সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব একুশ) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:০৩

আপডেট:
১৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৩৬

ছবিঃ অমর মিত্র

 

ললিতা দাসী অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করল, তোর কথা সত্য ?

কী সত্য?

ঘাড় ঘুরিয়ে গর্ভগৃহের তাকায় দেবদাসী। অর্গল রুদ্ধ আছে কিনা দেখে নেয়। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে দেবতার দিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলে, তোর মতো আমারও মনে হতো মহাকাল পাথর মাত্র, মহাকাল যেন হিমশীতল।

কী বলছ? বিস্মিত হয় দেবদাসী সুভদ্রা।

যা বলছি তা সত্য, মহাকাল যেন জড়, অনড়, প্রস্তরবৎ।

দেবদাসী সুভদ্রার মুখমণ্ডলে ভয়ের ছায়া ফুটে ওঠে। কুঁকড়ে যায় যেন সে। যে কথা সে নিজেই উচ্চারণ করেছিল এই গর্ভগৃহের বাইরে, চাতালের অন্ধকারে বসে, সেই কথা দেবতার সামনে অন্যের মুখে শুনতে  স্বস্তি চলে যায়। এই গর্ভগৃহে দেবতা আছে। দেবতা আছেন তার সম্মুখে। দেবতার সম্বন্ধে যে কথাই বলুক না কেন সুভদ্রা, তা তো এখনে উচ্চারিত হয়নি। হয়েছিল মন্দিরের চাতালে, অন্ধকারে, এই গর্ভগৃহ থেকে দূরে। এখন ললিতা দাসী তার সূত্র ধরে সেই কথা শুরু করেছে আবার। যেন সে মহাকালকে শোনাতে চাইছে কী বলেছে সুভদ্রা মহাকালের অগোচরে। যেন মহাকাল সত্যিই রক্তমাংসের কেউ। তিনি গর্ভগৃহে থাকলে সেখানেই থাকেন, তিনি মন্দিরে থাকলে  সেখানেই থাকেন, তিনি তখন গর্ভগৃহের বাইরে, মন্দিরের বাইরে, উজ্জয়িনী নগরের বাইরে থাকতে পারেন না যেন। তিনি প্রদীপের আলোর নীচে থাকলে অন্ধকারে থাকতে পারেন না নিশ্চয়। তিনি মানুষের মতো একমাত্রিক। গর্ভগৃহে তাঁর অধিষ্ঠান, তাই গর্ভগৃহে এসে দেবদাসী ললিতা তাঁকে জানিয়ে দিচ্ছে কী বলেছে সুভদ্রা দাসী এই গৃহের বাইরে মহাকাল দেবতার অসাক্ষাতে।

সুভদ্রা বলল, থাক ওসব কথা।

কথাটি যেন শুনতেই পায় না ললিতা দাসী, ধীরে ধীরে বলে, তোর কথা সত্য মহাকাল যেন শুধু পাথর, পাথর আর পাথর।

না! আতঙ্কত হয়ে কুঁকড়ে যায় সুভদ্রা।

ললিতা দাসী বলল, কিন্তু পাথরকে তো জাগাতে হয়, ওই হিম শীতলতা যেন আমাদের পরীক্ষা। মহাকাল যেন দেখতে  চান কত নিষ্ঠাবতী আমি, শোন রে সুভদ্রা, দ্বিজদেব তো ভয় দেখাতেন অনাচার হলে,  তাঁর নির্দেশের ব্যত্যয় ঘটলেই মহাকালের তৃতীয় নয়ন জ্বলে উঠবে, ভস্ম হয়ে যাব আমরা।

