সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব একুশ) : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:২০

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৩৫

 

প্যারিস জীবন

লন্ডন বা প্যারিস আসার আগে দীর্ঘদিন যাবত জুলিয়াঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। আমার পুরস্কার প্রাপ্তির খবরও সম্ভবত তার জানা নেই। সুতরাং পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্যারিসের অর্লি এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করার জন্য তার থাকারও কথা নয়। প্যারিস কলেজ অব আর্ট থেকে আমাকে স্বাগত জানাতে এসেছিল গাইড সুদর্শনা তরুণী সোফি। স্বর্ণকেশী সোফি প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ করার মতো মেয়ে। সুদন্তা হাসিতে সে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল। নিজের মাতৃভাষা ছাড়াও ইংরেজি ভাষা কথনে তার কোনো জড়তা নেই। সোফি আমাকে নিতে প্যারিস কলেজ অব আর্টস এর গাড়ি নিয়ে এসেছে। গাড়ি চালক সে নিজেই। অর্লি এয়ারপোর্টে থেকে প্যারিস কলেজ অব আর্টস এর দূরত্ব প্রায় বিশ কিলোমিটার। উজ্জ্বল প্যারি শহরের দৃশ্য দেখতে দেখতে আর সোফির সঙ্গে নানা কথা বলতে বলতে সেন্ট্রাল মুনসিটি পেরিয়ে পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বিশাল, সুদৃশ্য প্যারিস কলেজ আর্টস এ। এবার আমার দু সপ্তাহের থাকার ব্যবস্থা কলেজের ডরমিটরি গেস্ট হাউজে। সোফি আমাকে রিসেপশন সেন্টারে নিয়ে গিয়ে আমার পাসপোর্টসহ নাম এন্ট্রি করে চাবি দিয়ে আমার জন্যে নির্ধারিত গেস্ট হাউজের সুসজ্জিত রুমটি বুঝিয়ে দিল। তারপর আমাকে নিয়ে গেল ক্যাফেটেরিয়াতে। এখানে সকাল, দুপুর, রাত্রে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের জন্যে খুব কম খরচে আহরাদীর ব্যবস্থা। কলেজ কম্পাউন্ডের বাইরেও বেশ কয়েকটি হোটেল, ক্যাফে, রেস্তোঁরা আছে সেখানেও খাবারের সুব্যবস্থা আছে। যেহেতু আমি কলেজের বিশেষ অতিথি, আমি আমার গেষ্ট রুমের কার্ড ব্যবহার করে যেখানে ইচ্ছে খেতে পারি।

কলেজ অব আর্টস এর ক্যাফেটেরিয়াতে আমি সামান্য কিছু খেলাম। সোফি শুধু এক কাপ কফি পান করল আমাকে সঙ্গ দেবার জন্যে। তারপর শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিল। বলে গেল, দেখা হবে আগামী কাল সকালে।

পরদিন সকালে সোফি আমাকে নিয়ে গেল কলেজ অব আর্টস এর মিলনায়তন কক্ষে। সেখানে আমাকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন কলেজের চেয়ারম্যান, ডিন, শিক্ষকবৃন্দ, কিছু চিত্র সমালোচক ও পত্র-পত্রিকার কয়েকজন সাংবাদিক। স্ট্যান্ডে শোভা পাচ্ছে আমার অঙ্কিত, পুরস্কারপ্রাপ্ত সেই ব্লু কোশ্চেন ছবিটি। বিমূর্ত এই ছবিটিতে তিনটি জিনিস ধরা পড়ে, একটি হচ্ছে শিশুটির নীল চোখে যেন আকাশের নীলের কাছে বিস্মিত প্রশ্ন, মাথার ওপরে একটি কাকের উড়োউড়ি এবং একটি হিংস্র দাঁতাল কুকুরের মুখ ব্যাদান আর চিৎকার।

সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে একজন প্রতিভাবান, নবীন চিত্র শিল্পী হিসাবে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন কলেজের চেয়ারম্যান মশিঁয়ে এতোঁয়ান এবং ডিন মশিঁয়ে দানিয়েল। মশিঁয়ে দানিয়েল নিজেই একজন বিখ্যাত চিত্র শিল্পী ও অভিজ্ঞ চিত্র সমালোচক। তিনি এই ব্লু কোশ্চেন ছবির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বললেন, সদ্যোজাত অবাঞ্ছিত শিশুটি তার বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে আকাশের কাছে যে প্রশ্ন রেখেছে সেই প্রশ্ন আমাদেরও প্রশ্ন আমাদের অমানবিকতা, পচা-গলা সমাজ, সভ্যতার কাছে। ব্যতিক্রমী বক্তব্য, বিমূর্ত পদ্ধতির অঙ্কন শৈলী, রং ব্যবহারের সংযমে ছবিটি জুরি বোর্ডকে, আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করেছে এবং এটা আমাদের প্রদর্শনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি হিসাবে নির্বাচিত করেছি।

সবার করতালিতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলঘর। আমি মাথা নুইয়ে সবাইকে অভিবাদন জানালাম।

একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, আপনার তিনটি ছবিতেই একটা বিষাদের সুর, বিষণ্ন সংগীতের ধ্বনি আর হতাশার ছায়া। কেন?

