সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছাব্বিশ) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৫৭

আপডেট:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:৪০

ছবিঃ অমর মিত্র

                                                            

উজ্জয়িনীতে সুভগ দত্তর গৃহ খুঁজ বের করতে কোনো অসুবিধেই হয়নি শিবনাথের। কে না চেনে শ্রেষ্ঠীকে? শ্রেষ্ঠীর ভৃত্য, রথের সারথি উতঙ্ক কে? কী ভয়ানক তার দৃষ্টি! কী গতিময় তার রথচক্র! কতদূর থেকে শোনা যায় চক্রের ঘর্ষর শব্দ, অশ্বের হ্রেষাধ্বনি, প্রহরণের সাঁই সাঁই। যখন রথাশ্বরা নিজ ছন্দে ছুটে চলে, উতঙ্ক বাতাসে প্রহরণ ঘোরায় বনবন। আকাশচেরা বিদ্যুৎরেখার মতো তীব্র সেই প্রহরণের গতি। মনে হয় উতঙ্কর কোনো গোপন রোষ আছে, সেই রোষে অদৃশ্য কাউকে কশাঘাতে রক্তাক্ত করতে চায়। উতঙ্কের তো ক্রোধ আছেই। এ নিয়ে কথা আছে কত! 

শিবনাথ যখন শ্রেষ্ঠীর গৃহতোরণে পৌঁছল, সূর্য গনগনে হয়ে উঠেছ। শিবনাথের গায়ের পট্টবস্ত্রের আড়ালে রেশম পেটিকার ভিতরে সোনার গহনা। সমস্ত রাত সে ঘুমোতে  পারেনি। সে কেন, রেবা, গন্ধবতীও ঘুমোয়নি। তাদের চাপা কণ্ঠস্বর শুনেছে শিবনাথ সব প্রহরেই। দূরে সারমেয়র ক্রন্দন শুনেছে, গর্জন শুনছে অন্ধকারে। আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে তখন; এই বুঝি শোনা যায় টাঙ্গন অশ্বের ক্ষুরের শব্দ। উদ্ধবনারায়ণ এল বুঝি আবার। অবন্তী দেশের যা অবস্থা, অপহরণ করে নিয়ে যায় যদি, কী করবে বৃদ্ধ? তার ওই ভয় হচ্ছে। এরপর গন্ধবতীকে জোর করে তুলে নিয়ে যাবে দুর্বৃত্ত, রাক্ষস-বিবাহ তো অসিদ্ধ নয়। উদ্ধবের কামনা ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। আরো দুর্বিনীতি হয়ে উঠছে ওই যুবক রাজকর্মচারী। তা শুধু উদ্ধব কেন, সমস্ত রাজকর্মচারীর লোভ আর সাহস দুই-ই বাড়ছে। রাজার যেসব খবর বাতাসে উড়ছে, তাতে রাজ-সিংহাসনেই কলঙ্ক লেগেছে বোধ হয়। হায়! এসব যদি জানত ধ্রুবপুত্র? 

শ্ৰেষ্ঠীগৃহের তোরণে উতঙ্কের সঙ্গেই দেখা হয়েছে শিবনাথের। হাড় হিম করা দৃষ্টি। মানুষটি তার দিকে চেয়েই আছে। শিবনাথ মাথা নামিয়ে বলল, শ্রেষ্ঠীর কাছে এসেছি, আমি বিপন্ন মানুষ। 

