সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব চৌদ্দ) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
৭ জানুয়ারী ২০২১ ২১:৫৮

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ২২:২৪

ছবিঃ অমর মিত্র

 

ছায়া দুলছিল। রাজা ভর্তৃহরি ঘুরে দাঁড়ালেন। জানালার কপাট খুললেন। ঠেলে দিলেন। চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল পৌষের আকাশ। দীপের আলো জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে ভেসে গেল। আকাশে চোখ রাখলেন ভর্তৃহরি। শীতের ধারালো বাতাসে প্রবেশ করছিল ভিতরে। রাজা তাঁর গায়ের শ্বেত বর্ণের আবিকটিতে স্বচ্ছন্দ হলেন এই বাতাসে। এটি মদ্রদেশীয়। এটির গায়ের চমৎকার সূচীকার্য আছে। শোনা যায় মেষলোমের এই বস্ত্রটি এমন অলঙ্কারখচিত করেছিল ভানুমতী। এখন ভানুমতী স্বীকার করে না। আশ্চর্য! বলে কতদাসী ছিল পিতৃগৃহে। তারা কতই না গুণবতী ছিল। তাদের কেউ করছিল বোধহয়। রাজা গিয়ে খোঁজ করতে পারেন কোন গুণবতীর কাজ এইটি। সে খুব সুন্দরী, অক্ষয় যৌবন তার। কিন্তু তাতেই বা রাজার কী? তিনি তো বৈরাগ্য নিয়েছেন।

অবন্তীরাজের মনে পড়ছিল। তিনি খোলা জানালা দিয়ে দূরের ক্ষীর সাগরকে লক্ষ্য করতে থাকেন। আকাশে অষ্টমী তিথির চাঁদ, পৌষের হিম কুয়াশায় ক্ষীর সাগর মিশে গেছে আলো আধাঁরে। চেনা যাচ্ছে না, নির্ণয় করা যাচ্ছে না কোথায় সেই সরোবর। সম্বৎসর শ্বেত পদ্মে ভরে থাকে  সরোবরের জল, যেন অগণিত চাঁদ প্রতিবিম্বিত হয় জলের চক্ষুতে। অবন্তীরাজের স্থির চক্ষুতে কোনো আলো নেই। প্রভা নেই। নিষ্প্রভ চোখে  তিনি তাকিয়ে আছেন অন্ধকারে। এমন কখনো হয়নি যে ক্ষীর সাগরকে এই জানালা দিয়ে দেখা যায়নি, দৃষ্টিপথে অদৃশ্য হয়েছে। এ হলো বিরল ঘটনা। ক্ষীর সাগরের পদ্ম শুকায়, ঝরে। কিন্তু কখনোই এক সঙ্গে নয়। কিছু ফুল আছে বারোমাস ফোটে। কিছু ফোটে ঋতুতে ঋতুতে। বর্ষা থেকে হেমন্ত-শীত পর্যন্ত ফুটে থাকে তারা। কিন্তু এমন কি হয়েছে যে ওই সরোবর জলহীন? পদ্ম আর ফুটে নেই। হাঁসেরা যায়না ওদিকে। জলের মাছ কবে কখন মরেছে, কোন পাঁকে মাথা গুঁজে আছে তা জানে না কেউ। রাজা ঘুরে দাঁড়াতে চাইলেন আবার। জানালার দিকে এসে ঘুরে দাঁড়ালেন। জানালা বন্ধ করলেন। কেমন উচ্ছিন্ন লাগছে নিজেকে। গায়ের আবরণটি আলগা করলেন। আবার ঘুরলেন। এগিয়ে যেতে লাগলেন। প্রজ্জ্বলন্ত দীপ পড়ে থাকল পিছনে। সামনের দেওয়ালে রাজার ছায়া দোলায়মান। তিনি স্তব্ধ হলে ছায়াও নিশ্চল হয়। রাজা তাঁর রাক্ষুসে ছায়ার দিকে তাকিয়ে ভাবলেন মঙ্গলনাথে যেতে হবে। গিয়েছিলেন সেই কার্তিক পূর্ণিমায়। তারপর  কেটে গেছে অনেকটা সময়। পৌষ মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিনি আজ। পৌষ পূর্ণিমাও এসে গেল, সাতটি দিন বাকি। রাজার পিঠ দেওয়ালে।

