সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

ধ্রুবপুত্র (পর্ব আটত্রিশ) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
১৯ এপ্রিল ২০২১ ১৯:২০

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ১৪:১৯

ছবিঃ অমর মিত্র

 

আচার্য বৃষভানুর কাছে যাচ্ছেন রাজা ভর্তৃহরি। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর এখন। নগর পাথর হয়ে আছে। দেবপথ দিয়ে বেরিয়ে শিপ্রানদীর তীর ধরে মঙ্গলনাথের মন্দির, বৃষভানুর আশ্রম পর্যন্ত পথটি এমনিই নিরালা, এখন পথের কুকুরও যেন জেগে নেই। কৃষ্ণা চতুর্দশী আজ। আকাশে চাঁদ নেই, আকাশগঙ্গার আলোটি যেন পথটিকে চিনিয়ে দিচ্ছে। তারার আলোয় পথ দেখছেন রাজা। হাতের দীপটি রেখে এসেছেন দেবপথের আড়ালে। এখন কোনো কিছুতে বিশ্বাস নেই। দিন দিন চুর্ণ হয়ে যাচ্ছেন যেন উজ্জয়িনীর রাজা। 

সেই কবে গিয়েছিলেন আচার্য বৃষভানুর আশ্রমে। যতদূর মনে পড়ে কার্তিক পূর্ণিমার রাতে। তারপর পাঁচটি পূর্ণিমা চলে গেছে। এতদিনে আচার্য কিছুই জানাতে পারেননি, কেন এই অনাবৃষ্টি  তা বলে দেবেন তো  তিনিই। রাজা ভর্তৃহরির নিজেকে এখন কেমন বিপন্ন মনে হচ্ছে। আগে তিনি সব কিছু অনুমান করতে পারতেন, একটি কথায় বুঝে নিতে পারতেন প্রিয়জন বা পারিষদবর্গের মনের ভাব, এখন অনুমান করতে পারছেন না কিছুই। অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে অনেক কিছু। চেনা মানুষকে অচেনা মনে হচ্ছে। রানী ভানুমতীকে মনে হচ্ছে কত দূরের কেউ, নিকটজন নন। অনুজ বিক্রমকে বুঝে উঠতে পারছেন না। শ্ৰেষ্ঠী সুভগ দত্তকে এক এক সময় এক এক রকম মনে হয়। সব চেয়ে বড় ব্যাপার হলো তাঁর নিজের জীবনে যা ঘটে যাচ্ছে, এই নগরে যা ঘটে যাচ্ছে তারও কোনো ব্যাখ্যা পাচ্ছেন না তিনি। আচার্য কি কিছুই জানাতে পারবেন না? এ ও তো অতি বিস্ময়ের। আকাশ যাঁর করতলের মতো প্রায়, তিনি আকাশ থেকে কিছুই পড়ে নিতে পারছেন না? তাহলে এই নগর, এই দেশের কী হবে? উজ্জয়িনীর নরম মানুষগুলির জীবন কোন দিকে বয়ে যাবে? 

অনাবৃষ্টিতে নগর পুড়ে যাচ্ছে, কেন? আচার্য বলেছিলেন জেনে নেবেন ওই আকাশ থেকে। সপ্তর্ষি, অরুন্ধতী, ব্রহ্মহৃদয়, বিশাখা নক্ষত্রের কাছে থেকে। রাশিগুলির তারা থেকে। জেনেছেন কি? তিনি নিজে বেরিয়েছিলেন আচার্য বৃষভানুর উদ্দেশে। কিন্তু সেই শীতের রাতে কোন ভবিতব্য তাঁকে নিয়ে গেল মহাকাল মন্দিরে? গিয়ে প্রধান পুরোহিতের কাছে পৌঁছনোর আগেই দেবদাসী তাকে থামালো। রোমাঞ্চ জাগে এইজন্য সেই রাত্রের কথা মনে এলে। কে সেই দেবদাসী? মুখখানিও ভাল করে দ্যাখেননি তিনি সেই রাতে। জীবনের অপূর্ব স্বাদ পূর্ণ হয়েছিল যেন। কিন্তু সেই ঘটনাই তো এখন নগরে রটে গেছে। কে বলল? দেবদাসী? সে তো তাকে রাজা বলে শনাক্ত করতেই পারেনি। মহাকালকে ধারণ করেছিল পৃথিবীর মতো সেই নারী। এখনো মনে পড়ে তার কণ্ঠের অস্ফুট ধ্বনি। সে যদি আবার অন্ধকারে ডাকে মহাকালকে, তিনি তাকে চিনতে পারবেন? 

