সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব একত্রিশ) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
৯ মার্চ ২০২১ ১৮:০৭

আপডেট:
৯ মার্চ ২০২১ ১৯:৫৮

ছবিঃ অমর মিত্র

 

গন্ধবতী বলল, সেদিন ছিল চৈত্র পূর্ণিমা, কামদেবের মন্দিরে গিয়েছিলাম আমি।

জানি তা। তাম্রধ্বজ বলে শুনেছি।

সেদিনই ফিরেছিল ধ্রুবপুত্ৰ উজ্জয়িনী থেকে, তুমিই তো জান মা, তুমি বলো। গন্ধবতী তার মাকে বলল। অন্ধকারে মা মেয়ে বসে আছে পাশাপাশি। দীপের আলোয় তাদের মুখ দেখতে পাচ্ছে তাম্ৰধ্বজ। গন্ধবতীর চোখদুটি যেন নদীর মতো। চকচক করছে জল। রেবা মায়ের চোখ দুটিও তাই। কিন্তু সে নদী জলহীন হয়েছে নিদারুণ তাপে।

চৈত্র পূর্ণিমা কেন আগে কোনো পূর্ণিমাতেই গম্ভীরার বাইরে থাকত না ধ্রুবপুত্র। নদীর ওপারে যখন সোনার থালার মতো চাঁদ ভেসে উঠত, ধ্রুবপুত্র তখন সেখানে। কিন্তু আগের দু’বছর আশ্বিনের পূর্ণিমা, কার্তিকের পূর্ণিমা, মাঘীপূর্ণিমা, ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে সে ফেরেনি গৃহে। তার কথা এসে শোনাত উদ্ধবনারায়ণ। গণিকাপল্লীতেই পড়ে থাকে ধ্রুবপুত্র। চরম ভোগে মেতেছে। তার জ্ঞানার্জন মিথ্যে হয়ে গেছে। নগরে ঢি ঢি পড়ে গেছে। ওইরকম দুশ্চরিত্র পুরুষ অবন্তীদেশে আর একটিও নেই।

খবর এনেছিল শিবনাথ, উদ্ধাবের কথা অসত্য নয়, নগরে ওই কথাই রটেছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কপালে হাত দিয়েছিল গন্ধবতীর ঠাকুর্দা। রেবা আর তার মেয়ে মুখ অন্ধকার করে শুনেছিল। শুনেছিল ধ্রুবপুত্রের নামে কত আকথা, কুকথা। বুড়ি পার্বতী এসে বলে যেত আরো কত কথা। উদ্ধাবের কথার চেয়ে তার কথার ধার ছিল বেশি। উদ্ধবের দূতী হয়ে আসত সে এই বাড়িতে। এখনো সেই দূতী হাল ছাড়েনি। আজ সকালেও এসেছিল।

চৈত্রমাসের সেই শুক্লা চতুর্দশীর রাতে ঘুম হয়নি গন্ধবতীর। তার মন বলছিল ফিরবে ধ্রুবপুত্র। চৈত্র পূর্ণিমাটি কাটাবে গম্ভীরায়। গম্ভীরায় চাঁদ ওঠা দেখবে ধ্রুবপুত্র। জ্যোৎস্না রাতে আঙিনায়  বসে উদয়ন বাসবসত্তার কাহিনী শোনাবে সে আবার। শোনাবে রেবা নদীর কথা, মলয় পর্বতের কথা, অগ্যস্ত নক্ষত্র যে দেশে উদয় হয় সেই দেশের কথা।