আমি উত্তরে বললাম, পচা পাঁকে যেমন পদ্ম ফোটে, তেমনি যন্ত্রণার মধ্যেই সৃষ্টি হয় শিল্পের। বিষাদের মধ্যেই আমার জন্ম, আমার জীবন, আমার বড় হয়ে ওঠা। হতাশা আর দারিদ্র নেই, কষ্ট নেই, শুধুই আনন্দ উল্লাস সেখানে কোনো মহৎ শিল্পের সৃষ্টি হয় না। আমার দুঃখ, কষ্ট, সংগ্রাম ছিল বলেই আজ আমি সামান্য রিক্শ পেইন্টার থেকে প্যারিস কলেজ অব আর্টস পর্যন্ত আসতে পেরেছি, আপনাদের অভিনন্দনে সিক্ত হয়ে পেরেছি। তবে এটা আমার শিল্পী জীবনের পরম ও শেষ প্রাপ্তি নয়। আমি একজন বড় শিল্পী হতে চাই।

একজন শিল্পী প্রশ্ন করলেন, কত বড় শিল্পী?

আমি বললাম, আপাদের আইফেল টাওয়ারের চাইতেও উচ্চতায় কিন্তু দ্য ভিঞ্চির মতো, পিকাসোর মতো, ভ্যানগগেঁর মতো অতো উচ্চতায় নয়, ওদের মতো আকাশ ছুঁয়ে দেবার ক্ষমতা আমার নেই।

প্রশ্নোত্তর শেষে আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ, পদক ও ওয়ান মিলিয়ন ফ্রাঁর একটি চেক প্রদান করা হল। মনে হল এই প্যারিসে আমি এখন আর কপর্দকহীন বা নির্ধন নই। দান দান তিন দান। ভাগ্যের জুয়া খেলায় জিতে গেছে আমার মতো একজন নিঃস্ব রিক্শ পেইন্টার।

এবার আমার প্যারিস ভ্রমণ আর দর্শনীয় স্থানসমূহ দর্শনের পালা। লন্ডনে দিনকয়েক একা একা ঘুরেছি সহজ সরল মানচিত্র নিয়ে। কিন্তু এই বিশাল প্যারিস আমার কাছে জটিল ও দুর্বোধ্য। প্যারিস আর্ট কলেজ থেকে সোফিকে আমার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে গাইড হিসাবে। তবে প্রতিদিন না। বিশেষ কয়েকটি স্থান ও প্রতিষ্ঠান দর্শনের জন্য সোফি আমার গাইড।

আমার ইচ্ছে ছিল জুলিয়াঁর সঙ্গে একবার দেখা করার। জুলিয়াঁ প্যারিতে থাকে না। নিকটবর্তী ভার্সেই সিটিতে থাকে। সোফিকে অনুরোধ করেছিলাম তার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে। কিন্তু সোফি টেলিফোন করে তাকে পায়নি। জুলিয়াঁ সম্ভবত দেশের বাইরে। সোফি জুলিয়াঁকে চেনে। সে তাকে মেসেজ দিয়ে রেখেছে।

