সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৪) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
১৬ ডিসেম্বর ২০২২ ০৩:০৯

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০১:১২

 

কলকাতা থেকে শরণার্থীদের দেখতে যশোর রোডে এসেছেন আমেরিকার কবি এ্যালেন গিনসবার্গ। সঙ্গে সুনীল গঙ্গ্যোপাধ্যায়। শরণার্থী শিবিরের দিকে তাকিয়ে মর্মাহত হন গিনসবার্গ। শিশুরা রাস্তার ধারে কিংবা মাঠের এখানে-ওখানে গড়াগড়ি দিচ্ছে। খিদায় কাঁদছে। ওরা খেলাধুলার মধ্যে নেই। গিনসবার্গ চারদিকে তাকিয়ে মর্মাহত হয়। মানুষের দুঃখ-কষ্টের জীবনযাপন তাদের চেহারায় প্রতিফলিত হয়ে আছে। বিশেষ করে বৃদ্ধ মানুষদের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ধরে রাখা যায়না। মানুষের কষ্টের চেহারা এভাবে দেখতে পাওয়া এক ভিন্নতর অভিজ্ঞতা। আগে কখনো দেখা হয়নি। এইসব দেখার অনুভব তার কবিতার লাইনে উঠে আসবে। মনে মনে ঠিক করে কবিতার নাম হবে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। শরণার্থী মানুষের চেহারা দেখে বুকের ভেতর কাঁপন ধরে। সুনীলের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে, বুঝতে পারছি ওদের খুব কষ্টে দিন কাটছে।
- কাটবেইতো। সুনীল সার্পোট করে বলে। তারা নিজের দেশের থেকে চলে এসেছে পাকিস্তানিদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। ভারত সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে নিজেদের সাধ্যমতো।
- বুঝেছি। থাক আর বলতে হবেনা। যুদ্ধের পরিস্থিতিতে এমন হবেই। আমি আমেরিকায় ফিরে গিয়ে কবিতা লিখব।
- বেশ, বেশ। সুন্দর ধারণা। আমিও লিখব।
- মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছি কি অবস্থা। সবার চেহারায় আছে দুঃখ-কষ্টের ছাপ। আরও নানা বর্ণনা করতে পারব। কষ্টের সীমারেখায় কবিতা লেখা হবে। আরো কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে তারপর চলে যাব। যশোর রোডের শরণার্থী শিবির আমার জীবনের নতুন শিক্ষা। জীবনযাপন দেখার নতুন বৈচিত্র্য। এই সময় কলকাতায় না এলে আমার দেখা হতোনা। তোমাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই সুনীল।
- পূর্ববঙ্গ স্বাধীন বাংলাদেশ হবে এটা আমার বিশাল প্রত্যাশা। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব বাঙালিকে সচেতন করে তুলেছে। বাঙালি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হবে এ বড় গৌরবের জায়গা। আমিতো মনে করি স্বাধীনতার পরে বাংলা ভাষা হবে রাষ্ট্রের ভাষা। সুনীলের এমন প্রত্যাশা মুগ্ধ করে অ্যালেন গিনসবার্গকে। বাঙালির সেই স্বপ্ন পূরণ হবে এটা নিয়ে নিজেও উদ্বুদ্ধ হয়। ও সুনীলকে বলে, এমন স্বপ্ন পূরণের জন্য মানুষের দুঃখ-কষ্ট প্রকৃতির নিয়ম। তোমার মতো আমিও বাংলা ভাষাকে নিয়ে এই স্বপ্ন দেখছি। কবিতায় ধরে রাখব সময়ের পরিধি।
- তোমাকে অভিনন্দন জানাই। কবিতার জন্য সুন্দর নাম নির্বাচন করেছ।
- থ্যাঙ্কু। চলো কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াই। মানুষের কষ্টের চেহারা আটকে থাকুক বুকের ক্যানভাসে।
সুনীল কথা বাড়ায়না। হাঁটতে শুরু করে। দুজনে এগিয়ে যায়। দেখতে পায় নানাদিকের দৃশ্য একরকমই। সবার চেহারায় কষ্টের ছাপ। ওদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনেক লোক। একইসঙ্গে হাঁটছে। অ্যালেন গিনসবার্গ বুঝতে পারে কোনোরকমে বাস করার ঠাঁই করে নিয়েছে সবাই। কিন্তু পর্যাপ্ত খাবার নাই, বিশুদ্ধ পানি নাই, স্যানিটেশনের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। এতকিছু দেখে ভীষণ মর্মাহত হলেন তিনি। মানুষের এভাবে দিনযাপন মানবিকতার ছোঁয়া না। কিন্তু কিছু করারও নই। যুদ্ধ শেষ হলে স্বাধীনতার বরণডালা মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরবে সবাই। এই শুভ ধারণা নিয়ে ফিরে যায় দুজনে। মাঝপথে দেখা হয় অঞ্জনের সঙ্গে। অঞ্জন সুনীলকে চিনতে পারে। কাছে গিয়ে বলে, সুনীলদা আপনি শরণার্থী শিবির দেখতে এসেছেন?