হ্যাঁ। মুখ নিচু করে বসে আছে সুভদ্রা।

ললিতার মুখখানিতে জেগে ওঠে প্রসন্নভাব। সে মৃদু  কণ্ঠে বলে, আসলে তা নয়, যখন মহাকাল হরণ করলেন আমার উত্তরীয়, যখন হরণ করলেন আমার মেখলা, আমার দেহখানি যখন উন্মুক্ত হয়ে গেল মহাকালের সামনে, তখন লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে আমি তাঁর দুটি চোখ ঢেকে দিয়েছি দু’হাত দিয়ে, কিন্তু তিনি যে মহাকাল, তিনি প্রবল কামুক পুরুষ তখন, তাঁর তৃতীয় নয়ন তখন জেগে উঠল, আমি কিছুই করতে পারলাম না, তিনি আমাকে দেখতে লাগলেন, আমি যে দেহখানি প্রতিদিন নিষ্ঠাভরে নিবেদন করতাম তাঁকে, সেই দেহখানিতে তিনি এঁকে দিতে লাগলেন ভালবাসার চিহ্ন।

সুভদ্রা শিহরিত হলো। সে মহাকালেশ্বরের লিঙ্গমূর্তির দিকে সভয়ে তাকায়। ওই হিম শীতল পাথর প্রাণ পেয়েছিল? সুভদ্রা সন্দেহভরা চোখ নিয়ে ললিতাকে দেখতে থাকে। দীপের আলোতেও ললিতা দাসীর মুখমণ্ডলে শিহরণের ভাব স্পষ্ট। সে ললিতার কাছে সরে যায়। তার পিঠে হাত রাখে, কে এসেছিল?

ললিতা আনত হয়, মহাকাল।

সত্য বল।

মহাকালই চিরসত্য।

পুরোহিত দ্বিজদেব, ওই বুড়োটা?

না।

শ্রেষ্ঠী?

না।

কোনো রাজকর্মচারী?

না।

ভিনদেশী কোনো বণিক?

নয়। দু’ হাতে কান চেপে রেখেছে ললিতা, আমি মিথ্যে বলছি না।

স্বপ্ন দেখেছিলি? জিজ্ঞেস করে সুভদ্রা।

না।

কেমন ছিলেন তিনি?

আশ্চর্য পৌরুষ তাঁর। কেঁপে গেল ললিতা।

তাঁকে দেখেছিলি?

না, চোখ খুলতে পারিনি। উত্তর দিতে গিয়ে থরথর করে কাঁপছে ললিতা। ভীতা কবুতরী। 

একবারও চোখ খুলিসনি? সুভদ্রা জেরা করে।

অন্ধকার ভীষণ, অন্ধকারে তিনি মিশে গিয়েছিলেন যেন।

সত্য বল, যতই অন্ধকার হোক, সে তো তোর উপর উপগত হয়েছিল।

ললিতা দাসী বলল, এভাবে কথা বলে না সুভদ্রা, তিনি এই মহাকাল, আমার আরাধ্য, তাঁকেই নিবেদন করেছি নিজেকে।

সে তো সব দেবদাসী করে, নতুন কী? সুভদ্রা বলল।

তাঁর সঙ্গে ছলনা চলে না, মহাকালের দাসী হয়ে শ্রেষ্ঠীর প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পাপ, মহাকাল সব জানেন।

কোনোদিন মহাকাল আমার স্বপ্নেও আসেন না। সুভদ্রা বলল।

প্রাণভরে তাঁকে না ডাকলে আসবেন কেন?

আর কেউ কি ডাকেনি, সকলকে তো মহাকাল ছাড়া আর সকলে ভোগ করে।

ললিতা বলল, আমি জানিনা, দেবতার সামনে এসব উচ্চারণও ঠিক না, সুভদ্রা, যদি সেই সময় হতো, দেখাতাম এই বুকে তাঁর দংশনের চিহ্ন।