সোফির সঙ্গে আমার প্যারিস দর্শন শুরু হল। তার সঙ্গে দেখতে গেলাম লুঁভ এ সেন্টার জরজ পম্পিডু আর্ট গ্যালারিতে, বিখ্যাত তুঁলো মিউজিয়ামে, কানে অবস্থিত মিউসি দেলা ক্যাসতার মিউজিয়াম, রু বোনোপার্তে ন্যাশনাল স্কুল অব ফাইন আর্টস, ন্যাশনাল স্কুল অব অ্যাপ্লায়েড আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটস এ, রুদে উলম এ ন্যাশনাল স্কুল অব ডেকোরেটিভ আর্টসএমনি কিছু বিশেষ নামী চিত্রকলা প্রতিষ্ঠানে, সুসজ্জিত শিল্প শহর শিল্পীপল্লি বারবিজনে। দেখতে দেখতে ছবির জগতে আমি হরিয়ে যাই। দেখার শেষ নেই, অন্ত নেই। মনে হয় আরো দেখি, বার বার দেখি, চিরকাল এই স্বপ্নময়, জাদুময় ছবির ভুবনে কাটিয়ে দিই। কিন্তু দেখার সময় সংক্ষিপ্ত, আমার প্যারিস ভ্রমণের আয়ূও প্রায় শেষ হবার পথে। আনন্দের বদলে এখন আমার বিষণœতা। ছবির এই স্বর্গভুবন ছেড়ে যাবার কথা ভাবতেই আমার ভীষণ কষ্ট শুরু হল। আমি তো এই দেশেই আসতে চেয়েছিলাম, ছবি আঁকা শিখতে চেয়েছিলাম, নামী চিত্রকর হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় সোফির সঙ্গে একবার আইফেল টাওয়ারে উঠেছি, আলোক উজ্জ্বল প্যারিসকে দর্শন করেছি কয়েক মুহূর্তের জন্যে। এই দর্শনই কি আমার শেষ দর্শন? প্যারিস ছেড়ে দেশে ফিরতে এখন মন চায় না। কিন্তু এখানে থাকা কীভাবে সম্ভব? আমি যদি এ দেশে থেকে যেতে চাই তাহলে অবৈধ অভিবাসী হিসাবে সরকারের আগে প্যারিস কলেজ অব আর্টস এর গেস্ট হাউজ থেকে বিদায় করে দেবে। আমাকে পথে নামতে হবে। প্যারিসের জীবন যাত্রা অত্যন্ত ব্যয় বহুল। হোটেল ভাড়া আমার আয়ত্বের বাইরে। এখানে পুরোনো ঢাকার মতো পুরোনো প্যারিস নেই, সস্তার বিউটি বোডিং বা বুড়িগঙ্গার তীরে বাতিল লঞ্চ বা বজরায় ভাসমান হোটেল নেই। অথচ প্যারিসে থাকতে গেলে আমার ছবি আঁকা-আঁকির স্বপ্ন পূরণ করতে হলে ঢাকার বিউটি বোর্ডিং এর মতো একটা এক রুমে এক চৌকির আশ্রয় চাই। সেটা কোথায় পাব? এ বিষয়ে এখন সোফির সঙ্গে পরামর্শ করা অসম্ভব। কারণ আর মাত্র তিনদিন পর সোফি প্যারিস কলেজ অব আর্টস এর গেস্ট হাউজ থেকে উঠিয়ে নিয়ে আমাকে অর্লি এয়ারপোর্টে ছেড়ে দিয়ে বলবে, অখরোয়া-বিদায়।

আইফেল টাওয়ার থেকে ফেরার পথে সোফির গাড়িতে সোফিকে বললাম, সোফি, খুব ক্লান্ত লাগছে। আমরা কি কোথাও একটা কফি শপে বসে কফি পান করতে পারি?

সোফি বলল, নিশ্চয়। কিছু দূরেই এক বাঙালি ভদ্রলোকের কফি শপ আছে। যাবে সেখানে?

বাঙালি শুনে আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম, নিশ্চয় চলো সেখানে।

সোফি বেশ কিছুটা পথ ঘুরে একটা লেনের মোড়ে একটা কফি শপে নিয়ে এল। কফি শপটির নাম ফ্রেন্স ও ইংরেজিতে লেখা, ক্যাফে দ্য বরিশাল্লা। নাম দেখেই বুখতে পারলাম কফি শপের মালিক রসবোধ কফির মতোই- তবে সেটা তিতুকুটে কালো কফি না কি মিষ্টি ফেনায়িত কফি বুঝতে পারব কফি পানের পর।

কফি শপটিতে শুধু কফি নয়, কেক, পেস্ট্রি, প্যাটিসসহ নানা ধরণের হালকা খাবার রয়েছে। কাউন্টারে আছেন একজন ফরাসি মহিলা, ওয়েটার হিসাবে কাজ করছে একজন কালোবর্ণা তরুনী এবং একজন মধ্যবয়ষ্ক বাঙালি চেহারার পুরুষ। আমি আর সোফি কফি আর চিকেন প্যাটিস খাব। পুরুষ ওয়েটার আমাদের টেবিলে এলেন অর্ডার নিতে।

কফি আর প্যাটিসের অর্ডার নিতে নিতে ওয়েটার ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে নম্রস্বরে প্রশ্ন করলেন, মশিয়েঁ এক্সকুঁজে মোয়া, এস ক্য ভূজ এত বঁগ্লাদে? (মাফ করবেন আপনি কি বাংলাদেশি?)।

আমি বিস্মিত কণ্ঠে বললাম, উহ জ্য সুই বঁগলাদে। (হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশি)

ওয়েটার তখন হেসে বললেন, আরে ভাইডি, মুইতো ছেলাম বরিশাল্লা বাংলাদেশি, অহন ফেরেন্সি। মোর নাম নন্দলাল, মোগো বাড়ি বরিশাল, যারে কয় আইতে শাল, যাইতে শাল। হেই শাল শালার দশ বছর ধইরা ফেরেন্সি কথা কইতে কইতে জিহ্বা, মুখ হইয়া গেছে, তিতপুল্লার মতোন খসখস। অহন মনের সুখে আপনার লগে একটু বাংলা কমু। বহেন। ঐ যে কাউন্টারে এক মুটকি খারাইয়া আছেন হেই তিনি আমার বঁধুয়া ফেরেন্সি বেগম। তারে চিন পরিচয় দিয়া আর অর্ডারডা দিয়া আপনার লগে দুইডা সুখ-দুঃখের বাঙলা কথা কমু।

সোফি বিস্মিত চোখে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল। ওয়েটার চলে যেতেই সোফি আমাকে প্রশ্ন করল, এই ওয়েটার নিশ্চয় তোমার বাংলাদেশি মানুষ?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

তোমারা বাংলা ভাষায় কথা বলছিলে?

