সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৩) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
৯ ডিসেম্বর ২০২২ ০৪:৩৮

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০২:৪৩

 

হাসনা বানু সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমিও তাই মনে করি। ছেলেমেয়ে দুটোকে রাতদিন এই গল্পই করি। ওরা রাতে ঘুমুতে পারেনা। মাঝে মাঝে কাঁদতে শুরু করে। বেশ কিছুক্ষণ কেঁদে তারপর আবার ঘুমায়। একজনের বয়স ছয়, একজনের বয়স তিন।
- ওদের বাবাতো যুদ্ধ করছে।
- হ্যাঁ, যুদ্ধ করছে। এজন্য আমি খুব কৃতজ্ঞ। আমার স্বামীকে মুক্তিযোদ্ধা ভাবলে আমার গৌরব হয়। আমার এই দুই বাচ্চাকে যদি দেশে রেখে আসতে পারতাম, তাহলে আমিও প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করতাম। শুরু তাঁবুর মধ্যে বসে থেকে দিন কাটাতাম না।
- আপনিতো বসে থেকে দিন কাটাচ্ছেন না।
- হ্যাঁ, তা কাটাচ্ছিনা। সাধ্যমতো যা করতে পারছি, তা করছি। করাতো কর্তব্য।
- হ্যাঁ, আমিও তাই মনে করি। দেখি ভারতীয় ভাইদের কাছে যাই। কিছু চাল জোগাড় করতে পারি কিনা। পারলে যাদের ঘরে চাল নাই ,তাদেরকে দেব। আমি বাচ্চাদের কান্না শুনতে পারিনা।
- খুব ভালো কথা। তাড়াতাড়ি যান।
অঞ্জন দ্রæত পায়ে হেঁটে এগোতে থাকে। চাল জোগাড়ের চিন্তা মাথার ভেতর গমগম শব্দ করে। অনুভবে দিশেহারা লাগে। নিজেকে শক্ত করার জন্য ভাবনার মোড় ঘোরায় - চাল পাবে। পাবেই। শরণার্থী শিবিরের বড় জায়গা ধরে নিজের শক্তি বাড়ায় - যুদ্ধ ও স্বাধীনতার পটভূমি শরণার্থী শিবির। বেঁচে থাকার সত্যকে ধারণ করে জীবনের জয়গান গায়। এসব ভাবতে ভাবতে যখন চাল দেয়ার ক্যাম্পে আসে দেখতে পায় কেউ নেই। ক্যাম্প বন্ধ। প্রবল মন খারপ নিয়ে ক্যাম্পের পাশের নিম গাছটা জড়িয়ে ধরে মাথা ঠোকে। কিছুক্ষণ পর ফিরে যায়। কেউ একজন জিজ্ঞেস করে, গাছে মাথা ঠুকলেন কেন?
- চাল পেলামনা। মন খারাপ হয়ে গেল।
- না খেয়ে থাকতে হবে আপনাকে?
- আমাকে না। বিভিন্ন তাঁবুতে চাল নাই। ভাত রান্না হয়নি। শিশুরা কাঁদছে।
- আসেন আমার সঙ্গে। আমি তিন কেজি চাল কিনে দিচ্ছি দোকান থেকে।
- কিনে দেবেন?
