সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (শেষ পর্ব) : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
২৮ অক্টোবর ২০২১ ০০:২০

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:২২

 

আমি যখন আর্ট কলেজের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সহকারী প্রশিক্ষক। এই ট্রেনিং ইনস্টিটিউটটি প্যারিস কলেজ অব আর্টস এর একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। আমার আকাক্সক্ষা আর্ট কলেজের শিক্ষক হওয়া। ডিন মশিঁয়ে দানিয়েল আমাকে বুঝিয়ে বললেন, শিক্ষক হতে হলে আমাকে অবশ্যই কলেজ অব আর্টস এ তিন বছরের অনার্স কোর্সে অ্যাডমিশন নিতে হবে এবং গ্রাজুয়েশনে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে হবে। এটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার এবং প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়াটা অত্যন্ত কঠিন বিষয়। কঠোর পরিশ্রমের সাথে মেধা ও সৃজনশীল দক্ষতার পরিচয় না দিতে পারলে প্রথম শ্রেণি পেতে তোমার কন্ঠের গান, বেহালা বাদন কোনো কিছুই সাহায্য করবে না।
আমার আত্মবিশ্বাস এখন প্রবল। বললাম, আই ওয়ান্ট টু অ্যাকসেপ্ট দ্য চ্যালেঞ্জ। শুধু আমাকে গ্রাজুয়েশন করবার সুযোগ দিন এবং আমাকে ফাইনানসিয়াল সাপোর্টটা দিন যাতে উপার্জনের জন্যে আমাকে অডজব না করতে হয়।
দানিয়েল বললেন, ইফ ইউ আর সো সিরিয়াস, তুমি গ্রাজুয়েশন কোর্স করার জন্যে যে স্কলারশিপ বা আর্থিক সুযোগ সুবিধা পাবে তা সহকারী প্রশিক্ষকের বেতনের প্রায় সমান। তোমাকে যদি স্কলারশিপ দেওয়া হয় এবং সেমিস্টার ফি মওকুফ করে দেওয়া হয় তাহলে তোমার সহকারী প্রশিক্ষকের পদটি বহাল রাখা হবে কিন্তু তুমি কোনো আলাদা বেতন পাবে না। স্কলারশিপের টাকাতেই তোমাকে সব খরচ চালাতে হবে। তবে সহকারী প্রশিক্ষক হিসাবে এবং কলেজের ছাত্র হিসাবে ডরমিটরিতে থাকার সুবিধাটুকু দিতে পারব। এনি মোর কোশ্চেন?
- আমার ছবি আঁকা আঁকি এবং প্রদর্শনের স্বাধীনতা কি থাকবে?
দানিয়েল হেসে বললেন, এটা প্যারিস শিল্পীদের শহর। গণতন্ত্রের শহর। আমরা শিল্পীদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করি না।
জুলিয়াঁ প্রায়ই আসা যাওয়া করছে আমাকে নিয়ে বেড়াতে। আমি তাকে এড়াতে চেষ্টা করি, বলতে গেলে বিকেল, সন্ধেটা পালিয়ে বেড়াই। কিন্তু সব সময় তাকে এড়ানো সম্ভব হয় না। দেখা হয়ে গেলে কৃত্রিম হাসিতে ভাব দেখাই যেন কত খুশি হয়েছি ওকে দেখে। সব সময়েই ওর অনুরোধ আমি যেন ভার্সেইতে একটা ছুটির দিন আর রাত ওর অ্যাপার্টমেন্টে একটা আনন্দময় সময় উপভোগ করি। কিন্তু কী করে যাই? ওর সঙ্গে ওর অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়া মানেই ওর ইচ্ছে, আকাক্সক্ষার কাছে আমার আত্মসমর্পণ। আমি এই ভুলটা দ্বিতীয়বার করতে চাই না।
আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক শুক্রবার সন্ধ্যায় জুলিয়াঁ তার প্রায় কান্না কান্না অনুরোধে নিয়ে গেল ভার্সেই সিটিতে। আশ্বাস দিল আমাদের মধ্যে এমন কেনো কিছু ঘটবে না যা তার বা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
রাত্রে ভার্সেই পৌঁছে এক রেস্তোরাঁয় আমাদের নৈশ ভোজ সারলাম। খেতে খেতে নানা প্রসঙ্গে আমাদের গল্প। জুলিয়াঁ একটু অভিমানও প্রকাশ করল যে, সে আমাকে ভায়োলিন উপহার দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি তা প্রত্যাখান করেছিলাম। অথচ যখন সোফি দিয়েছে তা আমি গ্রহণ করেছি এবং হৃদয় উজাড় করে তাতে সুর তুলেছি।
আমি হাসলাম। বললাম, সোফি আমাকে বেহালা উপহার দিয়েছে আমাকে না জানিয়ে। এই বেহালা না নিয়ে আমার উপায় ছিল না। কারণ সে বেহালাটি আমার অজান্তেই রেখে চলে গেছে শিকাগোতে। তার সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না।
- যদি হয়?
- হবে না। সম্ভাবনা নেই।
- তোমার সঙ্গেও তো আমারও দেখা হবার সম্ভাবনা ছিল না। তবুও তো দেখা হল, কথা হল। এই যে আমরা দুজনে বসে ভার্সেই এর এক রেস্তোরাঁয়এক টেবিলে খাচ্ছি, একটু পরেই আমার স্টুডিয়ো অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যাচ্ছি, এটা কি তুমি ভাবতে পেরেছিলে? না আমি?
আমি বললাম, জুলি, মানুষের জীবনে অনেক কিছুই অভাবিত বা অলৌকিক ঘটনা ঘটে যায় যার ব্যাখা নেই। আকাশ আর পৃথিবীর মধ্যে অনেক রহস্যময়তা আছে যার কিছুই আমরা জানি না।
জুলিয়াঁ মৃদু হেসে বলল, তা ঠিক। দেখা যাক আজ আমাদের মধ্যে অভাবিত অলৌকিক কোনো ঘটনা ঘটে কিনা।
রেস্তোঁরা থেকে বেরিয়ে নানা পথ ঘুরে জুলিয়াঁর অ্যাপার্টমেন্টে যখন পৌঁছালাম তখন জুলিয়াঁ অবাক। তার অ্যার্টমেন্টে বাতি জ্বলছে, অথচ প্রবেশ দরোজা বন্ধ। জুলিয়াঁ নিজের চাবি দিয়ে দরোজা খুলল। ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম এক মধ্যবয়সী হলুদ রং এর দীর্ঘদেহী পুরুষ সোফায় বসে টেবিলের ওপর পা তুলে টিভি দেখছে। টেবিলের ওপর মদের বোতল ও গ্লাস। একটা কিটব্যাগ ও ক্যামেরার ব্যাগও পড়ে আছে সোফার ওপর।
জুলিয়াঁর বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ কণ্ঠ, তুমি! তুমি কী করে আমার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকলে?
মার্তিন্স মদের গেলাসে চুমুক দিয়ে বলল, অ্যাপার্টমেন্টটা শুধু তোমার নয়। আমারও। আমার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি আছে।
জুলিয়াঁর ক্রুদ্ধ কন্ঠ, তাতে কী? বাড়ির মালিকানা নিয়ে কোর্টের রায় না পাওয়া পর্যন্ত এই বাড়ি আমার।
মার্তিন্স ব্যঙ্গ হাসিতে বলল, কোর্টের রায় না হওয়া পর্যন্ত এই বাড়ি আমারও। আমার জন্যেও এই বাড়িতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়নি। কারণ বাড়ি কেনার অর্ধেক টাকা আমিই দিয়েছিলাম। ওকে, আ অ্যাম নট গোয়িং টু ডিসটার্ব ইউ। আমি মাদ্রিদ থেকে এসেছি। এখানে দু’সপ্তাহ থাকব। তারপর ইরাক চলে যাব। এই কয়েকটা দিন তোমাকে মানিয়ে নিতেই হবে। ইফ ইউ তলারেত মি, আই উইল তলারেত ইউ। নো প্রবলেম।
জুলিয়াঁ গর্জে উঠল, না, দু’সপ্তাহ কেন দু মিনিটও আমি তোমাকে এখানে থাকতে দেব না। ইউ গেত লস্ত উইথ ইয়োর ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ। আদারওয়াইজ আই উইল কল দ্য পুলিশ।
মার্তিন্স আবার ব্যঙ্গ হাসি হাসল। বলল, এই বাসায় প্রবেশের আগে আমি পুলিশ স্টেশন হয়ে এসেছি। এই বাড়ির কাগজপত্র আমার স্বত্ত্ব, চাবি সব ওদের দেখিয়ে এনেছি। বলেছি, তুমি একটা ফ্রড, ফেরোশাস লেডি, এ হোর। তুমি নিত্য নতুন ইয়াং ছেলেদের ডেকে এনে এই বাসাতে সেক্স কর। পুলিশ ডাকলে ওরা নিশ্চয় আসবে। এসে দেখবে তোমার আজকের রাত্রের সঙ্গী এই বিদেশি ছেলেটি, তোমার সেই প্রাণের পাখি ব্লুবার্ড নিশ্চয়?
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হে ম্যান,হোয়াই ইউ আর স্তান্দিং হেয়ার লাইক এ স্তাচু? গো ইনসাইদ হার বেদরুম অ্যান্দ ফাক হার অ্যাজ মাচ অ্যাজ ইউ ক্যান।
জুলিয়াঁ উন্মদিনীর মতো মার্তিন্স এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। উভয়ের মারামারি আর অশ্রাব্য চিৎকারের মধ্যে আমি মুহূর্তেই ছিটকে বেরিয়ে গেলাম। পথে নামতেই একটা খালি ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। ট্যাক্সিতে উঠে স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে ড্রাইভারকে বললাম, প্লিজ টেক মি টু প্যারিস কলেজ আর্টস।
অভাবনীয়, অলৌকিক ঘটনা সবসময়েই ঘটে। কেউ তা জানে, কেউ তা জানে না।