এই ঘরটি তাঁর বিদ্যাচর্চার। এই ঘরে বসে তিনি রচনা করেছেন শৃঙ্গারের শ্লোক। ভানুমতীকে বিবাহের পরে শুনিয়েছিলেন। ওই যে পড়ে আছে ভূর্জপত্র, হংসপাখা, মসিপাত্র। রাজা আরো কত শ্লোক রচনার কথা ভেবেছেন। সেই শ্লোক কি হবে শৃঙ্গারেরই  আরো? নাকি হবে শৃঙ্গারবিহীন প্রেমের? অন্ধকার চরাচরের দিকে তাকিয়ে যেভাবে আবেগদীপ্ত হয়ে ওঠে শরীর মন, সেই আবেগই হোক না নতুন শ্লোকের উপাদান। এই কাব্য শৃঙ্গারের হবে না, এ হবে কামগন্ধহীন প্রেমের। কিন্তু একটি শ্লোকও রচনা করতে পারেননি তিনি। অন্ধকার চরাচরে, জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রিতে, গোধূলিবেলায়, ঊষাকালে কে তাঁকে উদ্দীপ্ত করবে? কোন বিরহ-বিষাদ তাঁকে দিয়ে সৃষ্টি করাবে আরও নতুন নতুন চরণ? রাজার ঘাড় নুয়ে গেল। ভানুমতী। ভানুমতী কেন নয়? ভানুমতী তার ভিতরে তো অনন্ত বিরহের আঁধার বিস্তৃত করেছে যেন। নতুন শ্লোক যেন এই আঁধার নিয়েই লেখা হবে। বিরহের আঁধারে এ যেন হবে বিরহের কথা। ওই যে ভানুমতী ঘুমিয়ে আছে দক্ষিণের শয়নকক্ষে। একা। রাজা আছেন এখানে। একা। ভানুমতী সেই মস্ত পালঙ্কে একা। রাজা ভর্তৃহরি তাঁর বিরহ নিয়ে একা। একা হলেই তো বিরহ জন্মায়। দক্ষিণর ওই শয়নকক্ষ যেন শত যোজন দূরে। মনে পড়ে ভর্তৃহরির, শ্লোক রচনার সময় জেগে বসে থাকত তরুণী বধূ। থাকত দরজার ওপারে, ভূমিতে আসীন। যতক্ষণ না কবি তাঁর রচনা শেষ করে শয্যায় যান বধূ কী করে শয্যা গ্রহণ করে? আবার স্বামীর পাশে যে বসে থাকবে তাই বা কী করে হয়? কবি তাঁর শ্লোক রচনায় গভীর নিমগ্ন। বধূ কাছে গেলে সেই নিমগ্নতা ভেঙে যেতেও তো পারে। কত সন্ধ্যা, রাত্রি গেছে, একটিও শব্দ প্রস্ফূটিত হয়নি ভূর্জপত্রে। হংসপাখা মসী ছুঁয়েছে, হংসপাখা আর ভূর্জপত্র ছোঁয়নি।

কবি বলতেন, সৃষ্টির রহস্যটাই জানে না মানুষ, যে সৃষ্টি করে সেও জানে না, গতকাল দুইটি শ্লোক রচনা করেছি। আজ একটিও নয়, পারিনি।

তরুণী বধূর দু চোখে বিস্ময়, উদ্ভাসিত চোখে সে জিজ্ঞেস করেছে, সৃষ্টি কর্তা যদি না জানে, তবে সৃষ্টি হয় কী করে?

জানি না।

খোলা জানালা দিয়ে বধূ তার দুই চোখ আকাশে স্থাপিত করত। যেন, গ্রহ, তারা উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করত, এই যে ব্রহ্মাণ্ড, এর সৃষ্টি কর্তাও কি জানে না কীভাবে কী হলো?