- দিবইতো। না খেয়ে থাকবে কেন আমার দেশের শরণার্থীরা। যতটুকু পারি অতটুকু সাহায্য তো করবই।
অঞ্জন লোকটির দুহাত জড়িয়ে ধরে। বলে, মানুষকে ভালোবেসে আপনি একজন মহৎ মানুষ। আপনাকে শ্রদ্ধা করি।
লোকটি কথা বলেনা। অঞ্জনের হাত ধরে দোকানে যায়। তিন কেজি চালের তিনটি পোটলা নেয় দোকান থেকে। অঞ্জনকে দিয়ে বলে, যার যার লাগবে তাকে এক কেজি করে দিয়েন।
- হ্যাঁ, তা দেব। আপনাকে অনেক ভালোবাসা জানাই। দেশ স্বাধীন হলে আমি আপনাকে আমাদের দেশে বেড়াতে নিয়ে যাব।
- আপনার কষ্ট করতে হবেনা। আমি নিজেই যাব আপনার দেশে বেড়াতে। আমার জনম সার্থক হবে। আমাদের চেনাজানা পূর্ববঙ্গ একবার পূর্ব পাকিস্তান হলো। এখন স্বাধীন বাংলাদেশ হবে। ভাবলে আমার মাথা তোলপাড় করে ওঠে। বাঙালি জাতির একটা স্বাধীন দেশ। আপনারা জীবন উৎসর্গ করে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছেন। ভাবলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। আমি কলেজে পড়াই। ছাত্র-ছাত্রীদের দরকার মতো ভাষা আন্দোলনের কথা বলি। এখন ওরা নিজেরাই দেখবে দেশটি স্বাধীন হয়েছে।
- আপনাদের সহযোগিতা না পেলে আমরা দেশ স্বাধীন করতে পারতাম না।
-আমিও আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি যেভাবে সহযোগিতা দিচ্ছেন সেটা একটি অতুলনীয় সিদ্ধান্ত। এটা বাঙালির একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য জরুরি ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার সামনে একজন অসাধারণ মানুষ। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডে আমি নিজেও খুব অনুপ্রাণিত হয়েছি। তাঁকে ছাড়াতো বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র হতো না।
অঞ্জন উদ্দীপিত হয়ে বলে, ঠিক বলেছেন, ঠিক বলেছেন। তিনি আমাদের স্বপ্নদ্রষ্টা। আমি ভেবে রেখেছি যে দেশ স্বাধীন হলে আমি তাঁর পায়ে মাথা ঠেকাব।
- পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেই হবে, না?
- তাও ঠিক। আপনাদের দেয়া চাল নিয়ে যাই। শিশুদের কান্নার শব্দ পাচ্ছি।
- হ্যাঁ, যান, যান।
অঞ্জন দ্রæতপায়ে হাঁটতে শুরু করে। যিনি এত সুন্দর করে কথা বললেন তাকে দেখার জন্য ঘাড় ঘুরায়। দেখতে পায় তিনি ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। অঞ্জন মৃদু হেসে হাত নেড়ে টা-টা বলে। লোকটিও হাত নেড়ে টা-টা বলে। গাঢ় হয় স্বপ্নের সেতু। ও আবার দ্রæতপায়ে হাঁটতে শুরু করে। কান্নার শব্দ ধরে সেই তাঁবুতে যায়। চাল দিয়ে চলে আসে। চাল জোগাড় করা গেছে ভেবে স্বস্তি বোধ করে। মানুষের চারপাশে এমনই মানুষই থাকে - এটাই বেঁচে থাকার সত্য-সুন্দর। বর্বরতাকে ডিঙিয়ে মানুষের বেঁচে থাকা সত্যের সুন্দরতা। অঞ্জন খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। সীমান্তের দিকে তাকালে দেখতে পায় একদল শরণার্থী আসছে। এগিয়ে যায় সেদিকে। দেখতে পায় রঘু রাই দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যে অমিয়ার চিন্তায় মাথা ভরে যায়। ভাবে, ও কি ঠিক আছে! কোনো পাক সেনার কবলে পড়েনি তো? বুকের ভেতর হাহাকার ধ্বণিত হয়। ও সীমান্তের একপাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে এগিয়ে আসা নারী-পুরুষের দিকে। না, এই দলে অমিয়া বাবা-মায়ের সঙ্গে নাই। বোঝা যাচ্ছে, ওরা ঢাকা ছাড়বে না। অঞ্জন মন খারাপ করে চারদিকে তাকায়। সামনে বিরাট প্রান্তর নিঃশব্দে পড়ে আছে। তারপর ও নিজেকে ধমকায়। মাটি নিঃশব্দে পড়ে থাকবে কেন? এই মাটি বুক পেতে রেখেছে বাঙালির স্বাধীনতার জন্য। একদিন এই মাটির উপর উড়বে বাঙালির স্বাধীনতার পতাকা। তখন ও গুনগুন করে গাইতে থাকে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা -’। শরণার্থীরা ঢুকে যাচ্ছে সীমান্ত পেরিয়ে। ও তাকিয়ে থাকে, তারপর কাছে এসে দাঁড়ায়। একজনকে জিজ্ঞেস করে, দেশের অবস্থা কি?
