথা ভাবি।
শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা।

লালবাগের একট লাল ইটের বাড়ির ছবি আমার চোখের পর্দায় ভাসতে থাকে। নিজের চোখে ঘুম আনতে আমার ঘুমন্ত বেহালাটা হাতে তুলে নিই। লাইব্রেরি রুমে যাই। দেয়ালে ঝুলানো আমার পুরাতন স্মৃতিখ- সেই রিকশার রংচটা ছবিটা দেখি। আমার বলা সত্ত্বেও নাজনিন ওটা সরায়নি। না সরাবার কারণ সে-ই জানে। ছবিটার সামনে আমি দাঁড়িয়ে থাকি। বেহালায় ছড় টেনে সুর তুলি। বুকের ভেতরে মৃত জীবনানন্দ যেন আবার জীবিত হয়ে ওঠেন। মন্থিতকণ্ঠে গেয়ে ওঠেন,

“মনে পড়ে কবে এক রাত্রির স্বপ্নের ভিতরে
শুনেছি কোনো এক কুণ্ঠ কলংকিত নারী
কেমন আশ্চর্য গান গায়;
বোবা কালা মিনসে এক অপরূপ বেহালা বাজায়;
গানের ঝংকারে যেন সে এক একান্ত শ্যাম দেবদারু গাছে
রাত্রির বর্ণের মতো কালো কালো শিকারী বিড়াল।”
জীবনানন্দ গাইতে থাকেন, আর আমি বোবা, কালা মিনসে বেহালা বাজাতে থাকি আমরই মতো নির্ঘুম, স্বপ্নহীন, রাত্রির কালো কালো শিকারী বিড়ালগুলো তাড়াতে।

আমার প্রায় রাতই নির্ঘুমে কাটে। পেটের ব্যথাটা মাঝে মধ্যেই চিড়িক দিয়ে ওঠে। পায়ের পাতা ভারী। বোধহয় পানি জমেছে। নার্স লতিফার মুখ গম্ভীর। নাজনিন ডাক্তারের সঙ্গে আমার স্বাস্থ্যের বর্তমান অবস্থা, অবনতি নিয়ে পরামর্শ করছে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বুঝে উঠতে পারছেন না তারা আমার কোন রোগটাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসার ধরণ পাল্টাবেন? নাজনিন ভাবছে আমাকে সিঙ্গাপুর নিয়ে চিকিৎসার কথা।

আমি অবশ্য এ সব নিয়ে চিন্তা করছি না। দেহ-যন্ত্রণার কথা ভুলতে বেহালা বাজাই, টুকটাক স্কেচ করি। নাজনিনের ছেলে দুটো রাশা আর পাশার সাথে আমার বন্ধুত্ব জমে উঠেছে। আমি ওদের ছবি উপহার দিই, পিয়ানো বাজিয়ে ওদেরকে ফ্রেন্স ভাষায় গান শোনাই। ওরা মজা পায়।

ওরা আরো মজা পেয়েছিল যেদিন একজন মহিলা হেয়ার ড্রেসার এসেছিল আমার চুল, দাড়ি ছাঁটতে। আমাকে দোতালার বাইরের ব্যালকনিতে বসিয়ে একটা আরামদায়ক চেয়ারে বসিয়ে সাদা ধবধবে কাপড় গলা পর্যন্ত মুড়িয়ে কাইচি, চিরুনি বের করল। এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখতে রাশা আর পাশা ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে উপস্থিত, উপস্থিত তাদের মা নাজনিন।
আমি ফ্রেন্স ভাষায় এই মহিলা হেয়ার ড্রেসারকে প্রশ্ন করলাম, পৌঋয়েষ ভৌস মে চৌপের লেস ছেভে উক্স?
হেয়ার ড্রেসার কাইচি হাতে হা করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি আবার গানের মতোই বললাম,
পাস ত্রপ চৌর্ত, সইঁল ভৌস প্লাইত ...।

সবাই তখনও দুর্বোধ দৃষ্টিতে হা করে। আমি যখন তা বাংলায় গেয়ে উঠলাম, ‘আপনি কি আমার চুল কাটতে পারবেন? হে দয়াবতী, দয়া করে খুব ছোট করবেন না ...।

সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

শুধু বালক দুটির সঙ্গে বন্ধুত্ব জমাতেই আমার চুল, দাড়ি কিছু অল্প-স্বল্প ছাঁটিয়ে ভদ্রস্থ হলাম। এরপর আমি রাশা, পাশার কাছে নট এ স্ট্রেঞ্জার, নট এ রিডিকুউলাস ম্যান। আ অ্যাম এ ওয়ান্ডারম্যান, এ ফ্রেন্ডফুল অব জয় অ্যান্ড সং।

রাশা, পাশা যখনই সময় পায় আমার কাছে ছুটে আসে। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে পিয়ানোর সামনে বসায়। বাংলা গানের সাথে ফ্রেন্স ভাষায় গান শুনতেও ওরা ভারি মজা পায়। আমি ফ্রেন্স ভাষায় ইচ্ছে মতো আবোল তাবোল কথায় গান শুনাই,

জে দেসসিনে উন হম্মে
ড’ আবর্দ, লা তেতে
ল’ হম্মে পর্তে উন ছাপেয়াউ
ওন নে ভৈত পাস লেস ছেভেউক্স
ওন নে ভৈত পাস নন পুস লেস অরেইল্লেস
জে দেসসিনে উন হম্মে ...।

জে দেসসিনে লেস ইয়েউক্স এত লা বৌছে
ল’ হম্মে দানসে এত রিত
ল’ হম্মে আ উন লং নেয
ঈল পর্তে এগালেমেন্ত উনে এ ছার্পে আউতৌর দু চৌ
ছ’ এস্ত ল’ হিভের এত ইল ফাইত ফ্রৈদ
ঈল নে পর্তেনি পান্তালন, নি মান্তেয়াউ
মাইস চেত হম্মে ন’ আ পাস ফ্রৈদ
ছ’ এস্ত উন হম্মে ফাইত দে নেইগে
ছ’ এস্ত উন বন হম্মে দে নেইগে ...।

গানের কথাগুলো ফ্রেন্স ভাষায় সাধারণ কথোপকথনের সংলাপ। তাতে আমি ইচেছ মতো সুরারোপ করে শিশুদের মন ভোলানো গানের মতো গেয়ে শোনাই,

আমি একজন মানুষের ছবি আঁকছি।
সবচেয়ে আগে মাথা
মানুষটি একটি টুপি পরে আছে
তার চুল দেখা যায় না।
তার কানও দেখা যায় না।
আমি একজন মানুষের ছবি আঁকছি।

আমি চোখ এবং মুখ আঁকছি।
লোকটি নাচছে এবং হাসছে
লোকটার একটা লম্বা নাক আছে
তার হাতে একটা ছড়ি ধরা
তার গলাতেও একটা স্কার্ফ জড়িয়ে আছে।
এখন শীতকাল এবং ঠান্ডার সময়
সে প্যান্ট আর কোর্ট কোনোটাই পরে নেই
কিন্তু মানুষটার ঠান্ডা লাগছে না
মানুষটা বরফ দিয়ে তৈরি
সে একজন হিম মানব
আমি একজন হিম মানুষের ছবি আঁকছি।

রাশা আর পাশা উল্লাসে হা হা করে হেসে ওঠে। ওরা আমার গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। আমার বুক তখন কান্না নয়, আনন্দে ভরে ওঠে।

আমি সেই বরফ মানুষটার দুটো ছবি এঁকে রাশা আর পাশাকে উপহার দিই। একটি বরফ মানুষের মুখ রাশার আর একটি বরফ মানুষের মুখ পাশার। ওরা ছবি দুটো নিয়ে আমার পিয়ানোর ঝংকারের সাথে ঘুরতে ঘুরতে নাচতে থাকে। আমার সুরে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইতে থাকে, ল’ হম্মে দানসে এত রিত। ল’ হম্মে দানসে এতরিত ... ছ’ এস্ত উন বন হম্মে দে নেইগে ...।

