সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

ধ্রুবপুত্র (পর্ব তেইশ) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৫৪

আপডেট:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২২:৫২

ছবিঃ অমর মিত্র

 

চৈত্র ধু ধু করছে। বাতাসে এখন ঘূর্ণী। ঘূর্ণী বাতাসের মতো রাজার কলঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছিল এদিক ওদিক। ফিসফাস হচ্ছিল, কানাকানি হচ্ছিল, মুখে মুখে কথা ছড়িয়ে যাচ্ছিল নগর পেরিয়ে আরো অনেক দূরে।

রাজার গায়ে কলঙ্ক লাগে না। তবু লাগছিল। চাঁদে কি কলঙ্ক নেই? কলঙ্ক নিয়েই চাঁদ সুন্দর। কিন্তু রাজার কলঙ্ক রাজাকে সুন্দর করেনি। পাপ! পাপ ঘিরে ধরেছে এই নগরকে, এই অবন্তী দেশকে। 

ফাল্গুনী পূর্ণিমা গিয়ে কৃষ্ণপক্ষ আরম্ভ হয়ে গেছে। শীত এবার আগেই ফুরিয়েছিল। তবে কিনা চৈত্ররাতেও হিমভাব থাকে অন্ধকারে। এবার তা একবিন্দুও নেই। মেঘবাহী যে বাতাস মাঘ থেকে চৈত্র পর্যন্ত যে-কোনো সময়ে ফেরে হিমালয় থেকে, যায় অপরা সাগরের দিকে, যাত্রা পথে বৃষ্টি নামায়, তা দু-এক ফোঁটা হলেও নামায়, সেই বাতাসের দেখা নেই এবার। বাতাস ফিরছে না উত্তর-পূর্ব থেকে। ফিরবে কী করে? বাতাস তো আষাঢ়-শ্রাবণে মেঘ নিয়ে যায়নি অপরা সাগর কিংবা দক্ষিণ-পশ্চিমের আম্রকুট পর্বত থেকে হিমালয়ে। যে বাতাস যায়নি, সেই বাতাস ফিরছে না। মাঘ-ফাল্গুনেও বৃষ্টির ছিটেফোটা পেল না অবন্তীর মাটি ও মানুষ।

অন্ধকার রাত্রি ভ্যাপসা। দিনমানের প্রকৃতিও দমচাপা। এর ভিতরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল কলঙ্ককথা। উজ্জয়িনীর বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছিল রাজার পাপ। মহাকাল মন্দিরে ধর্ষিতা হয়েছে এক দেবদাসী। ধরা পড়েনি ধর্ষক। কিন্তু তার পরিচয় গোপন থাকেনি। ধর্ষিতা দেবদাসী অন্ধকারে নিপীড়কের কণ্ঠহার ছিনিয়ে। নিয়েছে। সন্তানহীন রাজা শেষ পর্যন্ত মহাকাল মন্দিরকে অপবিত্র করেছেন।

কথাটা এইভাবে যখন রটে যাচ্ছিল, কেউ মাথা ঘামাচ্ছিল না। লোকে জানছিল রাজা এক দেবদাসীর যৌবন লুট করেছেন। লোকজনের মনে হচ্ছিল উজ্জয়িনীর রাজার এমন সাজে না। তিনি তো এই পুণ্যভূমির রাজা। রাজা সবই পারেন। সুন্দরী নারী, যুবতী যাঞা করলেই তাঁর দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াবে। রাজার কি  অভাব আছে? এই অবন্তীর আকাশের নীচে যা আছে, স্থাবর, অস্থাবর সবই তাঁর। তবে কেন তিনি তস্করের মতো মহাকাল দেবতার দেবদাসীকে ধর্ষণ করবেন? কামুক, লম্পটের মতো কেন হবে ভাব। আচরণ? এসব প্রশ্ন কারো কারো ভিতরে জেগেছে। তারপর সে ভেবেছে তিনি তো রাজা, রাজা কোনো অন্যায় করতে পারেন না। রাজার পাপ হয় না। কোনো পাপ রাজাকে স্পর্শ করতে পারে না। রাজা সূর্যের মতো নিষ্কলঙ্ক। কোনো কলঙ্কই কলঙ্ক নয় তাঁর কাছে। কথাটা ফিসফাস হচ্ছিল এইভাবে। কলঙ্কের কথা ভাবতে পারছিল না কেউ। রাজা সকলের অধীশ্বর। তাঁর কলঙ্ক হয় কীভাবে? 

