সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব কুড়ি) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
২৮ জানুয়ারী ২০২১ ২০:৩৪

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:০৭

ছবিঃ অমর মিত্র

 

মনে পড়ে তোর, এক সন্ধ্যায় শ্রেষ্ঠী এলেন, সুভগ দত্ত। চাপা গলায় ফিসফিস করে দেবদাসী সুভদ্রা, কত বয়স হয়েছে তার কিন্তু একটুও ধরা যায় না, মনে হয় যুবক।

ললিতা দাসী অবাক হয়, জরার চিহ্ন তো সুভগ দত্তের মুখমন্ডলে। তা কি দ্যাখেনি সুভদ্রা? তবে। হ্যাঁ, প্রধান পুরোহিতের চেয়ে তার বয়স কম, তার অর্থ এই নয় যে তিনি সদ্যযুবা, তাকে মনের ভিতরে। লালন করবে যুবতী দেবদাসী। কত বয়স হবে সুভদ্রার? অষ্টাদশী হবে, অথবা ঊনবিংশতী বর্ষীয়া। সুভগ দত্তর বয়স পঞ্চাশৎ-এর নিকটবর্তী।  ললিতা দাসী অন্ধকারে অবাক হয়ে তাকায় সুভদ্রার মুখে। আজ ফাল্গুনের শুক্লাপঞ্চমী। এই এখনই শৃগাল তৃতীয় প্রহর ঘোষণা করেছে। ভল্লের মতো বাঁকা চাঁদ দূর পশ্চিমে মহাকাল অরণ্যের উপর ঢলে গেছে। সুভদ্রা তার শয্যা থেকে উঠে এসে পুরোহিতের কক্ষ সংলগ্ন  অলিন্দে নিদ্রামগ্ন ললিতা দাসীকে টেনে তুলে মন্দিরের বাইরে প্রশস্ত চাতালে এসে বসেছে। ললিতা দাসী চমকেছিল সুভদ্রার স্পর্শে। সেই পৌষমাসের শুক্লা অষ্টমীর রাতটি তার মনে আঁকা হয়ে আছে  রঙের গভীরতায়। আবার কি ডেকেছেন মহাকাল? নিদ্রার ঘোরে সে ডেকেওছিল মহাকালেশ্বরকে। কিন্তু চোখ মেলার পর ভ্রম কেটেছিল। সুভদ্রার হাতে দীপ জ্বলছিল। দীপের আলোয় সে সুভদ্রাকে দেখেছিল।

এখন অন্ধকারে দু’জন মুখোমুখি। তারার আলোয় দু’জন পরস্পরের কাছে প্রকাশিত। সুভদ্রা বলেছ, স্বপনে এসেছিল শ্রেষ্ঠী, শ্রেষ্ঠীকে স্বপ্নের ভিতরে দেখেছে সে, তাই আকুল হয়ে উঠে এসেছে মনের কথাটি বলতে।
ললিতা দাসী বলে, তুই কি পাগল হলি সুভদ্রা, তুই না মহাকালের দাসী।
তা হোক, তিনি সেই সন্ধ্যায় আমার নাচে মুগ্ধ হয়েছিলেন, আমার রূপেও
কে বলেছে?
আমি দেখেছিলাম।
তুই তো জ্ঞানহারা হয়েছিলি?
না, আমি যেন সেইদিনই মহাকালকে অনুভব করেছিলাম, আমি জ্ঞানহারা হয়েছিলাম পরম আনন্দে, সেই সন্ধ্যায় যেন এ জীবন সার্থক হয়েছিল।

