সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৭) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
৪ জানুয়ারী ২০২৩ ০২:৫২

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ২০:৫৭


দিন গড়ায়। পার হয়ে যায় মাস। সামনে স্বপ্নে দিন প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। চারদিক তেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা খবর জানতে পারে শরণার্থীরা। কোথায় কি হচ্ছে জেনে নিজেদের পরিস্থিতি ঝাঁকিয়ে তোলে। অনেকে কাছে-ধারে যুদ্ধের নানা জায়গায় চলে যায়। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। লুৎফা অনেক আগ্রহ নিয়ে মুজফফরকে ধরে চৌগাছা যায়। কাছাকাছি গেলেই টের পায় মুক্তিবাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেখানে এসেছেন রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ-প্রস্তুতির এলাকাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেন। মুজফফর আর লুৎফা অন্যদের কাছ থেকে শুনে বুঝতে পারে যে তিনি কে। তাঁকে ঘিরে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। ওরাও এক জায়গায় দাঁড়ায়। শুনতে পায় তিনি কি বলছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘সেদিন আর দেরি নেই, যেদিন শত্রæর জেল থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এসে আমাদের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করবেন। মুক্তিবাহিনীর বীরযোদ্ধারা শিগগিরই হানাদারদের বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করবেন। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ তার নিজের শক্তিতেই রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত আছে এবং থাকবে।’
চারদিক থেকে সবাই চিৎকার করে বলে, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। মুজফফর আর লুৎফা উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। সবার কন্ঠের সঙ্গে নিজেদের কন্ঠ মেলায়। দেখতে পায় একটু পরে তিনি চলে যাচ্ছেন। অনেকেই তাঁর পেছনে পেছনে হাঁটে, কিন্তু বেশিদূর যেতে পারেনা। তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে সবাইকে নিষেধ করেন। মুজফফর আর লুৎফা সীমান্তের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সামনের দিকে তাকিয়ে দূরে পাকিস্তানি বাহিনীকে দেখে দৌড়াতে দৌড়াতে অন্যদিকে চলে যায়। এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালে একজন বলে, ওই দেখেন ঐটা ভারতের বয়ড়া গ্রাম। এই গ্রামের পাশেই আমাদের চৌগাছা। মুজফফর লুৎফার হাত ধরে বলে, চলে ওখান থেকে ঘুরে আসি।
লুৎফা দ্রæত পায়ে এগিয়ে যায়। মুজফফরের হাঁটার পেছনে থাকে না। বয়ড়ার মাটিতে পা রেখে দুজনে চারদিকে তাকায়। দেখতে পায় অনেক দূরে পাকিস্তানি বাহিনী স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক বহর নিয়ে অপেক্ষা করছে। লুৎফা ওই দিকে তাকিয়ে বলে, ওরা কি শরণার্থীদের মেরে ফেলার জন্য তৈরি হয়েছে? আমাদেরকে শত্রæ ভাবছে, যে কোনো সময় ছুটে আসতে পারে।
- আসুক। আসলে আমরা কি ছাড়ব নাকি? আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বাধা দিবে।
- তাই নে হয়। আমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে নতি স্বীকার করব না।
- কি যে বল এসব কথা। নিত স্বীকারের তো প্রশ্নই ওঠেনা। যদি শহীদ হতে হয় সবাই মিলে শহীদ হব। আমাদের ছেলেমেয়েরা স্বাধীন দেশের মানুষ হবে।
- স্বাধীনতার জন্য যা কিছু ঘটবে, ঘটুক। আম সবাইকে সালাম জানাই। দেখছিতো চৌগাছার এখানে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী এগিয়ে এলে রেহাই পাবেনা। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হবে।
- হয়েছে থাক। চলো আমরা যাই। যুদ্ধ শুরু হলে আমরা এখানে আসব।
- আমিও আসব। আমি যুদ্ধের মানুষ হতে চাই। শূন্য হাতে স্বাধীনতা চাইনা। স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে রেডি আছি।
- তুমি খুব সাহসী মহিলা লুৎফা।
- স্বাধীনতার জন্য সাহস তো থাকতেই হবে।
- আমার বউয়ের সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।
- ভালোবাসা দেখে অবাক হওনি?
- বাব্বা, তোমার সঙ্গে কথা বলে আমি পরিনা। তোমার ভালোবাসা আমাকে অবাক করেনি। জীবনকে ফুলবাগান করেছে। কত রঙের ফুল, আর কত সুন্দর সুবাস। নিঃশ^াস টানলে বুক ভরে যায়। তোমার ভালোবাসা আমাকে এভাবে উৎফুল্ল করে।
- আমার প্রাণ ভরে গেল তোমার কথায়। চলো দুজনে ফিরে যাই।
- আমাদের শরণার্থী জীবনে আমরা দুজনে দুজনকে আবিষ্কার করলাম।
- ঘরে গিয়ে আমরা একটি বাচ্চা নেব। যেন ওর জন্ম হয় শরণার্থী শিবিরে।
মুজফফর জোরে জোরে বলে, না আমি চাইনা। দেশ স্বাধীন হলে তারপর আমাদের অনেক স্বপ্ন পূরণ হবে। শরণার্থী শিবির মানে আমাদের এখন যুদ্ধের দিন। যুদ্ধ ছাড়া আমরা আর অন্যকিছু চিন্তা করব না।
লুৎফা এই কথায় দমে যায়। এটাইতো সঠিক কথা। ও নিজে কেন চিন্তা করলনা। নিজের ওপর রাগ হয়। লুৎফা আর কথা বলেনা। নিশ্চুপ হয়ে যায়। নতুন ভাবনা ওকে আলোড়িত করে। ভাবে, এখান থেকে চৌগাছায় চলে যাবে। সেখানে থাকার জায়গা না পেলে গাছের নিচে থাকব, এমন ভাবনা ওকে আলোড়িত করে। মুজফফরের হাত ধরে দ্রæতপায়ে ফিরে আসে তাঁবুতে। মেঝেতে বসে পড়ে বলে, আমি আর এখানে থাকবনা। চৌগাছায় যাব।
- হ্যাঁ, আমিও যাব। জীবনের মায়া নিয়ে পড়ে থাকবনা।
- কবে যাব আমরা?
- দু’একদিনের মধ্যে।
- কালকেই যাই?
- হ্যাঁ, চলো। চাল-ডাল সব যা আছে গুছিয়ে নাও।
- তাতো নিতে হবেই। তুমি কিছু ভেবোনা। আমি সব গুছিয়ে নেব। খাবারের জন্য কারো কাছে হাত পাততে হবে না।
- আমিতো জানি তোমার মাথা এমন চিন্তাই থাকবে। তোমার কাছে পিছুটানের হিসাব নাই। লুৎফা হাসতে হাসতে বলে, তুমি আমাকে খুব ভালো করে বোঝ। এটাই তোমার ভালোবাসা।
কথা বলে উঠে বসে লুৎফা। তাঁবুর ভেতরের সবকিছু এক জায়গায় এনে গোছাতে শুরু করে।
মুজাফফর বাইরে ঘুরতে যায়।

চলবে

 

শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৩)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৪)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৫)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৬)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৭)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৮)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৯)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১০)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১১)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১২)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৩)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৪)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৫)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৬)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৭)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৮)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৯)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২০)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২১)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২২)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৩)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৪)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৫)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৬)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top