- ইনি আমেরিকার কবি অ্যালেন গিনসবার্গ। তাঁকে দেখাতে নিয়ে এসেছি। তিনি আমেরিকা ফিরে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে কবিতা লিখবেন।
- ওহ দারুণ! আপনাকে ধন্যবাদ।
অঞ্জন হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে। অভিভূত হয়।
- আমিও শরণার্থী ক্যাম্পে থাকি স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে। এখানে থাকার কষ্ট অনুভব করিনা।
- দারুণ চিন্তা। আপনাকে অভিনন্দন জানাই। সবার মাঝে এমন চিন্তা ছড়াবেন। কেউ যেন কষ্ট করে না থাকে।
- হ্যাঁ, আমি সবাইকে এটা বোঝাই। তবে সবাইতো একরকম না। অনেকের কাছে কষ্ট প্রধান হয়ে ওঠে। তবে স্বাধীনতার স্বপ্ন সবার বুকের ভেতর আছে।
- আমিও তাই মনে করি। কষ্ট সাময়িক। স্বপ্ন থাকে জীবনভর।
- ঠিক, ঠিক। অঞ্জন হাসতে হাসতে মাথা ঝাঁকায়। অ্যালান গিনসবার্গকে দৃষ্টিতে নন্দিত করে। সুনীলকে বলে, দাদা, আপনাদের জন্য কি করতে পারি?
- এখানে কিছু করা যাবেনা। আমরা কিছু খাবনা।
- কবি কি কারো সঙ্গে কথা বলবেন?
- না, দরকার নেই। আমরা চলে যাই এখন।
- আচ্ছা, আপনাদের সঙ্গে আমিও এগোব।
- কতদূর যাবেন?
- যশোর রোডের শেষ মাথায়।
- চলেন, যাই।
তিনজনে হাঁটতে শুরু করে। দেখতে পায় চারপাশে দুঃখী মানুষেরা ঘোরাফেরা করছে। কেউ কেউ তাদের পেছনে আসছে। অঞ্জন অতিথি দুজনের সঙ্গে কথা বলে না। নিজের থেকে কিছু বলার ইচ্ছা হয় না। যারা দেখতে এসেছে তারা দেখুক চারদিক। নিজেদের উপলব্ধি দিয়ে মূল্যায়ন করুক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়।
যশোর রোডের শেষ মাথা এসে দাঁড়িয়ে পড়ে তিনজনে। অ্যালেন বলে, আমার এই শরণার্থী শিবির দেখার অভিজ্ঞতা আমি আজীবন মনে রাখব।
সুনীল বলে, আমিও মনে রাখব। আমার দেখা পূর্ববঙ্গ স্বাধীন বাংলাদেশ হবে, এটা আমার কাছে গৌরবের অহঙ্কার। বিদায় ডক্টর অঞ্জন।
- গুড বাই ডক্টর অঞ্জন। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোলেগেছে।
- আপনিও আমার প্রিয় কবি হয়ে থাকবেন, অ্যালেন গিনসবার্গ।
- থ্যাঙ্কু।
দুজনে সামনে এগিয়ে গিয়ে বাসে ওঠে। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে অঞ্জন। ভাবে, ও নিজেও একদিন বাসে উঠে কলকাতার সল্টলেকের শরণার্থী শিবির দেখতে যাবে। পরক্ষণে মনে হয়, কেমন করে যাবে? ওর কাছে তো ইন্ডিয়ান রুপি নেই। মুহূর্তে পেছনে ফিরে হাঁটতে শুরু করে। দেখতে পায় মাঠের ভেতরে বেশকিছু লোক জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে স্লোগান দিচ্ছে। নিজেও স্লোগান দিতে দিতে ওদের কাছে চলে যায়। ওদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ওদের মতো দুহাত উপরে তুলে স্লোগান দেয়। উদ্দীপিত হয়। একসময় লোকেরা ওকে জিজ্ঞেস করে, বঙ্গবন্ধুকে আমরা কবে দেখতে পাব ডাক্তার সাহেব?
