সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৫) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
২১ ডিসেম্বর ২০২২ ০০:৪৫

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:০৬

 


তিনচার জন একসঙ্গে বলে, আপনি আমাদের একটা ফুটবল কিনে দেন কাকু। আমরা ফুটবল খেলব।
- এখানেতো ফুটবল খেলার মাঠ নেই।
- মাঠ লাগবে না। আমরা এই রাস্তাতে খেলব।
- না, না রাস্তায় ফুটবল খেলা ঠিক হবে না। রাস্তা দিয়ে লোকজন হাঁটাহাটি করে।
চিৎকার করে ওঠে শিশুরা, আমরা কি কোনো দিন একটা ফুটবল পাব না। ফুটবল খেলা ছাড়া বড় হবো?
- দেশ স্বাধীন হলে তোরা ফুটবল খেলবি নিজের দেশে গিয়ে।
- কবে দেশ স্বাধীন হবে?
- আমরাতো যুদ্ধ করছি। যেদিন যুদ্ধে জিতব সেদিন স্বাধীন হবে।
- তাহলে আমরাও যুদ্ধ করব।
- তোরাও যুদ্ধ করবি! ওহ্ স্বাধীনতা, স্বাধীনতা! হাসতে হাসতে ওদের মাথার ওপর হাত রাখে অঞ্জন। ছেলেরা হাততালি দিতে দিতে চেঁচিয়ে বলে, স্বাধীনতা, স্বাধীনতা। ওদের হাততালি থামলে অঞ্জন বলে, তোরা আমার সঙ্গে গান কর।
- কি গান? আমরাতো গান গাইতে জানি না।
- আমার সঙ্গে গাইবি।
- আচ্ছা, আচ্ছা -
অঞ্জন গাইতে শুরু করে, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি -’
এক লাইন গানে মুখর হয়ে ওঠে শরণার্থী এলাকা। শিশুদের কণ্ঠস্বর প্লাবিত করে বেঁচে থাকার সমুদ্র। চারপাশ থেকে লোকজন বেরিয়ে ওদের ঘিরে দাঁড়ায়। কেউ কেউ অঞ্জনকে বলে, পুরো গানটা গেয়ে শোনান।
- আমার মুখস্থ নাই। আপনারাও একটা লাইন গান।
- আপনি আবার শুরু করেন।
অঞ্জন আবার শুরু করে।
সবার কণ্ঠে সুরের ছোঁয়ায় ধ্বনিত হয় ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ কিছুক্ষণ পর গান থামলে শব্দ হতে থাকে, সোনার বাংলা, সোনার বাংলা, আমার সোনার বাংলা। লোকজন নানাভাবে উচ্চারণ করে। ভেসে ওঠে মানুষের আবেগের ধ্বনি। অঞ্জন অভিভূত হয়। শুনতে ভালো লাগে। দু’কান পেতে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। একসময় গাছের কান্ডে মাথা ঘঁষে। দেখতে পায় সোনার বাংলা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে সবাই। যে যেদিকে যাক না কেন সবার বুকের ভেতরে শব্দ দুটি এক হয়ে থাকে। বিশাল মাত্রায় ফুলের মতো ফুটে থাকে। সৌরভ ছড়িয়ে যায় বিশ্বজুড়ে। অঞ্জন নিজের ভাবনায় আলোকিত হয়ে উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। দ্রæতপায়ে হাঁটতে থাকে যশোর রোড ধরে। এখান থেকেই একদিন স্বাধীন দেশে ফিরবে। এই প্রত্যাশা বুকের ভেতর ঢং ঢং করে। তখন রাস্তার ধার থেকে একজন নারী দৌঁড়ে আসে।
- ডাক্তার সাহেব -
- কি হয়েছে বুবু?