সুভদ্রা শিহরিত হলো আবার। ললিতার উন্মুক্ত স্তন নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে কাঁপছে। স্তনবৃন্ত  দৃঢ় হয়ে উঠেছে। কামতপ্ত হয়েছে যেন ললিতা। সে দীপটি  তুলে ধরল। দীপের আলোয় পর্যবেক্ষণ করল ললিতাকে। এতদিন কি থাকে সেই চিহ্ন? মিলিয়ে গেছে। তার কৌতূহল প্রবল হচ্ছে। কৌতূহলে তার বক্ষদেশ স্ফীত হয়ে উঠেছে যেন। কে এসেছিল? শ্রেষ্ঠী কি? সে তো শ্রেষ্ঠীকে মনে মনে কামনা করে। টের পেয়েছিল শ্রেষ্টী তার রূপে, নৃত্যে মুগ্ধ হয়েছেন। সে জানে শ্রেষ্ঠীর ভোগ্যা হতে পারলে এই মন্দির থেকে মুক্তি। প্রধান পুরোহিতের বিকৃত আচরণে দলিত হতে হতে দেবতার প্রতি বিশ্বাসই যেন টলে গেছে তার। ললিতার একটি কথাও বিশ্বাস হচ্ছে না সুভদ্রার। সবই বোধহয় ললিতার কল্পনা। এখন তো দেবতার অঙ্গমার্জনার অধিকারও নেই তার। তবুও মহাকাল তাকে গ্রহণ করেন? পাগল হলো নাকি ললিতা? যা বলছে সব তার কল্পনা! নাকি কেউ এসেছিল সত্যি? সে কে?

ললিতা বলল, আমার কাছে তাঁর চিহ্ন আছে।

কই চিহ্ন? সুভদ্রা নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে ললিতার বুক।

ললিতা পশম উত্তরীয়তে বুক ঢেকে বলল, তিনি রেখে গেছেন তাঁর চিহ্ন, তাঁর কণ্ঠহার, সেই হার দেখলে তোর  বিশ্বাস হবে।

সুভদ্রার চোখে গভীর সন্দেহ জেগে ওঠে। তাহলে কি সত্যই শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত? শ্রেষ্ঠী গ্রহণ করেছেন ললিতা দাসীকে? ললিতা তাকে মহাকাল জ্ঞানে নিবেদন করেছেন নিজের সর্বস্ব? ললিতা উঠে দাঁড়াল, আয় আমার সঙ্গে।

সুভদ্রা চলল। গর্ভগৃহের দ্বার টেনে দিয়ে দু’জনে বেরিয়ে এল অন্ধকারে। অলিন্দে যে দীপটি জ্বলছিল তা হাতে নিল ললিতা। একহাতে মৃদু বাতাস আড়াল করে দীপ হাতে সে এগোতে থাকে।

সুভদ্রা বলল, এতদিন তো বলিসনি?

মনে হতো মহাকাল গোপন রাখতে বলেছেন।

তবে বললি কেন? সুভদ্রা জিজ্ঞেস করে তপ্ত  কণ্ঠে।

মহাকাল ক্ষমা করবেন, তুই যখন নিজের অবিশ্বাসের কথা বললি...।

সুভদ্রা ভয় পেল। এই কথা যদি প্রধান পুরোহিতের কানে যায় আর রক্ষা থাকবে না। এই মন্দিরের দেওয়ালও সজাগ। কথা চলে যায় প্রধান পুরোহিতের কাছে। এই মন্দিরে যে হাওয়া থাকে, তা শীতের হোক, গ্রীষ্মের হোক, বসন্তের হোক, সেই হাওয়ায় কথা চলে যায় প্রধান পুরোহিতের কাছে। কী সর্বনাশ! কেন সে ললিতার কাছে মনের বাসনা খুলে বলল? ললিতা যদি বলে দেয়? সুভদ্রা বলল, আমার কোনো অবিশ্বাস নেই, তুই সব ভুলে যা।

কী ভুলে যাব, সেই রাত্রের কথা?

না, আজকের কথা। অস্ফুটস্বরে বলল সুভদ্রা।

ললিতা কোনো উত্তর দিল না। তারা মন্দিরের পিছনের দিকে চলে এসেছে। মূল মন্দিরের পর অনেকখানি পতিত ভূমি। তারপর দেড়মানুষ প্রমাণ প্রস্তর প্রাচীর। প্রাচীরের পিছনের গন্ধবতীর ধারা। মাথায় হিমরাত্রির আকাশ। দক্ষিণ-পশ্চিমে লুব্ধক নক্ষত্রটি জেগে। তার নীচে যে নক্ষত্রটি, সে হলো অগস্ত্য। চাঁদ দেখা যায় না। নক্ষত্রের আলোর নীচে দাঁড়িয়ে ললিতা বলল, মন্দিরের দ্বার বন্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যারতির পর, যিনি আমার কাছে এসেছিলেন, তিনি এই মন্দিরেই বাস করেন।

চিহ্নটি কই?

