সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বিশ) : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:৩৯

আপডেট:
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:২১

 

আমি তো এখন চোখের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না ... মনে পড়ছে না আমার রিকশার পেছনে কোন ভালোবাসার মুখ এঁকেছিলাম? কার চোখ ... কার চুল ... কার হাসি দিয়ে কোন রং এ এঁকেছিলাম?
এখন আমার চোখের সামনে কোনো দৃশ্য নেই। আলো নেই, শুধু অন্ধকার ... সেই অন্ধকার স্মৃতির মধ্যে দূরাগত সংগীত ধ্বনির মতো আমার নাম ধরে ডাকল, তা-ই-মু-র ...।
তাইমুরের পূর্বকথা, পূর্ব স্মৃতি
‘তাইমুর’ ডাকটি কোনো একক কন্ঠের আহ্বান নয়। এই ডাক যেন বাবা ফজলুল হাসানের। মা জয়ী মা, ভাই ছোটন, ভালোবাসার নাম শ্যামশ্রীর ডাক, পরপার থেকে ডাক। আমি ডাক শুনে ওদেরকে যেন দেখতে পাই। সবকিছু মনে পড়ে যায়।
ছোটন ক্যান্সারের অসহায় ভোগান্তিতে মরতে চায়নি। সে তার মৃত্যুর একটা সাহসী নাম চেয়েছিল। সেই মৃত্যুই সে সাহসের সঙ্গে বরণ করে নিয়েছে পরিবারের মান-মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে। ছোটনের নাম মানুষের মুখে মুখে, মানুষের হৃদয়ে।
কিন্তু আমার কোনো মহৎ নাম নেই। আ অ্যাম জাস্ট এ রিক্শ পেইন্টার-রিকশার রং মিস্ত্রি। রিকশা ছাড়াও যন্ত্রের মতো ছবি, নানারকম ছবি এঁকে যাচ্ছি কখনো জলরঙে, কখনো তেলরঙে, কখনো এক্রেলিকে। কিন্তু সে সব ছবি যেন প্রাণহীন। আমি নিজেই বুঝতে পারি, আমার ছবির ভেতরাত্মায় কোনো আলো নেই, স্পন্দন নেই, ঔজ্জ্বল্য নেই। আমার ছবির রং এলোমেলো, তুলির আঁশগুলো ভোতা। সে আমার দুর্বল আঙুলের আঁচড়ে সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর হতে চায় না। আমার হাত কাঁপে, মন কাঁপে। আমার আত্মা, শিল্প চেতনাবোধ এখন অসহায়। যা আঁকি তা কুৎসিত, বিকৃত।
নিজের প্রতি ঘৃণা আর বিভ্রান্ত মানসিকতা নিয়েই আঁকলাম, প্লেজার অ্যান্ড পেইন। গোলাকার চাঁদের মধ্যেই দুই কুকুর-কুকুরি সঙ্গম দৃশ্য এবং তার পরবর্তী অধ্যায়-দে আর লক্ড আফটার সেক্স। তাদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাএকে অপরের থেকে বিছিন্ন হতে। তাদের দেহের উর্ধ্বাংশ চাঁদের শেষ প্রান্তে, নিম্নাংশ পৃথিবীতে। তারা না পারছে চাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারছে পৃথিবীর মাটিতে পা রাখতে। দে আর হ্যাংগিং। একটা অস্থির শূন্যতায় তারা ঝুলছে। যন্ত্রণাকাতর স্বরে যেন আর্তনাদ করে বলছে, ওহ্ গড, উই আর লক্ড। প্লিজ আনলক্ আস, সেভ আস ফ্রম দিস ডার্টি প্লেজার ক্রুয়েলিটি।
এই ছবিটার শিল্পরূপ, শ্লীলতা এবং শিল্পবোধ নিয়ে আমি মাথা ঘামালাম না। প্রদর্শনী মেলায় শিল্পবোদ্ধারা এই ছবিটা কোন দৃষ্টিতে বিচার বিশ্লেষণ করবেন তাও ভাবলাম না। ছবিটা আঁকার সময় গুন গুন করে একটা গানের কথাই গাইলাম-‘ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে।’
দ্বিতীয়বার ভাবনা-চিন্তা না করেই ছবিটা পাঠিয়ে দিলাম সোয়েবিজ ইনস্টিটিউট চিত্রকলা প্রদর্শনীতে। ইংল্যান্ডের অন্যান্য আর্ট স্কুলেও ছবি পাঠিয়েছি কিন্তু সেখান থেকে ধন্যবাদ ও যৎসামান্য প্রশংসা ছাড়া আর কিছুই পাইনি। আমি জানি এবারও আমার ছবির ভাগ্য ও পরিণতি একই রকম ঘটবে। আমার ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে এটা হয়তো ডার্টি ছবি হিসাবে গণ্য হবে এবং প্রদর্শনীতে বাতিলও হয়ে যাবে।