 

 

এই ঘটনার দীর্ঘদিন পর জুঁলিয়া এক বিকেলে এসেছিল আমার কাছে ক্ষমা চাইতে। বলল, স্যরি তিমু, সেই দিনের ঘটনার জন্যে আ অ্যাম সো স্যরি। আমি জানতাম না মার্তিন্স হঠাৎ করে আসবে আর এই কা- ঘটাবে। এ সব কথা ভাবতে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। তিমু, তুমি কি আমাকে পরিত্যাগ করবে, আমাকে আর বন্ধু হিসাবে ভাববেনা?
আমি বললাম, জুলি, আমি তোমার বন্ধু ছিলাম, বন্ধুই থাকব। তবে এর বেশি কিছু নয়। আমাকে আর কখনোই তোমার বাসায় যাবার অনুরোধ করো না।
জুলিয়াঁ নিঃশব্দে উঠে চলে গিয়েছিল।
এরপর অনেক বছর ধরে জুলিয়াঁর সঙ্গে আমার আর কোনো যোগাযোগ নেই। প্যারিসে শুধু নয়, আন্তর্জাতিক পরিম-লেও একজন চিত্রশিল্পী হিসাবে আমার খ্যাতির বিস্তৃতি। আমি শুধু চিত্র অঙ্কনে মগ্ন থাকিনি বা গ্রাজুয়েশন কোর্স সমাপ্ত করেই শিক্ষা জীবনকে সমাপ্তি টানিনি। চিত্রশিল্পের নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছি, পি এইচ ডি করেছি, একজন খ্যাতিমান অধ্যাপক হিসাবে আমি সর্বত্রই সম্মানিত ও সমাদৃত।
শুধু একটা জিনিস ভুলে গেছি আমি ঢাকায় একজন রিকশ পেইন্টার ছিলাম, আমার বাবা একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, আমার প্রিয় জয়ী মা ছিল, ছোট বোন নাজু ছিল। এক নাজু ছাড়া বাবা, জয়ী মা কেউ বেঁচে নেই। তাদের জন্যে আমার তেমন দুঃখ-শোক নেই। আমি মাঝে মধ্যে নাজুকে বড় অঙ্কের টাকা পাঠাই। কিন্তু চিঠি লিখি না। চিঠি লেখালিখি মানেই মনের বন্ধন। মনটাকে ভীষণ দুর্বল করে ফেলা। সেই দুর্বলতা, মায়ার বন্ধনে আমি আর জড়াতে চাই না।
একদিন জুলিয়াঁ এল লা নেপলি আর্ট ফাউন্ডেশনে আমার সাথে দেখা করতে। ওর বয়স বেড়েছে, শরীর ভেঙেছে, চেহারা শীর্ণ-দীর্ণ-বিবর্ণ। আমি ওকে এই বিধ্বস্ত চেহারায় দেখে অবাক। প্রশ্ন করলাম, কেমন আছ জুলি?
- ভালো নেই।
- কেন?
- আমার ক্যানসার।
আমি চমকে উঠলাম, হোয়াট!
- হ্যাঁ আমার ক্যানসার, ব্রেস্ট ক্যানসার।
- চিকিৎসা করিয়েছ?
- হ্যাঁ করিয়েছি। করছি, আরো করতে হবে। আমি আমার মার্সেই এর বাড়িটা বিক্রি করব। তুমি কিনবে?
আমি বললাম, স্যরি, জুলি। আমি আমার সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে আর্ট অব ভিলেজ বারবিজনে একটা স্টুডিয়ো অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছি। একটা গাড়ি কিনেছি। আমার হাত এখন শূন্য।
জুলিয়াঁ যেন আশ্চর্য কন্ঠে বলল, বারবিজনের মতো জায়গায় তুমি একটা অ্যাপার্টমেন্টও কিনে ফেলেছ! অথচ এক সময় তোমার...! না, থাক ও সব পুরোনো কথা। হ্যাঁ তুমি প্যারির যে কোনো জায়গায় অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে পার। কারণ তুমি এখন নামী দামি শিল্পী, নামী দামি অধ্যাপক। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি এখন আর ফ্র্যাঁর হিসেবে নেই। তুমি এখন ইউরোতে। মিলিয়ন মিলিয়ন ইউরোতে। তাই তোমার কাছে ছুটে এসেছিলাম বাড়িটা যদি তুমি কেন।
আমি বলবার মতো বা ওকে সান্ত¦না দেবার মতো কোনো ভাষা পেলাম না। বললাম, স্যরি জুলি। সাধ্য থাকলে কিনতাম। কিন্তু আমি এখন উপায়হীন। তবে তোমার চিকিৎসার জন্যে আমি কিছু ইউরো তোমাকে দিতে পারি অ্যাজ এ টোকেন অব আওয়ার ওল্ড ফ্রেন্ডশিপ।
জুলিয়াঁ উঠে দাঁড়াল। বলল, স্যরি, আমি কারো দয়া বা টাকা ভিক্ষে নিই না। থ্যাংক ইউ। আমাকে অন্য কাস্টমার খুঁজতে হবে। আসি।