রাজা বলতেন, হয়ত জানেন, কিন্তু আগাম যদি জেনেই ফেলেন সৃষ্টির রূপটি , তাহলে তিনি কী সৃষ্টি করলেন? যার অস্তিত্ব রয়েছে তাই-ই তো জানাই যায়, আর অনস্তিত্বকে অস্তিত্ব দেওয়াতেই তো সৃষ্টির আসল আনন্দ।

কত জিজ্ঞাসা ছিল ভানুমতীর। কবির দিকে কীভাবে চেয়ে থাকা। মধ্যরাতে ঘুমন্ত কবির দিকে চেয়ে জেগে থাকা। জ্যোৎস্না কীভাবে সরে যায় কবির মুখমণ্ডল থেকে তা দেখতে দেখতে ঘুমে ঢলে পড়া, পরদিন অকপট হওয়া।

ভানুমতী বলতেন, রাজা সন্তান ধারণ করাও...।

রাজা বলতেন, এর চেয়ে বড় সৃজনকর্ম আর নেই, শত সহস্র শ্লোক রচনা করেও ওই সন্তানের কাছে আমি পৌঁছতে পারব না।

ভানুমতী তখন  জিজ্ঞেস করলেন, জ্ঞান আগে না সৃষ্টি আগে?

রাজা বললেন, জ্ঞানের সন্ধান পাওয়াই তো সৃষ্টি, সৃষ্টকর্ম থেকেই তো জ্ঞানের উন্মেষ হয়।

নাকি জ্ঞান থেকেই সৃষ্টির প্রেরণা?

কবি বললেন, অসত্য নয়।

তবে জ্ঞানের উন্মেষ?

তাও অসত্য নয়।

অসত্য কোনটি তা হলে?

রাজা বললেন, এই ব্রহ্মাণ্ড, আকাশ, মহাবিশ্ব সবই সত্য, অসত্য কোথায় তা জানি না।

ভানুমতী বললেন, সত্য থাকলে অসত্যও থাকবে, যা আছে তা না থাকলেই তো অসত্য হয়ে যাবে সত্য অসত্য কী?

রাজা বললেন, অজ্ঞানতা।

অজ্ঞানতা কী?

যা সৃষ্টির বিপক্ষে।

সৃষ্টি কী?

আলো, ভোরের আলো দেখেছ ভানুমতী?

শুনতে শুনতে ভানুমতীর দু’চোখ আলোয় ভরে যায়। সে ধীরে ধীরে বলে, কত আলোই না দেখেছি রাজা, ভোরের আলো, চাঁদের আলো, তারার আলো, তোমার চোখের আলো, তুমি কি জানো, যখন তোমার হাতের হংসপাখাটি ভূর্জপত্রের উপর রচনা করতে থাকে শ্লোকটি তখন তোমার চোখে কোন আলো ফুটে ওঠে, সেই আলোও তো জ্ঞান।

এখন রাজার চোখে অজ্ঞানতার বিষাদ। মন বিশৃঙ্খল হয়ে আছে। বিশৃঙ্খল মনে শ্লোক রচনা করা যায় না। রাজার মনে হচ্ছিল মঙ্গলনাথে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। এখন দু’চোখ অনিদ্রায় জেগে থাকবে। অনিদ্রা দীর্ঘ হতে হতে রাতই ফুরিয়ে যাবে হয়ত। শ্লোক রচনার ব্যর্থতা, ভানুমতীর প্রত্যাখ্যান, একাকী নিশ্চিন্ত নিদ্রায় মগ্ন থাকা, সবই মনের বিশৃঙ্খলার অন্তর্গত। রাজা ঘর থেকে বেরিয়ে দীপের আলোয় ঈষৎ আলোকিত, আলোছায়ায় ঢাকা দীর্ঘ অলিন্দ বেয়ে হাঁটতে থাকেন। অলিন্দটি সঙ্কীর্ণ, মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে দুটি হাত দু’দিকে প্রসারিত করলে দেওয়ালে হাত তো বাঁধা পাবেই, সম্পূর্ণ প্রসারিত করা যাবে না। রাজা অন্ধের মতো হাঁটছিলেন।  দেওয়ালের প্রস্তর গাত্রে একহাতের তিনটি আঙুল ঘষে যাচ্ছিল। দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। দক্ষিণ দিকে রাজা রানীর শয়নকক্ষ। রাজা তাঁর মনশ্চক্ষে ভানুমতীকে দেখতে পান।