গন্ধবতী নিজে জানে তার অনুমান কখনো কখনো মিলে যায়। যা ভাবে তাই হয়ে যায়। যেমন আজ এই সমস্তদিন পথের দিকে চেয়েছিল। বারবার আঙিনার ধারে গিয়ে পথের প্রান্তে তাকিয়েছে, আচার্য। বৃষভানুর শিষ্য, দশার্ণ দেশীয় জ্যোতির্বিদ তাম্ৰধ্বজ আসতে পারে এমন মনে হচ্ছিল তার। তাম্ৰধ্বজ না এলে আসবে সেই রাজকর্মচারী, দুরাচারী উদ্ধবনারায়ণ। আজ এলে তাকে যদি আপহরণ করে--ভয়ে নিজে নিজেই গুটিয়ে যাচ্ছিল সে। অপহরণ করে রাক্ষস-বিবাহে বাধ্য করবে উদ্ধব। তার মনের কথা মিলে গেছে। এমনই মিলেছিল সেই দিন। পূর্ণিমার ভোরে ফিরেছিল ধ্রুবপুত্র। চতুর্দশীর চাঁদের আলোয় উজ্জয়িনী থেকে হেঁটে এসেছে একা একা। পালিয়ে এসেছিল, এখন তাইই মনে হয়। শেষরাতে যখন সে আঙিনায়  পা দিল, পথের চেনা কুকুরটি দুবার ভুকভুক করে থেমে গেল। গন্ধবতী দুয়ারের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দেখেছিল ধূলিধূসর শরীর। পরম রূপবান ধ্রুবপুত্র মলিন হয়ে ফিরেছে। অযত্ন লালিত চুল, দেহ, নীল চোখের কোলে কলঙ্করেখাও যেন দেখেছিল গন্ধবতী। ফিরে সে নিজের কুটিরখানিতে ঢুকে গিয়েছিল। ওই যে দুয়ার টেনে বন্ধ করা আছে সেই কুটীর। গন্ধবতী নিজে পরিষ্কার করে প্রতিদিন। সে না করলে রেবা করে।

গন্ধবতী বলল, ধ্রুবপুত্র ফিরতে আমি কামদেবের মন্দিরে গেলাম, যাওয়া স্থির ছিল, সঙ্গী ছিল পার্বতী বুড়ি, যাওয়ার আগে গবাক্ষ-পথে দেখলাম মাটিতে শুয়ে আছে ধ্রুবপুত্র, লুটিয়ে আছে। শয্যা এলোমেলো।

থাকুক সে ঘুমিয়ে। ওই ঘুম কত রাত্রি জাগরণের তাই বা কে জানে। দুপুরে ফিরেছিল পুজো দিয়ে। দেখেছিল দুয়ার তেমনই বন্ধ। রেবা ডেকেছিল, কয়েকবার টোকা দিয়েছিল দরজায়। সাড়া দেয়নি  ধ্রুবপুত্র।

তারপর! সন্ধ্যায় দ্বার খুলল। বাইরে এল ধ্রুবপুত্র। আঙিনায় বসে থাকল অনেক সময়। তার সামনে ক্ষীর-তক্র আর জল রেখে এল গন্ধবতী। দুধ ফোটাল রেবা। পাথরের বাটিতে দুধ এনে রেখে দিল। সামনে কলা একজোড়া। ধ্রুবপুত্র নিশ্চুপ বসেছিল। সে ছিল ঘোরের ভিতরে। রেবা যখন তার সামনে এসে দাঁড়াল, নিম্নস্বরে ডাকল, ধ্রুবপুত্র সমস্তদিন কিছুই খাওনি, তুমি ক্ষুধার্ত নিশ্চয়, আজ পূর্ণিমা, চাঁদ উঠে গেছে ওই দ্যাখো, না খেলে গৃহস্থের অকল্যাণ হবে।

ধ্রুবপুত্র তখন ক্ষীর-তক্তি ভেঙে মুখে দিয়েছিল। জলগ্রহণ করে আবার নিশ্চুপ। নিঝুম। শিবনাথ তখন দূর থেকে ডেকেছিল, এ তোমার কী হয়েছে, সোনার বরণ কালি হয়েছে ধ্রুবপুত্র! তুমি শান্ত হও।