ইদানিং সকালে, বিকেলে বাড়ির প্রাঙ্গণে সামান্য হাঁটাহাঁটি শুরু করেছি। আজ সকালেও গায়ে একটা টি-শার্ট, পরনে জিন্স আর পায়ে নরম কেডস পরে ছড়ি হাতে হাঁটতে বের হলাম। আজ বাগানে হাঁটাহাঁটি না করে গেটের গার্ডকে বললাম, গেটটা খুলে দিতে। গার্ড প্রথমে ইতস্তত করল। কিন্তু আমার দ্বিতীয়বারের নির্দেশ অমান্য করতে সাহস পেল না। ও গেটের একাংশ খুলে দিল। আমি গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললাম, একটু বাইরে হাঁটতে যাচ্ছি। কাউকে চিন্তা করতে মানা করে দিয়ো।

বনানীর ফুটপাথ ধরে বেশ কিছুটা পথ হাঁটলাম। এখন অল্প হাঁটাতেই হাঁপ ধরে যায়। সহসা একটা খালি সি এন জি বেবি ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, লালবাগ যাবে?
ড্রাইভার বোধহয় এই বনানী থেকে লালবাগের দূরত্বটা চিন্তা করল। তারপর বলল, যাইতে পারি, তয় রাস্তায় যা জ্যাম। কত দিবেন?
আমি বললাম, আমি তো সবেমাত্র দেশে এসেছি। বাংলাদেশি টাকা এখন আমার পকেটে নেই। ডলার আছে। আমি লালবাগ যাওয়া আর বনানী ফিরে আসা বাবদ একশো ডলার দেব।

ড্রাইভার একশো ডলারের কথা শুনে আশ্চর্য ভঙ্গিতে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তারপর বোধহয় মনে মনে হিসেবে কসল, একশো ডলার মানে প্রায় সোয়া আট হাজার টাকা। এই সাত সকালে আমার মতো এক বুড়ো বোকা যাত্রী পাওয়া মানে আল্লার রহমত পাওয়া। তবুও বলল, ডলারটা দেখান।

আমি পার্স থেকে একশো ডলারের একটা নোট বের করে ওর হাতে দিলাম। ও নোটটা উল্টে পাল্টে দেখল, এটা আসল না জাল? তারপর নোটটির আসলত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নোটটি আমার হাতে ফেরত দিয়ে বলল, গাড়িতে উঠেন স্যার। বিসমিল্লাহ।

নানা যানজটের ফাঁক-ফোকর দিয়ে রাস্তার অন্য গাড়ির ধোঁয়া আর ধুলো খেতে খেতে বনানী থেকে লালবাগের কেল্লার মোড়ে পৌঁছাতে সময় লাগল প্রায় সোয়া ঘন্টা।

লালবাগের কেল্লা আমার দর্শনীয় স্থান নয়। আমি খুঁজতে এসেছি কেল্লার পাশেই আমলিগোলার একটি লেন। পুষ্পরাজ সাহা লেন, সেখানে একটা পুরোনো লাল ইটের লাল দোতালা বাড়ি ছিল। বাড়িটা ছিল সোমনাথ রায় উকিলের বাড়ি। আমি বেবিটেক্সি থেকে নেমে পুষ্পরাজ সাহা লেনের সেই বাড়িটা আতিপাতি করে খুঁজলাম। কিন্তু লাল বাড়িটার কোনো চিহ্ন নেই। সেখানে ম্যাচবক্সের মতো ঘিঞ্জি ফ্লাট বাড়ি। আশেপাশের কোনো বাড়ির মানুষ, কোনো দোকানদার কেউ জানে না সোমনাথ উকিলের কথা, তার পরিবারের কথা, তার কন্যা শ্যামশ্রীর কথা। তারা হারিয়ে গেছে লালবাগের মানচিত্র থেকে।

আমি হতাশ, বিষাদগ্রস্ত, ক্লান্ত। অপেক্ষারত বেবি ট্যাক্সিতে চড়ে আবার ফিরে এলাম বনানীতে। আমাদের বাড়ির সামনে ট্যাক্সিটা থামতেই দেখি আমার মাত্র তিন ঘন্টার আকস্মিক অন্তর্ধানে নাজনিন পুলিশ কর্মকর্তা, দু’জন পুলিশ ও বাড়ির সিকিউরিটি গার্ডদের নিয়ে সারা বনানী বোধহয় তোলপাড় করে ফেলেছে। আমি একশো ডলারের নোটটা বেবিট্যাক্সি চালকের হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম, ব্রাদার, বুঝতেই পারছ যে মানুষটি ঢাকায় বেবি ট্যাক্সিতে একশো ডলার দিয়ে ঘোরে সে যেন তেন মানুষ নয়। তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলে তা নিয়ে জেরা হবে। শুধু জেরা নয়, এই ডলারও বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। সুতরাং এইসব ঝামেলার মধ্যে তোমার থাকার দরকার নেই। চটজলদি কেটে পড়। আমার ব্যাপার আমিই সামলাব।