লোকটি তার কথা বুঝল কি না ধরা গেল না। নিঃস্পন্দ দৃষ্টি দিয়ে বিদ্ধ করছে। শিবনাথ  হাসতে চেষ্টা করল। লোকটি হাসে না। শিবনাথের ভয় ভয় করে। এভাবে চেয়ে আছে কেন? কী নিঃঝুম শ্রেষ্ঠী গৃহ। তাহলে তিনি কি নেই? না থাকলে কোথায় কার কাছে যাবে শিবনাথ? এই অলঙ্কার শ্রেষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়ে তার কাছে আত্মসমর্পণ করবে ঠিক করে এসেছে। এ ছাড়া উপায় নেই। শ্ৰেষ্ঠীই বাঁচাতে পারেন গন্ধবতীকে। শ্ৰেষ্ঠীই নিবৃত্ত করতে পারেন উদ্ধবনারায়ণকে। অভিজ্ঞতা বলে, রাজকর্মচারীর বিপক্ষে রাজসভায় গিয়ে দাঁড়ালে কোনো লাভ হয় না। নিজ অনুগত কর্মচারীর স্বার্থই দেখেন রাজা কিংবা রাজকর্মচারী। রাজশক্তির কী ক্ষমতা তা উদ্ধবকে দেখেই বুঝতে পেরেছে শিবনাথ। ছিল তো পথের ভিখারি, তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করত রাজসভায় প্রবেশের আগে। আর এখন...। এখন সুভগ দত্তই আশ্রয় দিতে পারেন বিপন্ন এই পরিবারকে। রাজশক্তির বিপরীতে দাঁড়াতে পারে ধনসম্পদে বলীয়ান মানুষ। উন্মুক্ত তরবারী, বর্শাফলক কিংবা ভল্লকে শান্ত করতে পারে হিরে, মানিক, সোনা, রূপা।

শিবনাথ বলল, শ্রেষ্ঠী আমাকে জানেন। 

লোকটি যেন পাথর। চোখের মণিতে কাঁপনও নেই। শিবনাথ চুপ করে তার প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু কোনো উত্তরই পায় না। 

শিবনাথ জানে না উতঙ্ক যদি সাড়া  না দেয় তবে ধরে নিতে হবে প্রস্তাবে তার সায় নেই। টের পাচ্ছিল বৃদ্ধ, রাজকর্মচারীর চেয়ে এ আরো ভয়ানক। আবার মাথা নোয়াল সে, বলল, আমাদের জীবন বিপন্ন, শ্ৰেষ্ঠী ছাড়া কে বাঁচাবে? 

উতঙ্ক স্থির। তার মাথার উপরে একটি আমগাছ ছায়া ফেলেছিল। অনেকটা ছায়ার ভিতরে সে একা দাঁড়িয়েছিল। শিবনাথ রোদে পুড়ছে। তার ইচ্ছে হচ্ছিল ওই ছায়ার ভিতরে দাঁড়ায়। কিন্তু সাহস হচ্ছিল না। উতঙ্ক নড়ছিল না, তাই শিবনাথও নড়তে পারছিল না। মাথা তুলে শিবনাথ গাছটিকে দেখল। আম মুকুলের চিহ্ন নেই। এ তো নবীন বৃক্ষ। এ বছরে নিষ্ফলা? নাকি বন্ধ্যা হয়ে গেল? এতক্ষণে মনে পড়ল তার। এই যে এতটা পথ হেঁটে এল, বাতাসে কোনো সুগন্ধ নেই। গতবছরও তো এমন বসন্ত ছিল না। এই অনাবৃষ্টির ভিতরেও। এবার বসন্তে কি ফুলই ফোটেনি? আম, নিম কোথাও ফুল আসেনি। কই পথে তো মঞ্জরী চোখে পড়েনি। বকুলফুল! এমন কি হয়েছে এ জীবনে? গন্ধহীন বসন্ত, ভ্রমরহীন বসন্ত এসেছে এই অবন্তী দেশে, উজ্জয়িনী নগরে? হায়! এখন আকাশের শকুনই ভ্রমর হয়েছে। শবদেহেই যার আসক্তি সে কিনা মধুলোভে ফুলে ফুলে ডানা ঝাপটে বেড়াচ্ছে। শিবনাথ আবার বলল, আমি শ্রেষ্ঠীর দর্শন প্রার্থী, বৃদ্ধ মানুষ।