বলে যেতে গিয়েও ফিরে এসে দাঁড়াল আমার সামনে। বলল, একজন পুরাতন বন্ধু কি তার অসুস্থ বন্ধুকে বলবে না হে বন্ধু বিদায়? মাত্র একটিবারও কি তার শেষ বিদায় চুম্বন দিয়ে বলবে না, ভালো থেক বন্ধু?
জুলির দিকে তাকিয়ে আমার মায়া হল। কিন্তু ওর বিবর্ণ ঠোঁটে আমার চুমু দিতে ইচ্ছে হল না। ওকে হালকা আলিঙ্গন করে ওর কপালে চুমু দিয়ে বললাম, স্যরি জুলি। আমি প্রার্থনা করব তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। মে গড ব্লেস ইউ। জুলিয়াঁ আর কিছু না বলে চলে গেল। তারপর যোগাযোগ হয়নি, কথাও হয়নি। আমি ইচ্ছে করেই ওর খোঁজ নিইনি। কারো কাছে জানতে চাইনি ও কেমন আছে। ঢাকার জীবনটাকে ভুলতে পেরেছি, বাবা, মাকে ভুলতে পেরেছি আর এই বৃদ্ধা, অসুস্থ জুলিয়াঁ নামের মহিলাকে কেন ভুলতে পারব না।
একমাত্র চিত্রশিল্প ছাড়া দুনিয়ার কোনো কিছুর প্রতি আমার আকর্ষণ নেই। না কোনো প্রিয়জন, না নারী, না স্বপ্নের আইফেল টাওয়ার। আইফেল টাওয়ারকে মনে হয় একটা লোহা লক্কড়ের জাংক।
প্যারিস ত্যাগের আগে আমি শেষবারের মতো দেখা করতে গিয়েছিলাম জুলিয়াঁর সঙ্গে। শুনেছিলাম ও এখন মার্সেইতে নয়, থাকে প্যারিস থেকে বেশ দূরের শহর রেনসিটি শহরে। জুলিয়াঁর ছোট্ট বাসাটি তালাবদ্ধ। ওর এক প্রতিবেশির কাছ থেকে জানতে পারলাম ও ব্রেস্ট ক্যানসারে অসুস্থতার শেষ পর্যায়ে। দু দু’বার ম্যাসটেকটমি করা হয়েছিল। কিন্তু ঘাতক ব্যাধির কাছে সে পরাজিত। হাসপাতালে পড়ে আছে নিবিড় পর্যবেক্ষণে। শুনে আমার খুব দুঃখ হল। যে তরুণী আমার একুশ বছর বয়সী মনে একটা স্বপ্নবীজ বুনে দিয়েছিল-এই প্যারিতে আসার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল সে এখন নিজেই ঘাতক মৃত্যু বীজের শিকার। অন্তত দশ বছর যাবৎ তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। সে থেকেছে তার স্বাধীন জীবন যাত্রার আপন ভুবনে। যাকে যখন ভালো লেগেছে তখন তার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে, লিভ টুগেদার করেছে। দুবার বিয়েও করেছে। কিন্তু জীবন যখন বৈচিত্রহীন, নিরস মনে হয়েছে, স্বামী বা বন্ধু তার উপর প্রভুত্ব করতে চেয়েছে সে তখন সব বন্ধনের শেকল কেটে পাখির মতো ফিরে গেছে নিজের ব্যস্ততম শিল্পের ভুবনে। শুধু বোধহয় আমিই ছিলাম তার বন্ধনহীন জীবনের বাইরের মানুষ।
রেনসিটির ক্যানসার হাসপাতালে জুলিয়াঁর কেবিনে প্রবেশ করলাম নার্সের অনুমতি নিয়ে। জুলিয়াঁকে এখন আর চেনা যায় না। মাথায় সেই মনলোভা স্বর্ণালি কেশের ছায়ামাত্র নেই। সমস্ত মুখ ফোলা, রক্তশূন্য। জুলিয়াঁ এখন এমন এক অচেনা নারী মনে হয় যাকে আমি কোনোদিন দেখিনি।
জুলিয়াঁকে আমি কোনোদিন স্বেচ্ছায় চুম্বন করিনি। ওর আগ্রাসী আকর্ষণে কখনো কখনো হয়তো আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু ভালোবাসা বলতে যা বোঝায় তা আমাদের মধ্যে কখনোই দানা বেঁধে ওঠেনি। ও অভিমান করেছে, ক্রুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আমি নিরুত্তর, নিস্পৃহই থেকে গেছি।
আজ ওকে দেখে বড় মায়া হল। আমি ওর অচেতন, ঘুমন্ত ঠোঁটে ঠোঁট রাখলাম। ঠোঁটের স্পর্শ দিয়েই যেন ওকে ডাকলাম, জুলি, জুলি তাকাও। দ্যাখো, আমি ফিরে এসেছি।
আমার চুম্বনে ও বোধহয় অলৌকিকভাবে জেগে উঠল। ঘোলাটে চোখে তাকাল। আমাকে দেখে মøান হাসিতে বলল, হে সাদা চুলের যুবক শেষ পর্যন্ত তুমি এলে! আমি মনে মনে এই দিন, এই বিদায় চুম্বনের অপেক্ষায় বেঁচে ছিলাম। এখন আমার আর কোনো দুঃখ নেই। নো পেইন।
আমি ওর হাত ধরে নিঃশব্দে বসে রইলাম। জুলিয়াঁ অচেনতার গভীরে ডুবে যাবার আগে বোধহয় শেষ মুহূর্তের প্রদীপ শিখার মতো জ¦লে উঠল। বলল, ভালোবাসার হে সাদা দাড়ির যুবক, আমি কি তোমার কাছ থেকে আর একটা চুম্বন আশা করতে পারি? আমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখো যতক্ষণ না আমি ঘুমিয়ে যাই।
আমি ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখলাম। সে চুম্বনে না ছিল উষ্ণতা, না অনুভূতি। ছিল শুধু হৃদয়ের কান্না। ওর ঠোঁটে এখন মৃত্যুর কটু স্বাদ, গন্ধ।
ও কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই যেন গভীর অচেতনতার মধ্যে ডুবে গেল। আমি ঠোঁট সরিয়ে নিলাম।
সেই সন্ধ্যাতেই জুলিয়াঁ পৃথিবীর সব আলো, সব তৃষ্ণা, সব প্রেম নিঃশেষে নিভিয়ে চলে গেল।