কেউ কিছু জিজ্ঞেস বা জেরা করার আগেই বেবিট্যাক্সি চালক মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেল বনানীর গলির মধ্যে।

নাজনিন আমার সম্মুখে ছুটে এল। তার সারা মুখে উদ্বেগের ঘনঘটা, চোখে পানি। পারলে এক্ষুণি সে আগের মতোই দুমদুম করে কিল মারত। কিন্তু বাড়ির বাইরে সবার সামনে এমন একটা সিন ক্রিয়েট করা তার পক্ষে শোভা পায় না। তাই ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, বড়দা, তুই সাত সকালে আমাদের কাউকে না বলে কোথায় কোথায় গিয়েছিলি? আমাকে বলতি, আমি নিয়ে যেতাম।

আমি শান্ত কণ্ঠে ম্লান হেসে বললাম, আমি লালবাগে গিয়েছিলাম একটা লাল বাড়ির খোঁজে। কিন্তু পাইনি।

 

 [নাজনিনের কথা]
বড়দা লালবাগে কেন গিয়েছিল তা আমি জানি। মানুষতো তার হারানো স্মৃতির সন্ধান করবেই চেতন বা অচেতন মনে। তাই বড়দাকে কোনো প্রশ্ন করে তাকে বিব্রত করতে চাইনি। ছোটোকাল থেকেই তো জানি আমাদের তিমুদা, আমাদের বড়দা এক অদ্ভুত মানুষ, আমাদের অহঙ্কার, সবার প্রিয় মানুষ।

আমাদের এই বড়দাকে ভালোবাসার আকাক্সক্ষায় মাহুতটুলি, আরমানিটোলার কত মেয়ের গোপন চিঠি আসা এবং চিঠির ছত্রে-ছত্রে কত কান্না আর আঁকুতি। বড়দাকে না পেলে তারা নাকি আত্মহত্যা করবে। তাই চিঠির মধ্যে গোলাপের পাপড়ি আর লেখা, যদি মরে যাই, ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই ...

 

বড়দা ওসব চিঠি কোনোদিন খুলেও দ্যাখেনি, পড়েওনি। আমি আর জয়ীমা পড়তাম আর হাসতাম। জয়ীমা কখনও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্তভাবে বলতেন, তিমুকে একটা শান্ত, সুন্দর মেয়ে দেখে বিয়ে দিতে পারলেই বোধহয় ভালো হত। তা না হলে প্যারিসের সেই পরি পরি ডাইনি জুলিয়াঁ মেয়েটাই ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

আমি বলি, মা শ্যামশ্রীদি তো তোমার কল্পনার মতোই মেয়ে ছিল। কী লাবন্যময় চেহারা, ঐ রিকশার ছবির চাইতেও সুন্দর। বড়দা ওকে পছন্দ না করলে কি ওর ছবি আঁকত? মেয়েটাও মনে হয় বড়দার প্রতি খুব দুর্বল। কিন্তু বাবার নিষেধের পর বড়দা তো আর ও মুখোই হয় না।

ছোটন আমাদের কথার মাঝে বলে উঠেছিল, বড়দার জীবনটা শুধু আমার জন্যেই অন্যরকম হয়ে গেল।

মা ওকে ধমকে বলেছিলেন, এমন কথা বলিসনে ছোটন। তুই সুস্থ হ। দেখিস তিমু তখন হবে আমাদের গর্বের মহানায়ক।

ছোটন বলেছিল, আমিও তো তা-ই চাই। আমি থাকি বা না থাকি আমি যেন আকাশ থেকে দেখতে পাই, বড়দা বিশ্বময় দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথা আকাশ ছুঁই-ছুঁই। বড়দার মাথায় হাত ছুঁয়ে বলব, বড়দা এইতো আমি। আমার হাত ধরে টেনে নামাও তো আবার পৃথিবীতে, এই মাহুতটুলির বাড়ির উঠোনে?