আশ্চর্য লাগছে! কী করে সেই না চেনা, না দেখা রমণীতে উপগত হলেন তিনি? কীভাবেই বা সে তাকে মহাকাল রূপে চিনেছিল? রাজাকে অন্ধকারেও কি চেনা কঠিন? এমন ঘটনা এ জীবনে আর কখনো হয়নি। কখনো মনে হচ্ছে তিনি যেন দুরাচারীর মতো ধর্ষণ করে এসেছেন এক সহায়হীনা যুবতীকে। এই ঘটনা তাঁর প্রকৃতির বিপক্ষে। প্রকৃতি বিরূপ, আকাশ মেঘহীন, নদী সরোবর জলহীন হলে কি এমন হয়? মহাপ্রকৃতি অন্যরকম হয়ে গেছে বলে, তাঁর নিজের প্রকৃতিও কি অমন অবোধ্য আচরণ করেছে? নিজেকে যেন অচেনা মনে হচ্ছে ওই ঘটনার পর। কিন্তু জীবনের অন্য সত্য হলো এই, অমন পূর্ণতা  আর কখনো অনুভব করেননি তিনি। জীবন কী বিচিত্র। জীবনে কত বিস্ময়! ভবিতব্য কত আঁধার কুয়াশায় ছাওয়া। তাঁর কি নারীর অভাব? উজ্জয়িনীর সেরা সুন্দরী, প্রধান গণিকা দেবদত্তা তাঁকে শুধুই ডাকে, তিনি প্রত্যাখ্যানেই স্বস্তি পান। অথচ দেবদত্তার রূপ কি তাঁকে মুগ্ধ করে না ? আবার রানী। ভানুমতী তার দিকে ফিরেও তাকান না এখন। কেন এমন হয় এক জীবনে?

সেনাপতি বিক্রম ক’দিন আগে অগ্নিদগ্ধ করে মেরেছে শ্ৰেষ্ঠীর দাসকে। শ্রেষ্ঠী নাকি ওই মরণ যজ্ঞে উপস্থিত ছিলেন। তিনি উতঙ্ককে দেখেছেন। উতঙ্ক ছিল শ্রেষ্ঠীর সবচেয়ে অনুগত দাস। উতঙ্কর ইতিহাস তাঁর অজানা নয়। শোনা যাচ্ছে তার ক’দিন আগে শূদ্রপল্লীর অগ্নিকাণ্ড নাকি উতঙ্করই ঘটানো। কেন ঘটিয়েছিল সে ওই ঘটনা? নিজের ইচ্ছায়? সে কি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল? কোনো কারণ ব্যতীতই আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল শূদ্রবসতিতে? তা কি হয় ? নাকি সে ঘটায়নি ওই ঘটনা। এই প্রবল অগ্নিময় দিনে যে কোনোভাবে ঘটে গেছে তা। মানুষের অসাবধানতায় এই সমস্ত অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ভেবেছিলেন নগর কোটালকে দিয়ে খুঁজে বের করবেন ঘটনার উৎস। কিন্তু তার আগেই তো জানা গেছে সব। উতঙ্কর মৃত্যুও হয়েছে। সব অস্পষ্ট লাগছে তার। শ্রেষ্ঠীই তাঁর দাসকে তুলে দিয়েছেন বিক্রমের হাতে--অবাক লাগছে শুনে। পুড়েছে তো শূদ্র বসতি। তার জন্য শ্রেষ্ঠী তাঁর দাসকে দায়ী করলেন কেন? শূদ্রজাতির প্রতি তার এত মায়া! এ কি বিশ্বাস্য? শ্ৰেষ্ঠী কি শ্ৰেষ্ঠীর মতো কাজ করেছেন? 

