সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৬) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
২৭ ডিসেম্বর ২০২২ ১৮:২৬

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০২:০৫


- স্বাধীন দেশের জন্য তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে।
- যুদ্ধ করার জন্য অস্ত্র চালানো শিখতে হবে। কোথায় শিখব জানিনাতো।
- আশেপাশে খোঁজ নিয়ে দেখনা।
- তাহলে আমি কালকে চৌগাছায় যাব। দেখব কি করতে পারি।
- হ্যাঁ, যাও যাও। আমিও যাব তোমার সঙ্গে।
- তুমি গিয়ে কি করবে?
- যুদ্ধ করব। তোমার সঙ্গে থেকে যা করতে হয় তার সব কাজ করব।
- ঠিক আছে। তাহলে আমরা একসঙ্গেই যাব।
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে লুৎফা। হাসতে হাসতে বলে, আমার ভাগ্য ভালো যে তুমি আমাকে না বলোনি। তুমি না বললে আমি কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যেতাম।
- চলো, যশোর রোডে হেঁটে আসি।
- চলো, দেখি চারদিকের অবস্থা কি।
দুজনে তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়ে। হাত ধরে হাঁটে। মুজফফর মৃদু হেসে বলে, দূর থেকে কেউ দেখলে বলবে আপনার বউ কি হারিয়ে যাবে?
- তাহলে হাত ছেড়ে দাও।
- না, ছাড়বনা। তুমি হারাবে কেন? এটা আমার মাথায় নাই। আমি ভালোবাসার হাত ধরেছি।
লুৎফা দুজনের হাত বুকে চেপে ধরে। মুজফফর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, আর হাত ধরে হাঁটবনা। লোকে হাসবে। দুজনে চুপচাপ হেঁটে এগোয়। দেখতে পায় অঞ্জন গাছের নিচে বসে খবর শুনছে। মুজফফর আর লুৎফা ওর সামনে গিয়ে বসে।
- কি খবর শুনছেন অঞ্জন ভাই?
- খবরটা আমেরিকার। ওখানে নিউইয়র্কে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গানের আসর অনুষ্ঠিত হয়। বলা হয় কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। সব টিকিট বিক্রি হয়েছে।
লুৎফা চেঁচিয়ে বলে, দারুণ খবর জানালেন অঞ্জন ভাই।
- আরও বড় খবর আছে ভাবী। এই টাকা ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের দেয়া হবে। ওখানে একজন গায়ক একটি গান গেয়েছেন যে গানের লাইনে ছিল বাংলাদেশ বাংলাদেশ।
মুজফফর লাফ দিয়ে দুহাত উপরে তুলে বলে, আমরা এখনও স্বাধীন হইনি। কিন্তু দুনিয়ার মানুষের কাছে বাংলাদেশ নাম পৌঁছে গেছে। ওহ্ গানটা শুনলে আমরাও গাইতাম বাংলাদেশ বাংলাদেশ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সবাই হাততালি দিয়ে লাফালাফি করে। চিৎকার করে বলতে থাকে, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। চারদিক থেকে লোকজন এগিয়ে আসে - সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। তিনটি শব্দ আকাশ-বাতাস তোলপাড় করে। যারা শব্দ তিনটি বুঝতে পারেনা তারা অঞ্জনকে বলে, অঞ্জন ভাই আমাদেরকে বলেন কনসার্ট ফর বাংলাদেশ কি? অঞ্জন ওদেরকে বুঝিয়ে দিলে সবাই একসঙ্গে বলে, দুনিয়ার সামনে বাংলাদেশ ফুটে উঠেছে। আমাদের স্বাধীনতার দেরী নাই। আমরা যশোর রোড থেকে মিছিল করে স্বাধীন দেশে ঢুকব। হুররে, বাংলাদেশ বাংলাদেশ।
সবাই চিৎকার করতে করতে যে যার পথে যেতে শুরু করে। বাংলাদেশ শব্দে মুখর হয়ে ওঠে যশোর রোড। মুজফফর আর লুৎফা হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সীমান্ত পর্যন্ত যায়। লুৎফা মাটিতে বসে পড়ে দেশের মাটিতে মাথা ঠেকায়। কপালে লেগে থাকে মাটির ছোঁয়া।
মুজফফর ওর দিকে তাকিয়ে বলে তাঁবুতে ফিরলে কপালের মাটি পুরো মাথায় ঘঁষে দিও।
- এখনই দিব। মাথা ভরে যাক মাটিতে।
লুৎফা কপালে লেগে থাকা মাটি টেনে মাথার চুল মাখায়। পেছন থেকে চুল টেনে কপালের মাটি মোছে। একসময় ধপ করে বসে পড়ে মাটিতে হাত ঘঁষে চুলে লাগায়।
মুজফফর ধমক দিয়ে বলে, বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এত মাটি লাগালে চুল নষ্ট হবে।
- নষ্ট হলে আমার চুল হবে। তোমার কি?
- আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার মন খারাপ হচ্ছে। চলো ওই দূরের পানিতে তোমাকে নিয়ে যাই। ওখানে গিয়ে মাথা ধুয়ে ফেল।
- ধুয়ে ফেলবনা। মাটি আর পানি এক করব।
- এটাইতো মাথা থেকে সরিয়ে দেয়া।
- হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছ। মাটিকে পানিতে মিশিয়ে দিলে পানি মাটিকে ওর তলদেশে নিয়ে যাবে।
- চলো, চলো। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকার দরকার নাই।