ছবিটা পাঠানোর পর আমার মন যেন একটা পচা পাঁকের মধ্যে হাবুডুব খেতে লাগল। আমি এ কী করলাম? কী ছবি পাঠালাম? মানসিক অস্থিরতা নিয়ে আমি সোয়াবিজ আর্ট ইনস্টিটিউটে দ্বিতীয় আর একটি ছবি পাঠালামছোটনের পছন্দ করা সেই ছবিটা, ‘নো ক্যাপশন ফর দিস মারটায়ার।’ যে ছবিটা ছিল রক্তাক্ত সিঁড়ির ওপর পড়ে থাকা নিহত বঙ্গবন্ধুর চশমার ভাঙা কাচের ভিতর দিয়ে তার অসমাপ্ত জীবনের নিঃশব্দ মুখের আভাস।
এরপর আমি আর একটা ছবি পাঠালাম প্যারিসের বিখ্যাত প্যারিস কলেজ অব আর্টসের এক প্রদর্শনী মেলায়-‘ব্লু কোশ্চেন ফ্রম দ্য ব্লু আইজ অব এ নিউ বর্ণ বেবি’। যে ছবিটিতে সদ্যোজাত একটি অবৈধ শিশু পড়ে আছে ডাস্টবিনে। তার নীল চোখে নীল আকাশের কাছে যেন অবাক প্রশ্ন। তার পাশে তার জন্মদাত্রী মা নেই। আছে শুধু একটা ভয়াল কুকুরতার একমাত্র পাহারাদার। বিমূর্ত পদ্ধতিতে আঁকা এই ছবিটা সম্পর্কেও আমার সন্দেহ। আমার এই উপলব্ধি, শিল্পচেতনা ও প্রশ্নের সঙ্গে কি একমত হবেন শিল্প বোদ্ধারা। এটাকে কি তারা ঠাই দেবেন প্রদর্শনীতে?
শিল্পবোদ্ধারা যাই ভাবুক আমি এখন এক অস্থির সময়ের মানুষ। আমি বাতিল ছবির বাতিল মানুষ। এই যে কয় বছর আমি ছবি এঁকে কাটালাম এক রিকশা পেইন্টার ছাড়া আর কিছুই হতে পারলাম না। উঞ্ছবৃত্তি করেই আমার জীবন যাপন। আ অ্যাম জাস্ট এ রিক্শ পেইন্টার।
বল্টুর হাতে বাবার প্রহৃত হওয়া, প্রতিশোধ স্পৃহায় ছোটনের হাতে বল্টুর হত্যাকা- এবং ফোরকান খানের সিকিউরিটি গার্ডের গুলিতে ছোটনের নিহত হওয়া নিয়ে যে প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝা আমাদের সংসারের সবকিছু এলেমেলো করে দিয়েছিল তা এখন কিছুটা স্তিমিত। ছোটনের মৃত্যু তুষের আগুনের মতো আমাদের চাপাশোক সত্ত্বেও আনন্দ ও স্বস্তি এই যে বাবা যুদ্ধাহত সৈনিকের মতো আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন, আগের মতো হ্যান্ডক্রাচে ভর করে হাঁটতে পারছেন।
শ্যামশ্রী সময়ে অসময়ে প্রায়ই আসে আমাদের বাড়িতে। কখনো ছোটনের জন্যে আহাজারি করে, কখনো জয়ী মা আর নাজুকে হাসি-গল্পে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করে শোকের ছাই-ছাই ধুলোগুলোকে উড়িয়ে দিতে। আমি নানান কাজের ব্যস্ততায় বাইরে থাকি বলে আমার সঙ্গে ওর দেখা সাক্ষাত কম হয়। তবে মন যখন খুব বিষণœ থাকে, হতাশা আমাকে গ্রাস করে তখন হয়তো লালবাগে ওদের বাসাতে যাই, দু-দ- ওর সাথে গল্প করি মন থেকে বিষাদের মেঘ উড়িয়ে দিতে। আমি জানি শ্যামশ্রী আমার প্রতি অসম্ভব দুর্বল। আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলে ওর চোখে যেন রৌদ্রমুগ্ধ আলো জ্বলে ওঠে, শাড়ির অন্তরালে দেহে যেন উচ্ছ্বল বর্ষার ঢেউ জেগে ওঠে, কণ্ঠে যেন হাজার পাখির সংগীত বেজে ওঠে। আমাকে বসিয়ে সে হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে গান শোনাতে বসে প্রিয় পরিচিত গানে, ‘যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম।’
অথবা ‘একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে ...।’