- জানিনা ভাইয়েরা আমার। আমার মনে হয় পাকিস্তানিদের লাত্থি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়ার পরে পাকিস্তানের জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা যাবে।
- হুররে.... ঠিক ঠিক। জয় বাংলা- জয় বঙ্গবন্ধু।
স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে শরণার্থী শিবির। অঞ্জন স্লোগান দিতে দিতে নিজের তাঁবুর দিকে হাঁটতে শুরু করে। অন্যদিকের লোকজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে, কি হয়েছে? কোনো নতুন খবর আছে?
- নতুন খবরের জন্য আমরা স্লোগান দিচ্ছি। তবে এটাও ঠিক খবর না পেয়ে স্লোগান দিয়ে লাভ কি?
- তবে দিচ্ছেন কেন?
- মনের আনন্দের জন্য দেই। ভবিষ্যতের খুশির খবর নিয়ে আমরা স্বাধীন দেশে যাব। বঙ্গবন্ধুকে দেখব। এজন্য নিজেদের প্রস্তুত করছি। যেন কোনো ভাবে কোনো দুঃখের খবর না পাই। আমাদের আনন্দ তোমরাও বুকে তুলে নাও।
সঙ্গে সঙ্গে স্লোগান দেয় কয়েকজন - জয় বাংলা- জয় বঙ্গবন্ধু। পেছনে দাঁড়ানো একজন তরুণ ছেলে মামুন গেয়ে ওঠে গানের লাইন - ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি - আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।’ এক লাইন গান শুনে সবাই হাততালি দেয়। একজন বলে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমরাও এই গান শুনেছি, কিন্তু মুখস্ত করতে পারিনি।
মামুন বলে, আপনারা শিখতে চাইলে আমি গানটা সবাইকে শেখাব।
অঞ্জন উচ্চস্বরে বলে, সবাই শিখবে। আমিও শিখব।
একসঙ্গে উচ্চারিত হয়, আমরাও শিখব। আমরা গান গাইতে পারিনা, কিন্তু এই গানটি গাইলে বঙ্গবন্ধুকে আমাদের বুকের ভেতর দেখতে পাব। তাঁর অপূর্ব সুন্দর চেহারা ভেসে উঠবে চোখের সামনে। আমরা তাঁর পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ব।
- সাবাস। ভরে উঠেছে শরণার্থী শিবির। এখানে আমাদের কোন কষ্ট নেই। আমরা না খেয়ে থাকলেও মরে যাবনা। সবার মনের শক্তি এভাবে ধরে রাখতে হবে।
- ঠিক, ঠিক। আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বঙ্গবন্ধু।
- চলো, এই স্লোগান দিতে দিতে রাস্তা ধরে এগোই। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হবে সবাই। কেউ বসে থাকবেনা।
অঞ্জন নিজে শুরু করে - আমাদের স্বাধীনতা - আমাদের বঙ্গবন্ধু।