কিন্তু দেবদাসী তো মহাকালের অধীন, মহাকালের ভোগ্যা। মহাকাল সবার উপরে। মন্দির চূড়ায় চোখ ফেললে অনুমান করা যায় মহাকাল কত বড়। মহাকাল কত মহিমময়। রাজপ্রাসাদ শীর্ষ তো মহাকাল মন্দিরের শীর্ষের কাছে নতজানু। রাজা কেন দেবতার দাসীকে ভোগ করবেন? তাও তো এক প্রশ্ন। এইরকম নানা জিজ্ঞাসা মানুষের মনের ভিতরে ঘুর্ণীপাক দিয়ে উড়ছিল। 

মহাকালেশ্বর শিব হলেন সর্বশক্তিমান। এই উজ্জয়িনী নগরকে তিনিই মুক্ত করেন ত্রিপুরাসুরের দানবীয় বন্ধন থেকে। রাজা নিজে মহাকালেশ্বরের উপাসক। তিনি কী করে মহাকালে নিবেদিতা দাসীকে ভোগ করেন? দেবদাসী কেঁদেছিল রাজার দ্বারা ধর্ষিতা হতে হতে। দেবদাসী বলেছিল মহাকাল ভগবান ছাড়া আর কারোর কথা ভাবতে পারে না সে। ভগবানের প্রতি নিবেদন করেছে সে নিজেকে। তাকে পীড়ন থেকে মুক্তি দিন রাজা। রাজা শোনেননি। তাকে বলপূর্বক ভোগ করেছেন। এই ঘটনা কি পাপ নয়? পাপ তাহলে কী?  

পাপ কী করে হবে? রাজা তো ভোগ করেছেন একটি যুবতীকে। দেবদাসী তো যুবতী নারী মাত্র। যুবতী নারী আর শূদ্রতে বলপ্রয়োগ তো বিধেয়। নারী এবং শূদ্রের ইচ্ছা অনিচ্ছার দাম কী? শূদ্রের জন্ম যেমন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যর দাসত্ব করতে, নারী জন্ম তো পুরুষের ভোগ্যা হতে। সমস্ত নারীই যেন শূদ্রাণী। শূদ্রকে স্পর্শ করা যেমন অশৌচ কর্ম, শূদ্রাণীকে ভোগ করা তা নয়। দেবদাসী তো শূদ্রাণীর মতোই এক নারী। তার ভাগ্য ভাল রাজা তাকে ভোগ করেছেন মাত্র। শিয়াল কুকুর দিয়ে ভক্ষণ করাননি। মহাকাল অরণ্যে নিক্ষেপ করেননি তার প্রাণহীন দেহ। যুবতী যদি রাজার কণ্ঠহার ছিনিয়ে নিয়ে থাকে, তবে সে অন্যায় করেছে। কে সেই দেবদাসী যে এই কাজ করেছে? দেবদাসীকে ভোগ করা তো রাজারই অধিকার। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলে কে? 