কেউ তার নিজের মতো কাজ করছে না। সেনাপতি বিক্রমও নয়, রানী ভানুমতীও নয়। শূদ্ৰজাতি সেনাবাহিনীর শক্তি। সত্য তা। কিন্তু ওই অগ্নিকাণ্ডের পর দ্রুত অপরাধী শনাক্ত করে তাকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা--এও যেন স্বাভাবিক নয়। রানী তো রাজার পাশে থাকেন, তবু অবোধ্য লাগে ভানুমতীকে। কেন হচ্ছে এমন? এ সবই কি অনাবৃষ্টিজনিত ঘটনা? অনাবৃষ্টিতে এমন ঘটেই থাকে। এই বিশ্বসংসার, সমস্ত প্রাণীকূল আকাশের মেঘ, বৃষ্টি, রোদ, শীত, কুয়াশা, আলো, অন্ধকারে সজীব থাকে। প্রকৃতি বিরূপ হলে মানুষের আচরণে কি এমন অসঙ্গতিই দেখা যায়? কী আশ্চর্য! শোনা যাচ্ছে উতঙ্কর মৃত্যুতে প্রত্যক্ষদর্শীরা উল্লাস প্রকাশ করেছে। নগরের কোনো মানুষের নাকি শোক নেই উতঙ্কর জন্য। শোনার  পর তিনি নিজেই তো শোকার্ত হচ্ছেন। উতঙ্ক নাকি খুব কষ্ট পেয়ে মরেছে। মানুষের মন থেকে দয়া মায়া কি অন্তর্হিত হলো? এও কি প্রকৃতিরই রোষ!

উজ্জয়িনীর মানুষ তো এমন ছিল না। কেন হলো এমন? এসব তিনি জানতে চাইবেন আচার্য বৃষভানুর কাছে। তিনি ছাড়া কেই বা বলতে পারেন এসব? দেবদাসীর কোনো খোঁজ নেননি তিনি। তার নামটিও জেনে নেননি সেদিন। এখন তো জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে সেই রাতের কথা নগরের সব মানুষের কানে গেছে। তিনি কেমন গুটিয়ে যাচ্ছেন তা জানার পর। ভবিতব্য যে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে তাঁকে?

বাম পার্শ্বে শিপ্রানদী। এখন ওই নদী অন্ধকার ধারণ করে আছে। মনে পড়ে, এমন গভীর কৃষ্ণপক্ষে ওই নদীর জলে আকাশের তারাদের ছায়া দেখেছিলেন তিনি! কতদিন আগের কথা তা। এখন আকাশ ভরে আছে তারায় তারায়, নদীর বুক তার ছায়া ধারণ করতে অপারগ।

অন্ধকারে আচার্য বৃষভানুর আশ্রমের সামনে এসে দাঁড়ালেন তিন। আজ এক বিন্দু বাতাস নেই। আশ্রম দ্বারে দেখা হলো তাম্রধ্বজের সঙ্গে। দীপ হাতে সে রাজাকে দেখে মাথা নোয়াল, আশ্রমে স্বাগত জানাই।

আচার্য?

আছেন, ওই যে বসে আছেন অন্ধকারে। দীপ তুলে প্রাঙ্গণ আলোকিত করল তাম্রধ্বজ। রাজা এগিয়ে গেলেন।

আচার্য বৃষজানু কি ঘুমিয়ে আছেন? এমন স্তব্ধ নিশ্চল তিনি! রাজা ঘুরে তাকান। তাম্রধ্বজ বলল, ধ্যানে আছেন আচার্য।

কখন জেগে উঠবেন?