উতঙ্ক নিশ্চল। তার উন্মুক্ত বক্ষদেশ রোমহীন, মসৃণ, ধবল বর্ণের। মাথার চুল ঈষৎ লালচে। দেহটি পেশী বহুল। শ্বাস-প্রশ্বাসে সর্বাঙ্গ কাঁপছে। দুই চোখ অতি ক্ষুদ্র কীটের মতো মুখমণ্ডলে ছুঁয়ে আছে। শিবনাথ বুঝতে পারছিল শ্রেষ্ঠীর এই উত্তরপূর্বদেশীয় দাসটি তাকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেবে না। দাস হলেও উতঙ্ক হলো শ্ৰেষ্ঠীর দেহরক্ষী। শিবনাথ শুনেছে এই দাসটি অতি নিষ্ঠুর প্রকৃতির। ধ্রুবপুত্রই বলেছিল তাকে। কারণে অকারণে মানুষের উপর অত্যাচার করে সুখ পায়। শ্ৰেষ্ঠী তার জন্য তাকে তিরস্কার করেন না। তাঁর প্রশ্রয়েই উতঙ্ক এমন। আর শ্রেষ্ঠীর যদি প্রশ্রয় থাকে, তবে সে প্রশ্রয় তো রাজশক্তির অনুমোদনও পায়। শিবনাথের ভয় করতে লাগল। বিপন্নতা বাড়ল যেন। এতদূর এসে ফিরে যেতে  হবে? শ্রেষ্ঠী ছাড়া কার কাছে যাবে? শ্ৰেষ্ঠীর হাতে অলঙ্কারগুলো তুলে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হত সে। এই অলঙ্কার হাতে রাখা মানে উদ্ধবনারায়ণের দাবী মেনে নেওয়া। ওই কামুক পাষণ্ডের হাতে পৌত্রীটিকে সমর্পণ করা। এক পা এগিয়ে ছায়ার সীমানায় দাঁড়িয়ে মাথা নত করে সে ডেকে উঠল, হে উতঙ্ক, হে প্রভু উতঙ্ক, আমার পুত্র দশপুরার যুদ্ধে হারিয়ে গেছে, আমি ভীষণ বিপদে পড়ে শ্রেষ্ঠীর শরণাপন্ন হয়েছি। 

উতঙ্কের ভিতরে স্পন্দন এল যেন। অবাক হয়ে বৃদ্ধর দিকে তাকিয়ে আছে সে। শিবনাথ হাঁটুমুড়ে বসে পড়েছে তার সামনে। পট্টবস্ত্রের আড়াল থেকে হাতটি সরাচ্ছে না সে। রেশম পেটিকার জন্য ভয়ে আছে। শিবনাথ মাথা নত করল রৌদ্রের ভিতরে। যেন সে ধুলায় মিশে যাবে এমনই ভাব। আবার ডেকে উঠল, হে প্রভু, হে উতঙ্ক, শ্রেষ্ঠী আমাকে বাঁচাতে পারেন দুর্বৃত্তের রোষ থেকে।

মাথা তুলল শিবনাথ। তাকে ডাকছিল উতঙ্ক। ইঙ্গিত করল ভিতরে যেতে। উঠে চোখের কোল কাপড়ের খুঁট দিয়ে মুছতে মুছতে হাঁটতে লাগল শিবনাথ। তৃণের মতো হয়ে গেছে সে। ধুলো হয়ে গেছে। ধুঁকতে ধুঁকতে সে ভিতরে প্রবেশ করল। তোরণের পর অনেকখানি জমি জুড়ে প্রাঙ্গণ। দু’পাশে বাগান। বাগানে ফুল নেই। কেমন হতশ্রী চেহারা। হাঁটতে হাঁটতে শ্ৰেষ্ঠীর প্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়াল সে। মানুষজন নেই কেন? চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল সে। 