তাই ই তো হয়। বিড়বিড় করল ললিতাদাসী। তার মনে পড়ে যায় শীতের সেই রাত্রির কথা। স্বয়ং মহাকাল এসে মিলিত হয়েছিলেন তার সঙ্গে। সেই মিলনের পরম আনন্দের রেশটুকু এখনো যেন শরীরে লেগে আছে। এখনো তার স্তনাগ্র দৃঢ় হয়ে ওঠে সেই রাত্রির কথা মনে এলে। শরীরের রোম দাঁড়িয়ে পড়ে, দু’চোখ বুঁজে আসে। স্তন দুটিতে কি খুঁজে পাওয়া যাবে না সেই রাতের নখের চিহ্ন। তিনটি পক্ষ গেছে তারপর। ওই চিহ্ন সমস্ত জীবন ধারণ করে রাখবে যেন ললিতা দাসী। কিন্তু সেই স্পর্শ তো ছিল মহাকালের। মহাকালের ভোগ্যা সে। মহাকালের দাসী। মহাকালেই নিবেদন করেছে নিজের সমস্ত সত্তাকে। সে জানে মহাকালের দাসী মহাকাল ব্যতীত অন্য কারোর কথা ভাবতে পারে না। কিন্তু কী বলে সুভদ্রা?

সুভদ্রা বলল, আমি যখন মহাকালেশ্বরকে দেখছিলাম, দেখছিলাম যেন রূপবান শ্রেষ্ঠীকে, ধূপের ধোঁয়ার ভিতরে তিনি চোখ মেলে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। মহাকাল সেদিন যেন শ্রেষ্ঠীর রূপে আমার সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তারপর তো শ্রেষ্ঠী এলেন না।

শ্রেষ্ঠী কেন আসবেন, প্রধান পুরোহিত দ্বিজদেব তাঁর কাছে যান। বলল ললিতা।
আমার সেই সন্ধ্যার কথা অনবরত মনে হয়।
এ চিন্তা পাপ, তুই মহাকালের দাসী।
আমি তাঁকে অনুভব করতে করতে জ্ঞানহারা হয়ে পড়লাম, তারপর তিনি তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করলেন, মনে আছে সব।
হাসল ললিতা, বলল, তুই উপোসে দুর্বল ছিলি।
না, আমি তো জানি কেন লুটিয়ে পড়েছিলাম মহাকালের সামনে।

এবার নিশ্চুপ হলো ললিতা দাসী। অবাক হচ্ছিল সে যেমন, ভয়ও পাচ্ছিল। দেবদাসী সুভদ্রা কিনা কামনা করছে শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্তকে। আশ্চর্য! ধনবান বটে শ্রেষ্ঠী, কিন্তু রূপ কোথায় তাঁর? পৌরুষ কোথায়? আর কয়েক বছর পরে প্রধান পুরোহিতের মতোই তো হয়ে যাবেন তিনি। আর মহাকালের কাছে যে দাসী সমর্পিতা, সে কেন অন্য পুরুষকে কামনা করবে? তাহলে তো কুলভঙ্গ হয়। কুলটা হয় নারী। এই কথা যদি প্রধান পুরোহিতের কানে যায় হেনস্থার শেষ থাকবে না সুভদ্রার। সত্যিই তো, মহাকালের গর্ভগৃহে প্রবেশাধিকার দিয়ে তাঁর অঙ্গ মার্জনার অধিকার যে দাসীকে দেওয়া হয়েছে তার মনে যদি অন্য পুরুষ প্রবেশ করে তবে তো এই মন্দিরই হবে অপবিত্র। হায় সে কী ভীষণ হবে! এক দেবদাসীর পাপে সকলেই না পাপী হয় প্রধান পুরোহিতের চোখে, রাজার চোখে, এমন কি শ্রেষ্ঠীর চোখেও।