- আমার স্বামীর জ্বর এসেছে। কাশিও হচ্ছে।
- চলেন দেখি -
দুজনে একসঙ্গে হেঁটে যায়। তাঁবুতে ঢুকে রোগীর পাশে বসে পড়ে অঞ্জন। পকেট থেকে থার্মোমিটার বের করে জ্বর দেখে। দেখতে পায় প্রবল জ্বরে আক্রান্ত আমিন মিয়া। জ্বর দেখে নিজেই আঁতকে ওঠে। কিন্তু মুখে কিছু বলেনা। পকেট থেকে জ্বরের ওষুধ বের করে পানি নিয়ে খাইয়ে দেয়। বাকি ওষুধ সখিনার হাতে দিয়ে বলে, বুবু এগুলো রাখেন। সকাল দুপুর রাতে একটি করে খাওয়াবেন। আমি যাই। দরকার হলে আমাকে ডাকবেন।
- আচ্ছা, ঠিক আছে।
অঞ্জন যশোর রোডে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকায়। হাঁটতে হাঁটতে কখনো পায়ের ধুলো ঝাড়ে। একসময় মনে হয় শরীরজুড়ে ধুলো মাখিয়ে নিলে মনে হবে স্বাধীন দেশকে ধারণ করেছে বুকের ভেতর। তখন বিভিন্ন তাঁবু থেকে শিশুদের কান্নার শব্দ ভেসে আসে। দ্রæতপায়ে হেঁটে যায় এক এক তাঁবুতে। ওদের কি হয়েছে, নাকি কিছু হয়নি। নিজেকে এমন প্রশ্ন করে বিব্রত হয় অঞ্জন। একটি তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে বাচ্চাটির?
ওর মা মাথা নাড়িয়ে চোখ মুছে বলে, ছেলেটার জ্বর এসেছে। কি খাওয়াব জানিনা। আমার কাছে কোনো খাবার নাই। ওতো অনেক কিছু খেতে চায়?
অঞ্জন পকেট থেকে থার্মোমিটার বের করে বলে, দেখি কত জ্বর আছে?
- দেখেন, দেখেন। মা ছেলেটিকে কোলে তুলে ধরে।
অঞ্জন মাটিতে বসে বাচ্চাটিকে নিজের কোলে নেয়। থার্মোমিটার বগলের নিচে দিয়ে ওকে দুহাতের মাঝে আটকে রাখে। ছেলেটি চোখ বুঁজে মাথা নেতিয়ে পড়ে। থার্মোমিটারে একশর উপরে জ্ব র দেখে ওর মাথা গুমগুম করে ওঠে। দ্রæত ওষুধ সংগ্রহের জন্য যেতে হবে। নইলে জ্বরের ঘোরে ও বাঁচবে বলে মনে হয়না। ওর বিষণœ মুখের দিকে তাকিয়ে মা বলে, ওষুধ কোথায় পাব?
- আমি দেখছি। আমি যাব ওষুধ আনতে। এখন আসি।
দ্রæতপায়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে ও কান্নারত আর এক শিশুর কাছে যায়। তাঁবুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বেরিয়ে আসে ওর বাবা।
- কি হয়েছে বাচ্চাটার? কাঁদে কেন?
- বলে যে পেট ব্যথা করছে।
এবং এই পর্যন্ত সংশোধণ করা হলো
- কি খাইয়েছেন?
- আমি জানিনা, ওর মা জানে।
হঠাৎ করে কান্না থেকে যায়। গড়িয়ে পড়ে ছেলেটি।
অঞ্জন আঁতকে উঠে বলে, কি হলো?
- কি আর হবে, কান্না বন্ধ করেছে।
- আপনি ওকে বাইরে নিয়ে আসেন।
মুজাফফর ভেতরে ঢুকে ছেলেকে কোলে করে বাইয়ে আনে। বুকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। অঞ্জন ওকে কোলে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখে যে, মরে গেছে বাচ্চাটি। ও মুখে কিছু বলেনা। শরণার্থী শিবিরে এমন মৃত্যু প্রায়ই দেখতে হয়। কিছু করার উপায় নাই। মুহূর্তে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে ওর বাবা। পেছন থেকে ওর মাও। মৃত শিশুটিকে ওদের কোলে দিতে হবে এই ভাবনা ওকে মর্মাহত করে। সেজন্য শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে রাখে। চোখ থেকে জল ঝরতে শুরু করে। অঞ্জন তাঁবুর সামনে এসে দাঁড়ায়। দুকান ভরে বাবা-মায়ের কান্নার শব্দ শোনে। এ কান্না থামানোর জন্য কিছু বলার নেই। এখন বুকের ভেতরে নদীর ¯্রােতের মতো বয়ে যাবে কান্নার ঢেউ।