শিবনাথের সমস্ত বোধই ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দিয়েছে উতঙ্ক। সে দুই হাতে রেশম পেটিকা ধরে প্রায় কেঁদে উঠল, হে প্রভু, আমি বিপন্ন, আমাকে রক্ষা করুন, আমি আসছি গম্ভীরা থেকে, ধ্রুবদাস ছিল আমার বয়স্য, আমি শিবনাথ, প্রভু কি আছেন, হে শ্রেষ্ঠী।

ভিতর থেকে একটি যুবতী দাসী বেরিয়ে এল শিবনাথের উঁচু গলার কান্নায়। সে অবাক হয়ে দেখল। ক্রন্দনরত বৃদ্ধকে। হায় হায়, বুড়ো মানুষটা কাঁদে কেন? একী কাণ্ড! কান্নার কী হলো? উতঙ্ক কোথায়? প্রহরীরা কোথায়? আজ তো প্রভুর বিশ্রামের দিন। আজ প্রভু দীনহীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না। আজ তো অন্নও দেওয়া হবে না দীনজনকে। তবে কেন উতঙ্ক একে প্রবেশ করতে দিল?

যুবতী দাসীর চিৎকারে ভিতর থেকে এক বৃদ্ধা দাসীও বেরিয়ে এল। সেও অবাক। এ কে? কোথা থেকে এল লোকটা? কোন গাঁয়ে ঘর, কাঁদো কেন, প্রভু আছেন, কিন্তু প্রভু তো আজ দান করবেন না। আজ তো দরিদ্র দীনজনের সেবার দিন না। আর প্রভু ওসব করবেন না তা ঠিকই করে ফেলেছেন। ওসব রাজার কাজ। রাজসভায় যাও বাবা। রাজার কাছে যাও। শ্রেষ্ঠী এখন বিশ্রামে আছেন।  

শিবনাথ বলল, আমি বিপন্ন, প্রভু আমাকে বাঁচাবেন। 

দুই দাসী পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। তারপর তাদের খেয়াল হয় শিবনাথের হাতে ঝোলান রেশম পেটিকাটিকে। শিবনাথ আত্মবিস্মৃত হয়ে কান্নার সময় পেটিকাটি পট্টবস্ত্রের আড়াল থেকে বের করে এনেছে। যুবতী দাসী বলে ওঠে, ওতে কী আছে? 

ভয় পেয়ে শিবনাথ পেটিকা আবার পট্টবস্ত্রের আড়ালে লুকোতে যায়। তা দেখে দুই দাসীর কৌতূহল বাড়ে। তারা যেন অলঙ্কারের অস্তিত্বই টের পেয়ে গেছে। যুবতী নেমে আসে প্রাঙ্গণে, কী আছে পেটিকায়? চেনা লাগে যেন পেটিকাটি!

শিবনাথ আবার উচ্চ স্বরে ডেকে ওঠে শ্রেষ্ঠীকে, হে প্রভু সুভগ দত্ত...। 

যুবতী ঝপ করে শিবনাথের মুখ চেপে ধরেছে, কী আছে বলো, আরে প্রভু আছেন অন্তঃপুরে, তোমার কণ্ঠস্বর অতদূর পৌঁছবে না, তুমি কে গা, এস ভিতরে এস। বলতে বলতে যুবতী শিবনাথের হাতের। রেশম পেটিকা চেপে ধরেছে পট্টবস্ত্রের উপর থেকে, সোনার গয়না আছে নাকি, এ পেটিকা তো আমার চেনা, তোমার মতো মানুষের হাতে গেল কী করে?