খাতার সাদা পাতা বলল, কলম তুমি কাহিনি আর দীর্ঘ করিয়ো না। আমার পৃষ্ঠা প্রায় শেষ।
কলম বলল, মানুষের জীবন একটাই মাত্র। কিন্তু সেই জীবনের অর্ধেক দেখা হয়, অর্ধেক লেখা হয়। বাকিটা অসমাপ্ত, অচেনাই থেকে যায়। আমার লেখার কালিও প্রায় শেষ। তবুও তোমার সাদা পাতায় আঁচড় কেটে হলেও শেষের কথা শেষ করতেই হবে। তাইমুর হাসান নামক এই অর্ধ জীবনের মানুষটির নিঃশ্বাসগুলি ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। তাই আর বৃথা বাক্য ব্যয় বা সময় নষ্ট নয়। এসো শুরু করা যাকশেষ থেকে শুরু।
... তাইমুর এখন হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে অচেতন অবস্থায়। নাজনিন তার শয্যা পাশে হাত ধরে বসে আছে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে। তার বুকের ভেতর নিঃশব্দ কান্নার স্রোত, হায় কেন আমি ঐ মেয়েটিকে বড়দার কাছে পাঠালাম? সত্যটাকে এমন নির্মমভাবে প্রকাশের কী প্রয়োজন ছিল? এই কাজটি না করলেও তো পারতাম? কিন্তু মর্মপীড়নে আমি ছিলাম উপায়হীন। আমি যখনই শুভশ্রীর দগ্ধমুখ আর দৃষ্টিহীন চোখের দিকে তাকাতাম তখনই যেন শুনতে পেতাম ওর নিঃশব্দ, নিসন্দী গভীর কান্নার শব্দ,অনুচ্চ হাহাকার তার মৃত মায়ের জন্য। শ্যামশ্রী যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন সে তার সমাজ, সংসার থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে শুধুমাত্র শুভশ্রীকে নিয়ে একইু মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। কারো অনুকম্পা, দয়া সে গ্রহণ করেনি। বাবা আর জয়ী মার সকল সাহায্য, সহযোগিতা সে সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিল। কন্যা শুভশ্রীর কাছে সে কখনোই প্রকাশ করেনি কে তার পিতা, কী তার জন্ম বৃত্তান্ত।
শুভশ্রী জন্মের ইতিহাস জানতেন তার বাবা সোমনাথ, আমার বাবা হাসান, জয়ী মা এবং আমি। কিন্তু জানত না শুধু বড়দা। কারণ, বড়দা তখন প্যারিসে। বড়দাকে কখনোই আমরা কিছু জানাইনি রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে। কেননা বড়দার স্মৃতি আর ইতিহাসে আমরা তখন ছেঁড়া পাতা।
শ্যামশ্রী যখন গর্ভাবস্থায়, শুভশ্রী তার জরায়ুর অন্ধ কুঠুরিতে তখন শ্যামশ্রী কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছিল অল্প কিছুদিনের জন্যে। আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তার মধ্যে তখন দুঃখ-যন্ত্রণার ভাব নেই, মুখে সুখানন্দের উজ্জ্বল চিহ্ন। তবে সে শুভশ্রীর পিতৃত্বের দাবি নিয়ে আসেনি। জয়ী মা’র জিজ্ঞাসাবাদে শুধু বলতে বাধ্য হয়েছিল কেন এমন হল?
বড়দা প্যারিসে যাবার আগের প্রায় দু’সপ্তাহ আগের ঘটনা। সোমনাথ বাবু তার স্ত্রীর গুরুতর অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে চলে গেছেন কলকাতায়। শ্যামশ্রী যেতে পারেনি। তখন তার এম কম ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা চলছে। আর মাত্র একটি সাবজেক্ট বাকি। পরীক্ষাটা শেষ করেই সে একটি প্লেনে চলে যাবে কলকাতায় এমনটাই সিদ্ধান্ত।
বাড়িতে শ্যামশ্রী একা। সঙ্গী বিশ্বস্ত কাজের মাসি সবিতা রানী আর তার এক বোন পো পনেরো বছর বয়সী অমলকান্ত। বাড়ির আশ্রিত মুহুরি অবিনাথ সাহা সোমনাথ বাবুর চেম্বারে মক্কেলদের কেস লিপিবদ্ধ করে, কোর্ট-কাচারিতে যায়, সোমনাথ বাবুর নাম করে দু’হাতে পয়সা লোটে। বাইরেই খাওয়া দাওয়া করে। রাতের বেলাটা চেম্বারের মেঝেয় শয্যা পেতে ঘুমোয়। দিনের বেলায় যখনই সে শ্যামশ্রীকে ট্যারা চোখে দেখে, তার সর্বাঙ্গ যেন লেহন করে। রাত্রে বিছানায় শুয়ে শ্যামশ্রীর কথা ভাবতে ভাবতে প্রচন্ড যৌন ক্ষুধা, আক্রোশে হস্ত মৈথুন করে।
শ্যামশ্রীকে এই জীবনে তার পাবার আশা নেই। শ্যামশ্রীর কাছে সে এক পথের কুকুর।
সবিতা মাসির বোন পো অমলকান্ত মফস্বলের গ্রাম থেকে আসা ছেলে। বায়না ধরেছে সে আজ লালবাগের কেল্লা দেখতে যাবেই যাবে। সবিতা মাসি তাকে একা ছাড়তে রাজি নয়। অবিনাশকে অনুরোধ করে। কিন্তু অবিনাশ তার নিজের কাজের দোহাই দিয়ে সরাসরি না করে দেয়। অগত্যা দুপুরে আহারাদির পর সবিতা মাসি বেলা প্রায় চারটার দিকে বোনপোকে নিয়ে লালবাগের কেল্লা দেখতে নিয়ে যায়।
বাড়িতে দোতালায় শ্যামশ্রী একা তার নিজের ঘরে পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। নিচে চেম্বারে অবিনাশও একা। সবিতা মাসি বোনপোকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে বাড়ির অন্দর মহলে প্রবেশের দরজায় তালা মেরে গেছে। কিন্তু অবিনাশের কাছে আছে একটা গোপন চাবি এবং যে কোনো তালা খোলার কলকাঠি বুদ্ধি-যা কেউ জানে না।

মাসি আর তার বোনপো লালবাগের কেল্লা দেখতে বেরিয়ে যাবার এই সুযোগটাই গ্রহণ করল অবিনাশ। বারবার সে শ্যামশ্রীর কাছে প্রত্যাখ্যাত, অপমানিত। তার চোখের সামনে এক বেজাত মুসলমান তাইমুরের সঙ্গে শ্যামশ্রীর প্রেমলীলা তাকে দেখতে হচ্ছে। নীরবে সবকিছুই সহ্য করতে হচ্ছে। সোমনাথ বাবুর বদান্যতায় সে টাকা পয়সা যথেষ্ট কামিয়েছে। কিন্তু অভাব শুধু শ্যামশ্রীর মতো একটি দেহের। বিপুল ক্ষুধা মেটাবার নারী মাংসের। সে অভাব যখন মিটছে না তখন সে সোমনাথ বাবুর দাস হয়ে আর এখানে থাকবে না। সে চলে যাবে কিন্তু যাবার আগে নিয়ে যাবে চরমতম প্রতিশোধ।
রাত জেগে পড়াশুনা, দিনভর পড়াশুনার ক্লান্তিতে শ্যামশ্রী তার বিছানায় সামান্য সময়ের জন্য তন্দ্রামগ্ন হয়ে পড়েছিল। অবিনাশ তার গোপন চাবিটা দিয়ে বাইরের দরজাটার তালা খুলল। দরজাটা বন্ধ করল নিঃশব্দে। তার হাতে নিজের একটা পুরোনো ধুতি আর গামছা। সারা বাড়িটা নিজঝুম। কোনো সাড়া শব্দ নেই। অবিনাশ পা টিপে টিপে দোতালায় উঠল। শ্যামশ্রীর ঘরটা নিস্তব্ধ। ভাগ্য সহায়দরোজাটা বন্ধ নয়। শুধুমাত্র ভেজানো। অবিনাশ দরজাটা খুলল অতি সন্তর্পণে। দেখল, শ্যামশ্রী তার বিছানায় তন্দ্রামগ্ন। এটাই অবিনাশের জন্যে মোক্ষম সময়। সে মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমন্ত শ্যামশ্রীর মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলল যাতে সে চিৎকার না করতে পারে। শ্যামশ্রী এই আকষ্মিক আক্রমণে জেগে উঠল বটে কিন্তু মুখের শক্ত বাঁধন খোলার আগেই ধূর্ত অবিনাশ তার হাতের ধুতি দিয়ে শক্ত প্যাচে শ্যামশ্রীর হাত দুটোও বেঁধে ফেলল। শ্যামশ্রী প্রাণপণে তার পা ছুঁড়তে লাগল অবিনাশকে বাধা দিতে। কিন্তু অবিনাশ তখন উন্মত্ত। সে চিতাবাঘের মতো শ্যামশ্রীর পায়ের ওপর চেপে বসল। শ্যামশ্রীর পরনের শাড়ি, পেটিকোট টেনে খুলে ছুঁড়ে ফেলল। ব্লাউজ, ব্রা সবকিছু ফর ফর করে টেনে ছিঁড়ে যেন তুলোর মতো উড়িয়ে দিল। কামার্ত দৃষ্টিতে শ্যামশ্রীর নগ্ন দেহ দেখতে দেখতে হিংস্র স্বরে বলল, শ্যামা, তোমার দেয়া অনেক অপমান সয়েচি, তোমাদের অনেক লাথি-ঝাঁটা খেয়েচি। সর্বক্ষণ আমাকে গালি দাও, আমি একটা ট্যারা শিংগি মাছ। কিন্তু এই ট্যারা শিংগি মাছের কাঁটায় যে কত বিষ তা তোমাকে ঢেলে দিয়ে যাব। যাবার আগে আমি তোমার জীবন, তোমার দেহটাও তচনচ করে দিয়ে যাব।
শ্যামশ্রী প্রবল প্রতিরোধের চেষ্টায় সাপেরমতো পাক দিতে থাকল বিছানায়, চেষ্টা করতে থাকল অবিনাশকে উল্টে ফেলতে। কিন্তু অবিনাশ সব প্রতিরোধ অগ্রাহ্য করে তার চুলের মুঠি ধরে ঠুকতে থাকল খাটে, বিছানায়। আঘাতে আঘাতে শ্যামশ্রী ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়ল, প্রতিরোধের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। অবিনাশ শ্যামশ্রীর নগ্নদেহ, তার স্তন, তার নাভীতল, তার রেশমি যোনিপ্রদেশ আঁচড়ে, কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকল কামার্ত আক্রোশে। তারপর নিজে উলঙ্গ হয়ে যখন শ্যামশ্রীর যোনি প্রদেশে প্রবেশে উদ্যত, তখন সেই চরম মুহূর্তে ধ্বক ধ্বক অগ্নুৎপাতের মতো তার স্খলন ঘটে গেল শ্যামশ্রীর গোপনাঙ্গের ওপরেই। ক্ষীপ্ত অবিনাশ এই চরম মুহূর্তে নিজের ব্যর্থতা আর হতাশায় নিজেই নিজের চুল ছিঁড়ল। শ্যামশ্রীকে দ্বিতীয় বার উত্থান ও ধর্ষণের জন্য এখন তার প্রয়োজন কিছুটা সময়। কিন্তু সময় তার হাতে নেই। মাসি হয়তো এক্ষুণি এসে পড়বে। শ্যামশ্রী এখন সম্পূর্ণ অচেতন। সে জীবিত না মৃত তা ঠিক বুঝতে পারছে না। শ্যামশ্রীকে এই অবস্থায় ফেলেই তাকে পালাতে হবে সবিতা মাসি ফিরে আসার আগেই।
অবিনাশ দ্রুত নিচে নেমে এল। প্যান্ট, শার্ট পরে নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে রাস্তায় একটা খালি বেবি ট্যাক্সিতে উঠে বলল, চলো গাবতলী।
সবিতা মাসি বোনপো অমলকান্তসহ ফিরে এল কিছুক্ষণেই মধ্যেই। এসে দেখল বাড়ির বাইরের দরজা খোলা, খোলা তালাটা ঝুলছে। অবিনাশও নেই। সবিতা মাসি শ্যামশ্রীর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে দোতালায় উঠল। শ্যামশ্রীর সাড়া নেই। শ্যামশ্রীর ঘরে ঢুকেই সে চিৎকার করে উঠল। তার চিৎকারে যেন ধসে পড়ল লালবাগের কেল্লা, নতুন পুরাতন যত সব বাড়িঘর।
লোকজনের ভিড় সরিয়ে পুলিশের গাড়ি এল। সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এল। ডাক্তার এল। অচেতন শ্যামশ্রীকে সব আলামতসহ পুলিশ এসকর্টে নিয়ে যাওয়া হল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
অবিনাশ পলাতক। পুলিশ অবিনাশের চেহারার বর্ণনা দিয়ে সব জেলা, বর্ডার, সব থানায় মেসেজ পাঠাল তাকে গ্রেফতার করতে।

এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে শ্যামশ্রীর জীবনে তা তাইমুর একটুও জানতে পারেনি। সারাদিন তার সময় কেটেছে ফরাসি দূতাবাসে নানা কাজের ব্যস্ততায়।
এই মহা দুর্ঘটনার সংবাদটি সে জানতে পারল সন্ধ্যার পর শ্যামশ্রীর বাসায় এসে। বাড়িটাতে মাসি একা বসে কপাল চাপড়াচ্ছে আর হাউমাউ করে কাঁদছে। তাইমুর তার কান্না আর চিৎকারের মধ্যেই যেটুকু জানবার তা জানল। তক্ষুণি সে ছুটল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
শ্যামশ্রীকে রাখা হয়েছে হাসপাতালের দোতালায় একটি কেবিনে পুলিশের কড়া পাহারায়। তাকে দেখবার কোনো অনুমতি নেই বহিরাগত কারো জন্যেই। পুলিশি বাধায় নিরুপায় তাইমুর রাতভর দাঁড়িয়ে রইল হাসপাতালের করিডোরে। সকাল হতেই সে ছুটল লালবাগ থানায়। ওসিকে নিজের পরিচয় দিয়ে সে শ্যামশ্রীকে দেখা এবং তার যাবতীয় সেবা যতেœর দায়িত্ব নেবার অনুমতি চাইল। ওসি তাকে নানা জিজ্ঞাসাবাদ, শ্যামশ্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন শেষে তাকে অনুমতি দিলেন দিনে রাতে মাত্র এক, আধঘন্টার জন্যে দেখা করতে পারবে সে। কিন্তু সতর্ক করে দিয়ে বললেন, মেয়েটি এখন একটা শকিং পিরিয়ডের মধ্যে আছে। এই পিরিয়ডটা মারাত্মক। যে কোনো মুহূর্তে আবার একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, আত্মহত্যা করতে পারে। দৈহিকভাবে একটু সুস্থ হলেই ওকে একজন সাইক্রিয়াটিস্ট দিয়ে ওকে সাইকোথেরাপি দিতে হবে তার মানসিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে।
তাইমুর দৃঢ়তার স্বরে বলল, ওর মানসিক শান্তি আর সুস্থতা আর শান্তি ফিরিয়ে আনতে আমিই বোধহয় পারব। আমিই তার একমাত্র প্রিয় বন্ধু।
ওসি হাসলেন। বললেন, হ্যাঁ এবং প্রিয় ভালোবাসাও। ভালোবাসায় কী না হয়। দেখুন চেষ্টা করে। তবে এমন কিছু করবেন না যাতে সে আবার বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
তাইমুর বলল, আমার পক্ষ থেকে সেটা হবে না। আমিই তার বিশ্বস্ত বন্ধু।
ওসি বললেন, অবিনাশও তো ঐ বাড়ির বিশ্বস্ত মানুষ ছিল। সোমনাথ রায়ের আস্থাভাজন, স্নেহভাজন মানুষ ছিল। কিন্তু সে সুযোগ বুঝে পশু হয়ে গেল। সে যা করেছে এখন আমরা আর কাউকেই বিশ্বস্ত ভাবতে পারছি না।
ওসির অনুমতিপত্র নিয়ে তক্ষুণি হাসপাতালে গেল না। ফিরে এল নিজেদের বাড়িতে। জয়ী মা আর বাবাকে সব ঘটনা খুলে বলল। দ্বিধাহীন চিত্তে সে তার সঙ্গে শ্যামশ্রীর সম্পর্ক, ভালোবাসার কথাও স্বীকার করল। বলল, মেয়েটাকে এই দুর্বৃত্ত ধর্ষকামী অবিনাশ দৈহিক ও মানসিকভাবে যথেষ্ট নিপীড়ন করেছে। কিন্তু যতটুকু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি তা হচ্ছে অবিনাশ তার চরম সর্বনাশ ঘটাতে পারেনি।
মেয়েটি এখন মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। শি নিড্স কাউন্সেলিং। ওকে কাউন্সেলিং করে আবার সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা দরকার। আমি তা করতে চাই। তোমাদের আপত্তি আছে?
বাবা মাথা নাড়লেন। বললেন, না নেই। কিন্তু তুমি তো আর ক’দিন পরেই প্যারিসে চলে যাবে। তখন?
তাইমুর বলল, যে ক’দিন আছি আমি ওর কাছাকাছি থাকব, সঙ্গ দেব, সান্ত¦না দেব, সাহস জোগাব।
মা প্রশ্ন করলেন, তারপর?
তাইমুর বলল, তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে আমি প্যারিস থেকে ফিরে আসার পর ওকে বিয়ে করব।
মা সামান্য চমকে উঠলেন। বললেন, ওকে বিয়ে করবি? কিন্তু ...
- কিন্তু কী মা?
- ও যে হিন্দু।
তাইমুর হাসল। বলল, মা তুমিও তো হিন্দু ছিলে।
মা বললেন, হ্যাঁ ছিলাম। কিন্তু তোমার বাবাকে বিয়ে করার জন্যে আমি মুসলমান হয়েছিলাম। আমি শুধু নামে জয়তুন্নেসা মুসলমান হইনি। নিষ্ঠার সাথে ধর্ম পালন করেছি, করে যাচ্ছি। ও কি তা করবে?
তাইমুর বলল, মা তা আমি জানি না। ধর্মান্তরিত হবার জন্যে ওকে আমি চাপও দেব না। আমি শুধু জানি ও আমাকে ভালোবাসে। আমিও ওকে ভালোবাসি। ভালোবাসাটাই আমার কাছে বড়।
মা মেঘাচ্ছন্ন কন্ঠে বললেন, তোমার যা ইচ্ছে তাই কোরো। আমি কারো ইচ্ছেতেই বাধা দেব না। তোমাদের সুখই আমারও সুখ।
বলে মা উঠে চলে গেলেন। তাইমুর নিশ্চুপ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা, তোমার কী মত? আমি কি কোনো ভুল করছি?
বাবা মøান হাসলেন। বললেন, কোনো সংশয়ের মধ্যে থেক না। ভুলের মধ্যেও নয়। তবে আমার একটি কথা, প্যারিস থেকে ফিরে আসার পর তুমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ো। আবেগের বশবর্তী হয়ে এক্ষুণি এই মুহূর্তে নয়।
রাত জাগা ক্লান্তির কারণে তাইমুর সারাদিন বাড়িতেই ঘুমিয়ে কাটাল। মা’র মুখ এখনও থমথমে। তাইমুর বুঝতে পারল ধর্ম নয়একটি ধর্ষিতা মেয়েকে এ বাড়ির বধূ হিসাবে গ্রহণে তার মন সায় দিচ্ছে না। বাবার মনোভাব একই রকম। এমন একটা অস্বস্তিকর পরিবেশে শ্যামশ্রীও কি রাজি হবে তার ছারখার জীবন নিয়ে এই সংসারে প্রবেশ করতে?
বিকেলে তাইমুর শ্যামশ্রীর কেবিনে যখন প্রবেশ করল তখন শ্যামশ্রী চোখ বুজে শুয়ে। সাদা চাদর দিয়ে ওর শরীর ঢাকা। আঘাতে আঘাতে তার কপাল, চোখ ফোলা, কালসিটে দাগ, মাথার এক খাবলা চুল ওপড়ানো, মুখে দংশনের ক্ষত চিহ্ন। ওর সারা শরীরে অবিনাশ কী পরিমান তা-ব চালিয়েছে, ওকে বিদীর্ণ করেছে তা মুখটুকু দেখলেই বোঝায় যায়। চাদর সরিয়ে তা আর দেখার প্রয়োজন হয় না।
ডাক্তাররা ইতোমধ্যেই ওর শরীর থেকে অবিনাশের নির্যাতন, ধর্ষণ চেষ্টার সব আলামত সংগ্রহ করেছেন। ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের স্পেশালিষ্ট ফটোগ্রাফার এসে ওর শরীরের সব ক্ষত স্থানের ছবি তুলে নিয়ে গেছে। এখন সব তদন্তের ভিত্তিতে সাক্ষ্য প্রমান নিয়ে পুলিশ একটা ক্রাইম রিপোর্ট তৈরি করবে। তার আগে প্রয়োজন পলাতম অবিনাশকে ধরা। প্রয়োজন শ্যামশ্রীর পিতা সোমনাথ বাবুর উপস্থিতি। তাকে ঘটনা জনিয়ে তারবার্তা পাঠানো হয়েছে। লালবাগ থানার ওসি তার সাথে ট্রাংকলে কথা বলেছেন। কিন্তু সোমনাথ বাবুর এই মুহূর্তে ঢাকায় ফিরে আসা সম্ভব হচ্ছে না। তার স্ত্রী এখন হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে। যদিও তার বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা নেই তবুও তিনি সারাক্ষণ বসে আছেন স্ত্রীর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের প্রতীক্ষায়। তিনি ওসির মারফত তাইমুরকে অনুরোধ করেছেন শ্যামশ্রীর এই দুঃসময়ে সে যেন শ্যামশ্রীর দেখ-ভাল করে, তাকে সঙ্গ দেয়। স্ত্রীর সম্ভাব্য মৃত্যু ও দাহকার্য শেষেই তিনি ঢাকায় ফিরে আসবেন এবং আইনগত সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
তাইমুর শ্যামশ্রীর বেডের পাশে বসে তার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। শ্যামশ্রী প্রায় বন্ধ চোখের পাতা খুলে ওর দিকে চমকে তাকাল। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠল ওকে দেখে। দীর্ণ কন্ঠে বলল, তিমু, তুমি তো কচি কলাপাতা শাড়ির এই মেয়েটিকে দেখেই স্মৃতি থেকে তোমার রিকশার পেছনে একটা ছবি এঁকেছিলে। কিন্তু পরে যখন পরিচয় হল, ভালোবাসা হল তখন একটি বারের জন্যেও তার আইভি লতার মতো দেহটা দেখতে চাওনি, দেখতে চাওনি তোমারই অপেক্ষায় উন্মুখ সদ্য ফোটা দুটি পদ্ম, শুনতে চাওনি তার দেহের ঝুমকো, জবা কুসুমের জুম-ঝুম আনন্দ। আমি ... আমি তো আমার সব আকাক্সক্ষার ঝাঁপি তোমার জন্যেই খুলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নাওনি। শেষে কী হল? অবিনাশ আমাকে বিনাশ করল। ঐ কুকুরটার হিংস্র আঁচড়ে, কামড়ে আমি ক্ষত-বিক্ষত। আমার শরীরে এখন অবিনাশের নোংরা জল-ওহ্ কী দুর্গন্ধ! আমি নষ্ট হয়ে গেছি তিমু ... আমি আর বাঁচতে চাইনে। এখন ঘেন্নায় মরে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই ... আমি কারো দয়া মায়া চাইনে ... শুধু মরতে চাই ... তার আগে আমার এই নিঃস্বতার, একটা ছবি এঁকে দাও ... একটা নষ্ট মেয়ের ছবি যার দেহের গোপন ভাষ্কর্য একটি জানোয়ারের হিংস্র থাবায় ভেঙে-চুরে একাকার।