কিন্তু আমি জানি ওর জীবন আমি সোনার আলোয় ভরিয়ে দিতে পারব না। ও ওর কষ্ট আর বিচ্ছেদের আগুনে নিজেই নিঃশব্দে পুড়ে মরবে। ও এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম কম পড়ছে। ওর বাবা আর ওর বড়দা কলকাতায় ওর বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। এই পাকা কথার অবাধ্য হবার কিংবা জাত, ধর্ম উপেক্ষা করে আমাকে বিয়ে করার শক্তি ওর নেই। তবুও আমাকে তার ভালোবাসার কথাগুলো না বলতে পেরে চাপা কষ্ট উজাড় করে দেয় গানের ভেতর দিয়ে। আমি বুঝি। সব বুঝি। কিন্তু সব বুঝেও তার দিকে কামনা বাসনার হাত বাড়াই না। অবিনাশ সাহা শকুনের মতো শ্যেন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। সোমনাথ বাবুকে সে আমার আর শ্যামশ্রীর অন্তরঙ্গতা নিয়ে অতিরঞ্জিত নানান কানকথা শোনায়। সোমনাথ বাবু তা নীরবে শোনেন কিন্তু প্রমাণাভাবে শ্যামশ্রীকে কিছু বলতে সাহস পান না। কিন্তু আমার প্রতি তার শীতল আচরণে তিনি বুঝিয়ে দেন আমি এ বাড়িতে অবাঞ্ছিত। আমি তার অপ্রিয় ব্যক্তি। কারণ, একদা আমি তাকে বটতলার উকিল বলেছিলাম।
আমাদের জীবন কাটছে একটা বালুচরা নদীর ক্ষীণ স্রোতধারার মতো। এই গতানুগতিক বদ্ধ জীবনের মধ্যে জাপান থেকে এলো এন এইচ কের একটি টেলিভিশন টিম। তারা ঢাকা শহরের রিকশা চিত্রের ওপর তিরিশ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি বা প্রামান্য চিত্র তৈরি করবে। রিকশাচিত্রী বা রিকশা পেইন্টার হিসাবে যাদের খ্যাতি বা চাহিদা আছে তাদের চিত্রকর্ম যাচাই বাছাই করে ওরা মাত্র পাঁচজন রিকশাচিত্রীকে নির্বাচিত করেছে তাদের মধ্যে আমি একজন। খলিল চাচা মহানন্দে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন ঐ জাপানি টিভি টিমের কাছে। জাপানি অনুষ্ঠান প্রযোজক অর্থাৎ এই অনুষ্ঠানের নির্মাতা কাওয়াহিতো আমার সঙ্গে চলতি প্রমিত বাংলায় আমার জীবন বৃত্তান্ত, আমার সংগ্রাম, সাধনা, কেন রিকশাচিত্র অঙ্কনের এই পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছি তার খুঁটিনাটি সব বিষয়েই জানতে চাইলেন এবং রিকশাচিত্রের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত নিয়ে প্রাথমিকভাবে আলাপ আলোচনা করলেন। এইসব আলোচনা অনুষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত নয়। এটা তাদের কাজ শুরু করার পূর্ব প্রস্তুতি বা হোমওয়ার্ক। তারপর ওরা ওদের নির্বাচিত পাঁচজন রিকশাচিত্রীকে নিয়ে পৃথকভাবে এক এক দিন এক একজনের চিত্রীকে নিয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা, অঙ্কন কৌশল, রঙের সংমিশ্রণ, তুলির আঁচড়ে তাদের ভাবনার পরিস্ফুটন এসব বিষয় তাদের ক্যামেরার চোখের সম্মুখেই বসে বসে দিনভর প্রাকটিকাল পরীক্ষার মতোই নিজেদেরকে প্রমাণিত করতে হল যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও রিকশা চিত্রীরা ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভার অধিকারী। এইসব রিকশাচিত্র যাত্রীদের কতটুকু আকর্ষণ করে তা নিয়েই তাদের কয়েকজন আরোহীর সঙ্গে কিছু টুকটাক সাক্ষাত নিলেন। যে সব রিকশা মহাজন তাদের রিকশাকে আরামদায়ক, মনোরম ও সৌন্দর্যম-িত করতে দ্বিধাবোধ করেন না তাদেরও সাক্ষাতকার নেওয়া হল। খলিল চাচাও তাদের মধ্যে অন্যতম এবং ভীষণ আবেগাপ্লুত। ‘ও আল্লাহ, আমাগো রিকছা, আমাগো কথা জাপান টেলিভিশনে দেখানো হইবো! কী অতাজ্জব ঘটনা! সোবহান আল্লাহ সোবহান আল্লাহ।’ রিকশার পেছনে কোন ছবির চাহিদা বেশি তা নিয়েও যাত্রীদের ও সাধারণ জনগনের মতামাত যাচাই করা হল। মতামত জরিপে দেখা গেল প্রায় সত্তুর ভাগ মানুষের প্রিয় বিষয় হচেছ চলচ্চিত্রের সুদর্শন নায়ক-নায়িকাদের রোমান্টিক মুহূর্তের ছবি। তারপর বাংলাদেশের নদী, নারী ও নিসর্গের ছবি। রিকশার পেছনে বিমূর্ত, উচ্চমার্গের ছবির কোনো স্থান নেই। এখানে সবারই ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে সহজ সরল ভালোবাসার উজ্জ্বল রঙের ছবি। ছবি আঁকা ছাড়াও আমাদের পাঁচজন রিকশাচিত্রীর সঙ্গে জাপানি অনুষ্ঠান নির্মাতা অত্যন্ত অন্তরঙ্গ ও গল্প করার ভঙ্গিতেই ঢাকার রিকশা চিত্রের ইতিহাস, ঐতিহ্য, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা কথা জানতে চাইলেন এবং জানলেনও। তার সবশেষ প্রশ্ন ছিল সংগীতে, নৃত্যে, অভিনয়ে একজন শিল্পী যেমন জীবনভর সাধনায় মগ্ন থাকে আমরাও তেমনি এই রিকশা চিত্রের জনপ্রিয়তা মর্যাদা সমুন্নত রাখতে রিকশা চিত্রীই হিসাবে সাধনা করে যাব কি না? আমাদের চারজন একবাক্যে বলল, হ্যাঁ। আমি সবাইকে চমকে দিয়ে বললাম, না। জাপানি অনুষ্ঠান নির্মাতা আমার দিকে বিস্ময় মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকালেন। তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে আমি বললাম, আমার জীবনটার পরিধি কতটুকু তা আমি জানি না। কিন্তু আমার চিন্তা আকাশের চাইতেও বড়। আমি আমার জীবন, আমার লক্ষ্য এই রিকশার পেছনের ছোট্ট একটা জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইনে। আই ওয়ান্ট এ বিগ ক্যানভাস ফর মাই আর্ট।
সবাই আমার কথায় নিস্তব্ধ। জাপানি ভদ্রলোক হেসে হাততালি দিলেন। প্রশংসার সুরে বললেন, হ্যাঁ জীবন যত ছোটই হোক, লক্ষ্য হতে হবে বড়। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে চাই বিশাল ক্যানভাস। আমি আশা করছি, সেই ক্যানভাস তুমি একদিন খুঁজে পাবে।
সাতদিন অবিশ্রান্ত পরিশ্রমের পর এন এইচ কে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নির্মাতা একটা পাঁচতারা হোটেলে চা চক্রে আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাদের পাঁচজন রিকশাচিত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রত্যেকের হাতে তুলে দিলেন একটি করে সানিয়ো রঙিন টেলিভিশন এবং প্রত্যেকের হাতে দশ হাজার টাকার খাম। আমরা টাকার জন্যে যতটা না আনন্দিত তার চাইতে বেশি আনন্দিত রঙিন টেলিভিশন উপহার পেয়ে।
আমাদের বাড়িতে রঙিন টেলিভিশন কেন সাদা-কালো টেলিভিশনও নেই। দারুন অর্থাভাবে আমাদের টেলিভিশন কেনার সামর্থ ছিল না। বাবার অনাগ্রহে রেডিও ছিল না। একটি মাত্র সংবাদপত্র রাখা হত তা-ই বাবা পড়তেন। মাঝে মধ্যে সেই বাসিপত্রিকা, ছোটন কিংবা আমি পড়তাম। ক্লাসে নাজুর বান্ধবীরা টেলিভিশনের নাটক বা গান নিয়ে অনেক উচ্ছ্বাস, আনন্দ প্রকাশ করত। নাজু নীরবে শুনত। সহপাঠিনীদের মতো তার মনে নাটক দেখা বা গান শোনার ইচ্ছেটা সুপ্তই থেকে যেত। সে কখনোই টেলিভিশন কেনার জন্যে আমাদের কাছে আবদার করেনি বা প্রতিবেশীদের বাসায় কখনোই টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখতে যায়নি। মরমের কথা সে মরমেই রেখে দিয়েছে।