ললিতা জিজ্ঞেস করে, তুই কি এই কথা বলতে ডেকে তুললি আমাকে?
হ্যাঁ।
গর্ভগৃহের দুয়ার খোলা?
হ্যাঁ।
দ্বিজদেব জানেন?
তাঁর দরজার কাছেই তো তুই ঘুমিয়েছিলি বাঈ।
মহাকাল জেনে যাবেন। ফিসফিস করে বলে ললিতা দাসী।
মহাকাল তো পাথর।
চমকে ওঠে ললিতা, হাত বাড়িয়ে মুখ চাপা দিল সুভদ্রার, কী বলিস, এসব কথা উচ্চারণ পাপ। মহাকালই আমাদের আশ্রয়।
সুভদ্রা মাথা ঝাঁকায়, অন্ধকারে তার মাথার খোঁপা ভেঙে দেয়। এলো চুল নিয়ে খেলতে থাকে নিজের মনে, বলে, আমি কতবার ছুঁয়েছি ওই মূর্তি।
শিহরিত হয় ললিতা, কী বলিস?
অঙ্গ মার্জনা করেছি, প্রস্তরমূর্তি হিম শীতল, স্পর্শ করলে শরীরের রক্ত  যেন জমাট বেঁধে যায়, কী নিশ্চল! স্পন্দনহীন!
থাম! ললিতা দাসী ধমকে ওঠে সুভদ্রাকে, তোর তো পাপের কোনো সীমা নেই, তুই এসব কী বলিস?
কেন তুমি কোনোদিন মার্জনা করনি ওই মূর্তি?
যখন অধিকার ছিল, করেছি।
কী অনুভব করেছিলেন তখন?
মহাকাল আমার আশ্রয়, তাঁকে স্পর্শ করতে পারা আমার পরম সৌভাগ্য।
সত্য কথাটি বলো।
মহাকালকে ছোঁয়ার সময় কোনো পাপ আমার মনে থাকত না। বলল ললিতা দাসী, মহাকাল সময়ে দেখা দেন, আমি তাঁর দেখা পেয়েছি।
চমকে ওঠে সুভদ্রা, কম্পিত কন্ঠে বলে,  দেখা পেয়েছিস  বাঈ?
হ্যাঁ, তিনি আমাকে সমস্ত কিছু দিয়েছেন।
কী বলিস বাঈ?
হ্যাঁ, পাথর ঠান্ডা হতে পারে, কিন্তু তাতো তোর কাছে, আমি তাঁকে পেয়েছি রক্তমাংসের মানুষের মতো, তপ্ত সেই দেবশরীর! হে মহাকাল! যুক্তকরে অন্ধকারকে প্রণাম করল দেবদাসী ললিতা। অতঃপর যুক্তকরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকল। তার মনে হচ্ছিল গর্ভগৃহের খোলা দরজা দিয়ে মহাকালেশ্বর বেরিয়ে এসেছেন এই অন্ধকারে। খুব কাছেই আছেন তিনি। তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ যেন শুনতে পাচ্ছে ললিতা। অবিকল মানুষের শরীর। মহাকাল তার সঙ্গে প্রিয়ামিলনে মত্ত হয়েছিলেন সেই শুক্লা অষ্টমীর হিমেল রাত্রিতে। সে হয়ে উঠেছিল তপঃক্লিষ্টা উমা। উমার তপস্যার কথা কি জানে না সুভদ্রা? মহাকালকে পাওয়া কি এতই সহজ? তিনি কি এত সহজে ধরা দেন? থরথর করে কাঁপছে ললিতা দাসী। তার স্মৃতিতে সেই রাত্রি সম্পূর্ণ হয়ে ফিরে এসেছে। শিহরণ জাগছে অঙ্গে অঙ্গে।