এখন তো ওই দেহখানি, ওই যৌবনে অলঙ্কৃত ভানুমতীর অঙ্গ স্পর্শের কোনো স্পৃহাই জাগেনা রাজা ভর্তৃহরির ভিতর। সুখ আর কামনা তো পরস্পরের পরিপূরক হতে পারে না। কাম নিবারণ কি সুখ? ভানুমতী কি সুখের আধার? তাই যদি হতো রাজার ভালোবাসার প্রতিদান দিতে বিমুখ হত না ভানুমতী। স্ত্রী অঙ্গ কি সমস্ত সুখের আবাস? তাহলে রাজার মনে, শ্রেষ্ঠীর মনে বিষাদের জন্ম হত না। রমণীরত্নের অভাব কোথায় রাজার রাজত্বে? মানুষ তৃষ্ণার্ত হলে শীতল জলপানে শান্ত হয়, তৃষ্ণা নিবারণ করে, ক্ষুধার্ত হলে অন্ন গ্রহণ করে ক্ষুধার অনল থেকে মুক্ত হয়, মানুষ কামার্ত হলে রমণীকে গ্রহণ করে, সে রমণী পত্নী হোক বা বারাঙ্গনা হোক। কামাগ্নি তো তৃষ্ণার মতো, ক্ষুধার মতোই সাময়িক জ্বলে ওঠা আগুন। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কাম হলো জীবিত প্রাণীর বেঁচে থাকার উপকরণ। মনুষ্যেতর প্রাণীরও ক্ষুধা আছে, তৃষ্ণা আছে, কাম আছে। ক্ষুধা তৃষ্ণার অন্ন জলের মতোই কামনা বাসনা নিবারক রমণী অথবা পুরুষ। এসব তো বেঁচে থাকার উপকরণ। কিন্তু সুখের উপাদান তো নয়, বেঁচে থাকা সুখ নয়। সুখ বেঁচে থাকার বাইরে আরো কিছু। অন্ন জল, রমণী, মানুষের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কামনারূপ ব্যাধির প্রতিষেধক। মানুষ কি তা জানে না?

রাজা ভর্তৃহরি প্রবেশ করলেন শয়নকক্ষে। এই ঘরের কোণে একটি ঘৃতের প্রদীপ। সেই নরম হলুদ আলো পালঙ্কের কিনারা পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। পালঙ্কের অন্ধকারে  ভুবনমোহিনী রূপ নিয়ে ঘুমিয়ে আছে ভানুমতী। রাজা ঘরের ভিতরে পা রেখেই সেই রূপের আঁচ পেলেন। এই আঁচ কি আগুনের? রূপের আগুন! এই আগুন কি কামনার? ভোগের! রাজার দুই চক্ষু মুদিত। মুদিত চক্ষু নিয়েও তিনি তাঁর দৃষ্টি থেকে ভানুমতীকে অদৃশ্য করতে পারছেন না। এখন যদি জেগে ওঠে ভানুমতী, অবন্তীলক্ষ্মী, তার দু’চোখের তারার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হবে তাঁকে। যেন আকাশে ফুটে ওঠা নতুন তারাকেই দেখবেন রাজা। তাঁর ভিতরে সৃষ্টি হতে থাকবে নতুন সব রঙ। নতুন শ্লোক। যদি আহ্বান করে ভানুমতী রাজা যেন পতঙ্গের মতোই এগিয়ে যাবেন অগ্নিশিখাময় ওই রূপের দিকে। বিড়বিড় করলেন ভর্তৃহরি, হায় ভানুমতী! ডাকো, আমাকে ডাকো।

রাজা প্রদীপটি দু’হাতে তুলে নিলেন। উচ্চতা পাওয়ায় প্রদীপের স্নিগ্ধ আলো আবৃত করল ঘুমন্ত ভানুমতীর দেহটিকে। যে রূপ ছিল অন্ধকারের আড়ালে তা প্রকাশিত হলো। প্রদীপের আলো যেন ভানুমতীর রূপের আশ্রয় হলো। রাজা তাঁর দুই চক্ষু মেলে ধরলেন। কী দেখলেন? চাঁদের মতো মুখখানিতে নীলকান্তমণির ছায়া। গুরুভার স্তন যুগল, শীতের কম্বলে আবৃত থাকা সত্ত্বেও তার রেখা খুব স্পষ্ট। ব্যাকুল হলেন তিনি। তাঁর দুচোখ ভানুমতীর রূপে বিহ্বল হলো। ঘুমন্ত রমণীর রূপে যে রূপের অতিরিক্ত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে তা প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন রাজা। পরনারীর মতো তিনি দেখতে লাগলেন ভানুমতীকে। চাপা স্বরে ডাকলেন, ভানুমতী!