কর্তব্যরত নার্স ওর বিকারগ্রস্ত কান্নায় ছুটে এল ওর কাছে। তাইমুরকে নির্দেশের স্বরে বলল, প্লিজ, আপনি এখন বাইরে যান। আমরা চাইনে ও কাউকে দেখে আরো বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়–ক। ওর ঘুম আর বিশ্রামের প্রয়োজন। প্লিজ, যান।
তাইমুর উঠে দাঁড়াল। নার্সের সামনেই শ্যামশ্রীর কপালের ক্ষত চিহ্নের ওপর একটা চুমু দিয়ে বলল, শামু, আমি তোমার একটা ছবি আঁকবঅন্য রকম ছবি। তোমার রক্তের বিষাদ থেকে, তোমার নিঃস্বতা থেকে, তোমার হৃদপি- থেকে, তোমার শোক-যন্ত্রণা থেকে একটু একটু রং নিয়ে তোমার ছবি আঁকবঅন্য রকম ছবি। শুধু তুমি শান্ত হও, সুস্থ হও। আত্মহত্যার কথা ভেব না। মনে রেখ আমি তোমার ছিলাম, তোমারই আছি। বলে তাইমুর বেরিয়ে গেল।
একটি মেয়ে ধর্ষিত হলে ধর্ষণের ক্ষত, রক্তপাতের চাইতে বড় বেশি রক্তপাত, গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয় তার মনে। সে যেন আর পবিত্র থাকে না। নিষ্ঠুর সংসারের চোখে সে পরিগণিত হয় একটি নষ্ট মেয়ে হিসাবে। ফলে তার মানসিক সংকট আরো ঘনিভূত হয়, বিকারগ্রস্ত হয়, উন্মাদ হয়, অবশেষে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। শ্যামশ্রীর ক্ষেত্রে সেই একই রকমের সংকটের মুখেমুখি হতে হল তাইমুরকে। হাসপাতালের কেবিনেই নানা রকম পুলিশি তদন্ত ও অপ্রিয় জিজ্ঞাসাবাদে শ্যামশ্রী জর্জরিত ও অতীষ্ঠ। তাইমুর বাধ্য হয়েই নিজ দায়িত্বে শ্যামশ্রীকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে নিয়ে এল লালবাগের বাসায়। শ্যামশ্রীকে নিরাপত্তা দিতে তাইমুরের লিখিত আবেদনে কড়া পুলিশ পাহারা বসল সোমনাথ বাবুর বাসায়।
আর ক’দিন পরেই তাইমুরকে উড়াল দিতে হবে লন্ডন আর প্যারিসের উদ্দেশে। পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিট সব রেডি। তাইমুর নিজেও ভীষণ উত্তেজিত। তার এতকালের পরিশ্রম এখন সফল, স্বপ্নটা হাতের মুঠোয়। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন ফিকে, বিবর্ণ হতে চলেছে শ্যামশ্রীর এই বিপর্যয়ে। শ্যামশ্রীকে একলা এই অবস্থায় ফেলে কীভাবে দেশ ছাড়বে? এ দিকে বাড়িতে জয়ী মা’ও বিষণœ। শ্যামশ্রীকে তিমু বিয়ে করবে কি করবে না তা নিয়ে তার উদ্বেগ নয় তার আশংকা তিমু বোধহয় আর ফিরবে না। খাঁচার পাখি একবার উড়াল দিলে, নীল আকাশে সাদা মেঘের মতো ডানা মেললে মুক্তির আনন্দে সে আর ফিরে আসে না।
তাইমুর তার বিদেশ যাত্রার সকল প্রস্তুতি ও ব্যস্ততার মধ্যেও সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সময়টা কাটায় লালবাগে শ্যামশ্রীর কাছে। তাকে সাহস দেয়, অভয় দেয়, ভালোবাসার কথা বলে। কিন্তু শ্যামশ্রী মাঝে মধ্যে খুব ক্ষীপ্ত হয়ে যায়, অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে, ধারালো বটি হাতে ছুটে যেতে চায় বাইরে অবিনাশকে সে হত্যা করবে। সবিতা মাসি আর বালক অমলকান্ত তাকে কোনোক্রমে সামলায়।
অবিনাশ ধরা পড়েছে সুন্দরবন এলাকার নদী পথ দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাবার পথে। পুলিশের পিটুনি খেয়ে সে স্বীকার করেছে তার অপরাধের কথা। সে এখন ঢাকার জেল হাজতে।
সোমনাথ বাবুর তারবার্তা এসেছে। শ্যামশ্রীর মা অবশেষে পরলোক গমন করেছেন। সোমনাথ রায় এবং পুত্র প্রসূন রায় দুজনেই শ্যামশ্রীর মায়ের দাহকার্য শেষ করে আগামী পরশু ঢাকায় ফিরবেন এবং অবিনাশের চরমতম শাস্তির ব্যবস্থা করবেন।
মায়ের মৃত্যু সংবাদে শ্যামশ্রী যেন আরো উন্মাদ হয়ে যায়। সবিতা মাসি এবং কিশোর অমলাকান্ত তাকে কিছুতেই সামাল দিয়ে উঠতে পারে না।
সন্ধ্যায় শ্যামশ্রীর বাসায় গিয়ে শ্যামশ্রীর এই অবস্থা দেখে ভীষণ বিপাকে পড়ে যায়। ওকে নিয়ে সে কী করবে? কীভাবে তাকে শান্ত করবে ভেবে পায় না। ওকে ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে যায়। শ্যামশ্রী ওষুধ ছুঁড়ে ফেলে। পানির গ্লাস আছড়ে ভাঙে। ডাক্তার ডেকে আনার কথা শুনে আরো ক্ষিপ্ত আচরণ করতে থাকে। গলায় ফাঁস নেবার হুমকি দিতে থাকে। সবিতা মাসি নিরুপায় কন্ঠে বলে, বাবা আজ রাতটা তুমি ওর কাছে থাকো। ওরে যেইভাবে পারো সামলাও। আমিতো আর পেরে উঠছিনে। কত্তা বাবুর পথ চেয়ে বসে আছি। পরশুদিন এসে পড়বেন। তিনি যা হয় একটা কিছু করবেন।
শ্যামশ্রী হিংস্র কন্ঠে বলে, ইউ গেট আউট বুড়িধাড়ি ...। বাবা তোর ওপর ভরসা করে আমাকে দেখাশুনোর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল। আর তুই আমাকে কুত্তা অবিনাশের জিম্মায় রেখে চলে গেলি লালবাগের কেল্লা দেখতে! তুই বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে।
তুমুল গালাগালির মধ্যে ভীত সবিতা মাসি আর অমলাকান্ত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তারপর শ্যামশ্রী খ্যাপার মতো ঘরের দরোজা বন্ধ করে দিল। তাইমুরের বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অঝোর কান্নার মধ্যে ওর বুকে মাথা ঠুকতে থাকল, বলতে থাকল, অবিনাশ আমাকে নষ্ট করার আগে তুমি কেন আমাকে নষ্ট করলে না? কেন আমাকে গ্রহণ করলে না? তুমি তো এখন প্যারিসে পালাচ্ছ। আমি ... আমি এখানে একলা পড়ে কী করব? কী আশা নিয়ে বেঁচে থাকব? বলো, উত্তর দাও?
এ বিলাপ প্রশ্নের কী উত্তর দেবে তাইমুর? শুধু বলল, শামু, তুমি শান্ত হও। আমি কথা দিচ্ছি আমাদের জাত-ধর্মের যে ব্যবধানই থাকুক না কেন আমি তোমাকে আমার স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করব। আমি আমৃত্যু তোমার। তোমার পাশেই থাকব জীবনের সঙ্গী হিসাবে।
তাইমুরের কথা শুনে শ্যামশ্রী এক অদ্ভুত কা- করল। আলু থালু কাপড়ে তাইমুরের সামনে নতজানু হয়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে পড়ল। বলল, তোমার কথা যদি ঈশ্বরের অস্তিত্বের মতো সত্য হয়, তাহলে তুমি আমার প্রাণেশ্বর, আমার দেবতা, তুমি আমার দুঃখ-সুখের জীবন, তুমি আমার মৃত্যু। এই আমি তোমার পায়ে মাথা কুটছি-তুমি আমাকে এক্ষুণি গ্রহণ করো। শিল্পী, তুমি আমাকে মাতাল রোদ, বৃষ্টি দাও, আলো দাও, ছায়া দাও। আমাকে গ্রহণ করো, নাও, আমাকে পবিত্র করো ... পবিত্র করো।
শ্যামশ্রী অবিরাম তাইমুরের পদপ্রান্তে মাথা কুটতে লাগল। উন্মত্ত কান্নায় তার কপাল রক্তাক্ত, রক্তাক্ত তাইমুরের পা। ঘরে, বাইরে প্রচ- ঝড়ের শব্দ, রক্তপাতের শব্দ, মেঘ গর্জনের শব্দ। কোনো কোনো ঝড় এমনভাবে আসে তখন কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবকিছু ল-ভ- হয়ে যায়, চোখ অন্ধ হয়ে যায়। শব্দে শব্দে আকাশ, পাতাল চৌচির হয়ে যায়। বড় বড় বৃক্ষ শেকড় শুদ্ধ উপড়ে পড়ে। তাইমুরও সেই বৃক্ষের মতোই উপড়ে পড়ল। রাতভর উপড়ে পড়ে রইল শ্যামশ্রীর দেহে, কখনো শ্যামশ্রী তার দেহে। কখনো বজ্রপাত, কখনো অগ্নুৎপাত, কখনো জলপ্রপাত। তাইমুর যতবার তার শেকড় উপড়ানো শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেয়েছে শ্যামশ্রী তাকে উঠতে দেয়নি। তাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে শুয়ে থেকেছে তার ভীষণ ক্ষুধা নিবৃত্তির আনন্দে।
ভোর হল, পাখি ডাকল। তাইমুর শ্যামশ্রীর বিছানায় পড়ে রইল উপড়ে পড়া বৃক্ষের মতোই। শ্যামশ্রী এখন শান্ত। সে ঘর লাগোয়া স্নান ঘরে ঢুকল। স্নান শেষে নতুন শাড়ি পরে এসে শায়িত তাইমুরের পায়ে প্রণাম করল। চুমু দিল তার পায়ে, বুকে এবং ঠোঁটে। বলল, তিমু আমি এখন পবিত্র। আমার আর কোনো ক্ষোভ, দুঃখ নেই। তুমি এখন যাও তুমি। যদি তুমি আর কোনোদিন ফিরে নাও আসো আমার কোনো দুঃখ, অনুতাপ থাকবে না। আজকের রাতের স্মৃতি নিয়েই আমি বেঁচে থাকব।
তাইমুর বিধ্বস্ত দেহে টলতে টলতে লালবাগের রক্তাক্ত বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এল। সে তার নিজের রিকশা আনেনি। অন্য কারো রিকশায়ও চড়ল না। প্রায় নির্জন ভোরের পথে টালমাটাল পায়ে একটা শূন্যতার মাঝে সে হাঁটতে লাগল। জুলিয়াঁও দু’বছর আগে একদিন তাকে দীর্ঘ চুম্বনে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে প্রলোভিত হয়নি। তার দেহে কামনা বাসনার অগ্নিও জ্বলেনি। কিন্তু উন্মত্ত শ্যামশ্রীর শোক-ধ্বনি, আহত চিৎকার আর প্রার্থনায় ওকে শান্ত করতে নিজেকেই বিসর্জন দিতে হল। শ্যামশ্রী বলল, অবিনাশের পূতি-গন্ধময় নর্দমার জল থেকে সে এখন তাইমুরের ঝর্ণা প্রপাতে শুদ্ধ, পবিত্র। কিন্তু তাইমুর নিজে কি পবিত্র হল? এটা তো পাপ। এই গোপন পাপের কথা সে কাকে বলবে?
তাইমুর বাসায় ফিরে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভেঙেও কাউকে কিছু বলল না। তার জয়ী মা’কে না, নাজনিনকেও না।
নিজের রিকশাটা নিয়ে গেল বংশালে খলিল চাচার কাছে। তার পা ছুয়ে সালাম করে হাত ধরে বলল, চাচা আমি তো চলে যাচ্ছি। রিকশাটা আপনাকেই ফেরত দিয়ে গেলাম। শুধু আমার একটা অনুরোধ, আমি যতদিন না ফিরি আমাদের পরিবার, বিশেষ করে আমার বাবাকে একটু দেখবেন। রিকশাটা একটা সৎ, নির্লোভ এতিম ছেলেকে দেবেন যে রিকশাটা চালিয়ে নিজের আয় উপার্জন করবে। বিনিময়ে আমাদের বাড়ির ছেলের মতোই প্রতিদিন সংসারের কাজকর্মে সাহায্য সহযোগিতা করবে।
খলিল চাচা তাইমুরকে বুকে চেপে ধরে আবেগাক্রান্ত স্বরে বললেন, তাই হইবো, তা-ই। আমি তোমাগো বাড়ির সব দেখভাল করুম। তয় তুমি সহি সালামতে ফিরা আসো এটাই আমার চাওয়া।
বাবার মøান হাসি, জয়ী মা আর নাজুর চোখের পানির ভেতর দিয়ে তাইমুর দু’দিন পরেই উড়াল দিল লন্ডন ও প্যারিসের উদ্দেশে।
শ্যামশ্রীর সঙ্গে শেষবারের মতো তার না দেখা হল, না কথা হল। পাখি উড়ে গেল নিঃশব্দে ডানা মেলে।