সবাই মিলে স্লোগান দিতে শুরু করলে সরব হয়ে ওঠে যশোর রোডের শরণার্থী শিবির। চারদিক থেকে ছুটে আসে অন্যরা। পথজুড়ে বিশাল সমাবেশ স্লোগানে মুখর করে সবাই। সীমান্তের কাছে এসে শেষ হয়ে যায় মিছিল। কিন্তু স্লোগান ফুরোয়না। চলতে থাকে আরো কিছুক্ষণ। চারদিক থেকে শিশুরা দৌড়াতে দৌড়াতে আসে। একসময় বড়দের স্লোগান থেমে গেলে শিশুরা বলতে থাকে - আমাদের স্বাধীনতা - আমাদের বঙ্গবন্ধু। ওরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেনা। এদিক-ওদিকে দৌড়াতে থাকে। ওদের কন্ঠস্বরে স্লোগানের বলিষ্ঠতা মায়াবী উচ্চারণে ভরে থাকে। বড়রা তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। কাছে এলে মাথায় হাত দিয়ে আদর করে। ওরা হাসিতে উচ্ছ¡সিত হয়ে উঠলে কন্ঠস্বরে স্লোগানের ধ্বনি ব্যাপকতা লাভ করে, যেন শরণার্থী শিবিরে বেঁচে থাকার আনন্দের উচ্ছ¡াস প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে বসন্তের বাতাস হয়ে। অঞ্জন বুকভরে শ্বাস টানে। কাছে আসা শিশুদের বুকে টেনে ধরে। কাউকে কাউকে বলে, আয় একসঙ্গে ¯স্লোগান দেই। আমাদের স্বাধীনতা - আমাদের বঙ্গবন্ধু। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুরা সবাই ওর সঙ্গে গলা মেলায়। বসন্তের বাতাস আরও প্রবলভাবে প্রবাহিত হয় উঠে যায় নীল আকাশের তটরেখায়। অঞ্জন প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়। ভাবে শরণার্থী শিবিরের সুবর্ণরেখা ওদের মাথায় ছুঁয়ে নীল আকাশে ছড়িয়ে আছে। এভাবে স্বাধীনতার স্বপ্ন গৌরব-দীপ্ত হয় শিবিরে বাস করা সবার কাছে। কয়েকজন বলে, আমাদের কোনো কষ্ট নেই। আমরা আনন্দের জোয়ারে আছি। ভেসে যাচ্ছি হাজার হাজার নৌকা ভরা ফুল নিয়ে। ফুলের গন্ধে ভরে আছে প্রকৃতি। আমাদের স্বাধীনতা আমাদের স্বপ্নের ঘর।
সবাই হাততালি দেয়। হাততালি থামলে অঞ্জন সবাইকে বলে, চলো আমরা সীমান্ত পার হয়ে নিজের দেশের মাটি ছুঁয়ে আসি।
- ঠিক, ঠিক। যাই আমরা। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আসব।
- অঞ্জন ভাই আপনি যাবেন না?
- যাব, যাব।
দুপা হেঁটে অঞ্জন উপুড় হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকায়। ওর দেখাদেখি অন্যরাও তাই করে। অঞ্জন মাথা উঁচু করে বলে, বাংলার মাটি আমাদের প্রাণের মাটি। জন্ম হয়েছে এখানে, মৃত্যুও হবে এই মাটিতে। বাংলার মাটি আমাদের মাটি। কয়েকবার কথাটি বলে অঞ্জন নিজের দেশের মাটি ছেড়ে ভারতের মাটিতে ঢোকে। বলে, নিজেদের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় এই মাটিও আমাদের প্রিয় মাটি। ঠাঁই দিয়েছে বেঁচে থাকার অধিকার সামলে নিয়ে। আবার স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করার মহান ব্রতে। সেজন্য আমাদের দায়িত্ব হবে স্বাধীনতার জন্য নিজের শক্তি কাজে লাগাতে। আমরা যেন সময়ের বরখেলাপ না করি।
- অঞ্জন ভাই আপনি আমাদের চেয়ে বেশি বোঝেন। আমরা শুধু বুঝি প্রশিক্ষণ নেয়া আর যুদ্ধে যাওয়া।
- এটাইতো স্বাধীনতার যুদ্ধের বড় দিক। তোমরা ঠিকই বোঝ।
- আর কতদিন আমাদেরকে যুদ্ধ করতে হবে অঞ্জন ভাই?