শিবনাথ আরো ভয় পেয়ে সরে যেতে চায়। কিন্তু পারে না। যুবতীর দৈহিক শক্তি অনেক বেশি। আর যুবতী নির্লজ্জও। তাকে জাপটে ধরেছে, চলো, ভিতরে চলো।

শিবনাথ চিৎকার করতে চায়। মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করতে থাকে। না পেরে এক ঝটকা মেরে সরে যায়। ডেকে ওঠে, হে শ্রেষ্ঠী, হে উতঙ্ক, আমাকে প্রভুর কাছে নিয়ে চলো, প্রভু সুভগ দত্ত...। 

শিবনাথের চিৎকারে যুবতী দাসী ভয় পেয়ে সরে যায়। বৃদ্ধা ঢুকে গেছে ভিতরে। কিন্তু ভিতর থেকে আরো কয়েকজন দাস দাসী বেরিয়ে এসেছে। তোরণ থেকে উতঙ্ক নিঃশব্দে হেঁটে আসছে। শিবনাথ মাটিতে বসে পড়ে হাঁপাচ্ছে। উতঙ্ক এগিয়ে এসে তাকে দেখল। তারপর ঢুকে গেল ভিতরে। উতঙ্ককে আসতে দেখে অন্য দাস দাসীরা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। তারা যেন উতঙ্কের নির্বাক ইঙ্গিতেই নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। যে যুবতী শিবনাথকে আঁকড়ে ধরেছিল সে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখন প্রাঙ্গণে রোদের ভিতরে বৃদ্ধ একা। বুকের উপর চেপে আছে অলঙ্কার ভর্তি রেশম পেটিকা। রোদে তার বেঁকে যাওয়া দেহ পুড়ছিল। উত্তাপ যেন মেরুদণ্ড ছুঁয়ে ফেলছিল। দেহের লোল চর্ম আরো শিথিল হয়ে যাচ্ছিল। তার কানে কোনো শব্দ আসছিল না। সে যেন বধির হয়ে গেছে। তার চোখে কোনো দৃশ্য ফুটছিল না। সে যেন অন্ধ হয়ে গেছে। দেহতে শুধু কম্পন ছিল মৃদু, কিন্তু আন্দোলন ছিল না কোনো। অচল হয়ে গেছে যেন তার দেহ। 

বহু সময় বাদে হয়ত, সময়ের কোনো ঠিক ছিল না, ঘোরের ভিতরে পড়েছিল সে, কে এসে তার পিঠে হাত রেখেছে। এই ছোঁয়ায় সচল হয়ে ওঠে তার সর্ব অঙ্গ। চোখে দৃষ্টি দিয়ে বধিরতা দূর হলো। শিবনাথ শুনল কে যেন তাকে ডাকছে, ভালো মানুষ, ও বাপ ভয় নেই ওঠো, তোমার ডাক হয়েছে।

শিবনাথ দেখল প্রৌঢ়া দাসী। মুখখানিতে শান্তভাব। অবাক হয়ে তাকে দেখছে বুড়ি। সে উঠে দাঁড়ায়। ভয় করল। অলঙ্কার লুণ্ঠনের এও কি আর একজন? সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চায় কোথায় উতঙ্ক। তার প্রভু। উতঙ্ক তার রক্ষাকর্তা। উতঙ্ক তার অধিকারী। সমুদ্রপারের আরবদেশীয় বণিকরা বলে ‘মালিক’। যিনি প্রভু তিনিই মালিক। কথাটা ধ্রুবসখা শিখে এসেছিল বারুগাজা বন্দর থেকে। আচমক তার মনে পড়ে যায়। সে দেখল তার মালিক প্রাঙ্গণের প্রান্তে রৌদ্রের ভিতরে দাঁড়িয়ে এদিকে চেয়ে আছে নিশ্চল। অশোক গাছের ছায়া তাকে ঈষৎ ছুঁয়ে আছে। অশোকই তো। কিন্তু ফুল কই? অশোক মঞ্জরী? সত্যিই তো! এতটা পথ যে হেঁটে এল সে গম্ভীরা থেকে উজ্জয়িনী, ঝরা ফুল তো দেখেনি পথে। উতঙ্কের চোখের সামনেই যখন বুড়ি দাসী তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে, তাহলে সত্যিই তার ডাক হয়েছে। চলল শিবনাথ। 