কিন্তু রাজা মহাকাল-পরিচয়ে দেবদাসীর ঘুম ভাঙিয়েছিলেন। কথা একটু একটু করে বেরিয়ে আসছে মহাকাল মন্দির থেকে। রাজা অন্ধকারে নিজে মহাকাল পরিচয়ে দেবদাসীর অনুমোদন চেয়েছিলেন প্রবৃত্তি নিবারণে। দেবদাসী তাকে হয়ত চিনতে পেরেছিল, অথবা না চিনেও টের পেয়ে গিয়েছিল মহাকাল পরিচয়টি সত্য নয়। সত্য হবে কী করে? মহাকাল ভগবান তো পরমেশ্বর শিব। তিনি তো পার্বতী ব্যতীত অন্য কোনো নারীকে ভোগ করতে পারেন না। দেবতা কেন সামান্য দাসীকে ভোগ করবেন? শঙ্কর। আর পার্বতীর একশত রাত্রির লীলার কথা কে না জানে? শঙ্কর কেন পার্বতীকে ত্যাগ করে সামান্য দেবদাসীকে লুণ্ঠন করবেন? তিনি যে বহুগামী তা কোনো শাস্ত্রে লেখেনি। তিনি এই জগৎ সংসারের অধীশ্বর। কে কবে শুনেছে কাম নিবৃত্তির জন্য অনন্ত যৌবনা পার্বতীকে ছেড়ে মহাকাল শঙ্কর দেবদাসীতে উপগত হবেন? এ হলো রাজার পাপ। রাজা দেবমন্দির অপবিত্র করেছেন মহাকাল পরিচয়ে দেবদাসীকে ভোগ করে। 

রাজার পাপের কথা একদল বলছিল। আর একদল তা বিশ্বাস করছিল না। কেউ কেউ বলছিল  রাজার পাপের চিহ্ন ফুটে উঠছে চারদিকে। কেউ বলছিল রাজা পাপ করতে পারেন না। প্রজার ক্ষেত্রে যা পাপ, রাজার ক্ষেত্রে তা নয়। রাজা ভর্তৃহরি মানুষ। মানুষকে যদিও পাপ স্পর্শ করে থাকে, রাজাকে করেনি। আবার কেউ কেউ এও বলছে, মৈথুনে কোনো পাপ হয় না। পদ্ম রক্তবর্ণ। প্রকৃতি তাকে রক্তবর্ণ করেছে বলেই, তবুও ভ্রমর তার কাছে ঘোরাফেরা করে। দেবদাসী হলেও সে যুবতী। যুবতী নারীর ভিতরে অমৃতও নেই, হলাহলও নেই। মৈথুনে, মিলনে সে অমৃত। বিরূপ হলে সেই তীব্র হলাহল। হায়! রাজা যেন দেবদাসীকে ভোগ করতে গিয়ে হলাহল পান করে এসেছেন। দেবদাসী হলেও সে তো যুবতী নারী। তাকে ভোগ করায় অন্যায় কোথায়? 

কথাগুলি শূদ্রপল্লী থেকে রাজপ্রাসাদে পৌঁছে গিয়েছিল। উজ্জয়িনীর পথে পথে শোনা যাচ্ছিল। বারাঙ্গনা পল্লীতেও ফিসফিস করে এ ওকে শুনিয়ে দিচ্ছিল। 

শূদ্রপল্লীতে এখন সমস্ত দিন মানুষই থাকে না প্রায়। অভাবের দিন শুরু হয়ে গেছে। কাজের খোঁজে মেয়েপুরুষ ঘর ছেড়ে বেরোচ্ছে রোজই। মাঠ জমিতে সবার কাজ থাকে না বটে, কিন্তু অভাবও থাকে। একটু হিসেব করে চললে অভাব শুরু হতে সেই আষাঢ় শেষ। ক'দিন আগে গম, যব, কলায়, সর্ষপ জমি থেকে যেটুকু ঘরে আসার কথা ছিল তা আসেইনি প্রায়। অনাবৃষ্টিতে মাঠ জমি সব খটখটে। প্রোষ্টপদে বোনা ফসল জমিতেই মরেছে। শূদ্রপল্লীর মানুষজন এখন ঘুরছে ঘূর্ণীর বাতাসের মতো। বনে, ঘুরছে, পথে ঘুরছে, নগরে ঘুরছে, শ্রেষ্ঠীগৃহের ধারকাছে চক্কর মারছে দিনভর। 