হ্যাঁ। দেশের মানুষতো দেশের ভাষাতেই কথা বলবে। স্যরি, সোফি তুমি কিছু মনে কোরো না। ভদ্রলোক মনের সুখে বাংলা ভাষাতেই কথা বলতে চাইছেন। লেট আস টক।

সোফি বলল, না না আমি কিচ্ছু মনে করব না। তোমরা কথা বল।

ওয়েটার আমাদের জন্যে শুধু ফেনায়িত চকলেট স্বাদের কফি নয়, সঙ্গে নিয়ে এলেন ডেনিশ পেস্ট্রি, চিকেন প্যাটিস, আর পাই বাদাম।

বললেন, দাদা আর দিদি, আপনেরা আমার শপের অতিথি নারায়ন, মোস্ট অনারেবল গেস্ট। এই যৎসামান্য কফি, প্যাস্ট্রির জন্য কোনো পে করতে হইব না। কারণ এই কফি শপের মালিক আমি আর আমার ঐ মুটকি বউ মোর জানে জান ফেরেন্সি রোঁজে। সো নে টেনশন ফর বিল। এনজয় ইয়োর কফি।

সোফি বিস্মিত ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। আমি বললাম, মশিঁয়ে নন্দলাল এবং ঐ যে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী মাদাম রোঁজে। আমাদেরকে সম্মানিত অতিথি হিসাবে ওরা আমাদের আপ্যায়ন করছেন। সুতরাং স্বচ্ছন্দে আমরা খেতে পারি। সোফি মৃদু হেসে ফরাসি ভাষায় বলল, ওদেরকে বলো খাবার এবং কফি দুটোই সুস্বাদু। আপ্যায়নের জন্যে মশিঁয়ে নন্দলাল এবং তার স্ত্রী রোজেঁকে ধন্যবাদ।

নন্দলাল মাথা ঝুঁকিয়ে ফরাসি ভাষাতেই বললেন, মেখসি অর্থাৎ ধন্যবাদ।

আমাদের কফি পান ও কথার এক ফাঁকে নন্দলাল আমারে নাম, ধাম সব বৃত্তান্ত জানতে চাইলেন। আমি সংক্ষেপে আমার পরিচয়, প্যারিসে আসার কারণ বললাম। নন্দলাল তার চোখ কপালে তুলে বললেন, ও আপনেই সেই শিল্পী যিনি লন্ডন আর প্যারিস থেক্যা তিন তিন খান পুরস্কার পাইছেন! কী তাজ্জব কথা! আপনের মতো গুণী মানুষ আমার কফি শপে! কন আবার কবে আইবেন আমার কফি শপে? এই সুন্দরী বেডিরে লইয়া আইবেন লগে। আপনেরা যা খাইতে চান খাওয়ামু।

আমি হেসে বললাম, তা আর হবে নারে ভাই। আর তিন দিন পরেই আমার বিদায়, গুড বাই প্যারিস।

নন্দলাল মহা আশ্চর্য! কী কন ছুডো ভাই! মাত্র তিন দিন পর প্যারিসরে বিদায়? এইডা কি হয়? আরে মানুষ প্যারিস আসার পাগল, থাকনের পাগল। আর আপনে কন বিদায়? উহুঁ বিদায় বিদায় নয়। এইহানে যেমনে পারেন মাটি কামড়াইয়া পইড়া থাহেন।

সম্ভব না। প্যারিসের পুলিশ আমাকে ঘাড় ধরে প্লেনে উঠিতে দেবে।

 

ধুৎ কি যে কন ছুড়ো ভাই। কত দেশের কত মানুষ এই হনে মাটি কামড়াইয়া পইড়া থাকতাছে, কত কামের ধান্দা করতাছে, আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়া সিটিজেন হইয়া যাইতেছে। কেডা ঠ্যাকায়? আমারে কি পারছে? পাট ব্যবসায়ী বাবার পাট ব্যবসার ধান্দা লইয়া দশ বচ্ছর আগে এই প্যারিসে আসছিলাম। বহুত পয়সা উড়াইয়া শেষে ঐ মুটকিরে পটকাইয়া বিয়া কইরা আমি অহন পার্মানেন্ট সিটিজেন। বউয়ের টাকায় আমার বাড়ি, গাড়ি, কফি শপ, কুনো কিছুর অভাব নাই।

আমি হেসে বললাম, আপনি ভাগ্যবান। মাদাম রোজেঁ আপনাকে ভালোবেসে সব উজাড় করে দিয়েছেন। কিন্তু আমি হতভাগ্য আমাকে ভালোবাসার কেউ নেই, সবকিছু উজাড় করে দেবারও কেউ নেই।