রঙিন টেলিভিশনটা আমি নাজুকেই উপহার দিলাম। আর টাকাটা জয়ী মার হাতে। এতকাল পরে একটা টেলিভিশন পেয়ে নাজু মহাখুশি। বাবার প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না। তবে পুত্রগর্বে তার পা-ুরমুখে কিছুটা উজ্জ্বলতা ফুটে উঠল। তবে তিনি টেলিভিশন দেখতে আগ্রহী নন। তার নির্দেশে টেলিভিশন সেটটি জয়ী মা আর নাজুর ঘরে ক্যাবল সংযোগ দিয়ে সেট করা হল। নাজুর আনন্দ দেখে মনে হল একটা রঙিন স্বপ্নের জগত তাদের চোখের আলোয়। তাদের ঘরের ভেতরে টেলিভিশনে কত নাটক, গান, দেশ বিদেশের খবর, এনিমাল প্লানেট ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক চ্যানেলে কত রহস্যময় অ্যাডভেঞ্চার! নাজু কয়েকটা দিন রঙিন মাছের মতেই ডুবেই রইল টেলিভিশন নামক অ্যাকুরিয়ামে। এরপর জয়ী মা তার রাশ টেনে ধরলেন। সারাক্ষণ টেলিভিশন চালিয়ে পড়াশুনার ক্ষতি করে তিনি নাজুকে টেলিভিশনে আসক্ত হতে দিলেন না। তিনি টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখার সময়, নিয়ম বেঁধে দিলেন। কোনো ভারতীয় চ্যানেল, হিন্দি সিরিয়াল নিষিদ্ধ। সন্ধে সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত টিভি সম্পূর্ণ বন্ধ। কেননা ঐ সময়টা নাজুর লেখাপড়ার সময়। নিরুপায় নাজুকে এই বিধি-নিষেধ মেনে নিতেই হল।
একদিন রাত সোয়া দশটার দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের এক খবর শুনে নাজনিন চিৎকার করে ছুটে এল আমার ঘরে। দারুন উত্তেজনায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বড়দা, তুমি পেয়েছ, পেয়েছ ...।
আমি বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিলাম। ওর উত্তেজনা দেখে উঠে বসলাম। প্রশ্ন করলাম, কী পেয়েছি।
- পুরস্কার ... পুরস্কার।
- কীসের পুরস্কার?
নাজু আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, একটা নয়, দুটো নয়। দুই দেশের তিনটে পুরস্কার। একটা প্যারিসের আর দুটো লন্ডনের ...। ও আমার বড়দা গো, এতদিনে তোমার সব কষ্ট, সব পরিশ্রমের ...।
নাজু অতি উত্তেজনা আর আবেগে কথা বলতে পারল না। আমাকে জড়িয়ে ধরেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। নাজুর কান্না আর চিৎকার শুনে জয়ী মা আর বাবাও খোঁড়া পায়ে ছুটে এলেন আমার ঘরে।
আমাদের প্রশ্নে নাজু তার উত্তেজনা, কান্না কোনোক্রমে প্রশমিত করে বলল, আর প্যারিসের দুটো নামী আর্ট এক্সিবিশনে আমার তিনটে ছবি আর্ট ক্রিটিক ও জুরিদের বিবেচনা অনুযায়ী কয়েকজনের সাথে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি হিসাবে বিবেচিত হয়েছে এবং পুরস্কার লাভ করেছে। এটা বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিজস্ব খবর নয়, বিবিসির সংবাদ সূত্র থেকে পাওয়া।
নাজুর মুখে আমি এ সংবাদ বিশ্বাস করতে পারলাম না। বললাম, এতো চিৎকার করিসনে। আমাদের বিনে পয়সার টেলিভিশনে তুই ভুল খবর শুনেছিস।