এমন চৈত্র সায়াহ্নে শ্রেষ্ঠীর রথ আবার এসেছে রত্নাকর সাগর ধারে। তখন মানুষজন ঘরে ফিরছে। বেলা এখন দীর্ঘ। দিনমণি আকাশে থাকেন বহু সময়। শ্রেষ্ঠীর রথ ঘিরে আছে গোটা  শূদ্র পল্লীর মানুষজন। শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত রত্নাকর সাগরের জলহীন রূপের দিকে তাকিয়ে। একবিন্দুও জল নেই সাগরে। যেন কেউ শুষে নিয়েছে।

শ্ৰেষ্ঠী বললেন, তোমরা সব শুনেছ? 

ঘাড় কাত করে পরাশর। বুড়ো শুনেছে বটে কিন্তু কোনো কথা বিশ্বাস করেনি। 

রত্নাকর সাগর জলহীন হলো কেন? 

শুকিয়ে গেছে, সূয্যি ঠাকুর টেনে নিয়েছে। বলে বুড়ো পরাশর পশ্চিমে নত হলো, খুব তেজ এবার রোদে, এত তেজ হয়নি আগে, দু’বছর প্রায় বিষ্টি  নেই। 

মন্দিরের খবর জান? 

না প্রভু! বুড়ো বিড়বিড় করে, আমরা নীচ জাতি, শুদ্দুর। 

শ্ৰেষ্ঠী বললেন, বৃষ্টি নেই কত কাল, কেন জানো? 

মাথা নাড়ে পরাশর, তারপর ফিসফিসিয়ে বলে, মহাকাল জানেন। 

মহাকাল ছারখার করে দেবেন সব। 

ভীত মুখে নানা বয়সের জীর্ণদেহী মানুষগুলি শ্ৰেষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা ভয় পেয়েছে, কিন্তু কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। সেই যে শীতের এক দুপুরে,পৌষমাসে শ্রেষ্ঠী এসে স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে গিয়েছিলেন তারপর এই এলেন। কেন আসছেন শ্রেষ্ঠী? শুদ্র বসতিতে এঁর মতো মানুষের তো আবার আসার কথা নয়। বুড়োর মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই দুপুরের কথা। পৌষমাস, এই সরোবর তখন প্রায় জলশূন্য, শুধু তলানি কর্দমাক্ত জল দেখে তারা ভাবত আচমকা বৃষ্টিতে ভরে উঠবে সাগর। শ্রেষ্ঠী বলেছিলেন, কেন জল শুকোচ্ছে, কেন পদ্ম নেই সেই খোঁজ করতে। রাজসভায় যেতে। শূদ্র কখনো রাজার কাছে পৌঁছতে পারে? সেই সরোবর নিয়েই দিনপাত করছে বুড়ো পরাশর। ভয় পাচ্ছে শ্রেষ্ঠীর কথায়। শ্ৰেষ্ঠী কী ভয়ানক কথাই না বলছেন। 

শ্রেষ্ঠী বললেন, মহাকাল বিরূপ হয়েছেন, মন্দিরে অনাচার, ছারখার হয়ে যাবে সব। 

হে প্রভু! পরাশর জোড়হাতে কাঁপতে থাকে। 

বৃষ্টি আর হবে না যে তা টের পাচ্ছ? 

পরাশর ভীত মুখে চুপচাপ। শ্রেষ্ঠী বলছেন, সূর্যদেব জলপান করে আরো তেজী হবেন, আগুন জ্বলবে, আগুনে সব জ্বলে যাবে।

প্রভু!