ছেলেকে কোলে নিয়ে মুজাফফর এগিয়ে যেতে থাকে। ধানক্ষেতের পাশে গিয়ে বসে পড়ে। মৃত ছেলেকে কোলে রাখে। আশপাশের থেকে লোকজন আসতে শুরু করে। কেউ কেউ মুজাফফরের পাশে বসে। বাকিরা এদিক ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কোনো কথা বলে না। মৃত ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে থাকা বাবাকে কি বলবে? কবর দিতে হবে এটাতো বাবাই ভালো জানে। বলবে কি, একটা কি কবর খুঁড়ে দেব? না, সে কথা কেই বলবে না। এখানে খোঁড়া হবে না, গর্ত খুঁড়তে হবে। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তখন মুজাফফর ছেলে ঘাসের ওপর শুইয়ে রেখে বলে, আসেন আমরা জানাজা পড়ি।
- এটাতো জানাজা পড়ার জায়গা না। সবাই একসঙ্গে দাঁড়াতে পারব না।
- সেটাতো আমিও দেখছি। যেখানে পারি এলোমেলোভাবে দাঁড়াই। তাও জানাজা হোক। সবাই ধানক্ষেতের পাশে এলোমেলোভাবে দাঁড়ায়। সবাই যারা যার মতো করে সুরা পড়ে। আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে সবার কন্ঠস্বর। সুরার শব্দ শুনে বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে আসে অনেকে। তারাও মাথায় টুপি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সকলের বুকের ভেতর তড়পায় শোক। ঘাসের ওপর রেখে দেয়া শিশুটির দিকে তাকালে পানিতে চোখ ভরে যায়।
একসময় শেষ হয় দাঁড়িয়ে থাকা। তারপর দা দিয়ে গর্ত খোঁড়ে কেউ কেউ। মাজাফফর ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকে। মৃদুস্বরে সুরা পড়ে ছেলের সারা গায়ে ফুঁ দিয়ে। চোখের পানি মুখে শেস করতে পারে না। মোছার চেষ্টাও করে না। লুৎফা তাঁবুতে গড়াগড়ি করে কাঁদে। ভাবে, তাঁবুতে ফিরলে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখবে। বলবে, কেঁদো না গো। তোমাকে আর একটি ছেলে উপহার দিব। পরক্ষণে ভাবে, লুৎফা কি মানবে এমন কথা? ও বলবে আল্লাহর কাছে চাও। নামাজ পড় আর চাও। আল্লাহর রহমত হলে আমরা আর একটি ছেলে না হয় একটি মেয়ে পাব। মুজাফফর নিজের ভাবনায় ¤øান হয়ে যায়। লুৎফার কাছে এমন কথা শুনতে চায় না ও। সুতরাং ছেলে উপহার দেবে এমন কথা বলা মানে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করা। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে মুজাফফর। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ কোনো কথা বলেনা। দেখতে পায় মুজাফফর ছেলেটিকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে আছে কঠিনভাবে, যেন ওকে কবরে নামাবেনা। এভাবে নিজের বুকে রেখে দিন কাটাবে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাবিবুর ওর পাশে বসে বলে, ছেলেটিকে আমার কাছে দাও। আমি কবরে নামাই।
- না, আমি নামাব। আমি ওকে সুন্দর করে শুইয়ে দেব। যেন ওর কোনো কষ্ট না হয়।
- মাটিতে শোয়ালেতো কষ্ট হবে।
- তাহলে একটা ছোট চাদর নিয়ে আসি।
- না, খবরদার না, কবরে এসব চলবে না। তুমি কি আগে কখনো কবর দেয়া দেখনি?
- হাবিবুর চুপ করে থাক। আমার সঙ্গে কথা বলোনা।
- হ্যাঁ, চুপ করলাম। তুমিও চুপ করো। মরে যাওয়া একটি শিশুর আবার কষ্ট কি?