আমার কথা সত্য, মন্দিরে যাঁরা থাকেন তাঁরা ব্যতীত কেউ তো আসতে পারে না আমার কাছে?

প্রধান পুরোহিত, ওই কামুক অনাচারী বৃদ্ধ?

না, তিনি মহাকালেশ্বর। দু’হাত জোড় করে ললিতা দাসী নত হলো, মন্দিরের দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে এখানে।

প্রাচীরের কাছে নিম গাছের গোড়ায় নিচু হয়ে বসল ললিতা। তারপর পাথর সরিয়ে কণ্ঠহারটি বের করল। ছিন্ন একটি মেখলার একখণ্ড বস্ত্রে জড়ানো হারখানি তুলে অন্ধকারে তা খুলে দেখায়।

আকাশ থেকে যেন আলোর ফুল নেমে এসে শূন্যে মালা তৈরি করেছিল। সুভদ্রা বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছে। হীরে, মণিমুক্তা খচিত সোনার হারখানি যেন আকাশ গঙ্গায় ভেসে যাওয়া আলোর ফুল দিয়ে গাঁথা। আলোর স্রোত বয়ে গেল সুভদ্রার সামনে। দ্যুতিময় হয়ে ওঠে পুরনো আঁধার। চোখ ঝলসে গেল সুভদ্রার। এ তো অমূল্য সম্পদ। এ কণ্ঠহারের নাম কী? এই কি মহালতা? মহালতার কথা শুনেছে সুভদ্রা, কোনোদিন চোখে দ্যাখেনি। মহালতার কথা মনে পড়তেই দেবদাসী সুভদ্রা শিহরিত হলো। কী আশ্চর্য! সেই হার কিনা সামান্য দেবদাসীর অধিকারে? কে দিতে পারে? সুভদ্রা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। মহালতা তো সামান্য সম্পদ নয়। শুনেছে শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত তার কন্যার বিবাহের সময় মহালতা অর্পণ করেছিলেন। শুনেছে উজ্জয়িনীর রাজা ভর্তৃহরির পিতা গন্ধর্ব সেন এই অলঙ্কার দিয়েছিলেন তাঁর আশ্রিতা গণিকা রসমঞ্জরীকে। এসব শোনা কথা। রসমঞ্জরী থেকে সেই কণ্ঠহার কি দেবদত্তার অধিকারে গেছে? আর এই হার থাকতে পারে রানী ভানুমতীর, রাজা ভর্তৃহরির। থাকতে পারে সুভগ দত্তর। থাকতে পারে খুব ধনী কোনো শ্রেষ্ঠী, বণিকের। ভাবতে ভাবতে উত্তেজিত সুভদ্রা ছিনিয়ে নেয় হারখানি, তারপর অন্ধকারে দৌড়য়।

কী করলি বাঈ? ফিরিয়ে দে, ও যে মহাকালের দেওয়া, ও তে মহাকালের ছোঁয়া। চাপা আর্তনাদ করে সুভদ্রার পিছনে ধাবিত হয় ললিতা। চাপা গলায় ডাকছে সে, গর্জন করছে রাগে, ওরে তোর সব্বেনাশ হবে, মহাকাল তোকে শেষ করবেন।