শ্ৰেষ্ঠী সুভগ দত্ত পায়চারি করছেন। মানুষজন দেখছিল শ্ৰেষ্ঠীর উচ্চশির দেহখানি আরো উচ্চ  হয়ে উঠছে যেন। পূর্বগামিনী ছায়া ঢেকে দিচ্ছে চারদিকের আলো। ছায়ার ভিতরে ঢুকে পড়ে শূদ্রজনেরা কুঁকড়ে যেতে থাকে। শ্ৰেষ্ঠীর ভৃত্য, রথ-সারথি উতঙ্ক রথের সামনে নিঃস্পন্দ দাঁড়িয়ে। উতঙ্ক কথা বলে না বড় একটা। উতঙ্কর চোখমুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, কিন্তু তার দিকে তাকালে বুক হিম হয়ে যায়। শ্রেষ্ঠী বললেন, মহাকাল কেন বিরূপ? 

শূদ্ৰজন নিশ্চুপ। জবাব না দিয়ে অপরাধীর মতো মাথা নামিয়ে বসে থাকে। 

শ্ৰেষ্ঠী বললেন, পাপের ছায়া ঢেকে ফেলেছে নগর, এর ফল বিষম। 

হে প্রভু! 

পাপীর পাপের ভার কি পাপী নেয়? 

প্রভু! 

শ্ৰেষ্ঠী বলছেন, অনাচার, পাপ তো একজনের, কিন্তু রত্নাকর সাগরে জল নেই, রত্নাকর সাগর। কাদের? 

আমাদের প্রভু। 

পাপী কি তোমরা? 

না প্রভু। 

পাপের ভার কে নেয়? 

শেষ কথাটায় ভয় করতে লাগল সকলের। চোখের সামনে থেকে আলো মুছে যেতে লাগল যেন। শ্রেষ্ঠী বলছেন, পাপ কে করেছে, কার অনাচারে সাগর শুকিয়ে যাচ্ছে তা কে না জানে, কিন্তু এর জন্য কষ্ট পাচ্ছে কারা? ফসল মরলে কাদের ক্ষতি ? মহাজনের পাপের ভার নেয় কে? কারা? 

কারা প্রভু? 

শ্রেষ্ঠী হাসলেন, মহাকালের রোষ কাদের উপরে পড়ছে? 

বুড়ো পরাশর বলল, প্রভু! আমরা অজ্ঞান।

শ্রেষ্ঠী বললেন, কিন্তু সমস্ত পাপের ভার তো তোমাদের মাথায়। যতো অনাচার, তত পাপ, যত  পাপ ততই তার ভার। সেই ভার নেবে নীচ জাতি, শূদ্র জাতি, ভগবানের এই তো বিধান। 

হে প্রভু! বুড়ো পরাশরের চোখ দিয়ে জল ঝরছে, হে প্রভু, আমাদের কী অপরাধ আমরা কোন পাপ করেছি? 

শ্রেষ্ঠী বললেন, পাপ না করলেও তার ভার তো নিতে হবে, সাগরে আর কখনো পদ্মফুল ফুটবে না, কুয়োয় জল থাকবে না, শিপ্রা নদী, গন্ধবতী নদী শুকিয়ে যাবে, গোধূম, যব ক্ষেতেই মরে যাবে, এতে কী হবে? 