নাজু চিৎকার করে বলল, বাংলাদেশের ঢাকায় আর কার নাম তাইমুর হাসান? কোন তাইমুর হাসান শিল্পী? কার ছবির নাম ‘নো ক্যাপশন ফর দিস মারটায়ার?’ কার ছবির নাম ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন?’ কার ছবির নাম ‘ব্লু কোশ্চেন?’ আর কেউ না জানুক আমি ভুল শুনিনি। এই শিল্পী এই তাইমুর মাত্র একজনই আছে সে আমার বড়দা।
নাজু যে ভুল খবর শোনেনি তা প্রমাণিত হল পরদিনের সকল সংবাদপত্রে এবং রেডিও, টেলিভিশনের পুনঃসংবাদ প্রচারে। আমাদের মাহুতটুলির বাসায় টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের সংবাদকর্মী এসে ভিড় জমাল আমার মুখ থেকে কিছু কথা জানতে। আমার মতো একজন অনামী রিকশা পেইন্টারের পক্ষে দুটি দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান থেকে তিনটি ছবির জন্যে এ ধরনের সম্মানজনক স্বীকৃতি ও পুরস্কার পাওয়া একটা অভাবিত বিস্ময়।
সাংবাদিকরা আমার ছবিগুলির বিষয়বস্তু জানতে চাইল এবং আমার শিল্প ভাবনার কিছু তাত্ত্বিক কথা জানতে চাইল। আমি তাদের নিরাশ করলাম। বললাম, দেখুন আমি সামান্য একজন রিক্শ পেইন্টার। আমি তো ফিদা মকবুল হোসেন নই, রামকিংকর নই, জয়নুল আবেদীন বা নড়াইলের সুলতানও নই। আমি তাদের পায়ের ধুলিও নই। সুতরাং যা এঁকেছি তা আমি আমার খেয়াল খুশি অনুযায়ী এঁকেছি। সুতরাং বিদেশে ছবির প্রদর্শনীতে আমার ছবি কোন বিবেচনায় পুরস্কৃত হয়েছে তা আমার জানা নেই। হ্যাঁ তবে একটা ছবির কথা বলতে পারি সেটা ছিল আমার মৃত। ভাই ছোটনের প্রেরণা অনুযায়ী আঁকা একটি অর্দ্ধ সমাপ্ত ছবি রক্তাক্ত সিঁড়ির ওপর পড়ে থাকা চশমার ভাঙা কাচের ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর অস্পষ্ট মুখের রেখা একজন অসমাপ্ত মানুষের, অসমাপ্ত জীবনের অসমাপ্ত ছবি। ছবিটার শিরোনাম দিয়েছিল ছোটন‘নো ক্যাপশন ফর দিস মারটায়ার’-শিরোনামহীন শহীদের মুখ।
আমি সত্যি সত্যিই পুরস্কার পেয়েছি কিনা তার সত্যতা যাচাই করলাম নিজে আলিয়ঁজ ফ্রসেঁজে ও ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে। যদিও বিষয়টিতে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই তথাপি আমার অনুরোধে সত্য যাচাইয়ের ব্যাপারে ওরা লন্ডন ও প্যারিসের আর্ট কলেজের সঙ্গে ফ্যাক্স ও টেলেক্স মারফত যোগাযোগ করলেন এবং খবরটির সত্যতা সম্পেির্ক নিশ্চিত হয়ে আমাকে অভিনন্দন জানালেন। জানা গেল ছবি তিনটির জন্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দুটি থেকে আমাকে এশিয়ার সেরা নবীন শিল্পী হিসাবে সনদ, পদক এবং নির্ধারিত অর্থ ছাড়াও পুরস্কার গ্রহণের জন্য লন্ডন ও প্যারিসে তিন সপ্তাহ ভ্রমণের এয়ার টিকেট ও আথিতেয়তা দেওয়া হবে। এ বিষয়ে শীঘ্রই আমাকে অফিসিয়াল লেটার, ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলের সিডিউল পাঠানো হবে। চিঠি পাওয়া মাত্রই আমি যেন ভিসার জন্যে উভয় দেশের দূতাবাসে যোগাযোগ করি। আমার এয়ার টিকিট হবে ঢাকা টু লন্ডন, লন্ডন টু প্যারিস অ্যান্ড আফটার টু উইকস, রিটার্ণ টু ঢাকা ফ্রম প্যারিস।

এখন আমার অপেক্ষার পালা।

এতকাল পরে আমি যেন আমার স্বপ্নের দরজা খোলার চাবিটা খুঁজে পেলাম। চাবিটা যেন হাতের মুঠোয় নিয়ে গুন গুন করে গেয়ে উঠলাম,
‘এবার চলিনু তবে
সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে ...