নাজনিনের কথা
বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যেই বড়দা চোখ মেলে তাকাল। উদভ্রান্ত দৃষ্টি। মনে হল ঘোলাটে চোখে সে যেন কাউকে খুঁজছে। তার একহাতে স্যালাইন ড্রিপ চলছে। নাকে অক্সিজেন নল। তার অন্যহাত আমার হাতের মধ্যে। তার ব্যাকুল চোখের দৃষ্টি অবশেষে আমাকে যেন খুঁজে পেল। ঘড়-ঘড় কন্ঠে আমাকে যেন ডাকল,
- নাজু?
- এই তো আমি বড়দা।
- ওই যে মেয়েটা ... কী নাম বলেছিল?
- শুভশ্রী।
- ও কি এখানে?
- না।
- ও কোথায়?
- আছে। ও আসতে চায়নি। চোখে না দেখলে এখানে এসে লাভ কী?
- হ্যাঁ তা ঠিক। তবে আমি তো দেখতে পেতাম।
- তুমি সুস্থ হও। ও তোমার কাছেই থাকবে।
- আমার কাছে থাকবে? থাকবে কি?
- থাকবে। নিশ্চয় থাকবে। তুমি ছাড়া ওর আপন বলতে আর কে আছে?
- তুই আছিস। তুই ওকে দেখিস।
- হ্যাঁ দেখব।
- কথা দিচ্ছিস?
- হ্যাঁ।
- তুই কি জানতিস ও আমার ...
- হ্যাঁ জানতাম।
- কবে থেকে?
- ওর জন্মের আগে থেকেই।
- মা জানতো? বাবা?
- হ্যাঁ জানতো।