সে স্থির হয়ে বসেছিল। তার অনাবৃত শরীর থেকে চাঁদের আলো গড়িয়ে পড়ছিল। অনেকক্ষণ বাদে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়েছিল, ফিরে গিয়েছিল নিজ কুটীরে। ওই সেই কুটীর। অন্ধকার হয়ে আছে।

তাম্ৰধ্বজ বলল, দীপ ওখানে রেখে এস গন্ধবতী।

গন্ধবতী দীপ হাতে উঠে গেল। মুগ্ধ চোখে দেখল তাম্ৰধ্বজ ধ্রুবপুত্রের অনুরাগিনীকে। দীপ নিয়ে মন্দচরণে গন্ধবতী হেঁটে যাচ্ছে। রেবা দেখল দশার্ণ দেশীয় জ্যোতির্বিদের মোহাচ্ছন্ন চোখ দুটি। কেমন চেয়ে আছে। একী হলো! রেবা যে ওই চোখ চেনে। ওই চোখের ভাষা জানে। হায় ধ্রুবপুত্র। অগ্নি আর ঘৃত মুখোমুখি হয়েছে। কী হয়ে যাবে কে জানে! তাম্ৰধ্বজ কি জেনেও গোপন রেখেছে ধ্রুবপুত্রের সংবাদ?

রেবা নৈঃশব্দ ভাঙল, আমার মেয়েটির হয়েছে জ্বালা, অনন্ত আগুনে পুড়ছে যেন সুগন্ধা আমার, ধ্রুবপুত্র ব্যতীত সে যে কাউকেই দ্যাখে না এ জগতে।
হাসল তাম্ৰধ্বজ, আমি জানি মা।
উদ্ধবনারায়ণ কী ভয়ানক, সে কী করেছে তা জান তুমি?
জানি মা।
কে বলেছে?
তাম্ৰধ্বজ বলল, আমি সব জানি, যা জানি না তাও জানতে চাই, তুমি বলো এবার ধ্রুবপুত্রের কথা।
ওই তো ফিরে আসছে মেয়ে, ওই বলুক।

ফিরে এল গন্ধবতী। মায়ের পাশে বসল। ধ্রুবপুত্রের অন্ধকার কুটীরে দীপ জ্বলে আছে। একাকী এক নক্ষত্র যেন। ধ্রুবপুত্র কুটীরে প্রবেশ করলে শিবনাথ বলেছিল, অনুশোচনায় ভুগছে ও, একা থাকুক, ধীরে ধীরে মুক্ত হবে, ওর তুল্য জ্ঞানী, শুদ্ধ পুরুষ এই অবন্তী দেশে আর নেই।

শিবনাথ আরো কিছু বলেছিল গন্ধবতী আর রেবাকে। জ্ঞান হলো দিনমানের মতো। আর অজ্ঞানতা হলো গভীর অমানিশা। অজ্ঞানতা সব সময় জ্ঞানকে অধিকার করতে চায়। পারে কি? পারে না। ধ্রুবপুত্র মুক্ত হচ্ছে। জ্ঞান দ্বারা আচ্ছন্ন হচ্ছে একটু একটু করে। আমাদের কারোর কোনো উদ্বেগের কারণ নেই।

ধ্রুবপুত্র ঘরেই থাকল। রাত বাড়তে লাগল। সকলে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে গেল। গন্ধবতীর কাছে চৈত্র পূর্ণিমাটি মলিন। নিরানন্দময়। দূরে নিষাদ বনচারীরা দুন্দুভি, ঢাক বাজিয়ে আনন্দ করছিল। তার শব্দ কানে আসছিল। বাইরে দুধের মতো আলো যেন উথলে পড়ছিল। গবাক্ষপথে সেই আলো এসে পড়েছিল ঘরে। গন্ধবতী ঘুমোতে পারেনি। একটু বাদে উঠে অর্গল খুলে বেরিয়েছিল। ধ্রুবপুত্রের কুটীরের সামনে দাঁড়িয়েছিল। তারপর ঘুরে গবাক্ষ পথে তাকিয়ে দ্যাখে সে যেন ধ্যানস্থ। ফিরে এসেছিল গন্ধবতী।
গন্ধবতী বলল, এরপর আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঘুম ভেঙে গেল আচমকা।
কী হলো? তাম্ৰধ্বজ জিজ্ঞেস করে।