- যতদিন আমরা পাকসেনাদের হারাতে না পারি ততদিন। ধৈর্য রাখ সবাই।
সবাই হাততালি দিয়ে বলে, জয় বাংলা - জয় বঙ্গবন্ধু। আমরা করব জয় -
- চলো, কে কেমন আছে জেনে দেখি। সব তাঁবুতে যেতে হবে।
- আপনি তো ডাক্তার, আপনি একা যান।
- কেন একা যাব? আপনারা কি সবার ভালোমন্দ জানতে চান না?
- আমরা জানতে চাই। কিন্তু আমরা চাইনা যে একসঙ্গে গিয়ে ভিড় করি। আমরা সবাই সবার খোঁজ রাখব।
- ঠিক আছে, যে যার মতো চলে যান। সবাই এদকি-ওদিক চলে যায়। একটি তাঁবু থেকে শিশুর কান্না শুনতে পেয়ে অঞ্জন সেদিকে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, মা আপনি কি ভেতরে আছেন?
- হ্যাঁ আছি। আপনি কে?
- আমি ডাক্তার অঞ্জন। বাচ্চা কাঁদছে কেন তা জানতে এসেছি।
- ওর পায়খানা হচ্ছে - পেট ব্যথা করছে।
- আপনি যতœ করে রাখেন। আমি ওর জন্য ওষুধ আনতে যাচ্ছি।
অঞ্জন বুঝে যায় বাচ্চাটি কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে। ওর মা সঙ্গে সঙ্গে বলে, ওর বাবা ওষুধ আনতে গেছে আপনাকে যেতে হবেনা।
- ও আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে যাই। মাহমুদ ভাইকে বলবেন দরকার হলে আমাকে ডাকতে।
- আচ্ছা। আচ্ছা।
ওর মা কান্নাজড়িত কন্ঠে কথা বলে। মায়ের এই কন্ঠস্বর অঞ্জনের বুকে বাধে। অন্যদিকে শিশুটির চিৎকার করে কান্নাও মেনে নিতে কষ্ট হয়। তারপরও দ্রæতপায়ে হেঁটে সরে আসে তাঁবুর কাছ থেকে। আর একটি তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসে শরীফ। অঞ্জনকে দেখে দ্রæতপায়ে কাছে আসে।
- ডাক্তার সাহেব আমার মেয়েটির খুব জ¦র। মুষড়ে পড়ে আছে। কিছু খেতেও চায়না।
- ও কত বড়?
- পনেরো বছর হয়েছে।
- চলেন দেখি।
অঞ্জন পকেট থেকে থার্মোমিটার বের করে হাতে রাখে। দুজন দ্রæত হেঁটে গিয়ে তাঁবুতে ঢোকে। মেয়েটি মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে কঁকাচ্ছে। এক অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে ওর মুখ থেকে। অঞ্জন ওকে দেখে বিব্রত হয়। বুঝে যায় যে মেয়েটির শুধু জ¦র নয়। থার্মোমিটার দিয়ে জ¦র মেপে বিস্মিত হয়। বুঝতে পারে ও টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছে। হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু সেটা সম্ভব হবেনা। তাঁবু থেকে বেরিয়ে শরীফকে বলে, আমি যাই, ওষুধ আনার ব্যবস্থা করি।
শরীফ ঘাড় নেড়ে বলে, আচ্ছা।
অঞ্জন দ্রæতপায়ে হেঁটে যায়। মাথায় ভেসে ওঠে সুশান্তের চেহারা। ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। চৌগাছা সীমান্তে। ওখান দিয়ে ভারতে ঢুকে বনগাঁও হাসপাতালের কাছে ওরা একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকে। এখনও ওরা ওখানে আছে। পরিবারের সবাই মিলে নানা কাজ করে সংসার চালায়। সুশান্তর কাছে গেলে বনগাঁও হাসপাতাল থেকে ওষুধ আনতে পারবে। কিন্তু যেতে সময় লাগবে। যশোর রোডের ধুলোমলিন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শরণার্থী জীবনের অনুভব ওকে দায়িত্বের চেতনায় গম্ভীর করে। পথের রেখা স্তব্ধ হয়ে চেপে যায় বুকের ভেতর। ও মাথার ওপর ছড়িয়ে থাকা গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। নিজেকে বলে, এই আকাশ আমার স্বাধীনতার পতাকা। একটুপরে রাস্তার ধারে বসে থাকা একজনের ট্রানজিস্টারে শুনতে পায় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানের খবর। খবর শুনে অঞ্জন অনুপ্রাণিত হয়। ভালো করে শোনার জন্য রাস্তার ধারে যার ট্রানজিস্টার তার কাছে বসে পড়ে। জানতে পারে যে আগস্টের ১ তারিখে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে একটি গানের অনুষ্ঠান হবে। বর্তমানে পন্ডিত রবিশংকর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তাঁর লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমত গড়ে তোলা। পাশাপাশি টিকিট বিক্রির মাধ্যমে যে অর্থ পাওয়া যাবে তা শরণার্থীদের আর্থিক সাহায্য হিসেবে দেয়া হবে।