প্রভু আমরা বাঁচব কী করে? আর্তের স্বর সায়াহ্নকালে বাতাসে ভাসতে লাগল। 

বাঁচবে না, পাপীর বিপক্ষে দাঁড়ালে বাঁচবে। 

বুড়ো পরাশর চমকে ওঠে। পাপীর বিপক্ষে মানে রাজার বিপক্ষে। রাজার বিপক্ষে কথা বলছে শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত। না কি শ্রেষ্ঠীর কথা সে বুঝতে পারছে না। ধনী ব্যক্তি, নগরের সবচেয়ে শক্তিমান ব্যক্তি, শ্ৰেষ্ঠী কেন রাজার বিপক্ষে কথা বলবেন? তাহলে কি অনাচারী অন্য কেউ? চারদিকে যে কথা রটছে। তা কি সত্যি নয়। সত্য তো নয়ই। রাজা কোনো অন্যায় করেন না, রাজা কোনো পাপ করেন না। তাহলে পাপী কে? কার পাপের ভার নিয়ে শূদ্র পল্লীতে হাহাকার উঠেছে? কার পাপে রত্নাকর সাগর। শুকিয়ে গেছে? কার পাপে ফসল মরে গেছে জমিতেই? 

শ্রেষ্ঠী বললেন, মহাকালের রোষ আরো কঠোর হবে, কী যে হবে! হায় মহাকাল, কার পাপের ভারে কে মরে! নীচ জাতিকে তুমি রক্ষা করো ভগবান। 

বুড়ো পরাশরের চোখে জল এসে যায়। সে দ্যাখে তার আশপাশের সকলে ভয়ে কাঁপছে। অন্ধকার হয়ে এল প্রায়। শ্রেষ্ঠী ধীর পায়ে রথের দিকে এগোলেন। তাঁকে অনুসরণ করছে শূদ্রপল্লীর মানুষজন। শ্ৰেষ্ঠী রথের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, পাপীর বিপক্ষে গেলে ভগবানের রোষ কমবে। 

কে পাপী হে প্রভু? জিজ্ঞেস করল বুড়ো পরাশর। 

শ্ৰেষ্ঠী থমকে গেলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গ্রামবৃদ্ধকে লক্ষ্য করতে লাগলেন। মানুষটাকে যেন অভিসন্ধিপরায়ণ মনে হয়। তাঁর মুখে রাজার নাম শুনতে চাইছে। শ্রেষ্ঠী বলুন পাপীর নাম। তিনি বললেন, পাপী কে তা জান না ? 

না প্রভু, কার পাপ? 

কান পাতো শুনতে পাবে, নগরের ভিতরে যাও শুনতে পাবে। বলতে বলতে শ্রেষ্ঠী রথে উঠলেন। উতঙ্কের প্রহরণ ঘোড়ার পিঠে নেমে আসছে দেখে সভয়ে মানুষগুলো সরে গেল। কশাঘাতে ঘোড়া ডেকে উঠল চিঁহি চিঁহি করে। ছুটল। উতঙ্কের প্রহরণ সাঁই সাঁই করে শূন্যে আছড়ে পড়ল। তার প্রান্তভাগ ছুঁয়ে গেল একজনের বাহুপাশ। আর্তনাদ করে লোকটা মাটিতে বসে পড়ল। রথ চলে যেতে অন্ধকার নেমে এল। আকাশে তারা ফুটল। বুড়ো পরাশর বসে থাকল রত্নাকর সাগর তীরে। তার মনে পড়ছিল ধ্রুবপুত্রের কথা। ধ্রুবপুত্ৰই না রত্নাকর দস্যুর কথা বলেছিল। রত্নাকর দস্যুর পাপের ভার তার পরিবারের কেউ নেয়নি বলে রত্নাকর বাল্মিকী হয়ে গেল। ধ্রুবপুত্র বলত রত্নাকর  তাদেরই পূর্বপুরুষ। কিন্তু এখন কেন মহাজনের পাপ তাদের নিতে হয়? ধ্রুবপুত্র থাকলে জবাব দিতে পারত। পরাশর উত্তর আকাশের ধ্রুবতারার দিকে তাকিয়ে ডাকল যেন নিরুদ্দিষ্ট সেই সুজনকে, হে ধ্রুবপুত্র, তুমি ছাড়া এ কথার জবাব দেবে কে? 

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব এগার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চৌদ্দ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পনের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ষোল)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সতের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আঠারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব উনিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব কুড়ি)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব একুশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বাইশ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top