... পাখি উড়ে যাবে সাগরের পার
সুখময নীড়ে পড়ে রবে তার
মহাকাশ হতে ওই বারে বার আমারে ডাকিছে সবে
সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে।’

কিন্তু বাঁধন ছেঁড়ার আগেই নিয়তি নামক একটি চন্দ্রপোড়া সাপ আমার পা পেঁচিয়ে ধরল, তার সর্বনাশা ছোবলে আমাকে সব ভালোবাসার বাঁধন ছিঁড়ে পালাতে হল অন্য এক অন্ধকারে দীর্ঘ এক জীবন যাপনে। তবে সেই দুঃখ-শোক এখন বলার সময় নয়। বলব পরেশেষবারের মতো পেছন ফিরে তাকিয়ে।

তাইমুরের লন্ডন ও প্যারিসের জীবন

লন্ডন শহরের রঙিন চিত্র দেখেছি ব্রিটিশ কাউন্সিলের গাইড টু লন্ডন বুকলেটে কিংবা চলচ্চিত্রে। ভাবতে অবাক লাগে আমার এই চব্বিশ বছরের জীবনে বিমানকে উড়ে যেতে দেখেছি প্রতিদিন। বহুবার, কিন্তু একবারও চড়ার ভাগ্য হয়নি। এই প্রথম ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে আমার বিদেশ যাত্রা। পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে আমার এই প্রথম বিদেশ ও বিমান ভ্রমণ নিঃসন্দেহে আনন্দের হত যদি না শ্যামশ্রীর সঙ্গে আমার ভাগ্য জড়িয়ে না পড়ত। তার চাইতে বড় কথাআমি অসহায় অসুস্থ বাবা, জয়ী মা আর কিশোরী নাজুকে একটা অনিশ্চিত ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে উড়ে যাচ্ছি আনন্দের মেঘের মেলায় নয়, বরং যন্ত্রণাবিদ্ধ ডানায় ভর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি বুকে একরাশ কষ্টের পাথর নিয়ে।
প্রায় ষোল ঘন্টা ক্লান্তিকর জার্নির পর আমি হিথ্রো এয়ারপোর্টে পৌঁছেছিলাম ভোরবেলাতে। আমাকে এয়ারপোর্টে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিল লন্ডনের সোয়েবিজ আর্ট ইনষ্টিটিউটের এক তরুণ গাইড পিটার ফিলিপস। আমার ব্যাগেজ বলতে একটিমাত্র স্যুটকেস আর একটি ব্যাগপ্যাক ছাড়া আর কিছুই নেই। পিটার ফিলিপস গাড়ি নিয়ে এসেছিল।
হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় একঘন্টা ড্রাইভে হিম হিম কুয়াশাময় স্থানের দেশ লন্ডনের রাস্তার দুপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে আর ফিলিপস এর সঙ্গে গল্প করতে করতে পথ শেষ হল। ফিলিপস আমাকে নিয়ে এল ব্রাডফোর্ড স্কয়ারে সোয়েবিজ ইনস্টিটিউট অব আর্ট এর সন্নিকটে গাওয়ার হাউস হোটেলে।

গাওয়ার হাউজ হোটেলে চেক ইন আর রুম বরাদ্দ পাবার পর ফিলিপস বিদায় নিল। একটি শুভ্র, সুকোমল শয্যা পেয়ে আমি কোনোক্রমে কাপড় বদলে পথশ্রান্তি মুছতে ঘুমিয়ে গেলাম একটি শিশুর মতো। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর গাইড পিটার ফিলিপস এল আমাকে সোয়েবিজ আর্ট ইনস্টিটিউট নিয়ে যেতে। আমি ঢাকার বঙ্গবাজার থেকে গোটা দুই পুরোনো স্যুট কিনে এনেছিলাম। তারই একটা পরে ফিটফাট সজ্জায় ফিলিপসের সঙ্গে গেলাম ব্রাডফোর্ড স্কয়ারে সোয়েবিজ ইনস্টিটিউটে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কাছেই এই স্বনামধন্য ইনস্টিটিউট। ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান, ডিন এবং ডিরেক্টর, জুরি বোর্ডের সদস্যগণ, শিক্ষক ও আর্ট ক্রিটিক সোসাইটির অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অনেকে উপস্থিত আমাকে স্বাগত জানাতে। সবার সাথে হাত মেলাতে আর গুডমর্নিং স্যার, গুডমর্নিং স্যার, বলতে বলতে আমি মুখে একটু হাসি ঝুলিয়ে রাখলাম বটে কিন্তু এমন বিশিষ্টজনদের সমাগমে আমার কণ্ঠশুষ্ক, বক্ষ দুরু দুরু।
চেয়ারম্যানের সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পর আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে পদক ও সনদের সঙ্গে আর্থিক পুরস্কারও দেওয়া হল তিন হাজার পাউন্ড। আমার জন্যে এটা একটা বিশাল প্রাপ্তি। আমার ছবি দুটি বিপরীত চিন্তাধারার, একটি ছবি অন্য ছবিটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তথাপি ছবি দুটির অন্তর্নিহিত শিল্পবোধ, আমার অঙ্কন নৈপূন্যের কথা অন্যদের মুখে আলোচিত হতে শুনে আমাকে বিস্মিত ও আনন্দিত হতে হল। আসলে এই ছবি দুটো নিয়ে আমি ওদের মতো এতটা ভাবিনি, বিচার বিশ্লেষণও করিনি।