ঘুম ভাঙার পরই গন্ধবতী শুনেছিল দূরে দ্বার খোলার শব্দ। ওই শব্দে ঘুম ভেঙেছিল, না ঘুম ভাঙার পর ওই শব্দ শুনেছিল তা বলতে পারবেনা সে। তার মনে হয়ত কোনো আশঙ্কা গোপনে লালিত ছিল। সে টের পেয়েছিল ধ্রুবপুত্র ভীষণ অশান্ত, মনে মনে ভীষণ অস্থির। শয্যা ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ার অন্ধকারে এসে বসেছিল গন্ধবতী। তখন ধ্রুবপুত্র দুয়ার খুলে বেরিয়ে এসেছিল। দাওয়ায় বসে গন্ধবতী অবাক হয়ে দেখেছিল আঙিনায় নেমেছে ধ্রুবপুত্র। উত্তর আকাশে তাকাল। গায়ের উত্তরীয়খানি মলিন, তার একটি কোণ ধুলোয় লুটোচ্ছিল। ধ্রুবপুত্র যে আবার চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে সখা? আবার কি উজ্জয়িনীতে? আবার সেই গণিকালয়ে? উন্মাদ হয়ে গেল ধ্ৰুবপুত্র! তার সমস্ত জ্ঞানার্জন মিথ্যে হয়ে গেল! নিঃশেষ হয়ে গেছে সব! সে কিছুতেই ধ্রুবপুত্রকে উজ্জয়িনী যেতে দেবে না।

গন্ধবতী দুয়ার নিঃশব্দে টেনে দিয়ে ধ্রুবপুত্রকে অনুসরণ করতে থাকে। সে যেতে দেবে না সখাকে। উজ্জয়িনী নগরই শেষ করেছে ধ্রুবপুত্রকে। আঙিনা পার হয়ে পথে নামল গন্ধবতী। পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নায় পথঘাট সব দিনমানের মতো স্পষ্ট। গন্ধবতী দেখছিল তার আগে আগে একটি পদচিহ্ন এগিয়ে গেছে। ওই পদচিহ্ন ধ্রুবপুত্রর। চেনে গন্ধবতী। এই ধুলোয় কতদিন ওই চিহ্ন অনুসরণ করে ধ্রুবপুত্রকে খুঁজে বের করেছে সে।

বাইরে বেরিয়ে ঘুরে তাকায় গন্ধবতী। ওই পথ গেছে উজ্জয়িনীর দিকে। কই কেউ তো নেই। পথ অনেকদূর সোজা চলে গেছে। শূন্যপথে জ্যোৎস্নায় ধুলো উড়ছিল চৈত্র বাতাসে। এর ভিতরে কতদূর যেতে পারে সে? পিছনে পিছনেই তো এল গন্ধবতী। তাহলে কি তার ভুল হলো? মাটিতে তাকায় গন্ধবতী। না, সেই পথে তো যায়নি ধ্রুবপুত্রর পদচিহ্ন। ঘুরে দক্ষিণ পুবে তাকায় গন্ধবতী। ওই দিকেই তো গেছে সখা। বুকটা কেঁপে ওঠে। ওই যে দূর, বহুদূরে, গম্ভীরা নদীর পথে ছায়া হেঁটে যায়। চলে যায় ধ্রুবপুত্র। তার উত্তরীয় পড়ে গেছে ধুলোয়। উড়ছে তা চৈত্ৰবাতাসে। ধুলো উড়িয়ে হাঁটে গন্ধবতী।