- পাকিস্তানি শয়তানরা যতই মারুক আমাদেরকে, ওরা টিকতে পারবেনা এই দেশে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ওদেরকে মেরে ভাগাবে।
- হ্যাঁ, তা ঠিক। যান, আপনারা এগিয়ে যান।
- তাতো যাবই। নইলে আসলাম কেন?
অঞ্জন কথা বাড়ায়না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে একপাশে। সারিবদ্ধ লোকেরা বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। মাথায় পোটলা-পুটলি। ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওদের। অঞ্জন পরক্ষণে নিজেকে ধমকায়, কতদূর পথ হেঁটে এসেছে। ক্লান্ততো হবেই। কোথায় ঠাঁই পাবে ওরা? এতকিছু ভাবনার মাঝে সীমান্ত অতিক্রম করে লোকেরা। কেউ কেউ বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে গাছের নিচে বসে পড়ে। সীমান্ত রক্ষীরা জানাচ্ছে, আপনাদের যশোর রোডে জায়গা হবেনা। আপনারা কলকাতার দিকে এগিয়ে যান। অঞ্জন তাকিয়ে থাকে। দেখে যশোর রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছে শরণার্থীরা। ওরা কোথায় ঠিকানা পাবে ভাবতে ওর কষ্ট হয়। পরমুহুর্তে আশ^স্ত হয় এই ভেবে যে কোথাও না কোথাও ব্যবস্থা হবে। শরণার্থীদের জন্য ভারতের অনেক মায়া আছে। অঞ্জন হঁটতে হাঁটতে কিছুদূর এসে দাঁড়িয়ে থাকে। একসময় দেখে দুটো নয়-দশ বছরের ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় রাস্তার ওপর। ওরা ওঠে না। পড়েই থাকে। অঞ্জন দ্রæত গিয়ে ওদের ওঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ওঠাতে পারেনা। ওরা নিজেরাও ওঠার চেষ্টা করেনা। অঞ্জন বুঝতে পারে ওরা জ্ঞান হারিয়েছে। ও ওদেরকে রাস্তার পাশে টেনে আনে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের বাবা-মা এসে হাজির হয়।
- কি হয়েছে আমাদের ছেলে দুটোর? ওরা পড়ে গেল কেন?
মা কাঁদতে কাঁদতে বলে, পড়বেনা কেন? কাল দুপুরে আর রাতে ভাত খেতে পায়নি। ডাক্তার সাহেব আপনি দেখেন ওদের।
অঞ্জন বুঝতে পারে, ওরা জ্ঞান হারিয়েছে। ওদেরকে তাঁবুতে নিয়ে যেতে হবে। হাত ঈশারায় ওদের বাবাকে ডেকে বলে, ওরা জ্ঞান হারিয়েছে। আপনি একজনকে কোলে নিন, আমি একজনকে নিব। ওদেরকে তাঁবুর ভেতর নিয়ে বিছানায় শোয়াতে হবে। ওরা জ্ঞান হারিয়েছে।
ওদের বাবা দুহাতে চোখ মুছে একজনকে কোলে তোলে। অঞ্জন আর একজনকে। হাঁটতে শুরু করে দুজনে। ওদের মা কাঁদতে কাঁদতে হাঁটে। কান্নার শব্দ শুনে চারদিক থেকে লোকজন বেরিয়ে আসে। আকরাম জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে?
অঞ্জন বলে, ছেলেদুটো জ্ঞান হারিয়েছে। পড়ে গিয়েছিল রাস্তায়। পেটে খিদা। ভাত খেতে পায়নি।
- আমার ঘরে অল্প ভাত আছে। আনব?
- আনেন, আনেন।
আকরাম ভাত আনার জন্য তাঁবুতে ঢোকে। অঞ্জন ওদের নিয়ে গাছতলায় বসে। ওরা জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। ওদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। একজন বলে, ভাত খাব। ভাত খাব। অন্যজন বলে, মা কোথায় ভাত পাবে?