উঠবেন, মহারাজ আপনি এদিকে এসে বিশ্রাম নিন, আশ্রমের ভিতরে যাবেন?

না। রাজা ধীর ধীরে হেঁটে গেলেন শিপ্রার বাঁধানো ঘাটের দিকে। দীপ হাতে তাঁকে অনুসরণ করল তাম্রধ্বজ। রাজা মাটিতে বসলেন, তাম্রধ্বজ দীপ একটু দূরে রেখে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেত লাগল। রাজাও কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। আকাশের আলোর বিন্দুগুলির দিকে তাকিয়ে আছেন উজ্জয়িনীর রাজা। তাম্রধ্বজ রাজাকে দেখতে লাগল।

একটু বাদে রাজা ভর্তৃহরির সম্বিত ফিরল। আচার্যর শিষ্যটি আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। তিনি ফিরলেন তার দিকে। যুবকটিকে দেখে ধীমান মনে হয়েছিল আগের বার। তিনি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন তাম্রধ্বজের পরিচয়। তাম্রধ্বজ মাথা নামিয়ে আত্মপরিচয় দিতে, রাজার তাঁকে ভাল লাগল, বললেন, দাঁড়িয়ে কেন, বসো। 

তাম্রধ্বজ হাঁটু মুড়ে বসল রাজার সামনে। অন্ধকারে বহুক্ষণ থাকলে চোখের আলোয় তা স্বচ্ছ হয়ে যায়। তাম্রধ্বজ দেখতে পাচ্ছে নদীর জলহীন তলদেশ পর্যন্ত, সে বলল, মহারাজ, আমার দেশে বেত্রবতী নদীও শুকিয়ে গেছে প্রায়।

জানি, সংবাদ এসেছে।

তাম্রধ্বজ বলল, এমন অনাবৃষ্টি নাকি আগে কখনো হয়নি?

আমি দেখিনি, অস্ফূট স্বরে বললেন রাজা ভর্তৃহরি, আচার্যর নিকটে নিবেদন রেখেছিলাম অনাবৃষ্টির কারণ অনুসন্ধান করতে।

তাম্রধ্বজ চুপ করে থাকল। সে কিছু বলতে চায়, কিন্তু বাধো বাধো ঠেকেছে। বলতে চাইছে ধ্রুবপুত্রের কথা।  তাকে কি জানেন মহারাজ?

রাজা অবাক হলেন, কার কথা বলছ?

ধ্রুবপুত্র, ধ্রুবদাস ছিলেন শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্তর সখা।

রাজা বললেন, মনে পড়ে না তো।

আপনার মনে থাকার কথা নয় তো, এ বহুদিন আগের কথা, পুত্রের যখন বয়স এক বৎসর, ধ্রুবদাস মারা যান, পুত্রটির জন্মের সময় তার মাও মারা যান, অনাথ শিশুটিকে মানুষ করেন গম্ভীরা গ্রামের এক গৃহস্থ।

তারপর?

ধ্রুবপুত্র ছিল জ্ঞানী, শ্রেষ্ঠী তাঁর শিক্ষার ভার নিয়েছিলেন...। বলতে লাগল তাম্রধ্বজ। রাজা অবাক হয়ে শুনতে লাগলেন। তাম্রধ্বজ ধীরে ধীরে ধ্রুবপুত্রকে বর্ণনা করছিল গন্ধবতীর বর্ণনা মতো, তারপর আচমকা বলল, সে নির্বাসনে যাওয়ার পর থেকে এই দেশে বৃষ্টি নেই।

তা কী করে হয়, তোমার দশার্ণ দেশেও তো অনাবৃষ্টি।

দশার্ণ, উজ্জয়িনী--সব এক আকাশ মহারাজ।

সমস্ত পৃথিবীই তো এক আকাশ।

সমস্ত পৃথিবীর কথা জানি না, তবে কোথাও যে বৃষ্টি হয়েছে, এ সংবাদ শুনিনি।

কোনো দেশে মেঘ নেই? 