- আমি পানিতে নামবনা। আমার মাথায় মাটি থাকবে। তাঁবুতে ফিরে খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়ব।
- মাথায় মাটি নিয়ে ঘুম আসবে?
- আসবে। মনে করব স্বাধীন দেশকে মাথায় নিয়ে ঘুমাচ্ছি।
মুজাফফর আর কথা বলেনা। বুঝতে পারে এসব দিয়ে কথা বলে লাভ নেই। লুৎফা নিজের ধারণা থেকে সরবেনা। নিজে যা করেছে তাকে নিজের মতো করে ধরে রাখবে। তবে এটা ঠিক যে ও একটি বড় চিন্তা করছে। নিজেকে ডুবিয়েছে সেই চিন্তায়। ওর সঙ্গে তর্ক করে আর লাভ নেই। মুজফফর ওর হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে। দু’পা হাঁটার পরই লুৎফা হাত ছাড়িয়ে নেয়। মাথা থেকে ঝরতে থাকে মাটির কণা মুজফফর মাঝে মাঝে চুলের সঙ্গে লেগে থাকা মাটি হাত দিয়ে মুছে দেয়।
লুৎফা আপত্তি জানিয়ে বলে, মুছে দিচ্ছ কেন? এটাতো শুধু মাটি না, এটা আমার স্বাধীন দেশ। মাথায় নিয়ে হাঁটছি।
- আচ্ছা, ঠিক আছে। আর মুছবনা। তোমার চিন্তা আমাকেও স্বাধীন দেশের মানুষ করল। তাঁবুতে গিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকব। আজকের শুয়ে থাকা হবে একদম অন্যরকম।
লুৎফা আর কথা বলেনা। দ্রæতপায়ে হাঁটতে থাকে। কাছাকাছি কোথাও থেকে শুনতে পায় গানের সুরে উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশ বাংলাদেশ। দুহাত মাথায় রেখে মুজাফফরের দিকে তাকিয়ে বলে, বাংলাদেশ আমার মাথায়।
- ঠিক বলেছ। তোমার চিন্তায় আমিও ব্যাকুল হয়ে গেছি। চলো দৌড়াই।
- না, দৌড়াবনা। লোকজন কিছু না বুঝে হাসাহাসি করবে।
- হাসুক না, আমাদের কি যায় আসবে-
- আমার খারাপ লাগবে। নিজের কোনো আচরণ দেখে অন্যদের ব্যঙ্গের হাসি আমি সহ্য করতে পারিনা।
- ঠিক বলেছ। আমি আমার জীবনে অনেক কিছু উপেক্ষা করতে চাই। তবে তোমার ভাবনা মান-সম্মানের। তুমি আমার চেয়ে বড় ভাবনায় আছ।
লুৎফা গভীর দৃষ্টিতে মুজফফরের দিকে তাকায়। মুজফফর কথা না বলে নিজের মাথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। দুজনে ধীর গতিতে হাঁটতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেদের তাঁবুতে এসে ঢোকে। লুৎফা গুণগুনিয়ে বলতে থাকে, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।
মুজফফর একসময় ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, মনে রেখ আমরা আর কোনোদিন যেন পূর্ব পাকিস্তান না বলি। আমাদের কাছে পূর্ব পাকিস্তান শব্দ আর থাকবে না।
- ঠিক, ঠিক। বাংলাদেশ বাংলাদেশ -
লুৎফার গানের সুরে উচ্চারিত শব্দ ভরে দেয় তাঁবুর পরিধি। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে। লুৎফা মাথা ঘঁষতে থাকে মুজফফরের বুকে।

চলবে

 

শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৩)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৪)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৫)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৬)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৭)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৮)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৯)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১০)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১১)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১২)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৩)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৪)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৫)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৬)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৭)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৮)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৯)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২০)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২১)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২২)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৩)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৪)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৫)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top