মা ছোটনের কথায় অস্থির কণ্ঠে বলে উঠেছিলেন, আঃ ছোটন, এমন করে বলিস নে তো! আমার বড় কষ্ট হয়।

ছোটন হাসি মুখেই বলেছিল, জানি তো। তবু বলি, কারণ মৃত্যুর সঙ্গে আমার বসবাস। তাই চরম সত্যের সঙ্গে কল্পনাটাতেও আমি কিছু আনন্দ পেতে চাই।

মা রেগে বলেছিলেন, আনন্দ পেতে চাস? তাহলে তোর বড়দাকে লেখা পাড়ার যত মেয়েদের গোছা গোছা প্রেমপত্র আসে এইগুলো পড়। মনে কর, এগুলো তোর বড়দাকে লেখা নয়, তোকেই লেখা।

বলে মা একগাদা চিঠি ছোটনদার বিছানায় ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। ছোটন হা হা করে হেসে উঠেছিল। চিঠিগুলো হাতে নিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ মা, তাই হোক, সব চিঠি আমি সব মেয়ের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেব, লিখব, ওগো মেয়ে,

কে বলেছে তোমায়, বঁধু এত দুঃখ সইতে
আপনি কেন এলে, বঁধূ আমার বোঝা বইতে।
প্রাণের বন্ধু, বুকের বন্ধু
সুখের বন্ধু, দুঃখের বন্ধু-
তোমায় দেব না দুখ, পাব না দুখ
হেরব তোমার প্রসন্ন মুখ,
আমি সুখে-দুঃখে পারব, বন্ধু চিরানন্দে রইতে ...।

বলতে বলতে ছোটন হা হা করে হাসতে থাকে, সব চিঠি তার বিছানায় ফুলের মতো উড়োতে থাকে। মা আদরের ভঙ্গিতে ছোটনদার কান মলে দিয়ে বলেছিলেন, এই দুষ্টু ছেলে থামবি?

সেই সময় সেই ভর দুপুরে বাইরের দরজায় কড়ানাড়ার শব্দ হল। বাবা তো ইস্কুলে। বড়দা এই দুপুরে বাসায় তো আসে না। কে এল তা দেখার জন্যে বাইরে ঘরের দরজা খুলেই অবাক। আমি বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলাম, এ কী তুমি? ওমা, দেখে যাও কে এসেছে!

মা ছোটনদের ঘর থেকে সাড়া দিলেন, কে এসেছে রে?
মা, তুমি এসে দেখেই যাও না কে এসেছে! শিগগির এসো।

মা ছোটনের ঘর থেকে প্রায় ছুটেই এলেন। তিনিও অবাক। দরজার ওপাশে সেই মেয়েটি শ্যামশ্রী। পরনে তার কচি কলাপাতা শাড়ি নেই। আজ তার পরনে বাসন্তি রঙের শাড়ি। সেই শাড়িতে সে যেন আরো উজ্জ্বল। তার হাতে গোটা চারেক প্যাকেট। সারা মুখে যেন ঘামের চিক চিকে হীরে কুচির দানা।

শ্যামশ্রী বলল, অনেক কষ্ট করে বাড়িটা খুঁজে বের করেছি। ছোটনের জন্যে কিছু খাবার এনেছি। শুধু মিষ্টি ছাড়া সব আমার নিজের হাতে রান্না করা। আমি ছোটনকে দেখতে এসেছি।

আমি মনে মনে হাসলাম। মনে মনে বললাম, হ্যাঁ তা তো জানিই তুমি কেন এসেছ, কার জন্যে এসেছ।
মা বললেন, এসো মা ভিতরে এসো। তুমিই বুঝি সেই শ্যামশ্রী?
শ্যামশ্রী ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বলল, হ্যাঁ মা আমিই সেই শ্যামশ্রী, কুশ্রী, হতচ্ছাড়ি।
মা শ্যামশ্রীর চিবুকে হাত ছুঁয়ে আদরের ভঙ্গিতে বললেন, এমন মিষ্টি মেয়েকে যে কুশ্রী, হতচ্ছাড়ি বলবে তার মুখে কুড়িকুষ্টি পড়বে।