না মহারাজ, একদল মানুষ চলে গেল পুবের দিকে, তারা মনে করেছে পুবদিকে বৃষ্টি হয়েছে, একদল মানুষ এল পুব থেকে এই দিকে, তারা মনে করেছিল এই দিকে বৃষ্টি হয়েছিল, এইরকম উত্তরের মানুষ দক্ষিণে যাচ্ছে, দক্ষিণের মানুষ উত্তরে, মানুষ চঞ্চল হয়েছে মহারাজ, অস্থির মানুষ দাঁড়াতে চাইছে না কোথাও। 

রাজা বললেন, আমি বোধহয় ওসবের কিছুই জানি না।

তাম্ৰধ্বজ বলল, জানেন, কোনো কিছুই তো অজানা থাকার কথা নয়, আপনি রাজা।

ঘাড় ঘুরিয়ে তাম্রধ্বজকে দেখলেন রাজা। যুবকটির কণ্ঠস্বরের দার্ঢ্যকে তিনি অস্বীকার করতে  পারছিলেন না। তাঁর একবার মনে হলো জিজ্ঞেস করেন ধ্রুবপুত্রর আরো কথা। নামটি তাঁর শোনা হতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু যেভাবে তার কথা বর্ণনা করল তাম্ৰধ্বজ, মনে হচ্ছে, ধ্রুবপুত্রর কথা তাঁর আরো বেশি করে শোনা উচিত। কিন্তু কী হবে? অস্থির হয়ে উঠেছে মন। কোথাও বসতে চাইছে না। তাম্ৰধ্বজের কথা তাঁর কানে আসছে। সে বলছে, সমস্ত রাত পথে মানুষ চলে, যদি দেখতে চান রাজা পথে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন। 

রাজা আচমকা উঠে দাঁড়ালেন, আচার্য কি জেগে উঠলেন?

উনি তো জেগেই আছেন।

মনে হয় না, মনে হয় উনি ঘুমিয়ে। 

তাম্ৰধ্বজ একটু সংকুচিত হয়ে গেল। কথাটা যে তার মনেও ঘোরে না তা নয়। কিন্তু ভাবতেই ভয় করে। ধ্যানমগ্ন আচার্য ঘুমিয়ে আছেন? রাজা উঠেছেন। আশ্রমের দিকে পা বাড়িয়েছেন। তাম্ৰধ্বজ রাজাকে অনুসরণ করছে। এগোতে এগোতে রাজা আচমকা দাঁড়ালেন, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন, তুমি এক আশ্চর্য কথা বলেছ। 

কী কথা? তাম্ৰধ্বজ অবাক হলো। 

আমার মনে হচ্ছে ধ্রুবপুত্রকে আমি দেখেছিলাম।

হতে পারে। অস্ফূট কণ্ঠে জবাব দিল তাম্ৰধ্বজ।

রাজা বললেন, মানুষের মন মায়ায় পূর্ণ, মায়াবিনে জগৎ বাঁচে না, পুবের লোক ভাবে পশ্চিমে বৃষ্টি, ফসল, সুখ; পশ্চিমের লোক ভাবে পুবেই সব, রাজা ভাবেন প্রজার জীবন সুখের, আর প্রজারা ভাবে রাজার জীবনেই সমস্ত সুখ। 

তাম্ৰধ্বজ বললেন, মহারাজ এ তো পুরনো কথা, পুরনো প্রবাদ, সকলেই জানে।

রাজা বললেন, মন বড় অস্থির হয়েছে, মন অস্থির হলে পুবের মানুষের আর পুবে মন বসে না, পশ্চিমে যায়, ওহে আচার্যর ঘুম ভাঙাও।