কাঁদতে শুরু করে চিৎকার করে দুজনেই। অঞ্জন চুপচাপ থাকে। ভাবে, কাঁদুক, কেঁদে শান্ত হোক। ওদের বাবা ওর কোলে শুয়ে থাকা ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। তারপরও ওর কান্না থামে না। তখন ওরা দেখতে পায় থালায় করে ভাত নিয়ে আসছে আকরাম। ওদের কান্না শুনে দ্রæত এগোয়। কাছে এসে ওদের মাকে থালা দিয়ে বলে, আপনি ওদেরকে খাইয়ে দেন। এই যে পানিও আনছি। আমি শুধু ভাতের মধ্যে ডাল দিয়েছি। কারণ আমাদের তরকারিতে খুব ঝাল থাকে। ওরা খেতে পারবেনা।
- আচ্ছা দেন।
ওদের মা থালাভরা ভাত ডাল দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে ওদের মুখে দেয়। ছেলেরা দ্রæত চাবিয়ে গিলে ফেলে। আবার হাঁ করে। দুজনকে ভাত খাওয়াতে পেরে পরিতৃপ্ত হয়ে যায় সবাই। আকরামও ওদের সঙ্গে বসে থাকে। অঞ্জনের মনে হয় শরণার্থী শিবিরে এ একটা অন্যরকম দৃশ্য। ও যে কয় মাস থাকল এতদিনে এখানে এমন দৃশ্য দেখেনি। এই দেখাটা আজকে ওর সামনে স্বাধীনতার স্বপ্নের ফুল হয়ে ফোটে। মানুষের সঙ্গে মানুষের এমন সম্পর্কইতো বেঁচে থাকার সত্য। ও আকরামের ঘাড়ে হাত রেখে বলে, আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাই ভাই। আপনি বাচ্চাদুটোর পেট ভরে দিয়েছেন।
- আমার হাঁড়িতে ছিল বলে দিতে পেরেছি। নইলেতো পারতাম না।
- যাক, আমাদের বাচ্চা দুটোকে খাওয়াতে পারলাম এটা আমাদের ভাগ্য। ওদেরকে খাওয়াতে পেরে আমাদের মনের কষ্ট কমেছে। আপনাকে সালাম জানাই।
- থাক, এত কথা বলবেন না। বাচ্চা দুটোকে খাওয়ানোর দায়তো আমারও ছিল। কিছুতেই ওদের কান্না শুনতে পারতাম না।
- আমরা সবাই এমন চিন্তায় শরণার্থী শিবিরে থাকব।
- হ্যাঁ, তাই থাকব। থাকতেই হবে। আমরা সবাই স্বাধীনতার জন্য এসেছি।
স্বাধীনতা শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনি ওঠে চারদিকে - স্বাধীনতা - স্বাধীনতা - বঙ্গবন্ধু - বঙ্গবন্ধু।
অঞ্জন নিজেও বলতে থাকে। ওর মন-প্রাণ ভরে যায় স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু শব্দে। বঙ্গবন্ধু ছাড়াতো স্বাধীনতার সূচনা রচিত হতোনা। এক বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন তিনি। সেই কর্মযজ্ঞে শামিল পুরো দেশবাসী। অনেকে আবার উল্টো কর্মে আছে। ওদের বিবেক নাই। ওদেরকে অবশ্যই মুখ থুবড়ে পড়তে হবে স্বাধীনতাকামী মানুষের পায়ের নিচে।
আকরাম তখন বলে, চলো যে যার তাঁবুতে চলে যাই।
সবাই উঠে পড়ে। বাচ্চাদুটোর হাত ধরে ওদের বাবা। ওরা হাঁটতে শুরু করে।
অঞ্জন আকরামকে বলে, দেখেন ওদের শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন আপনি।
- আহারে, এতটুকু ভাত দেয়া খুব বড় কাজ হয়েছে নাকি?