- তাতো ঠিকই বলেছো। কষ্ট থাকবে বেঁচে থাকা সবার। মৃত্যু মানে কষ্টের বাইরে চলে যাওয়া।
- এত কথা না বলে আমার মানিককে কবর দেই। গর্ত খুঁড়ি। তোমরা ওর জন্য দোয় কর। সবাই বসে পড়ে যে যার মতো দোয়া করো। মৃত ছেলেকে কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে রেখে বাবা ওকে কবরে নামায়। তারপর দুহাতে মাটি টেনে দেয়। টানা শেস হলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। দুহাতে মুখ ঢেকে রাখে। তার চিৎকার ছড়িয়ে যায় চারদিকে। আশপাশ থেকে অনেকে এসে তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। পানিভরা চোখে সবার দিকে তাকায় মুজাফফর। দুহাতে চোখের পানি মুখে মাথা ঝাঁকায়। কেউ কোনো কথা বলেনা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মুজাফফার একটুক্ষণ পরে বলে, আমি যাই। বউয়ের অবস্থা দেখি গিয়ে, ওতো কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ হয়ে যায়।
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি যান মুজাফফর ভাই। ভাবীকে সামাল দেন।
মুজাফফর কারো সঙ্গে কথা না বলে দ্রæত পায়ে হাঁটতে শুরু করে। তাঁবুর কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পায় লুৎফা কাঁদছে। কান্নার ধ্বনি বুকের ভেতর গেঁথে নেয় মুজাফফর। তাঁবুর ভেতরে ঢুকে বুকে জড়িয়ে ধরে লুৎফাকে। দুই চোখে চুমু দিয়ে চোখের পানি মুছে দিতে চায়। কিন্তু মোছা হয়না। পানি গড়াতেই থাকে লুৎফার দুই চোখ বেয়ে। ওর মাথা বুকে জড়িয়ে রেখে মুজফফর বলে, আর কেঁদোনা। ছেলের জন্য দোয়া কর।
লুৎফা কথা বলেনা। চুপ করে থাকে।
- কিছু বলছ না কেন?
লুৎফা দুহাতে চোখের পানি মোছে। নিজের মাথা ধাম করে মুজাফফরের ঘাড়ের ওপর রেখে দুহাতে জড়িয়ে ধরে স্বামীকে। সন্তান হারানোর বেদনা কাটিয়ে ওঠা যাবেনা, এমন চিন্তায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। মুজফফর লুৎফাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে, আমাদের ছেলে স্বাধীনতার স্বপ্ন হয়ে মরে গেছে। ওকে আমরা স্মরণ করে বলব, ও আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন, স্বপ্ন।
- ঠিক বলেছো।
লুৎফা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। আমি আমার মরণের আগ পর্যন্ত ওকে স্বাধীনতার স্বপ্ন বলতে থাকব। মুজফফর বউকে ছেড়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের চোখ থেকে পানি গড়ায়। লুৎফা ওর দিকে তাকায়না। ওকে নাস্তা খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভাবে প্রথমে এক চামচ সুজির হালুয়া নিজে ওর মুখে দেবে। মুহূর্তে মনে হয়, যুদ্ধ-জীবন এমনই। মৃত্যুও প্রাণের টান হয়ে দাঁড়ায়। পরক্ষণে নিজেকে বলে, এটা তো যুদ্ধ না স্বাধীনতার স্বপ্ন।
পরক্ষণে এক চামচ সুজির হালুয়া মুজফফরের মুখের সামনে ধরে বলে, খাও। মুজফফর চট করে খেয়ে নেয়। ভাবে, এটা একরকম খাওয়া না, অন্যরকম। হাসতে হাসতে বলে, বেশ করে খাওয়ালে। পেট ভরে না, কিন্তু মন ভরে যায়।
- মন ভরাতেইতো চেয়েছি। চাইলে পেটও ভরাতে পারব। দেব?
- না, না। তোমার ভালোবাসায় মন ভরিয়ে আমি বেঁচে থাকতে চাই।
- বাব্বা, এতবড় কথা বললে।
- বলবইতো। তুমি আমাকে পরীর মতো ভালোবাস। তোমার ভালোবাসায় আমি বাতাসে উড়ি, নদীতে ভাসি, মাটিতে গড়াই।
খিলখিলিয়ে হাসে লুৎফা। হাসতে হাসতে উচ্ছ¡সিত হয়ে ওঠে।
- হাসছ কেন?
- আনন্দে হাসছি। তোমার কথায় আমার বুক ভরে গেছে। কত সুন্দর করে ভালোবাসার কথা বললে তুমি।
- বলবইতো। ভালোবাসা পেলে বলব না কেন? তুমিওতো আমার ভালোবাসা পাও।
- হ্যাঁ, পাইতো। তোমার কথা আমারও কথা। আমরা দুজনে এক হয়ে দাঁড়িয়েছি সংসারের কাঠগড়ায়।
মুজফফর হা-হা করে হাসে। কাঠগড়া শব্দ শুনে মাথা দপ্দপ্ করে ওঠে। লুৎফা হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বলে, হাসছ কেন?