ভানুমতীর ঘুম ভাঙে না। রাজার হাতের প্রদীপ কাঁপছিল। প্রদীপটি স্বস্থানে ফিরিয়ে দিয়ে চঞ্চল রাজা স্থির হতে চাইলেন। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আবার ডাকলেন, ভানুমতী ওঠো; ভানুমতী।

রাজা টের পাচ্ছিলেন তাঁর সমস্ত শরীরে প্রবেশ করেছে আগুন। কোন আগুন? ভানুমতীর রূপের? সেই আগুনে পুড়ছেন তিনি। আত্মদহনে জ্বলছেন। তিনি স্পর্শ করতে  পারছেন না ভানুমতীকে, কিন্তু ভানুমতী তার সমগ্র সত্তা নিয়ে প্রবেশ করেছে তাঁর ভিতরে। রাজা বসে পড়েছেন বরফ শীতল মেঝেয়। চিত হয়ে শীতল পাথরেরর উপরে শুয়ে পড়লেন। দুই চোখ মেলে দিয়েছেন ছাদের দিকে। প্রদীপ শিখা কাঁপছে। রাজা নিজেকে রক্ষা করছিলেন। ক্রমশ তাঁর দেহের আগুন নিভে যাচ্ছিল। তখন তাঁর অগোচরে পালঙ্কের উপর জেগে উঠেছেন ভানুমতী। পালঙ্কে বসেই ভানুমতী দেখতে পাচ্ছিলেন রাজাকে। অবন্তীর অধিপতি ভূমিশয্যায় শায়িত।

ভানুমতী ডাকলেন, কী হলো ওখানে যে!

রাজা নিশ্চল হয়ে আছেন। তার চঞ্চল শরীর স্থির হচ্ছে।

ভানুমতীর অসহ্য হলো, কর্কশতা এলো কণ্ঠধ্বনিতে, ডেকে উঠলেন, এমন আত্মপীড়নের কারণ কী রাজা, আমি তো ঘুমোতে পারব না।

রাজা ধীরে ধীরে উঠে বসলেন অন্ধকারে। দাঁড়ালেন। ভানুমতীর মনে হলো মৃত্তিকাগর্ভ থেকে উঠে এলেন যেন অবন্তীরাজ। ভানুমতীর মনে হলো পাথর ফাটিয়ে মাথা তুললেন রাজা ভর্তৃহরি। ভানুমতীর মনে হলো শূন্য অন্ধকার থেকে আবির্ভূত হলেন অবন্তীর রাজা। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ভানুমতী। রাজা ভর্তৃহরি, অবন্তী অধিপতি রাজা ভর্তৃহরি, স্বামী ভর্তৃহরিকে কেমন অচেনা মনে হয় যেন। এখন আর কাছের মনে হয় না মানুষটাকে। মনেই হয় না এই মানুষই রচনা করেছিলেন শৃঙ্গারের শ্লোক। বিশ্বাস হয় না রতিবিলাসী, কামনা বিহ্বল সেই রাজপুরুষ এখন নিজেকে কামনারহিত করে তুলতে শীতল মেঝেয় শয়ন করেন। বোঝেননি কি ভানুমতী? টের পাননি কি তিনি? আর নিজেও তো ভানুমতী কোনো আগ্রহই বোধ করেন না রাজার প্রতি। কী আশ্চর্য! জীবন এমন! এক সময় এই পুরুষের কণ্ঠস্বরেরই তাঁর সর্বঅঙ্গ বেজে উঠত যেন। শিহরিত হতেন তিনি একা একা এই মানুষটির কথা স্মরণ করে। কী উদ্দাম ছিল সেই প্রেমময় দিনগুলি। রাজা এই হিমেল রাতে মেঝেয় শুয়েছেন, শরীরকে শীতল করেছেন, তাহলে তাঁর দেহ উষ্ণ হয়েছিল। মেঝেতে শোওয়ার আগে রাজা নিশ্চয় দাঁড়িয়ে ছিলেন এই শয্যার কিনারে। তখন ভানুমতী নিজে ছিলেন ঘুমিয়ে। রাজা তাঁর ঘুমন্ত রূপ দেখেছিলেন নিশ্চয়। রাজা ভর্তৃহরির এ ছিল এক গোপন অভ্যাস। কতদিন ঘুম ভাঙার পর রানী দেখেছেন, তাঁর মুখের দিকে চেয়ে আছে দুটি চোখ। রাজা তো বলতেন, ভানুমতীর অজান্তে ভানুমতীকে দেখতে ভাল লাগে তাঁর। সেই অভ্যাসই ফিরে এসেছিল রাজার ভিতরে। উষ্ণ শরীরকে নিয়ন্ত্রণে আনতে রাজা হিম শীতল পাথরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ভানুমতীর মাথা টলমল করে ওঠে। রাজার প্রেম এখন অসহ্য লাগে তাঁর। রাজা যে কামনায় উষ্ণ হয়ে উঠেছিলেন তাঁর ঘুমন্ত শরীরের দিকে চেয়ে তা অনুধাবন করে শরীর যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুরে বসলেন ভানুমতী।