কী আশ্চর্য! সেই রাতে পথের কুকুরগুলির কেউ ধারে কাছে ছিল না। ঝিম ঝিম করছিল জ্যোৎস্না আর নৈঃশব্দ। দূর থেকে ডেকে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় গন্ধবতী। তার কণ্ঠস্বরে গ্রামের মানুষ জেগে যেতে পারে। সে ভারি লজ্জার হবে।

হাঁটতে হাঁটতে গম্ভীরার তীর। কী দ্রুতই না হেঁটেছে ধ্রুবপুত্র? গন্ধবতীর সাধ্য কি তাকে ধরে। চৈত্ররাতে উথাল পাথাল বাতাস ছিল, তবুও উত্তেজনায় ঘর্মাক্ত হয়ে গিয়েছিল গন্ধবতীর সর্বাঙ্গ। প্রায় ছুটতে ছুটতে নদীর বাঁকে এসে দ্যাখে ধ্রুবপুত্র নেমে যাচ্ছে নদীর ভিতরে। জলে।

নদীটি যেন ঘুমিয়েছিল সেই রাত্রে। জ্যোৎস্নাও তাকে আবৃত করে ঘুমিয়ে ছিল যেন। মনে পড়ে যায় গন্ধবতীর। একদিন, সে কতদিন আগে ধ্রুবপুত্র এক সন্ধ্যায়, চাঁদের আলোর ভিতরে দাঁড়িয়ে আকাশমণ্ডল, নক্ষত্র, নদী, প্রান্তর দেখিয়ে বলেছিল, সুগন্ধা জেনে নাও, এই হলো জ্ঞান।

একদিন বলেছিল, বলো দেখি কোথায় কালপুরুষ?

বলো দেখি শতভিষা নক্ষত্রটি জেগেছে কিনা, ওই দ্যাখো গন্ধবতী, ধ্রুব নক্ষত্র, ওর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় ওই নক্ষত্র থেকে শিশির বিন্দুর মতো কি নেমে এসেছিল মানুষের প্রাণ? মানুষের প্রাণ কি নক্ষত্রের জল? শুনেছি স্বাতী নক্ষত্রের জল নাকি মুক্তো হয়ে ঝরে পড়ে সমুদ্রে...।
গন্ধবতী অস্ফূট স্বরে বলল, সত্যি কি মানুষ নক্ষত্রের সন্তান?
তাই-ই তো সবিতা নক্ষত্র আমাদের বাঁচিয়ে রাখে গন্ধবতী। বলল তাম্রধ্বজ। সে চেয়ে আছে গন্ধবতীর দিকে। রেবা কখন উঠে গেছে জানে না কেউ।
গন্ধবতী ফিসফিসিয়ে বলল, আমাদের না হোক, তাঁর প্রাণ ধ্রুবতারার জল।
জানি তা, তারপর কী হলো?

কী হলো? সব যে ভুলে যাচ্ছে গন্ধবতী। সে নিশ্চিন্ত হয়েছিল এই ভেবে যে সখা উজ্জয়িনী যায়নি। ধ্রুবপুত্র অবগাহনে এসেছে গম্ভীরায়। ঠাকুর্দার কথাই ঠিক। কলুষমুক্ত হচ্ছে ধ্রুবপুত্র। শুদ্ধ হয়ে আবার আরম্ভ করবে জীবন। বেতসকুঞ্জে দাঁড়িয়েছিল গন্ধবতী। বাঁকানো বেত্রপত্রের ছায়া পড়েছিল আলপনার মতো। বেত্রপত্র দিয়ে জ্যোৎস্না গড়িয়ে পড়ছিল নদীতে। সে বছর তো এমন অনাবৃষ্টি ছিল না। গম্ভীরাতীর ছিল সুন্দর। নদী ছিল তখনো, সেই চৈত্রেও জলপূর্ণ প্রায়। বাঁকটিতে ছিল গভীরতা অনেক। নদীর জলে চাঁদ ভেসে ছিল।