সুভদ্রা মন্দিরে প্রবেশ করে অন্ধকারে মিশে গেল। তার নূপুরধ্বনি অনুসরণ করে ললিতা দৌড়তে লাগল। চেনা অন্ধকার চেনা অলিন্দ। তার অনুমান ঠিক সুভদ্রা গেছে গর্ভগৃহের পথে। ললিতা হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে দেখে গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ। দরজার বাইরে, দেওয়ালে কুলুঙ্গিতে রাখা প্রদীপ নিভু নিভু। ললিতা দরজায় করাঘাত করে। ডাকে সুভদ্রাকে, বাঈ, দোর খোল, বাঈ রে আমাকে ভগবান দিয়েছেন ওটা। স্তব্ধ মন্দিরের ললিতার ক্রন্দনধ্বনি, করাঘাত, নূপুরের শব্দ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এতক্ষণে সেই শব্দে মন্দিরের খিলানে খিলানে আশ্রয় নেওয়া কবুতরের ঘুম ভাঙল। কবুতরের দল জেগে উঠে ডাকতে আরম্ভ করল। কবুতর ডাকতে, ডানা ঝাঁপটাতে মন্দিরের সীমানায় নিম, আম, কাঁঠাল, কাঠগোলাপ গাছে আশ্রয় নেওয়া পাখিরা ডেকে উঠল। সেই পাখির ডাক মন্দিরের প্রাচীর পার হয়ে চলে গেল। প্রাচীরের ওপারে গন্ধবতী নদীর ধারের পুরনো এক শিরিস গাছে ঘুমিয়ে থাকা কাকের দল অন্য পাখিদের ডাকে জেগে উঠে অন্ধকারে ভয় পেয়ে ডাকতে আরম্ভ করল। অন্ধের মতো অন্ধকারে ডানা ঝাপটে আবার ডালে ফিরে আর্তনাদ করতে লাগল। কাকের ডাক, পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল পথের কুকুরদের। তারা জেগে উঠে সন্দিগ্ধ হয়ে কোনো দিশা না খুঁজে পেয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল আকাশের দিকে চেয়ে। অন্ধকারে গ্রহ তারা খচিত ফাল্গুনের আকাশই তাদের চেনা। আকাশের গ্রহ তারাদেরও তারা চেনে। চেনে তাই দক্ষিণ আকাশের অস্তগামী অগস্ত্য, তার উপরে জ্বলজ্বলে লুব্ধকের দিকে চেয়ে কাঁদতে লাগল। আকাশগঙ্গার দিকে চেয়ে কাঁদতে লাগল। কেঁদে কালপুরুষকে ডাকতে লাগল যেন। সপ্তঋষির দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকল।  তারা ভয় পেয়েছিল। কুকুরের কান্নায় গন্ধবতী নদীর পাড়ের ধীবরপল্লীর মানুষজন জেগে ওঠে। তারা কলরব করতে লাগল। অন্ধকার নদীর দিকে তাকাল, আকাশের দিকে তাকাল। নগরে কি শত্রুসৈন্য ঢুকল? হুন দল? তারা কিছু না বুঝতে পেরে জেগে থাকল অনেকজন মিলে।

বুড়ো প্রধান পুরোহিতের ঘুম আসে না নিবিড় হয়ে। যত বয়স হচ্ছে, ঘুম তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তবে এরই ভিতরে ঘুম আর জাগরণে পড়ে থাকেন তো। তাঁর ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙতেই কুকুরের ডাক শুনলেন প্রধান পুরোহিত। অন্ধকারে কুকুর কাঁদে কেন? কাক ডাকছিল না? এখন থেমে গেছে। কবুতর ডাকতে ডাকতে আবার স্তব্ধতায় ফিরে যাচ্ছে। প্রধান পুরোহিতের মনে হলো ওঠেন। তস্কর আসতে পারে। তবে কিনা এ হলো মহাকাল মন্দির। অবন্তী দেশের মানুষের মহাকালে অসীম বিশ্বাস। মহাকাল মন্দিরে তস্কর প্রবেশের আগে দশবার ভাববে।  বছর ক’য় আগে তস্কর ধরা পড়েছিল  মন্দিরের ভিতর। সে গর্ভগৃহে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। ধরা পড়ে প্রহৃত হয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করে। প্রধান পুরোহিত ব্রহ্মদেব ভট্টই তাকে নিমগাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলেছিলেন ধীবরপল্লীর লোক দিয়ে। তারপর এসেছিল উতঙ্ক। উতঙ্কই একা একা মেরে ফেলে লোকটাকে যন্ত্রণা দিয়ে। সেই মৃত্যুযন্ত্রণা বহুলোক প্রত্যক্ষ করেছিল। শূদ্রপল্লীর মানুষজন গন্ধবতীর তীরে দাঁড়িয়ে শুনেছিল মৃত্যুকান্না। লোকটা শূদ্রপল্লী থেকেই এসেছিল। তারপর থেকে মন্দির নিরুপদ্রবে আছে। মন্দিরের সম্পদ তো কম নয়। সমস্ত অলঙ্কার, ধনরত্ন যথাস্থানে গচ্ছিত আছে। সেই স্থানের কথা জানেন প্রধান পুরোহিত। জানেন সুভগ দত্ত। তাঁকে বলেছেন, ব্রহ্মদেব। রাজাকে তিনি বলতে বাধ্য, কিন্তু রাজার কোনো কৌতূহল নেই। মহাকাল দানস্বরূপ যা পান, সব প্রকারান্তরে প্রধান পুরোহিতেরই সম্পত্তি।