- হয়েছেতো বটেই। দেখছেন না ওদেরকে। দু’ভাই কেমন লাফালাফি করছে। ওরা প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছে। ওরা বলেনি যে আমরা একটুখানি ভাত খেয়েছি। আমাদেরকে আরও ভাত দাও।
আকরাম হাসতে হাসতে বলে, ওরা বুদ্ধিমান ছেলে। বুঝে গেছে যে ভাত চাইলেই রাস্তায় ভাত পাওয়া যায় না।
অঞ্জন হা-হা করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে, আপনার ব্যাখ্যা খুব সুন্দর। আপনি ওদেরকে বড় মানুষ বানিয়ে দিলেন।
- এই শরণার্থী জীবনের পরে স্বাধীনতা পেলে ওরা বড় মানুষ হবে।
ছেলেদুটোর বাবা-মা হাততালি দিয়ে বলে, আপনি ওদের জন্য দোয়া করবেন আকরাম ভাই।
- হ্যাঁ, দোয়াতো করবই। আল্লাহর রহমত থাকবে ওদের ওপর। আমি যাই।
- আমরাও যাই।
যে যার মতো হাঁটতে শুরু করে। ধুলোমলিন রাস্তায় হাঁটতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না অঞ্জন। এপাশে ওপাশে পা ফেলে হাঁটতে গিয়ে বিরক্ত হয়। দেখতে পায় অন্যরা একইভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদের দিকে তাকিয়ে নিজের বিরক্তি কাটিয়ে নেয়। তারপর এলোমেলো পথে দ্রæতপায়ে হাঁটতে থাকে। ধুলোয় ধুসরিত এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা জীবনের সরলরেখা নয়। জীবনযাত্রার এলোপাতাড়ি নানা সংকটের চিহ্ন তুলে ধরেছে। প্রত্যেককেই এমন পথ বুঝে চলতে হবে। কখনো স্বপ্ন, কখনো কষ্ট, কখনো শান্তি, কখনো জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে হেঁটে যাওয়া বেঁচে থাকার সত্যের মাত্রা। অঞ্জন চারদিকে তাকায়। কত তাঁবু মানুষের দিনযাপনের জন্য। প্রত্যেকের সামনে স্বপ্ন একটাই। স্বাধীনতা। এভাবে ব্যক্তির উর্ধে সমষ্টির স্বপ্ন এক হয়। নিজের ভাবনায় আলোড়িত হয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়ায় অঞ্জন। কেউ একজন ডাক্তার সাহেব বলতে বলতে ছুটে আসছে তার দিকে। কাছাকাছি এলে ও নিজেই বলে, কি হয়েছে আশরাফ?
- আমার ছেলেটার খালি পায়খানা হচ্ছে। কলেরা হলো নাকি? আপনি ওকে দেখতে চলেন।
- হ্যাঁ, চলেন।
দুজনে হাঁটতে শুরু করে। নানা তাঁবু থেকে শোনা যায় কান্নার শব্দ। অঞ্জন চারদিকে চারদিকে তাকিয়ে মুষড়ে পড়ে। তাঁবুতে তাঁবুকে কি অসুস্থতা শুরু হয়েছে। বুকের ভেতর টনটনিয়ে ওঠে অঞ্জনের। আশরাফের তাঁবুর দিকে দ্রæতপায়ে হেঁটে যায়। তাঁবুতে পৌঁছে বাচ্চাটিকে পরীক্ষা করে বলে, হ্যাঁ, ও কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে। আমি হাসপাতালে গিয়ে ওষুধের ব্যবস্থা করব।
আশরাফ কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ওষুধের জোগাড় করতে তো সময় লাগবে।
অঞ্জন ওর ঘাড়ে হাত রেখে বলে, ধৈর্য ধরেন। আপনাকে কাঁদতে দেখলে ছেলেটার মন খারাপ হবে।
আশরাফ দুহাতে চোখ মুছে চুপ করে যায়। অঞ্জন বলে, যাই, অন্য তাঁবুতে কারা কাঁদছে দেখে আসি।

কয়েকটি তাঁবুতে গিয়ে টের পায় সবাই কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে। ওর শরীর কাঁপে থরথর করে। শরণার্থী শিবিরে কলেরার মহামারী শুরু হয়েছে এটা দেখে ও স্থির থাকতে পারে না। মেঘভরা আকাশ থেকে হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হয়। যশোর রোডের কাঁচা রাস্তা বৃষ্টির পানিতে কাদামাখা হয়ে যায়। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অঞ্জন কাদামাখা রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে। মনে মনে ভাবে, শরণার্থী শিবিরে বাস করার এটা একটা ভিন্ন অভিজ্ঞতা। এর আগে কখনো এভাবে বৃষ্টিতে হাঁটেনি। বৃষ্টি পড়তে দেখলে ঘরে ঢুকেছে। তারপর বারান্দায় বসে বৃষ্টি পড়া দেখেছে। আজ ও বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গুনগুন করে গায়, ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ -। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে আসে অঞ্জন। ভেজার আনন্দ বুকের ভেতর জমে থাকে। কোনোরকম ভয় আসে না মনে। তাঁবুতে ফিরলে বাবা-মা বকবে এমন ধারণা পেয়ে বসে ওকে। ও আর এগোয়না। ফিরে আসে তাঁবুতে। বাবা ওর ভিজে থাকা অবস্থা দেখে চেঁচিয়ে বলে, এত ভিজেছিস কেন? যদি জ¦র আসে মার খাবি।