সবাই মিলে আমরা ছোটনের ঘরে এলাম। ছোটন তার খাটে আধশোয়া অবস্থায়। তার চারদিকে বড়দাকে লেখা যত প্রেমপত্র ছড়ানো। শ্যামশ্রী প্যাকেটগুলো মা’র হাতে দিয়ে বলল, মা আপনি যদি খাবারগুলো প্লেটে বেড়ে দেন আমি ছোটনদাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেব।

ছোটন বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে শ্যামশ্রীকে দেখছিল। বলল, শামুদি তুমি এসেছ আমি ভারি খুশি হয়েছি। কিন্তু খাবার কেন এনেছ? আমি তো তেমন একটা কিছুই খেতে পারি না। যা খাই তা বমি করে উগরে দিই।

শ্যামশ্রী বলল, বললাম তো আমি খাইয়ে দেব। আমার হাতে জাদু আছে। দেখবে কোনো কিছুই উগরে দেবে না।
আমি কৃত্রিম অভিমানের সুরে বললাম, এত খাবার সব বুঝি ছোটনদা একাই খাবে? আমি, তিমুদা আমরা বুঝি কেউ ভাগ পাব না?
শ্যামশ্রী সুন্দর করে হাসল। বলল, মন চাইলে সবাই খাবে। সেটাই তো আমার আনন্দ।
মা বললেন, নাজু যা প্যাকেটগুলো খুলে থালায়, বাটিতে বেড়ে নিয়ে আয়। মেয়েটি কষ্ট করে, সখ করে যখন এনেছে তখন ছোটনকে খাইয়ে দিক।

আমি প্যাকেটগুলো নিয়ে অন্যঘরে ভেতরে নিয়ে গেলাম। প্যাকেট খুলে দেখি এক প্যাকেটে গরম ফুলকো লুচি, আর এক প্যাকেটে সবজি-তরকারি আর এক প্যাকেটে ভুনা মুরগি এবং আর প্যাকেটে কাঁচা সন্দেশ।

আমি সব খাবার আলাদা আলাদা প্লেটে, বাটিতে বেড়ে ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে এলাম ছোটনদার ঘরে। ছোটনদার বিছানায় ছোটনদার পাশে বসে শ্যামশ্রী। মা চেয়ারে বসে। আমি বড়দার বেড সাইড টেবিলের কাগজপত্র সরিয়ে খাবারগুলো সেই টেবিলেই সাজিয়ে দিলাম।

শ্যামশ্রী ছোটনদার বিছানায় ছড়ানো চিঠিপত্রগুলো দেখে বলল, তোমার বিছানায় এত কাগজপত্র কীসের?
ছোটন হেসে বলল, কাগজ নয় শামুদি। এগুলো জরুরি প্রেমপত্র।
শ্যামশ্রীর অবাক কণ্ঠ, জরুরি প্রেমপত্র?
ছোটনের হাসি, হ্যাঁ, প্রেমের আহ্বানে অনতিবিলম্বে সাড়া না দিলে বিষপান, গলায় ফাঁস, চিরঘুমের ওষুধ পান ইত্যাদি নানা রকম আত্মহননের হুমকি আর বিষাদ গাথা লেখা হয়েছে।
শ্যামশ্রীর আরো বিস্ময়! তোমাকে লেখা হয়েছে এইসব? তুমি একটা অসুস্থ ছেলে তাকে এইভাবে ...

ছোটন হাসিতে ভেঙে পড়ল, ধুৎ তুমি যে কী বোকা শামুদি। আমাকে চিঠি লিখবে কোন বোকা মেয়ে! সব চিঠি বড়দাকে লেখা।
শ্যামশ্রী মুখেও এবার বাঁধভাঙ্গা হাসি। হাসতে হাসতে বলল, ও তাই বল। তোমাদের বড়দা হিরো অব আরমানিটোলা। তাকে মেয়েরা চিঠি লিখবে না তো কাকে লিখবে? তা তোমার বড়দার ইচ্ছেটা কী? তিনি কি সব চিঠি পড়েন?