সোফি খেতে খেতে বোধহয় মৃদু হাসিতে আমার দিকে তাকাল।

নন্দলাল ইঙ্গিতপূর্ণ হাসিতে বললেন, ক্যান আপনার পাশেই তো এই একখান দারুণ সুন্দরী বেডি আছে। আপনেও তো সুন্দর যুবক, গুণী শিল্পী। ভালোবাসার খুব সুন্দর সুন্দর ডায়ালগ দিয়া পটকাইয়া ফ্যালান।

সোফির মুখে প্যাটিস। সে যেন বিষম খেল। তারপর সামলে নিল নিজেকে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে বিষমকে সামলাল।

আমি সোফির বিষম খাওয়া দেখে একটু চমকে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, সোফি, আর ইউ ওকে?

সোফি মাথা নেড়ে বলল, ইয়েস আ অ্যাম ওকে। ফাইন।

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নন্দলালকে বললাম, দাদা, ইনি যেমন তেমনভাবে পটে যাবার মেয়ে নন। ইনি মাত্র কয়েকদিনের জন্যে আমার পথসঙ্গী। খুব ভদ্র। আমি ভাগ্যবান যে তার মতো সঙ্গী পেয়েছি। তাকে প্রেম নিবেদন করে আমি না নিজে ছোট হতে চাই, না তাকে ছোট করতে চাই। ভালো বন্ধু হিসাবে বন্ধুর মতোই বিদায় নিতে চাই।

নন্দলাল চিন্তিত স্বরে বললেন, আপনাগো মতন ন্যায়বান বোকা সোকা মানুষ লইয়া মুশকিল। তা আপনের ভিসা কয়দিনের?

আমি বললাম, এই তো মাত্র আর তিনদিনের।

নন্দলাল বললেন, আপনে কালই পাসপোর্ট নিয়া যান বাংলাদেশ এমবাসিতে। তাগো আপনার পরিচয় দিয়া একটা লেটার অব রিকমেন্ডশন নিয়া ফ্রান্সের ফরেন মিনিস্ট্রিতে যান, অন্তত আপাতত ছয় মাসের ভিসার মেয়াদ বাড়াইয়া লন।

- কোন কারণে, তারা আমার ভিসার মেয়াদ বাড়াবে?

- এই প্যারিসের বিভিন্ন আর্ট ইনস্টিটিউটে আপনে আগে নিশ্চয় অনেক ছবি পাঠাইছেন? না কি?

- হ্যাঁ পাঠিয়েছি।

- কত গুলান?

- হিসেবে মনে নেই। গোটা তিরিশেক হবে?

- আপনি সেই সব আর্ট স্কুল আর ইনস্টিটিউটে গিয়া আপনের সব পুরান ছবি ফেরত দিবার দাবি জানাইবেন। লিগ্যাল নোটিশ দিবেন। এই দাবি পেশ, আইনি লড়াই আর ছবি উদ্ধারের জন্য সময়ের প্রয়োজন।

আমি হেসে উঠলাম। বললাম, পুরাতন, বাতিল ছবি দাবি করে আমার কী লাভ?

নন্দলাল বললেন, ভাইডি, এই দেশ হইল অতি চালাকের দেশ। বিভিন্ন দেশ হইতে যেই সব ছবি প্যারিসের আর্ট স্কুল, আর্ট ফাউন্ডেশন আয়োজিত প্রদর্শনী মেলায় আসে, তার মধ্যে কিছু ছবি পুরস্কার পায়। কিছু ছবি বিক্রয় হয়, আর বাকি সব ছবি বাতিলের খাতায় চইলা যায়। সেই সব বাতিল ছবি আর্টশপের এজেন্টরা লট ধইরা কমদামে কিন্না নিয়া আর্ট শপে বিক্রি কইরা দেয়। আর্টশপ গুলান সেই ছবি ট্যুরিস্টগো কাছে দ্বিগুন দামে বেচাবিক্রি করে। মাঝখানে আসল শিল্পীরা খায় ধোঁকাবাজির কাঁচাকলা। কারণ তাগো পক্ষে তো সম্ভব না তাগো বাতিল ছবির ঠিকানা বাইর করা। আপনিও পারবেন না। তবু এই অজুহাতে যদ্দিন পারেন এই দেশে থাকনের চেষ্টা করেন। সেই সঙ্গে অন্য রুজি রোজগারের চেষ্টা করেন।

- তা না হয় করলাম। কিন্তু তিনদিন পর প্যারিস কলেজ অব আর্টস এর গেস্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তখন থাকব কোথায়?

-  কই থাকবেন? কই থাকবেন?হ্যাঁ এইটা একটা সমস্যা! বিগ কোশ্চেন ...! পুরস্কারের টাকা পয়সা কী করছেন?