শ্রেষ্ঠীগৃহ অনেক বড়। প্রাসাদ বলে কিনা একে তা জানে না শিবনাথ। একবার এসেছিল ধ্রুবপুত্রকে নিয়ে, মনে পড়ে যাচ্ছে সব। আগে চলেছে দাসী, তারপর ধ্রুবপুত্র, তারপর সে। চলেছেই দীর্ঘ অলিন্দ বেয়ে। দাসদাসীরা দ্রুত ত্রস্ত পদসঞ্চরণে অভ্যস্ত। তাদের কাজের ধারা এমনই। ফলে তাদের দু’জনকে, বিশেষত তাকে অনভ্যস্ত দ্রুততায় প্রায় ধাবিত হতে হচ্ছিল। সঙ্কীর্ণ অলিন্দে দাসীকে দেখতে পাচ্ছিল না সে। দেখছিল ধ্রুবপুত্রের রেশমী চুল, দীর্ঘ শরীর। দু’পাশে কত ঘর। কোনোটির দুয়ার রুদ্ধ ছিল, কোনোটি উন্মুক্ত। কোনোটির ভিতর থেকে আসছিল মশল্লার গন্ধ, দারুচিনির গন্ধ, কোনোটি থেকে চন্দনের গন্ধ, কোনোটি থেকে পুষ্প গন্ধ বেরিয়ে এসে ভরে তুলেছিল আধো অন্ধকার অলিন্দ। শোনা যায় শ্ৰেষ্ঠীর গৃহ এই  পুব দিক থেকে আরম্ভ হয়ে পশ্চিমে ক্রমাগত বেড়ে গেছে। এদিক যখন তৈরি হয়, শ্রেষ্ঠী  তখন সামান্য বণিক। পুরোন মায়া ত্যাগ করতে পারেননি। সব রেখে দিয়েছেন। বরং গৃহের এই অংশই তাকে লক্ষ্মীমন্ত করে তুলেছে। তাই যেমন ছিল তেমনি আছে। কিন্তু সেই দামী মশল্লার গন্ধ, দারুচিনির গন্ধ, চন্দনের গন্ধ, পুষ্পগন্ধ যে এখন নেই। গুমোট একটা বাতাস ভারী হয়ে ভেসে আছে দীর্ঘ অলিন্দে। সেবার কোকিলের ডাক শুনেছিল দূরে। সেও তো এমন এক বসন্ত ছিল। এবার সব নিঃঝুম। সে শুনেছিল বীণা বাদন। দেখতে পায়নি কে বাজাচ্ছিল, কিন্তু কানে এসেছিল। পরে শুনেছিল, শ্রেষ্ঠীগৃহে অবিরাম বীণা বাদন শোনা যায়। বীণা বাদনেই টের পাওয়া যায় শ্রেষ্ঠী গৃহে আছেন কি না। এবার কী হলো? অবন্তী দেশের মাঠ নদী যেমন হয়েছে, এই গৃহও তেমনি? নাকি সেবার ধ্রুবসখার পুত্রটি ছিল বলে বাতাসে সুগন্ধ ছিল, অন্ধকারে বীণার ঝঙ্কার কানে এসেছিল। 

বুড়ি দাসী থেমেছে, বলল, এই ঘরে ঢোক, প্রভু আছেন।

শিবনাথ দাঁড়িয়েই আছে। বুক ধকধক করছে। বুড়িকে সঙ্গে নিয়েই প্রবেশ করলে হতো। কত বাঁক ঘুরে এদিকে এসেছে সে। ফিরবে কীভাবে?

বুড়ি দাসী বলল, যাও বাপ, ভয় নাই, উতঙ্ক তোমার পক্ষে আছে, উতঙ্ক যখন খবর দিয়েছে কোনো ভয় নাই, প্রভু দয়াবান, কৃপাময়।

চলবে 

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব এগার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চৌদ্দ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পনের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ষোল)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সতের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আঠারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব উনিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব কুড়ি)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব একুশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বাইশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তেইশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চব্বিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পঁচিশ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top