তাম্ৰধ্বজ বলল, উনি ধ্যানে। 

আমি অস্থির হয়ে আছি, আচার্য আর কত সময় নেবেন? অবন্তীদেশ যে পুড়ে যায়, জ্বলে যায়, আমি আজই জবাব নিয়ে ফিরব। বলতে বলতে দীর্ঘ পদক্ষেপে রাজা এগিয়ে গেলেন। ধ্যানমগ্ন আচার্য বৃষভানুর সামনে দাঁড়ালেন। তারার আলো পড়েছে ধ্যানমগ্ন জ্যোতির্বিদের মুখের উপর। চোখ দুটি বুঁজে আছে। অস্থির রাজা হাঁটুমুড়ে বসে আচার্যর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা তাম্ৰধ্বজকে বললেন, গ্রহ তারা তো। গণনার বিষয়, ধ্যানে কী হয়? 

মহারাজ এটি আচার্য জানেন, ধ্যানে সব হয়, গণনা যখন দিশাহীন হয়, তখন ধ্যানই পথ দেখাতে পারে। 

রাজা ডেকে উঠলেন, আচার্য!

গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনলেন রাজা। ঘুমন্ত মানুষই এমন নিঃশ্বাস ফেলে থাকে।

রাজা ডাকলেন, আচার্য আমি উজ্জয়িনীর রাজা, আমি আপনার গণনার ফল জেনে নিতে এসেছি, বহুদিন এদেশ বৃষ্টিহীন হয়ে আছে। 

ধ্যানমগ্ন আচার্যর ভিতরে কোনো ব্যত্যয় নেই। রাজা তাকিয়ে আছেন। এ তো ঘুমন্ত মানুষেরই চেহারা। তাঁর অনুমানে কোনো ভুল হয়নি। তিনি হাত বাড়ালেন, স্পর্শ করলেন আচার্য বৃষভানুর বক্ষ দেশ, তখন যেন ভূমি কেঁপে উঠল। আন্দোলিত হয়ে উঠল বৃষভানুর স্থির দেহটি। চমকে চোখ মেলালেন তিনি। চোখ মেলেই দেখলেন রাজাকে। দু চোখ বিস্ফারিত হলো। বিস্ফারিত চোখে বিপন্নভাব ফুটে উঠল। তিনি মনে মনে টের পাচ্ছিলেন রাজা আসবেন। রাজার না এসে উপায় নেই। অবন্তীদেশে এখনো বৃষ্টি নামেনি। নগর জ্বলছে, গ্রাম জ্বলছে, মাটি ফেটে যাচ্ছে। রাজার বিশ্বাস আচার্য জানতে পারবেন প্রকৃতির এই রোষের কারণ? এ দেশে মেঘ না এলে বিপন্ন রাজা আরো বিপন্ন হবেন। রাজার সম্পর্কে যে কথা ভাসছে নগরের বাতাসে তা কানে গেছে তাঁর। রাজাকে এখন রক্ষা করতে পারে আকাশের মেঘ। সুবৃষ্টি যে রাজার পুণ্যে হয় তা মনে করে লোকে। সুবৃষ্টি হলে রাজার সমস্ত পাপ ধুয়ে যেতে পারে। ধুয়ে যায়, ধুয়ে যাবে। সিংহাসন নিরাপদ থাকবে। না হলে অকথা কুকথা আরো রটে যাবে। রাজার সমস্ত সুকৃতি পুড়ে যাবে রোদের তাপে। 

রাজা জিজ্ঞেস করলেন, সঙ্কট মোচনের উপায় খুঁজে পেলেন আচার্য? 