- যা পেয়েছিলাম তার অর্দ্ধেকই দেশে বাবার ব্যাংক একাউন্টে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন হাতে যা আছে তা দিয়ে সস্তার হোটেলে বড় জোর মাস দুই চলতে পারে।

- প্যারি হচ্ছে ধনবানদের জায়গা, ট্যুরিস্টদের পয়সা উড়ানোর জায়গা। এইখানে সস্তামস্তা কিছুই নাই।

- তাহলে আপনি আমাকে প্যারিসে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন কেন? আমি কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে অন্ধ সেজে ভিক্ষে করব? রাত্রে ফুটপাথে ঘুমিয়ে থাকব?

- না তা কই না। তয় যদি মন চায় তা হইলে আমার এই কফি শপের পেছনে আমার একটা বিশ্রামঘর আছে উইথ অ্যান অ্যাটাচড বাথরুম সেইখানে আপাতত সপ্তাহখানেক থাকতে পারেন। আমার দেশালি বন্ধু-বান্ধব যারা আসে তাগো আমি এইখানে রাখি কিছু অল্প টাকার বিনিময়ে। আর যদি কষ্ট কইরা বিনা পয়সায় থাকতে ইচ্ছা করেন আমার বাড়ির বেজমেন্টে আপনি মাস দুই থাকতে পারেন।

- বেজমেন্ট কি থাকার উপযুক্ত? আমার প্রশ্ন।

- অনেক বেজমেন্ট আছে বাড়ির মালিকরা ভাড়া দিবার জন্যে উপযুক্ত কইরা রাখে। আবার অনেকে করে না। আমার ফেরেন্সি বেগম এই সব ঝামেলা পোহাইতে চায় না বলে আমি কিছু করতে পারি নাই। তয় ফেরেন্সি বেগমের সঙ্গে আলাপ আলোচনা কইরা তানারে একটু তোয়াজ টোয়াজ কইরা আপনের জন্যে কিছু ব্যবস্থা করতে পারি কিনা হেই চেষ্টা করতে পারি।

- কিছু ব্যবস্থা বলতে কী?

- মানে বেজমেন্ট অতি ঠান্ডা সেলার। আপনার জন্যে সেইখানে রুম হিটার, একখান ফোল্ডিং লোহার খাট, গদি, কম্বল এইসব অ্যারেজমেন্ট কইরা দিবার চেষ্টা করতে পারি। আমি দাদা দিলদরিয়া। কিন্তু আমার ফেরেন্সি বেগম বড় চিপ্টা। আমার মতন দিলদরিয়া না। কিছু ভাড়া তো আপনারে দিতেই হইতে পারে।

- মাসিক কত ভাড়া?

- তা ধরেন আমার সুপারিশে ফেরেন্সি বেগম সন্তুষ্ট আর রাজি হইলে মাসে পাঁচশো ফ্র্যাঁ। এর চাইতে সস্তা আশ্রয় প্যারিসে আপনে কোথাও কিছু পাইবেন না। আসল কথা কই, আপনারে আমি বিনা ভাড়ায়ও রাখতে পারতাম। কিন্তু সেইডা হইতো আপনার নিজেরে ছোডো করা।

আমি চুপ করে রইলাম। সোফির কফি পান শেষ। ও আমার দিকে ঘনঘন তাকাচ্ছে আমি বুঝতে পারছি সে এখন উঠতে চায়।

আমি চিন্তা করছি নন্দলালের বেজমেন্টে মাসে পাঁচশো ফ্র্যাঁ ভাড়া, তারপর রোজ তিনবেলা শুকনো রুটি আর চা খেয়ে আমি প্যারিতে কতদিন টিকে থাকতে পারব? ঝুঁকিটা নেব কি নেব না?

উঠে দাঁড়িয়ে নন্দলালের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললাম, দাদা নন্দ, আজ রাতটা চিন্তা করে দেখি। যদি ভিসার মেয়াদ বাড়াতে পারি তবে আপনার বেজমেন্টে থাকার সিদ্ধান্ত জানাব। আর যদি দেশে ফিরে যেতেই হয় তবে এইখানেই আলবিদা। আপনার আতিথেয়তার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।

নন্দলালের কফি শপ থেকে বেরিয়ে কলেজ অব আর্টস এর গেস্ট হাউজে ফেরার পথে আমি গাড়ির মধ্যে নিশ্চুপ। সোফি গাড়ি চালাচ্ছে। আমি রাস্তার দুপাশের আলো ঝলমল শহর দেখছি। কখনো বা পথের দুধারের সুশোভিত বন দৃশ্য। কিন্তু আমার মন অন্য কোথাও। ভাবছি আমি কি নন্দলালের পরামর্শ মতোই এই বিদেশ বিভূঁয়ে পড়ে থাকব নাকি দেশে ফিরে যাব? দেশে ফিরে যাওয়াই মানে আবার সেই গতানুগতিক জীবন ও দারিদ্র। গত তিনটি বছর কঠোর পরিশ্রমের পর ভাগ্যক্রমে পুরস্কার জুটেছে। কিছু অর্থপ্রাপ্তি ঘটেছে, কিন্তু বার বার এই সৌভাগ্য কি আমার হাতের মুঠোয় ধরা দেবে? কী করব আমি?