- হাসব না কেন? ভালোবাসার সংসারকে তুমি কাঠগড়া বানালে। আমরা কি আসামী?
লুৎফাও হাসতে হাসতে বলে, হ্যাঁ, আমরা ভালোবাসার সংসারে আসামী। দুজনে দুজনকে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু পারিনা। দুজনে দুজনকে ভালোবাসায় খুন করেছি। ঠিক না?
- হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আমিতো আমার পুরো শরীরের ভালোবাসার রক্ত মেখে আছি।
আমিও ভালোবাসার রক্ত মেখে আছি। এই রক্তের রঙ লাল না গোলাপি।
- আমি মনে করি রক্তের রঙ সবুজ। জীবনভর গাছ-গাছালি, অনেকর রকম ফুল, কত পাখি ডানা মেলে ঘুরে বেড়ায়। আমার সবুজ রঙের ভালোবাসায় সবুজ ছবি ভেসে থাকে। মন ভরে যায় ছবি দেখে। চোখ জুড়িয়ে যায়। তুমি আমার সবুজ প্রকৃতি।
- বাব্বা অনেক কথা বললে।
- এটাতো শুধু কথা না।
- জানি কথা না, ভালোবাসার রক্ত। এই রক্তকে গায়ে মেখে ভালোবাসার বসন্ত বাতাস করি। চলো শুয়ে থাকি। গভীর নিশ্বাস ফেলে ভরিয়ে দেব তাঁবুর ছোট জায়গাটি। বলব, স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে এই নিশ্বাস আমার বসন্ত বাতাস।
- বাব্বা, আজ তোমার মনের দরজা খুলে গেছে। হু-হু করে বেরিয়ে আসছে ভালোবাসার বসন্ত বাসাত। যাই, বাইরে দেখি অন্যরা কি করছে।
মুজফফর তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেলে লুৎফা মাটিতে বিছানা মাদুরের উপর শুয়ে পড়ে। মাথার নিচে বালিশ নেই। ওর মাথা মাটিতে গড়ায়। নিজেকে বলে, মাথায় মাটি নিয়ে স্বাধীন দেশে যাব। আমার দেশের মাটি আমার বুকে থাকবে। আর সব দেশের মাটি মাথায় থাকবে। আমি মাটি থেকে দূরে থাকবনা। মাটি হবে বেঁচে থাকার উৎস। ভাবতে ভাবতে উপুড় হয়ে মাথা দোলায়। বিড়বিড় করে বলে, আমার মাটি আমার দেশ। আমার মাটি আমার স্বাধীনতা, আমার মাটি আমার স্বপ্ন। মাটিতে মাথা ঘঁষতে ঘঁষতে দুচোখ পানিতে ভরে যায়। লুৎফা একসময় গুণগুণ করে গায় - ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’ একটি লাইনই অনেকক্ষণ ধরে গাইতে থাকে। মাটি আর গানের সুরে ওর শরণার্থী জীবন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ওর মাথা সোজা করার ইচ্ছা হয়না। একটুপরে মুজফফর ফিরে এসে তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। লুৎফার কন্ঠ থেকে ভেসে আসা গানের মাধুর্য ওকে বিমোহিত করে রাখে। ওর ভেতরে ঢোকার ইচ্ছা হয় না। কারণ ওকে দেখলে থেকে যাবে লুৎফার প্রাণঢালা সঙ্গীত। ও তখন ওর সঙ্গে নানা কথা বলা শুরু করবে। তারচেয়ে এই গুণগুণ ধ্বণি অনেক বেশি আনন্দের। মুজাফফর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নিজেও মাটির ভাবনায় আপ্লুত হয়। একসময় থেমে যায় লুৎফার কন্ঠস্বর। মুজফফর সঙ্গে সঙ্গে তাঁবুর ভেতর ঢোকে। লুৎফা তখনও মাটিতে শুয়ে আছে। মুজফফর পাশে গিয়ে বসে পিঠে হাত রেখে বলে, চলো দুজনে মিলে গানের লাইনটা গাই। তোমার গান আমার বুকের ভেতর নাড়িয়ে দিয়েছে। এই মাটির টানে আমরা স্বাধীন দেশে যাব।

 

চলবে

 

শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৩)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৪)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৫)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৬)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৭)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৮)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৯)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১০)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১১)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১২)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৩)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৪)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৫)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৬)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৭)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৮)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৯)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২০)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২১)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২২)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৩)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৪)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top