রাজা বললেন, সপ্ত সরোবর জলশূন্য, মাটি পাথর, কতদিন উজ্জয়িনীর আকাশে মেঘ নেই, আমি কী করে কুসুমশয্যায় শয়ন করি?

রানী চুপচাপ। তাঁর মনে হচ্ছিল আবার ঘুমিয়ে পড়েন। তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়লে ওই রাজপুরুষ প্রদীপ হাতে আবার তাঁর রূপ দেখতে থাকবে। কামনায় জর্জরিত হবে। সেই কামনা থেকে মুক্ত হতে হিমশীতল পাথরে শয়ন করবে। রাজার সেই স্পর্ধা নেই যে তাঁকে স্পর্শ করে। স্পর্শের আগেই তো ঘুম ভেঙে যাবে ভানুমতীর। আশ্চর্য! ঘুমের ভিতরেও যে কীভাবে টের পান ভানুমতী।

রাজা বলছেন, আবার মঙ্গলনাথে যেতে হবে।

রানী নিশ্চল। স্তূপ অন্ধকারের মতো বসে আছেন ভানুমতী। প্রায় অনস্তিত্ব হয়েই গেছেন তিনি। রাজা ভর্তৃহরি যেন অন্ধকারের সঙ্গে কথা বলছেন। নিজের সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি বলছেন, আচার্য বৃষভানু কী বলেন শোনা যাক, আকাশে নাকি নতুন একটি তারা জন্মাচ্ছে, তার ফলে এই অনাবৃষ্টি ফসলহীনতা।

ভানুমতী বললেন, আমি এবার ঘুমোব।

রাজা ব্যথিত হলেন, আমার কথার গুরুত্ব অনুধাবন করছ রানী?

কী হবে?

তুমি অবন্তীর রানী, অবন্তীলক্ষ্মী, তুমি যাবে আমার সঙ্গে, বৃষভানুর আশ্রম হয়ে আমরা যাব মহাকাল মন্দিরে, প্রধান পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলব।

রানী আবার নীরব। নিশ্চল। জমাটবাঁধা অন্ধকারে আড়াল হয়ে আছেন যেন তিনি। রাজা নিম্নস্বরে বলছেন, এমন কখনো হয়নি আগে। সাতটি সরোবরই জলহীন, একটি পদ্মও কোথাও নেই। আমি অবন্তীর রাজা, আমি কী করে এখন ঘুমোই, কুসুম শয্যাও যে এখন কণ্টক শয্যা হয়ে উঠবে। হিম শীতল কর্কশ পাথর হয়ে উঠবে। অবন্তীর এখন দুর্দিন, কোনো জমিতে ফসল নেই, এবার গোধূম বপন করা হয়নি, যব, ধান, ওঠেনি..., রাজা বলে যাচ্ছিলেন, রাজসভায় জ্যোতিষীরা বলছেন উজ্জয়িনীর আকাশে নতুন একটি তারা দেখা দিয়েছে। সেই জ্যোতিষ্কটির প্রভাবে বর্ষার মেঘ উধাও। মহাকাল মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের দূত এসেছিল, তিনি খুব উদ্বিগ্ন, সময় চেয়েছেন আমার কাছে। আমি বলেছি অধিক রাত্রে তাঁর নিকটে যাব। প্রধান পুরোহিতকে রাজসভায় আসতে দেখলে কথা উঠবে, মানুষ কল্পনা করতে ভালবাসে...।