আমাকে গভীর চিন্তামগ্ন দেখে সোফি হঠাৎ প্রশ্ন করল, মশিঁয়ে তাইমুর হোয়াটস ইন ইয়োর মাইন্ড? তারপর আচমকা বাংলায় বলে উঠল, কী ভাবছ তুমি?

ওর মুখে বাংলা প্রশ্ন শুনে আমি যেন বিদ্যুতের শক খাবার মতো চমকে উঠলাম। বিমূঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, এই ... তুমি বাংলা জানো?

হ্যাঁ জানি। আমি গাইড, দোভাষী। আমাদের সব ভাষাই কিছু কিছু জানতে হয়।

আমি তোতলালাম, তা.. তাহলে এতদিন বলনি কেন?

- বলিনি। কারণ, তুমি বাঙালি। ফ্রেন্স ভাষা জানো, ইংরেজি ভাষা জানো তাই বলিনি। আমার বাংলা ভাষা জানার কথাটা তুমি যদি জানতে তাহলে তুমি আর মশিঁয়ে নন্দলাল আমাকে বোকা ভেবে যে সব গল্প, আলাপ আলোচনা করলে তা কি করতে? না। করতে না। আমি সবই বুঝেছি। কফি, প্যাটিসের সাথে বিষমও খেয়েছি। তবে নন্দলালের একটা কথা বুঝিনি, যেটা হচ্ছে, মোগো বাড়ি বরিশাল, মোগো আইতে শাল যাইতে শাল। এই কথাটার মানে কি?

আমি অসহায়ের মতো সোফির দিকে তাকালাম। মনে মনে বললাম, হায় মেয়ে তুমি বাংলা জানো তা কি আমি জানতাম? নন্দলালের বরিশালি শাল এখন আমার পশ্চাৎদেশে।

মুখে ক্লিষ্ট হাসি ফুটিয়ে বললাম, এটা আমাদের দেশে বরিশাল জেলার মানুষের একটা সরস বচন, ইটস এ ফানি টক। জানতে চেয়ো না।

সোফি বলল, ও. কে। ফরগেট ইট। এখন বলবে কি তুমি মশিঁয়ে নন্দলালের পরামর্শ মতো এই দেশের তার বেজমেন্টে থাকবে নাকি দেশে ফিরে যাবে?

আমি অসহায় কণ্ঠে বললাম, সোফি আমি বুঝতে পারছি না আমি কী করব? তুমি কী বল?

- বলব, তার আগে বল নন্দলাল ঐ যে ‘বেডি’ শব্দটা উচ্চারণ করেছিল ওটার মানে কী?

- ‘বেডি’ শব্দটা আঞ্চলিক ভাষা। মানে হচ্ছে মেয়ে।

- আর ‘বিয়া’ শব্দের মানে?

-এর মানে হচ্ছে বিবাহ, মানে ম্যারেজ।

আমার শব্দার্থ শুনে সোফি খিল খিল করে হেসে উঠল। বলল, নন্দলালের পরামর্শ মতো তুমি তার মতোই কোনো বেডিরে বিয়া করতে পারো। এই ফ্র্যান্সে তোমার থাকার ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে যাবে।

আমি বুঝতে পারলাম ও আমার সঙ্গে রসিকতা করছে। কারণ, নন্দলাল ওকে ইঙ্গিত করেই বিয়ের কথাটা বলেছিল। আমি ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, সোফি আমি দুঃখিত। আমি বুঝতে পারিনি নন্দলাল কাউকে ইঙ্গিত করে এ ধরণের কথা বলবে। আমরা দুজনেই বুঝিনি যে তুমি বাংলা জানো।

সোফি মৃদু হেসে বলল, মশিঁয়ে তাইমুর, ইটস, ও. কে.। তোমার দুঃখ প্রকাশের কিছু নেই। তবে ভবিষ্যতে নন্দলালের সঙ্গে দেখা হলে বলো যে আমি বাংলা বুঝি।

- তা না হয় বলব, কিন্তু এখন আমি কী করব?

- তুমি কি দেশে ফিরে যেতে চাও?

- না।

- তাহলে মশিঁয়ে নন্দলালের দুটো পরামর্শ তোমাকে মানতেই হবে। এক, তিনদিন পর আমাদের আর্ট কলেজের গেস্ট হাউজ ছেড়ে নন্দলালের বেজমেন্টে তোমাকে আশ্রয় নিতে হবে। আর দু নম্বর হচ্ছে নন্দলালকে বলবে এই দেশে স্থায়ী থাকার জন্যে তার মিসেস ফেরেন্সি বেগমের মতো তোমার জন্যে একটা বেডি আর বিয়ার পাত্রি খুঁজে দিতে।

আমি আহত কণ্ঠে বললাম, সোফি, আমি এই অসহায় অবস্থায় নন্দলালের প্রথম অফারটা মানতে রাজি আছি। তবে দ্বিতীয়টি নয়। আমি এ দেশে বিয়ে করে ঘর সংসার করতে রাজি নই। আমি ছবি আঁকতে চাই, একজন প্রকৃত শিল্পী হতে চাই। তাই ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে বাড়িয়ে যতদিন এ দেশে থাকা যায় তা-ই আমি করব।

- হুম। মশিঁয়ে তাইমুর, তুমি কি পাসপোর্টে ভিসার মেয়াদ লক্ষ করেছে?