চিত্র সমালোকগণ ও সাংবাদিকরা আমার মতামত, ধ্যান-ধারণার কথা জানতে চাইলেন। জানতে চাইলেন ছবির অন্তরালের মানুষটির কথা। নিজের বলবার আগে আমি আমার পিতার কথা বললাম। বললাম আমি একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত সন্তান। মুক্তিযুদ্ধে আমার পিতা আর মাতার সাহস ও বীরত্বের কথা বললাম। তাদের ভালোবাসার কথা বললাম। স্বাধীনতার পর আমাদের দারিদ্রের কথা বললাম। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করা সত্ত্বেও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারিনি, আমার ছোট ভাই ছোটনের ক্যান্সার চিকিৎসার জন্যে পড়াশুনা ছেড়ে আমাকে পেইন্টিং কাজ বেছে নিতে হয়েছে। আমাদেরকে পদে পদে অপমান সইতে হয়েছে। আমাদের ছোটন তার পিতা ও বোনের লাঞ্ছনা আর অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সেই দুষ্কৃতিকারীকে কীভাবে হত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল এবং নিজেও কীভাবে নিহত হয়েছিলসেই সব কথা, আমার যত দুঃখ-শোক একটা আবেগময় বেদনা বিধূর সংগীতের মতো যেন গেয়ে গেলাম। বললাম, আমার পিতার শোকাহত মুখ দেখলে আমার বড় কষ্ট হয়। আমি তার সেই শোকাহত মুখ আঁকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আঁকতে গিয়ে দেখলাম আমার পিতার চাইতেও আমাদের মহান পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আরো হতভাগ্য। তিনি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে, অসমাপ্ত জীবন, অসমাপ্ত স্বপ্ন নিয়ে দুস্কৃতিকারী চক্রের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন ১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্টে। তাই তার পড়ে থাকা চশমার ভাঙা কাচের ভেতর দিয়েই আমরা প্রতিনিয়ত তার মুখ দেখি, তার বাংলাদেশকে দেখি। আমি আরো কিছু বলতে চাইলাম। কিন্তু বলতে পারলাম না। হৃদয় থেকে উৎসারিত কান্নায় আমার কন্ঠ বন্ধ হয়ে গেল। আমি আমার গল্পের উপসংহার টানতে পারলাম না। দেখলাম হল ভর্তি মানুষ স্তব্ধ, তাদের চোখও অশ্রুসজল। নিস্তব্ধতা ভেঙে সোয়েবিজ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, নবীন প্রতিশ্রুতিশীল শ্রেষ্ঠ চিত্রকর, শ্রেষ্ঠ ছবি নির্বাচনে আমাদের অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। বিশেষ করে একই শিল্পীর দুটি ভিন্ন ধারার ছবি নিয়ে। কিন্তু আমি এখন নিশ্চিত যে এই ছবি দুটি নির্বাচনে, ছবির অন্তরালের শিল্পীর জীবন-যন্ত্রণা অনুধাবনে আমরা ভুল করিনি। লেট আস গিভ হিম এ বিগ হ্যান্ড।
দর্শকদের তালিতে তালিতে মুখরিত হল হল ঘরটি। কিন্তু আমি কাঁদতেই থাকলাম। শক্তি কবির কথা, ‘মানুষ যখন কাঁদে মানুষের সাধ্য কি, তাকে থামায়?’
যাবতীয় অনুষ্ঠান আমার সম্মানে আয়োজিত টি পার্টি শেষে সোয়েবিজ ইনস্টিটিউটের বদান্যতায় এবার আমার লন্ডন ভ্রমণের পালা। কখনো আমার সঙ্গে গাইড হিসাবে ফিলিপস থাকে, কখনো আমি একটি বাসে বা টিউবে চড়ে, মুগ্ধ বালকের মতো টেমস নদী, পার্লামেন্ট হাউজ ও তার বিশ্বখ্যাত প্রাচীন বিগবেন ঘড়ি, লন্ডন ব্রিজ ইজ ফলিং ডাউন এর সেই বিখ্যাত ছড়ার লন্ডনব্রিজ, মহারাণীর বাকিংহাম প্যালেস, হাইড পার্ক, অক্সফোর্ড স্ট্রিট, পিকাডেলি সার্কাস, মাদাম তুঁসো মিউজিয়াম, নভোথিয়েটার, ব্রিটিশ আর্ট মিউজিয়াম, লন্ডন জু, হাজার পায়রার উড়োউড়ির চত্বর নেলসন স্কয়ার সবই একে একে দেখলাম। আমি যেদিন যেটা দেখি তার মধ্যে ভালোলাগার দু একটি দৃশ্যের স্কেচ নাজুকে লেখা চিঠির মধ্যেই এঁকে পাঠিয়ে দিই।

সাতদিন লন্ডন শহর দর্শন শেষে সোয়েবিজ ইনস্টিটিউটকে তাদের আতিথেয়তার জন্যে ধনবাদ জানিয়ে ব্রিটিশ ওয়েজের নির্ধারিত ফ্লাইটে পাড়ি দিলাম প্যারিসের উদ্দেশে।

চলবে

 

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব তিন)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পাঁচ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ছয়)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব সাত)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আট)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব নয়)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব দশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব এগার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব তের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চৌদ্দ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পনের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ষোল)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব সতের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আঠারো)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব উনিশ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top