জলে নেমে ধ্রুবপুত্র নদীর বাঁকের দিকে সরে যেতে থাকে। ওই দহে দু’একবার মানুষ ডুবেছে। গন্ধবতীর মনে হয়েছিল ধ্রুবপুত্র বেভুল হয়ে গেছে যেন। সে দেখেছিল ধ্রুবপুত্র দহে নেমে গেছে। ডুবে যাচ্ছে নাকি? ওই যে ডুবে যাচ্ছে। ওই যে উঠছে। গন্ধবতী নেমে পড়েছিল নদীতে। পা ডোবা তিরতিরে জল পার হয়ে মধ্যিখানের বালিচর বেয়ে ছুটে গিয়েছিল দহের সমান্তরালে। দুটি হাত তুলে কেঁদে উঠেছিল, ডেকে উঠেছিল, ‘ধ্রুবপুত্র, তুমি বেভুল হয়ে গেছ, উঠে এস ধ্রুবপুত্র, হে সখা এ তুমি কী করছ?’

ভয়ে কাঁপছিল গন্ধবতী। বেভুল হয়নি ধ্রুবপুত্র মরতে এসেছে। আত্মহননে এসেছে গম্ভীরায়। সে তখন কেঁদে উঠেছিল, উঠে এস ধ্রুবপুত্র, এই নদী, এই আকাশ, চাঁদের আলো, এই সমস্তই জ্ঞান, তুমিই তা শিখিয়েছ ধ্রুবপুত্র, উঠে এস, ফিরে যাও নগরে।

শুনতে পেয়েছিল সে? জিজ্ঞেস করল তাম্ৰধ্বজ।
জানি না। অস্ফুটস্বরে বলল গন্ধবতী।
তারপর কী হয়েছিল?
উঠে এসেছিল সে, হ্যাঁ উঠে এসেছিল। বালুচরে দাঁড়াল আমার কয়েক হাত দূরে। সমস্ত শরীর থেকে। ঝরে পড়ছিল জ্যোৎস্নার জল। কী দ্যুতিময় চোখদুটি! অত বিস্ময় কোনো কালে আমি দেখিনি কারো চোখে।

তাম্ৰধ্বজ উঠে দাঁড়ায়, শোনা হলো।
কিন্তু সে কোথায়? গন্ধবতীও উঠে দাঁড়াল ধীরে ধীরে।
তাম্ৰধ্বজ বলল, এইটুকু তো আমার জানা ছিল না।
বাকিটা তো বলতে পারিনি এখনো।
সে তো চলে গেল?
হ্যাঁ, আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল, নদীতীরে উঠল, তারপর উত্তর-পুবদিকে চলতে লাগল, আমি ভেবেছিলাম সে ফিরবে ঘরে, কিন্তু ওই ভেজা কাপড়েই চলে গেল একা একা, আমি ডাকতে পারলাম না।
কেন?
গন্ধবতী বলল, তাকে অচেনা মনে হচ্ছিল যেন।
সত্যি?
হ্যাঁ, ধ্রুবপুত্র যেন অন্য কোনো মানুষ, আমি কেন যে পথ রোধ করে দাঁড়াতে পারিনি সেদিন।
তাম্ৰধ্বজ বলল, চাঁদ উঠে গেছে, আমি আসি।
আবার কতদিন অপেক্ষা করব?
কেন?
গণনা সম্পূর্ণ করে ধ্রুবপুত্রের খোঁজটা তো আনবেন।
আনব। তাম্ৰধ্বজ হাঁটতে আরম্ভ করল। অন্ধকার আঙিনা পার হয়ে গেল।

চলবে

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব এগার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চৌদ্দ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পনের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ষোল)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সতের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আঠারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব উনিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব কুড়ি)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব একুশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বাইশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তেইশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চব্বিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পঁচিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছাব্বিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাতাশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আটাশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব উনত্রিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ত্রিশ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top