সুভদ্রা বলল, পাথর কী করে রক্তমাংসের হয়?
পাপের কথা বলিস না তুই।
স্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে দুই নারীকে। ললিতা দাসী নিশ্চুপ কান পেতে আছে। ওই অদূরে শীর্ণস্রোতে বয়ে যাচ্ছে গন্ধবতী নদী। রাত্রিচর কোনো পশু সরে যাচ্ছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। খসখস শব্দ কানে আসছে। মেঠো খরগোস হয়ত পার হয়ে যাচ্ছে বুনোপথ। নাকি অন্য কেউ? ললিতা দাসী সতর্ক হয়ে শব্দটি আবিষ্কারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে থাকে। অলিন্দে কি কোনো পদশব্দ জেগে উঠল? মহাকাল কোন পথে এসেছিলেন তার কাছে? গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে অলিন্দ পার হয়ে? তিনি গন্ধবতীর কুল থেকে উঠে এসেছিলেন?
সুভদ্রা বলল, মহাকালের দাসী কিন্তু প্রধান পুরোহিতের ভোগ্যা।
উনি যা করেন তা মহাকালের অভিপ্রায়
কে বলেছে?
উনিই বলেন, উনিই জানেন মহাকালের ইচ্ছা। বলতে বলতে গলা বুঁজে যায় ললিতার। পৌষ মাসের সেই রাতটির কথা কিন্তু সে গোপনই রেখেছে নিজের কাছে। যে কারুকার্যময় সোনার হারটি সে পেয়েছিল সেই পৌরুষের দানে, তার কথা কাউকে বলেনি। মন্দিরের বাইরে একটি গোপন জায়গায় পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে তা। নিজের কাছে রাখা তো বিপদ। তার নিজের বলতে কী আছে এখানে? একটি ঘরও বরাদ্দ নেই তার জন্য। অলিন্দে পড়ে থাকতে হয়। এই অলিন্দে ঘুমন্ত অবস্থায় সে প্রথমে প্রধান পুরোহিতের কামনায় পুড়েছিল। এই মন্দিরে যা ঘটে তা দেবতারই অভিপ্রায়, এই কথা সে বিশ্বাস করতে শিখেছে। সেই বিশ্বাস গভীর হয়েছ মহাকালের সঙ্গে সেই হিমরাত্রির অলৌকিক মিলনে।