- না, তেমন একটা খেয়াল করিনি। শুধু জানি আমার লন্ডন, প্যারিসের ভ্রমণের মেয়াদ একুশ দিনের। আগামী তিনদিন পর আমাকে ঢাকায় ফিরে যেতে হবে।

সোফি হাসল। বলল, তুমি একটা বেখেয়ালি শিল্পী। আমাদের গেস্ট হাউজে তোমাকে চেক-ইন করার সময়ে তোমার পাসপোর্টে দেখেছি তোমার ভিসার মেয়াদ ছয় মাসের।

আমি চমকে উঠলাম, তাই?

- হ্যাঁ। তবে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের টিকিটের মেয়াদ একুশ দিনের।

- তাহলে?

- তুমি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের লোকাল অফিসে টেলিফোনে রিকোয়েস্ট কর, মেসেজ দাও টু চেঞ্জ ইয়োর ফ্লাইট ডেট বিফোর সিক্স মানথ। আই হোপ দে উইল ডু ইট। সুতরাং তুমি নিশ্চিন্তে আগামী পাঁচ মাস সাতদিন এই দেশে থাকতে পারছ।

সোফির কথায় আমার বুকের ভেতর দুঃশ্চিন্তার একটি পাথর সরলেও আর একটা পাথর জায়গা জুড়ে বসল। যেন সোফিকে নয়, নিজেকেই প্রশ্ন করলাম? কিন্তু এই পাঁচমাস সাতদিন থাকব কোথায়?

সোফি যেন একটা রোবট নারীর মতো বলল, সেটা তোমার ব্যাপার। প্যারিস কলেজ অব আর্টস আগামী তিন দিন পর তোমার জন্যে একটি ফ্রাঁও ব্যয়  করবে না। তোমাকে গেস্ট রুম ছেড়ে চলে যেতেই হবে। তখন তোমার দেশি বন্ধু নন্দলালের বেজমেন্ট ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

আমি বললাম, তাই হবে সোফি, তাই হবে। তবে আমার একটা আমাদের আজকের সন্ধ্যার এইসব কথা, নন্দলালের কথা, আমার সিদ্ধান্তের কথা তুমি কলেজ অব আর্টস এর ডিন বা চেয়ারম্যানকে জানিয়ো না।

- ওকে, আই উইল কিপ মাই মাউথ শাট। আমার মুখ বন্ধ থাকবে।

আমাকে গেস্ট হাউজে নামিয়ে দিয়ে সোফি বন্নুই (শুভরাত্রি) বলে চলে গেল।

আমার মনে হল সোফি সত্যি একটি রোবট নারী, যন্ত্রের মতো নারী। ও জুলিয়াঁ নয়।

রাত্রে গেস্ট হাউজে শুয়ে বসে বাবা আর জয়ী মাকে একটা ছোট্ট চিঠি লিখলাম,

প্রিয় বাবা আর জয়ী মা, আমার এই মুহূর্তে দেশে ফেরা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ইতোপূর্বে পাঠানো যত ছবি এদেশের বিভিন্ন আর্ট স্কুলে ও প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়েছিলাম তা পুনরুদ্ধার করতে হবে, আমার সব পাওনা বুঝে নিতে হবে, আইনি লড়াই করতে হবে। এর জন্যে প্রয়োজন সময়-হয়তো ছয়মাস বা এক বছর। এর মধ্যে আমার ছবি আঁকা-আঁকির কাজও চলতে থাকবে। আমার জন্যে চিন্তা কোরো না। আমি তোমাদের জন্যে কিছু টাকা পাঠিয়েছি। আরো টাকা পাঠাব। টাকার অভাবে তোমাদের আমি কোনো কষ্ট পেতে দেব না। দোয়া কোরো  যাতে আমি বড় শিল্পী হতে পারি। রিকশা পেইন্টার হিসাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের বদনাম ঘোচাতে পারি। নাজুর জন্যে আমার অনেক ভালোবাসা। বোলো, তার বড়দা একদিন নিশ্চয় ফিরে আসবে।

চিঠিটা আগামী কালই পোস্ট করব। মাত্র আর তিন দিন পর নন্দলালের বাড়ির বেজমেন্টে শুরু হবে আমার অন্য জীবন, সংগ্রামের অন্য অধ্যায়।

চলবে

 

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব তিন)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পাঁচ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ছয়)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব সাত)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আট)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব নয়)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব দশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব এগার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব তের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চৌদ্দ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পনের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ষোল)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব সতের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আঠারো)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব উনিশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বিশ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top