ছোটন বলল, বড়দা এসব চিঠি কোনোদিন খুলেও দ্যাখে না।
- তাহলে এগুলো জমাচ্ছ কেন?
- জমাচ্ছি একটা রিসার্চ ওয়ার্কের জন্যে। বড়দার মতো একজন রিকশা পেইন্টারের জন্যে মেয়েরা কতটা পাগল হতে পারে, কত প্রেম কথা, কত রকম কোটেশন ব্যবহার করতে পারে তার একটা পরিসংখ্যান বের করার ইচ্ছা আমার।
শ্যামশ্রী বলল, ওসব ইচ্ছে টিচ্ছে এখন শিকেয় তুলে রাখো। এখন খাবে এসো। নাজু, তুমিও আমার পাশে এসে বসো। আমি তোমাকেও খাইয়ে দেব।
আমি বললাম, না না আমি নিজেই খেতে পারব। আমাকে খাওয়াতে হবে না।
শ্যামশ্রী বলল, আমাকে হাত ধুতে হবে। এক গ্লাস জল দেবে?

আমি বললাম, বারান্দায় এসো। আমি হাত ধুইয়ে দিচ্ছি।

শ্যামশ্রী হাত ধুতে বারান্দায় এল। ভর দুপুরে ঝকঝকে উঠোন দেখে চমৎকৃত স্বরে বলল, কী সুন্দর উঠোন, ছায়াময় বকুল গাছ আর সিঁড়ির দুপাশে গোলাপ গাছ। জীবনটা আরো সুন্দর হত যদি ছোটনের এমন অসুখটা না থাকত।

হাত ধুয়ে শ্যামশ্রী এসে বসল ছোটনের বিছানায় ওর পাশে। লুচি, তরকারি একটু একটু করে খাইয়ে দিতে লাগল ছোটনকে। ছোটনের এখন যেন বমি বমি ভাবটা নেই। মনে হয় বেশ তৃপ্তির সঙ্গেই খাচ্ছে। কিন্তু দুটোর বেশি লুচি সে আর খেল না অথবা খেতে পারল না। বলল, শামুদি আর না। তোমার লুচি, সবজি রান্না চমৎকার। কিন্তু এখন এর বেশি খেলে দুটোর বদলে চারটে লুচি বেরিয়ে যাবে।

ছোটনের আপত্তি সত্ত্বেও শ্যামশ্রীর পিড়াপিড়িতে কাঁচা সন্দেশের এক টুকরো মুখে দিল।

এবার শ্যামশ্রী আমাকে নিয়ে পড়ল। তার হাতে আমাকে খেতেই হবে। জয়ী মা’কে সেই একই অনুরোধ। জয়ী মা বললেন, তুমি যে ছোটনকে লুচি, তরকারি খাওয়াতে পেরেছ আর ও তৃপ্তির সঙ্গে খেতে পেরেছে সেটাতেই আমাদের আনন্দ। খাবারগুলো তো রইল। তিমু আসুক, ওদের বাবা আসুক, আমরা সবাই মিলে রাত্রে এক সাথে খাব।

শ্যামশ্রী বলল, আচ্ছা তাই হবে। শুধু আমার হাতে এক টুকরো সন্দেশ খান। তা না হলে একটা দুঃখ নিয়ে আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।

শ্যামশ্রীর মতো মেয়েকে দুঃখ দেওয়া যায় না। আমরা সবাই শ্যামশ্রীর হাতের এক টুকরো করে সন্দেশ মুখে দিলাম ওকে দুঃখ না দিতে।

শ্যামশ্রী বারান্দায় আমার সঙ্গে গিয়ে হাত ধুয়ে আঁচলে হাত মুছে এসে বসল ছোটনের পাশে।

জয়ী মা বললেন, তুমি এলে অসময়ে। তিমু তো এ সময়ে বাসায় থাকে না।

শ্যামশ্রী বলল, মা আমি তো তিমুদার সঙ্গে দেখা করতে আসিনি। আমি এসেছি ছোটনকে দেখতে আর আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইতে।

জয়ী মা বললেন, ক্ষমা! কিসের ক্ষমা?