সুভদ্রা বলল, দ্বিজদেবের সব কথাই মিথ্যা।
আতঙ্কিত হলো ললিতা, চাপা গলায় বলল, এই মন্দিরের পাথরেরও কান আছে, প্রধান পুরোহিত রাজারও শ্রদ্ধার মানুষ, তাঁর সম্বন্ধে এসব কী বলিস?
সুভদ্রা বলল, তুমি কি বোঝ না কোনো কিছুই?
আমি সামান্য নারী, আমি মহাকালের আশ্রিতা, মহাকাল ব্যতীত অন্য কিছুতে আমার মন নেই, প্রধান পুরোহিত মহাকালের সেবায়েত, তিনি রাজারও উপরে থাকেন...।

সুভদ্রা চুপ করে থাকে। বলতে বলতে থেমে যায় ললিতাও। তার ভয় হচ্ছে সত্যিই।  এমন কথা যে কেউ অবন্তী দেশে, উজ্জয়িনী নগরে, মহাকাল মন্দিরে বসে ভাবতে পারে, তা অচিন্তণীয়। যদি একথা প্রধান পুরোহিত কেন, যে কোনো ব্রাহ্মণের কানে যায় তাহলে কি রক্ষা থাকবে? সুভদ্রার স্থান হবে মহাকাল অরণ্যে। অরণ্যের পশুদের খাদ্য হবে সে তখন। ললিতা দাসী বলে, আর নয়, তুই এবার ফের।
ভয় করছে? জিজ্ঞেস করে সুভদ্রা, বলল, শ্রেষ্ঠীর কাছে আমাকে যেতে হবে, তাঁর দর্শন পেতে হবে বাঈ, শ্রেষ্ঠীই নগরের শ্রেষ্ঠ মানুষ।
প্রধান পুরোহিতকে বল।
প্রধান পুরোহিতই আমাকে বলেছেন শ্রেষ্ঠী আমার নৃত্যে মোহিত হয়েছিলেন।
তারপর?
হায় মহাকাল! তোমার সমস্ত ক্ষমতার যাঁর নিকটে গচ্ছিত আছে, সেই দ্বিজদেব ব্রহ্মদেব, প্রধান পুরোহিত এত নিষ্ঠুর কেন এত অশ্লীল কথা কেন তাঁর মুখে?
ললিতার হাত সুভদ্রার মুখে। সুভদ্রা ঝুঁকে পড়ল। দুই হাঁটুর ভিতর মাথাটি স্থাপন করে বলল, আমি শ্রেষ্ঠীর কাছে যাব, তিনিই আমার মহাকাল।
ললিতা দাসী বলল, এত অবুঝ হলে কী করে পাবি তাঁকে, শ্রেষ্ঠী যদি তোকে ফেরত দেয়, কার কাছে যাবি? ধনবান শ্রেষ্ঠীর কি নারীর অভাব? তাঁর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হলে মহাকাল নেবেন?
সুভদ্রা মুখ তোলে না। জবাবও দেয় না। ললিতা আকাশগঙ্গা দেখে মাথাটি তুলে। তৃতীয় প্রহর অনেকক্ষণ পার হয়ে গেছে। এখন হিমপতন বৃদ্ধি পেয়েছে। ললিতা ওঠে। তার সঙ্গে সুভদ্রাও। দু’জনে অলিন্দের অন্ধকারে এসে দাঁড়ায়। ললিতা বল, অপেক্ষা করলে মহাকাল একদিন ধরা দেবেন, আমি তাঁকে পেয়েছি।
সুভদ্রা বলল, কীভাবে পেলে, তুমি তো দেবদাসীই রয়েছ?
মহাকালের দাসী, যাব কোথায়?
পুরোহিত তোমার প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করেন।
করুন, তিনি তো জানেন না আমি কার অনুগ্রহে বলীয়ান।
সুভদ্রা অন্ধকারে খুব ভাল করে দেখতে পায় না ললিতার মুখখানি। কিন্তু অবাক হচ্ছিল তার কণ্ঠস্বরের গভীরতায়। সে বলল, জানলে তো তোমার ভাল হতো।
না। ললিতার কণ্ঠস্বর গাঢ়। বলছে, মহাকাল যার আশ্রয়, তার কী যায় আসে পুরোহিতের নিষ্ঠুরতায়, পুরোহিত আমাকে কত খারাপ কথা বলেন তা কি তুই জানিস? তুই তো গর্ভগৃহের দাসী, তোর তবু ছাড় আছে, কিন্তু আমি তো এখন নৃত্যের অধিকারও যেন হারিয়েছি।
তবু বলো মহাকাল সহায়!
হ্যাঁ, তাঁকে আমি পেয়েছিলাম শুক্লা অষ্টমীতে, সে ছিল পৌষমাস, পুণ্যতিথি।
সুভদ্রার ঠোঁটের কোণে কৌতুক-ছায়া ফুটে ওঠে অন্ধকার। সে কৌতুকের সুরেই বলল, তুমি তো লুকিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করেছিলে, দুয়ার তো বন্ধ ছিল?
না, তিনিই এসেছিলেন আমার কাছে।
দুয়ার খুলে?
জানিনা, মহাকাল সর্বত্র আছেন, এই অন্ধকারেও আছেন, পাথরেও আছেন, আকাশে আছেন, চাঁদের আলোতেও তিনি থাকেন, এসেছিলেন কোথা হতে তা আমি জানব কী করে?
তোমার স্বপনে এসেছিলেন?
না, জাগরণে, তুই শুনে অবাক হবি, মহাকাল আসেন এইভাবেই।