রানী ধীরে ধীরে শয়ন করলেন পালঙ্কে। অন্ধকারে রাজা ভর্তৃহরি শুনতে পাচ্ছিলেন ভানুমতীর শ্বাস নেওয়ার শব্দ। অন্ধকারে ভানুমতীর শরীরের রেখা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন ভর্তৃহরি। ভানুমতী মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে শুয়ে আছে। ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়লেন তিনি ভানুমতীর উপর। সুগন্ধ টের পাচ্ছিলেন তিনি। ভানুমতীর শরীরের গন্ধ। মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে রাজার। তিনি অস্ফূট গলায় ডেকে ওঠেন, প্রিয়ে, ভানুমতী।

ভানুমতী শুনতে পেয়েছেন কিনা তা ধরতে পারলেন না ভর্তৃহরি। তাঁর সর্ব অঙ্গ আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল ভানুমতীর সৌরভে। দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে ভানুমতীর শরীর স্পর্শ করতে চাইলেন তিনি। তাঁর মনে হচ্ছিল ভানুমতী তাঁকে আবার সুযোগ দিক। আবার তাঁরা পরস্পর পরস্পরের দর্পণ হয়ে ওঠেন যেন। থরথর করে কাঁপছিলেন তিনি। অন্ধকারে তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন ভানুমতীর শরীরে বিপুল বিহ্বলতা। পশম বস্ত্রের ভিতরে ভানুমতীর শরীরখানি শ্বাস প্রশ্বাসে থমথম করছে। তিনি স্পর্শ করলেন। ভানুমতী এবার টের পেয়েছেন, চাপা গলায় বললেন, শীত খুব, তুমি যেতে পারো, আমি যাব না।

রাজা ভানুমতীর কপাল স্পর্শ করতেই শিউরে উঠে ছিটকে সরে গেলেন ভানুমতী, কী ঠান্ডা, যেন মৃতের হাত, তুমি যাও রাজা।

রাজা সরে এলেন। আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন তিনি। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। রমণী বা পুরুষ যখন কেউ কারোর প্রতি বিমুখ হয়, এভাবে হয়ে থাকে। একের স্পর্শ অন্যের কাছে মৃতের স্পর্শ মনে হয়। ভানুমতীর প্রত্যাখ্যানে রাজা নিজে প্রত্যহ সরে আসছেন হয়ত ওই পালঙ্ক থেকে, ওই শয়নকক্ষ থেকে, ভানুমতীর চোখের সামনে থেকে, কিন্তু কখনো কখনো তো বিস্ফোরণ ঘটে। যে বিস্ফোরণ ঘটল এই এখন। ভানুমতীর অস্তিত্ব যে এখনো এই পুরুষ মানুষটির সত্তায় প্রবল। তিনি এখন এই মুহূর্তে মরা মানুষের মতো হয়ে গেলেন ভানুমতীর কাছে। আর ভানুমতীও সেইরকমই হয়ে যাচ্ছেন কোনো আহ্বানেই সাড়া না দিয়ে।

রাজা দেবপথে প্রবেশ করছেন হাতে একটি দীপ নিয়ে। এই গোপন পথটি শিপ্রাতীরে উঠেছে একদিকে, অন্যদিকে গন্ধবতীর তীরে, মহাকাল মন্দিরের নিকটে। দুটি পথই গভীর, নির্জন। এর খোঁজ প্রধান সেনাপতি, তাঁর বৈমাত্রেয় অনুজ বিক্রম ব্যতীত আর কেউ জানে না। দেবপথে অন্ধকারে প্রবেশ করতে করতে থমকে দাঁড়ালেন রাজা ভর্তৃহরি। ঘুমন্ত কবুতরগুলি আচমকা জেগে উঠল যেন। ঘুমের ঘোরে বকম বকম করতে করতে আবার ঘুমিয়ে পড়ল তারা। রাজা এদিক ওদিক তাকিয়ে দীপ হাতে দেবপথে হাঁটতে লাগলেন।

চলবে

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব এগার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তের)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top