বিষয়টি জানতে পেরে অঞ্জন একদিকে যেমন অনুপ্রাণিত হয়, অন্যদিকে তেমন মনখারাপ করে। ভাবে, যদি ও নিজেও এই কনসার্টে থাকতে পারত! তাহলে স্বাধীনতার গৌরবগাঁথা আজীবন স্মৃতির সঞ্চয়ে রাখতে পারত। নিজে শরণার্থী হয়ে একটি দিক পেয়েছে। কিন্তু আর কোথাও যুক্ত হওয়ার সুযোগ এখন আর নাই। নিজে নিজে ভাবে কনসার্টের পুরো খবরটা ট্রানজিস্টার থেকে জেনে নেবে। সবসময় খুলে রাখবে। এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ অঞ্জনকে অনুপ্রাণিত করে। মেঠো পথে হাঁটার জন্য পায়ের স্যান্ডেল খুলে হাতে নেয়। তারপর পা ঘঁষে ঘঁষে হাঁটতে থাকে। মনে হয় মাটি আর আকাশ এক হলে এভাবে হেঁটে যাওয়া ব্যক্তির পায়ে সমুদ্রের ছোঁয়া থাকে। সেটা দেশপ্রেমের সমুদ্র। নিজের এমন ভাবনায় নিজের বুকের ভেতর উচ্ছ¡াস বয়ে যায়। নিজেকে আনন্দে রাখার এমন দিক ও মনের ভেতর রাখে। নিজের উচ্ছাসকে নিজে উপভোগ করে। হঠাৎ মনে করে, এমন করে কি অন্যরা ভাবে? নিজের ভেতরে উচ্ছাসের জোয়ার তৈরি করে? ধুত, কি যে সব ভাবছি! পরক্ষণে নিজেকে ধমকায়। অন্যের ভাবনার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করছে কেন? যে যার মতো দিন কাটাবে। একর সঙ্গে অন্যের ভাবনা মিলবে কেন? শয়তান একটা, নিজেকে ধমকায়। কঠিনভাবে নিজেকে শাসন করে। দেখতে পায় রাস্তার পাশে কয়েকজন শিশু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ও এগিয়ে যেতে থাকলে শিশুরা দৌড়ে ওর কাছে আসে। চারদিক দিয়ে ওকে ঘিরে ধরে। ওরা কাছে এসে দাঁড়ালে অঞ্জন একে একে ওদের মাথায় হাত রেখে বলে, ভালোইতো তোরা সবাই মিলে খেলা করছিস।

চলবে

 

শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৩)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৪)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৫)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৬)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৭)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৮)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৯)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১০)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১১)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১২)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৩)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৪)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৫)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৬)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৭)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৮)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৯)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২০)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২১)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২২)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৩)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top