সুভদ্রা ঘোর অবিশ্বাসী হয়ে পড়েছে শ্রেষ্ঠীকে দেখার পর থেকে। আর শ্রেষ্ঠীর কথা জানাতে জানাতে বৃদ্ধ পুরোহিত যখন তার প্রিয় অঙ্গ স্পর্শ করে নিজের কামনা মেটাচ্ছিলেন, তখনই যেন সকল বিশ্বাস গেছে জলাঞ্জলি। এখন মহাকালের সম্মুখে সমর্পণ নৃত্য প্রদর্শন করে বটে, কিন্তু নিজেই টের পায়  ভিতরে কোনো আবেগ নেই। যেন সে তার কৃতকর্মই সম্পাদন করছে। দায়িত্বটুকু পালন করছে মাত্র। তাকে প্রধান পুরোহিত বলেছিল তার নৃত্যে মোহিত হয়েছিলেন শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত, কিন্তু সুভগ দত্ত তাকে ভোগ করার দায়িত্বটি দিয়ে গেছেন বৃদ্ধ পুরোহিতকেই। একশত স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে গেছেন শ্রেষ্ঠী, সেই মুদ্রা সুভদ্রার, কিন্তু বিনিময়ে বৃদ্ধ পুরোহিত দ্বিজদেব ব্রহ্মদেব ভট্ট তার সর্বস্বের অধিকারী। হায় মহাকাল। এসব বৃদ্ধ পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণের মতো করেই বলেছেন তাকে গর্ভগৃহে বসে। যত বলেছেন সুভদ্রা ততো আকুল হয়েছে শ্রেষ্ঠীর প্রেমে। কাউকে অবলম্বন না করে সে এই যৌবন নিয়ে বাঁচে কীভাবে? কে তাকে বাঁচবে এই খিন্ন জীবন থেকে? গর্ভগৃহে দেবতার সম্মুখে বসে যদি বৃদ্ধ পুরোহিত অশ্লীল আচরণে প্রবৃত্ত হয়, তবে হে মহাকাল তুমি কার? ললিতা দাসী  বলল, সুভদ্রা আমাকে গর্ভগৃহে ভগবানের সম্মুখে নিয়ে যাবি?
যাবে তুমি?
যাব; কতদিন তাঁকে নিরালায় দেখিনি, পাইনি তাঁকে, সেই রাত্রির পর পর তিনটি পক্ষ চলে গেছে, আর তো এলেন না মহাকাল।
সুভদ্রার কৌতূহল প্রবল হলো। সে অন্ধকার হাত ধরল ললিতাদাসীর। অতি সতর্ক পায়ে দুই রমণী দেবতার উদ্দেশে রওনা হলো। অন্ধকার অলিন্দে তাদের পায়ের নূপুরের শব্দ ওঠে ক্ষীণ। ওই শব্দই তো তাদের অস্তিত্বকে প্রকাশ করে দিতে পারে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের নিকটে। যদি তাঁদের ঘুম ভেঙে যায় জিজ্ঞাসায় জিজ্ঞাসায় জীবন যাবে। নূপুরের শব্দ লুকিয়ে মহাকালের নিকটে পৌঁছতে সময় লাগে অনেক। কিন্তু গর্ভগৃহের সম্মুখে প্রশস্ত আঙিনায় পৌঁছে আবেগে যেন বিস্ফোরিত হয়ে যায় ললিতা দাসী, কেঁদে ওঠে, হে ভগবান!

ললিতাকে টেনে গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করায় সুভদ্রা। সে ক্রমশ ভীত হয়ে পড়ছিল ললিতার আচরণে। যদি কেউ টের পায়? মধ্যরাতে দুই রমণীর তো একসঙ্গে গর্ভগৃহে বাস শাস্ত্রসম্মত নয়। দুয়ার বন্ধ করে সুভদ্রা। মহাকালেশ্বরের সম্মুখে দুই ঊরু বেদীর মতো প্রসারিত করে বসেছে দুই রমণী।

গর্ভগৃহ ধূপগন্ধে ভরপুর। ঘরটিতে পুষ্পগন্ধ আছে। কিন্তু সেই গন্ধের তাজা ভাবটি এই মধ্যরাতে অন্তর্হিত। পচন ধরেছে সমস্ত দিনে নিবেদিত পুষ্প অর্ঘ্যে। এখন মহাকাল ভগবানের নিকষ কালো লিঙ্গ মূর্তিটি তিন-চতুর্থাংশ পুষ্পের স্তূপে ঢেকে। স্তূপ ভেদ করে লিঙ্গমূর্তিটি যেন মাথা তুলেছে। এই মূর্তি শুধুই পাথর। এই মূর্তির কোনো অঙ্গ নেই। ত্রিনয়নের একটিও নেই। এই মূর্তির কোনো প্রসন্নতা নেই, নেই বিষণ্ণতা। নেই রোষচিহ্নও। ইনি শুধুই পৌরুষ। ইনি প্রাণীর জন্মসূত্রে প্রোথিত হয়ে  জীবজগতের জন্মবীজ ধারণ করে আছেন।

দেবতার সামনে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছিল। প্রদীপের আলো ঘরের সর্বত্র পৌঁছতে পারেনি, কিন্তু মহাকাল মূর্তির গায়ে পড়ে পিছলে যাচ্ছে তাঁর তৈলাক্ত দেহ থেকে। ললিতা দাসীর দুই চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে আসছে গণ্ডদেশে, তা থেকে আনন্দাশ্রু পড়ছে। বুকের উপর। মলিন পশম চাদর, মলিন উত্তরীয়খানি দেবদাসী সরিয়ে রেখেছ গা থেকে। উত্তেজনায় যুগল-বক্ষ কম্পিত হচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাসে দেবদাসীর দেহে তরঙ্গ উঠছে। ললিতার দিকে সবিস্ময়ে চেয়ে আছে সুভদ্রা দাসী। যা বলছে তা কি তাহলে সত্যি?