মা গামছা এগিয়ে দিয়ে বলে, ভেতরে যা। গা মুছে তাড়াতাড়ি কাপড় বদলে ফ্যাল।
অঞ্জন মায়ের হাত থেকে গামছা নিয়ে তাঁবুর ভেতর ঢুকে পড়ে। শরীরজুড়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানির ছোঁয়া তখনও বুকের ভেতর আনন্দের ঢেউ তুলছে। ও বুকের ওপর গামছা চেপে ধরে গুনগুনিয়ে বলে বৃষ্টি আমার স্বাধীনতা। স্বাধীনতার সোনার পানিতে ভিজে ভিজে মৃত্যুর দরজায় যাব। মৃত্যুকে বলব, মৃত্যু তুমি আমাকে বৃষ্টির পানিতে ভিজিয়ে রাখ। আমি স্বাধীনতা বুকে নিয়ে মরে যেতে চাই।
ওর মা মাথা বাড়িয়ে বলে, কি রে তুই কার সঙ্গে কথা বলছিস?
- বৃষ্টির সঙ্গে।
শব্দ করে হেসে ওঠে ওর মা। হাসতে হাসতে বলে, ছেলেটাকে ডাক্তার বানিয়েছি। ওর নিজে নিজে কবি হয়েছে। বাড়িতে থাকতে জারুল গাছের ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকত। এখন বৃষ্টি ওর কবিতা হয়েছে। ভালোইতো ফুল আর বৃষ্টি নিয়ে আমার ছেলে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে।
মায়ের কথা শুনে শব্দ করে হাসতে থাকে অঞ্জন। হাসতে হাসতে বলে, মাগো স্বাধীনতার স্বপ্ন এমনই। সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে স্বাধীনতা সবার মনে থাকবে। আমরা কখনোই স্বাধীনতার অমর্যাদা করবনা।
- তাঁবুতে যে চারদিকে কলেরা শুরু হয়েছে এটা কি সৌন্দর্য?
- মাগো এটাও সৌন্দর্যের আর এক দিক। এটা হবে মানবিক সৌন্দর্য। কলেরা রোগীদের আমরা কীভাবে দেখাশোনা করব সেটাই সৌন্দর্য। কাউকে আমরা অবহেলা করব না। এই সৌন্দর্য আমাদের বানাতে হবে।
- বুঝলাম। সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। তবে এটাও জানি মহামারী সাবইকে সাবধান থাকতে দেয়না। সবাধান থাকলেও গায়ে চেপে বসে। রক্ষা পাওয়া যায়না।
- থাক, এসব কথা। আমাদের এখন এত কথা বলার দরকার নাই।
- তুই যে বৃষ্টিতে ভিজলি এটা নিয়ে আমার চিন্তার ঝড় উঠেছে রে ছেলে। কেন তুই বৃষ্টিতে ভিজলি?
- মাগো এটাকে আমার একটা খেলা মনে হয়েছিল। কোনো ভয় ছিলনা মনে।
- সবই বুঝলাম। এখন জ¦র না আসলে আল্লাহর রহমত হবে।
অঞ্জন হাসতে হাসতে বলে, দেখা যাক কি হয়। মায়ের দোয়ায় সুস্থ থাকব।
মা ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে, আল্লাহ তোকে সুস্থ রাখবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।
অঞ্জন মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। দূর থেকে ভেসে আসে কান্নার শব্দ। দুজনে স্তব্ধ হয়ে যায়। কেউ আর কোনো কথা বলেনা। শরণার্থী শিবিরে দিন কাটানোর কষ্ট বুকে নিয়ে বেদনায় ¤্রয়িমান হয়ে থাকে।

 

চলবে

 

শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৩)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৪)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৫)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৬)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৭)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৮)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৯)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১০)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১১)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১২)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৩)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৪)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৫)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৬)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৭)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৮)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৯)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২০)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২১)শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২২)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top