ছোট্ট শ্বাস একটু দীর্ঘ করে বড়দা বলল,
- সবাই জানতো। অথচ আমি জানলাম না। কেউ আমাকে কিছুই বলল না। না শ্যামশ্রী, না তুই।
- তুমি তো জানতে চাওনি বড়দা।
‘বড় পাপ ... পা..প’ কথাটা উচ্চারণ করতে করতে বড়দা আবার যেন গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেল।
আমি রাতভর বড়দার হাত ধরে তার বেডের পাশে পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলাম। দেখতে থাকলাম মনিটরে তার নাড়ির গতি, হৃদপি-ের স্পন্দন, রক্তচাপের ওঠা নামা, তার শেষ মুহূর্তের জীবন-মৃত্যুর খেলা।
আমি বড়দার হাত আঁকড়ে ধরে বসে রইলাম একটি চার বছর বয়সী শিশুটির মতো-যে তার পিতার বিদায়কালে হাত টেনে ধরে বলেছিল-
‘যেতে আমি দেবনা তোমায়’।
শেষ রাত্রে বড়দা যেন শেষবারের মতো ঘুম ভেঙে জেগে উঠল। তার নিঃশ্বাস ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। সেই অবস্থায় আমার দিকে স্বচ্ছ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমি একটা ছবি এঁকেছিলাম সেই কতকাল আগে ... ছবিটা একটা বন্ধ অন্ধকার দরোজার ছবি। দরোজাটা সুদৃশ্য ... কিন্তু তার তালাটা মরচে পড়া ... জীর্ণ অথচ সেটা খুলতে হবে একটা সোনার চাবি দিয়ে। সে চাবিটাও এঁকেছিলাম ... দরোজার বাইরে ধুলো ময়লার মধ্যে পড়েছিল .. কত খুঁজেছি ... পাইনি ... তালাটা ছিল ঘৃণা ... চাবিটা ছিল স্বপ্ন ...
বড়দার হাত আমার হাতের মধ্যে কিছু যেন একটা খুঁজছে। আমার আঙুলটা শক্ত করে ধরে বলল, নাজু, আমি এতদিন পর আমার চাবিটা খুঁজে পেয়েছি। ঐ পুরোনো মরচে পড়া তালাটা খুলতে হবে ... খুলব ... দরোজাটা ... আমার আত্মার দরোজা ... আত্মার মধ্যেই আমার আত্মার ঘর ... ওখানে আমি একটা ... একটা ছবি আঁকতে চাই ... আমার রং, তুলি দে ... রিকশাটাও ...
বড়দার জীবন এখন সুতোর সরু রেখায়, একটা মৃদু টানা সংগীত ধ্বনির মতো ক্রমে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
কাগজ বলল, কলম, ইহাই আমার সর্বশেষ পৃষ্ঠা। শেষ কথা লিখিবার জন্য আমার পৃষ্ঠায় বিন্দুমাত্র স্থান নেই।
কলম বলল, আমিও এখন কালি শূন্য। আঁচড় কেটে আর কিছুই লেখা যাবে না।
রঙের কৌটা মেঝেয় গড়াতে গড়াতে হাহাকার করে উঠল, আমিও শূন্য, সব রং শেষ।
ক্যানভাস বলল, আমি এখন বিবর্ণ, ছেঁড়া-ফাটা। আমার উপর ছবি আঁকা যাবে না।
কাঠি ভাঙা, আঁশ ওঠা তুলিটা খসখসে কণ্ঠে বলল, আমি বাতিল। আমাকে দিয়ে ছবি আঁকা যাবে না।
সবাই আক্ষেপের স্বরে বলল, তাইমুর মহানায়ক ছিল না। ও ছিল ভীষণ কষ্ট পাওয়া একটা ছেঁড়া, ফাটা মানুষ। বর্ণহীন, নিঃসঙ্গ। হি ওয়াজ জাস্ট এ রিক্শ পেইন্টার অ্যান্ড নাথিং এল্স।

সমাপ্ত

 

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব তিন)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পাঁচ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ছয়)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব সাত)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আট)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব নয়)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব দশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব এগার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব তের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চৌদ্দ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পনের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ষোল)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব সতের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আঠারো)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব উনিশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বিশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব একুশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বাইশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব তেইশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চব্বিশ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top