ললিতা দাসী বহুদিন পরে গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। তার সাধ হয়েছিল সেই শুক্লা অষ্টমীর রাতের পরের দিন মহাকালের কাছে নিজেকে নিবেদন করে নৃত্যে। কিন্তু তা হয়নি। প্রধান পুরোহিত তাকে সে অনুমিত দেননি। এখন কি এই মধ্যরাতে সে জাগিয়ে  তুলবে মহাকালেশ্বর ভগবানকে? লাস্য নৃত্যে জাগাবে তাঁকে?

সুভদ্রা নিজের উত্তরীয় দিয়ে মুছে দিল ললিতার চোখের জল, তারপর নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, বলবে না ভগবানকে কীভাবে পেয়েছো?

বলবে। বলার জন্যই তো উন্মুখ হয়ে আছে ললিতা। তার জীবনের এক পরমপ্রাপ্তি হয়েছে সেই পুণ্য রাতটিতে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গর্ভগৃহটি দেখছিল। চতুষ্কোণ ছাদ, একটি স্তম্ভ, ঝামাপাথরের দেওয়াল, অমসৃণ মেঝে। সে উপুড় হয়ে মাথাটি স্পর্শ করাল মেঝেয়, ডাকল ভগবানকে, হে মহাকাল, সেই পুণ্যরাত্রির কথা আমি উচ্চারণ করছি তোমার সামনে, তোমাকে সাক্ষী রেখে, হে ভগবান তারপর থেকে আমি শুধু তোমাকেই স্মরণ করি, আর তো এলে না দেবতা, আমার সমস্ত অঙ্গে তোমার স্পর্শ এখনো অনুভব করি ভগবান, আমার দুই বুকে তোমার সোহাগ চিহ্ন এখনো যেন রয়েছে, হে দেবতা, সেই সেই হিমশীতল রাত্রে তুমি এলে বুঝি  রাজবেশে...।

সুভদ্রা বিস্মিত হলো। সুভদ্রার দুই চোখ স্ফীত হলো ললিতা দাসীর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণে। উঠে বসেছে দেবদাসী। গায়ের পশম উত্তরীয় সরিয়ে বক্ষাবরণী থেকে মুক্ত করেছে স্তন দুটিকে। দেবতার সামনে তুলে ধরেছে নগ্নতা। একটু একটু করে বর্ণনা করছে সে মোহময়ী রাত্রিটিকে। কী আশ্চর্য! এ যে প্রিয় মিলনের বিবরণ। নারী আর পুরুষের মিলন মুহূর্তটিকে কী অনুপম ভঙ্গিতে না শোনাচ্ছে ললিতা দাসী।  শুনতে শুনতে শিহরিত হয় সুভদ্রা। তার জীবনে তো এমন কখনো ঘটেনি। বৃদ্ধ পুরোহিত যে আচরণ করেছেন তার সঙ্গে, তা তো মনুষ্যেতর প্রাণীর জীবনেও ঘটে না কখনো। সারমেয়র জীবনও অমন হয় না কখনো। সুভদ্রার দুই চক্ষু বুঁজে যায়। তার মনের ভিতরে শ্রেষ্ঠী সুভগদত্ত জেগে ওঠেন। কানে আসছিল ললিতাদাসীর অদ্ভুত উচ্চারণ। মন্ত্রপাঠের মতো করে ললিতা দাসী বর্ণনা করছিল মহাকালের সোহাগ বিবরণ। মহাকাল সেই হিম-রাত্রিকে করে তুললেন উষ্ণ। তিনি যেন গিরিনন্দিনী উমার সঙ্গে মিলিত হলেন সেই অন্ধকারে।

চলবে

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব এগার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চৌদ্দ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পনের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ষোল)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সতের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আঠারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব উনিশ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top