শ্যামশ্রী বলল, রিকশার পেছনে আমার ছবি নিয়ে সেদিন আমার বাবা আর বাবার মুহুরি যে তুলকালাম কা- ঘটিয়েছিল তার জন্যে আমি লজ্জিত, দুঃখিত। আমি বাবার হয়ে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আসলে আমার বাবা এতটা খারাপ মানুষ নন। ঐ মুহুরি অবিনাশের কুপ্ররোচনায় উত্তেজিত হয়েই এমন ব্যবহার করেছিলেন তিমুদা, ছোটন আর নাজুর সঙ্গে। আ অ্যাম সো স্যরি।

ছোটন যেন ধমকে উঠল শ্যামশ্রীকে। শামুদি কী সব স্যরি ফরি বলছ! সেদিন যদি ঐ ঘটনা না ঘটত, তাহলে তুমি কি আমাদের চিনতে না জানতে? বড়দার সঙ্গে এই জীবনেও কি তোমার দেখা হত? আর আজ কি পরমানন্দে তোমার এইসব লুচি তরকারি মন ভরে খেতে পারতাম?

শ্যামশ্রী যেন বিষণœ কণ্ঠে বলল, কিন্তু ছোটন তুমি তো আমার রান্না করা মুরগির মাংস এক পিসও খাওনি। অন্য কেউ খাবে কিনা জানি না। আসলে হিন্দুর রান্না মুরগি মুসলমানদের রান্নার মতো এতো সুস্বাদু হয় না। তবে মুরগিটা আমি এক মুসলমান পাচককে দিয়ে বিসমিল্লাহ বলিয়ে জবাই করিয়েছি। তার দেওয়া রেসিপি অনুযায়ী রান্না করেছি।

জয়ী মা বললেন, মা, তুমি মনে করে এত কষ্ট করে খাবারগুলো এনেছ তাতেই আমরা খুশি। এর মধ্যে জাতপাতের কথা তুলো না। এসব কথা ভুলে যাও।

শ্যামশ্রী বলল, ভুলে তো যেতেই চাই। কিন্তু জল যখন পানি হয়ে যায়, পানি জল হয়ে ঘোলা হয়ে যায়, তখন দুঃখটা বেড়ে যায়।

আমি বাচালের মতো ফট করে বলে উঠলাম, শামুদি, তুমি আমার বড়দাকে ভালোবাসো? আমার বৌদি হবে?

শ্যামশ্রী হেসে উঠল, বলল, নাজু তোমার মুখের আগল নেই দেখছি! মা’র সামনে এমন প্রশ্ন করতে হয়? তোমার বড়দাকে কে’না ভালোবাসে? এই যে অ্যাতো চিঠিপত্তর, আমি কিন্তু এই চিঠি-পত্তরের মতো ভালোবাসার জন্যে তোমাদের বাসায় আসিনি। তোমার বড়দার সঙ্গে আমার মাত্র দু’দিনের দেখা। দু’দিনের পরিচয়। যদি ভবিষ্যতে আরো দেখা হয় তখন আমরা বড়জোর বন্ধু হতে পারি। তার বেশি কিছু নয়।

ছোটনদার প্রশ্ন, বেশি কিছু হলে দোষ কী?

শ্যামশ্রীর উত্তর, তোমার বড়দা বিশাল একটা আইফেল টাওয়ারের স্বপ্নের মধ্যে বসবাস করছে। সেখানে তো আমি একটা বিন্দুমাত্র।

ছোটন হাসল। আর আমার খুব পছন্দ তোমাকে। তাই বিন্দু তো সিন্ধুও হতে পারে।

শ্যামশ্রী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, না। ছোটন তা হবার নয়। আমার বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে আছে। আর তাছাড়া আমাদের ধর্ম, জাত-পাতের ব্যবধান তো একটা বিশাল ফাটলের মতো। তোমরা মুসলমান, আমি হিন্দু-এ যে কত বড়।

জয়ী মা বাধা দিয়ে বললেন, শ্যামশ্রী, বিয়ের আগে আমিও হিন্দু ছিলাম। তিমুর বাবাকে বিয়ে করার জন্যে আমি স্বেচ্ছায় মুসলমান হয়েছিলাম।

শ্যামশ্রী ভীষণভাবে চমকে উঠল। জয়ীমার মুখের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। জয়ী মা উঠে এসে ওর মাথায় চুমু দিয়ে বললেন, তিমু তোমাকে ভালোবাসুক অথবা নাই বাসুক তুমি নাজুর মতন আমার মেয়ে। ভালো থেকো লক্ষ্মী মেয়ে।

চলবে

 

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব তিন)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পাঁচ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ছয়)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব সাত)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আট)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব নয়)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব দশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব এগার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব তের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চৌদ্দ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পনের)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top