আচার্য বৃষভানু মাথা নাড়লেন। ক্লিষ্ট মুখে হাসলেন, বললেন, জানি না। 

জানেন না? আর্তনাদ করে উঠলেন রাজা, এতদিনেও খুঁজে  পাননি  আকাশের কোনো গ্রহ তারা যার কারণে অবন্তীদেশে বৃষ্টি নেই। 

বৃষভানু বললেন, না।

যদি আচার্য বৃষভানু না পারেন, কে পারবে? 

জানিনা। বৃদ্ধ জ্যোতির্বিদ মাথা নুয়ে বসে আছেন, ফিসফিস করে বললেন, আপনার আনন্দের মতো। কোনো সংবাদ নেই মহারাজ।

তাহলে আমি কী করব, নগরে যদি বৃষ্টিই না নামে শিপ্রা, গন্ধবতী শুকিয়ে যাবে, সপ্ত সরোবর তো শুকিয়েই গেল প্রায়, নগর ছেড়ে চলে যাবে মানুষ, কী ভয়ঙ্কর কথা বলছেন আচার্য। 

আচার্য বৃষভানু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গেলেন অন্ধকারে। দুটি হাত তুলে আকাশের দিকে তাকালেন, ভাঙা গলায় বলতে লাগলেন, এই পৃথিবী এখন আমার কাছে নিরানন্দের হয়ে গেছে। মহারাজ, আপনি কার কাছে এলেন! আমার এই চোখে আকাশ বঙ্কিম লাগে, মৃত্তিকার মতো ফেটে গেছে। আকাশ!

রাজা এগিয়ে এলেন, কী বলছেন আচার্য!

আচার্য ডাকলেন তাম্ৰধ্বজকে, এদিকে এস।

তাম্ৰধ্বজ এল, গম্ভীর গলায় বলল, আপনাকে বিপন্ন মনে হচ্ছে আচার্য!

বৃষভানু বললেন, আকাশে তাকাও, উত্তর আকাশে। 

তাম্ৰধ্বজ উত্তর আকাশে সপ্তর্ষিমন্ডলকে দেখতে পায়। বুনোলতার আঁকশির মতো সাতটি তারা আকাশ বিদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর পূর্ব দিগন্তের কাছাকাছি সাতটি তারার দ্বিতীয়টি বশিষ্ট। আচার্য বললেন, বশিষ্ট আছে? 

আছে আচার্য। বলেই তাম্ৰধ্বজ শিহরিত হলো। এই প্রশ্ন কেন? উনিও তো দেখছেন। তাম্ৰধ্বজ কি সপ্তঋষিকে চেনে না? তখন আচার্য ডাকলেন, তাম্ৰধ্বজ, বশিষ্টর পাশে অরুন্ধতী? 

অরুন্ধতীকে দেখে তাম্ৰধ্বজের মনে পড়ল গন্ধবতীর কথা সে তাকিয়ে আছে ক্ষুদ্র তারাটিতে। আকাশে যেন গন্ধবতীর মুখ দেখতে পায় তাম্ৰধ্বজ। তখন কানে এল আচার্যের ডাক, দেখতে পাচ্ছ অরুন্ধতীকে? 

হ্যাঁ। আকাশে তাকিয়েই জবাব দেয় তাম্ৰধ্বজ।

মহারাজ দেখতে পাচ্ছেন? 

হ্যাঁ আচার্য। উত্তর দিতে রাজা দেখলেন আচার্যর সমস্ত মুখখানি যেন ভয়ে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। এই অন্ধকারেও তা স্পষ্ট দেখা যায়। স্পষ্ট দেখলেন রাজা।

চলবে

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব এগার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চৌদ্দ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পনের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ষোল)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সতের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আঠারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব উনিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব কুড়ি)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব একুশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বাইশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তেইশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চব্বিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পঁচিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছাব্বিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাতাশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আটাশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব উনত্রিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ত্রিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব একত্রিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বত্রিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তেত্রিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চৌত্রিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পঁয়ত্রিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছত্রিশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাঁইত্রিশ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top