ব্রহ্মদেব উঠলেন। তাঁর মনে হলো তস্কর না হলে ওভাবে কুকুর কাঁদে কেন? কী অমঙ্গলের ক্রন্দন ধ্বনি! আবার কি হুন আক্রমণ হবে। ব্রহ্মদেব উঠে তাঁর জায়গায় বসেই ডাক দিলেন, ললিতারে, ললিতা—।

সাড়া পেলেন না তিনি। সাড়া না পেয়ে ক্রুব্ধ হলেন প্রধান পুরোহিত। তাঁর ভয় করছিল। কুকুরের কান্না ক্রমশ থেমে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু তা যে রেশটি ছড়িয়ে দিয়েছিল অন্ধকারে তা ব্রহ্মদেবের গায়ের রোম খাড়া করে দিয়েছিল। তাঁর ভয় বাড়ছিল। মনে হচ্ছিল সত্যিই হয়ত শত্রু ঢুকেছে নগরে। হুন জাতি যদি আবার প্রবেশ করে, প্রথমে তো আসবে মন্দিরে। মন্দির লুঠ করে পাবে সোনা, রূপা, হীরা, মুক্তা, সঙ্গে যুবতী দেবদাসী। পুরোহিত হাঁক দিলেন, অ্যাই ললিতা, মাগী  তুই কোথায় গেলি? শুনে যা।

ললিতা এল না। প্রধান পুরোহিত চুপ করে বসে থাকলেন। আবার হাঁক দিলেন। অবশেষে নূপুর বাজল অন্ধকারে। ললিতার কানে গিয়েছিল ব্রহ্মদেবের ডাক। সে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে আসছে। প্রদীপ নিল এক কুলুঙ্গি থেকে। তারপর দরজায় এসে দাঁড়াতেই প্রধান পুরোহিত ক্রোধে আগুন হয়ে উঠলেন, ছিলি কোথায়?

ললিতা বলল, মহাকাল।

মহাকাল মানে?

ললিতা বলল, প্রভু, আমি মহাকালকে পেয়েছি।

ব্রহ্মদেব অবাক হলেন, তার মানে?

মহাকাল এসেছিলেন, আমার নিকটে, সত্য প্রভু।

ব্রহ্মদেব ভট্ট ডাকলেন ললিতাকে ভিতরে, ললিতা প্রদীপটি দেওয়ালের ধারে রেখে প্রধান পুরোহিতের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তাঁর পায়ের পাতা দু’হাতে ধরে অস্ফূট গলায় বলে, সত্য বলছি প্রভু।

সারমেয় কাঁদে কেন? তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

জানি না প্রভু।

কবে এলেন মহাকাল? প্রধান পুরোহিত তাঁর একটি পা ললিতার কাঁধে তুলে দেন, অন্য পা তার  বুকে স্থাপন করেন, তোর কাছে আসবেন কেন তিনি?

ললিতা বলে, ওই কথাই সত্য প্রভু।

ওইজন্য সারমেয় কাঁদে, মাগী তুই কী বলছিস সে খেয়াল আছে?

ললিতা কেঁদে ফেলে বুকে আঘাত পেয়ে। সে ছিটকে সরে গিয়ে বলে, সারমেয় কাঁদে কেন সারমেয় জানে, হে প্রভু সুভদ্রা আমার সর্বস্ব হরণ করেছে, বিহিত করুন।

চলবে

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব এগার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চৌদ্দ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পনের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ষোল)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সতের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আঠারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব উনিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব কুড়ি)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top